দিনে দুপুরে, সূর্য যখন ঠিক মাঝ আকাশে তখন কিংবা তার খানিক আগে আজরফ মিয়া খুন হয়ে যায় অথবা তার নিথর দেহ পড়ে থাকে ১নং শ্রীশ দাস লেনস্থ রাস্তার উপরে। যারা ইতিহাসের খবর রাখেন তারা জানেন মৃত্যু ১নং শ্রীশ দাস লেনের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। ১৯৭১ সালের ২৮ শে মার্চ এই রাস্তার উপরেই ব্রাশ ফায়ার করে মারা হয় বিউটি বোর্ডিংয়ের মালিক প্রহ্লাদ সাহাসহ ১৭ জন বোর্ডারকে। অতএব মৃত্যু কিংবা অপমৃত্যু ১ নং শ্রীশ দাস লেন অথবা তার আশপাশের মানুষেরা অবলীলায় মেনে নেই এবং আজরফ মিয়ার লাশের খানিক দূরে দাড়িয়ে রমজানকে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলি, “বুজলা রমজান, আজরফরে বার বার কইছি, সব জায়গায় নাক গলাইও না”। রমজানকে অবশ্য নির্লপ্ত মনে হয় না, কারন আজরফের বসতি ছিল তার পাশের গ্রামে এবং সেই পরিচয় সূত্রে আজরফ মিয়া গত ৭/৮ মাস যাবৎ রমজানের চায়ের দোকানে কাজ করে। রমজান ঘটনার আকস্মিকতা মেনে নিতে পারেনা- বিরবির করে বলতে থাকে, “এইডা কি অইলো?”
আজরফ কবে এই শহরে পদার্পন করে এবং কেন করে তা আমাদের জানা থাকেনা। তবে রমজান তাকে একদিন তার পাশের গ্রামের লোক বলে চিহ্নিত করে; ফলাফলে আজরফের গায়ে ‘পরিচিত’-র ট্যাগ পরে এবং পরদিন তাকে আমরা রমজানের টংয়ের হেল্পার হিসাবে দেখতে পাই। আজরফের পূর্ব ইতিহাস এই পর্যন্ত এসে সরল রৈখিক দাড়ি টানে। তবে সময়ের সাথে সাথে আমরা তাকে এই শহরের সাথে বেমানান হিসাবে দেখতে পাই। আমাদের মত লোকজন যারা রমজান মিয়ার চায়ের দোকানে এসে চা খাই আর দেশ উদ্ধারে নানা পরিকল্পনা ব্যক্ত করি, তারা যখন প্রথম সিগারেটের ফুটকি পর্যন্ত টেনে দ্বিতীয় সিগারেটের অর্ডার দেই তখন আজরফ সিগারেট হাতে সামনে এসে বলত “ভাইডি, বেশী সিগারেট খাওনি ঠিক না”। আমরা হেসে রমজানকে বলতাম “রমজান- তোমার দোকানে লাল বাত্তি জ্বলতে তো দেরি নাই”। সেই আজরফের নিথর দেহ ১নং শ্রীশ দাস লেনের উপর পড়ে থাকে সমস্ত দিন এবং সমস্ত দিন আমরা আজরফের নির্বুদ্ধিতার গল্প বলতে থাকি।
২.
সপ্তাহ কয়েক আগে আজরফ মিয়া, যে আমাদের চেয়ে বয়সে বড় হওয়া সত্তেও আর্থসামাজিক বৈষম্য অধিকারে “তুমি” সম্বধনে সম্বন্ধিত হত, আমাদিগকে জানায় এমপি’র ছেলে বাসেত এলাকার এক মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দিয়েছে। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা প্রাপ্ত হন আমাদের মত আম জনতাকে শোষন করতে, সেটা আমাদের DNA তে লিখা থাকে বলে আমরা মোটেও অবাক হইনা। কেবল নিশ্চিত হবার চেষ্টা করি অথবা প্রার্থনা করি মেয়েটা যেন আমাদের পরিচিত কেউ না হয়। যেদিন জানতে পারি নব্য শিকার মেয়েটি এলাকার নব্য কোন এক ভাড়াটিয়ার মেয়ে সেদিন আমরা খানিকটা হালকা বোধ করি; আমাদের আনন্দ হয়। আমরা সেদিন গোল্ডলিফের পরিবর্তে বেনসনের শলাকায় আগুন ধরাই। আজরফকে বলি “মাইয়াডা এদিক দিয়া গেলে একবার দেখাইও তো”। আজরফ এই শহরে বেনানান ছিল বলেই আমাদের মত মানুষের উপর আস্থা স্থাপন পূর্বক বলেছিল “বাচ্চা-কচি মাইয়া ভাইজান! ওনারে বুজাইয়া কইয়েন মাইয়াডারে যেন ত্যাক্ত না করে”। বাচ্চার চেয়ে কচি শব্দটি আমাদের বেশী পচ্ছন্দ হয়। আমরা বাসেতের লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে কচি মেয়েটিকে দেখার জন্য অপেক্ষা করি। আমাদের অপেক্ষা শেষ হবার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়। ঘটনাটা ঘটে যায় চোখের পলকে, কারো বুঝে উঠার আগেই। ভর দুপুরে রাজপথে দাড়িয়ে বাসেত যখন তরুনী মেয়েটির পথ রোধ করে, তখন সূর্যের আলো আমাদের চোখ বরাবর পড়েছিল বলেই কিনা, আমরা কিছু দেখতে পাইনা। সাহায্য প্রার্থনায় মেয়েটি যখন চিৎকার করে উঠে, আমরা উপলব্ধি করি এই শহরের শব্দ দূষনে আমাদের কান অনেক আগেই তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু আজরফ এই শহরে অপরিচিত কেউ প্রমান করার জন্য এগিয়ে যায়। তার খানিক পর আমরা আজরফের নিথর দেহ ১নং শ্রীশ দাস লেনের উপর পড়ে থাকতে দেখি।
৩.
টানা দুইদিন মর্গের বারান্দায় অপেক্ষার পর আজরফের লাশে পচন ধরে। টানা দুইদিন অপেক্ষার পর খুনের আলামত নষ্ট হয় কিংবা নষ্ট করে ফেলা যায়। পুলিশ যখন জিগ্যাসা করে আজরফকে কে? প্রতিউত্তরে আমাদের উপলব্ধির চোঁয়াল এঁটে আসে; আমরা বিভ্রান্ত হই। আমরা আজরফকে চিনতে পারি না; আজরফর যার থুতনির নিচে বড় একটা আচিল ছিল, যে আমাদের দিকে গোল্ডলিফের সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে মমত্ব নিয়ে বলত “ভাইডি, বেশী সিগারেট খাওনি ঠিক না” তার অস্তিত্ব আমাদের কাছ ঘোলাটে মনে হয়। এমপি সাহেব তার হাতের রং তুলিতে আজরফের নতুন অয়বয়ব আকেন। তুলির আচড়ে আমাদের চা দোকানী আজরফ ছিনতাই কারীতে বদলে যায় এবং আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পারি আজরফ নামের এক ছিনতাইকারী ছিনতাইকালীন সময়ে গনপিটুনীতে নিহত হয়েছে ১নং শ্রীশ দাস লেনের উপর।
সেই দিনই আমরা রমজানের টংয়ের উপর প্রথম শকুন টিকে দেখতে পাই। তারপর অতঃপর ধীরে ধীরে শকুনের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তীব্র উৎকট এক দুর্গন্ধ। আমরা দুর্গন্ধের উৎস কিংবা কারন উদঘাটনে ব্যার্থ হই। কিন্তু এলাকার আন্ধা হাফেজ ঠিক ঠিক বুঝতে পারেন এবং আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন “ওই মিয়ারা - মহল্লায় কি মড়ক লাগছে নিহি। লাশ পচা গন্ধ আহে কইত্থোনে”। আমাদের বোধদয় হয়। আমরা সমস্ত দিন তন্নতন্ন মৃত গলিত লাশ খুজে বেড়াতে থাকি। বুঝতে পারি গলিত পচিত লাশটিকে মাটি চাপা দিতে পারলেই মুক্তি। একবার লাশটুকুকে বের করতে পারলেই শকুন গুলোর চক্কর থেমে যাবে, শকুন গুলো অপেক্ষায় থাকবেনা ভোজনের মহাউৎসবের । কিন্তু সমস্ত মহল্লায় অলি গলি/ চিপা কোন কিছুই আমাদের সন্দেহের পেছনে রশদ যোগাতে ব্যার্থ হয়। দিনের শেষে রমজানের চায়ের দোকানের সামনে জয়নাল সন্দেহ প্রকাশ করে বলে, এটা নিশ্চয়ই আজরফের লাশের গন্ধ। আমরা জয়নালকে নাকোচ করে দেবার যুক্তি খুজি কিন্তু জয়নালের দাবীর বিপরীতে যুক্তির খুটি গাড়তে ব্যার্থ হয়ে এক সময় বিশ্বাস করে নেই মৃত্তিকার পাকস্থলিতে আজরফের লাশ গলে পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে। তখনই ঠিক করে ফেলি ভোরের আলো ফুটলেই আজরফের গলিত লাশ মহল্লা ছাড়া করব; ফেলে দিয়ে আসব দূরের কোন ভাগাড়ে। আজরফ কিংবা তার তুল্য মানুষদের প্রতি আমাদের বিরক্তি জন্মে।
৪
রাতে বাড়ি ফেরা হয়নি। বাড়ি ফেরার সময় জয়নাল বলে উঠে, “বিয়ান বেলা তো আবার বাইর হমু, বাইত্তে গিয়া কাম নাই। আমার বাড়িত চল। সারা রাইত কল ব্রিজ খেলুম নে। এরপর সক্কাল সক্কাল কাম সাইরা বাড়িত গিয়া ঘুম দিও”। জয়নালের প্রস্তাব আমাদের পছন্দ হয়। আমরা জয়নালের অতিথি হয়ে তার বাড়িতে গমন করি এবং চারজনের দলে ভাগ হয়ে আমরা তাস খেলতে বসে যাই। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি আমাদের বেশীক্ষণ জাগ্রত থাকতে দেয়না; আমাদের ঘুম পায়, ঝিমুনি আসে। পর্যাপ্ত ঘুমানোর জায়গার অভাবে আমরা যার যার অবস্থানে বসে কিংবা হেলান দিয়ে ঈষৎ ঘুমে নিজেদের সপে দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে কুৎসিত গন্ধটুকুর তীব্রতা বাড়তে থাকে। জয়নালের বাসার এয়ার ফ্রেশনার ফুরিয়ে ফেলি; তবু দম বন্ধ হয়ে আসে, নাড়ি উল্টে আসতে চায়, বমি পায়। বমির তীব্রতা আটকাতে বাথরুমে ছুটি। বমি করতে গিয়ে শরীর পাথরের মত জমে যায়। পলকেই কুৎসিত গন্ধের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাই। মেনে নিতে পারিনা তবে জানা হয়ে যায় পচন কেবল দেহ নয় স্বত্তারও হয়। বাথরুম থেকে ছিটকে বের হয়ে আসি। ততক্ষনে দূর হতে আযানের সুর ভেসে আসে, আমরা ভোরের অপেক্ষা করি; কিন্তু আমাদের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো উঁকি দেয় না। না।আমারা জানালার পর্দা সরাই এবং দেখি ভোরের আলো সরে গিয়ে কিভাবে ধীরে ধীরে অন্ধকার জমাট বাঁধে। জমাট বাধা অন্ধকারে শকুনদের শীতল চোখগুলো দূর আকাশের তারাদের মত জ্বলজ্বল করে। তাদের চোখে অপেক্ষা -- ভোজনের মহাউৎসবের।
তানভীর রাব্বানী
rabbi_grb এট yahoo.com
মন্তব্য
নাগরিক বাস্তবতায় গল্পের এই ফর্মটি ভালো লাগে। আজরফকেও অচেনা লাগে না। আমাদের অনেকেই আছে এই গল্পে।
এই দুটো বানান সংশোধন প্রয়োজন-
সম্বন্ধিত>> সম্বোধিত
সম্বধনে>> সম্বোধনে
লিখতে থাকুন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ নীড় সন্ধানী বানান শুদ্ধ করে দেবার জন্য। ভাল থাকবেন!
--> আমি অতিথি, দাড়াইলাম মডুদের দুয়ারে যদি উক্ত বানান দুইটা ঠিক করে দেন
খুব ভালো
আজকের এই খবরটা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক এই গল্পের সাথে।
ভালো লেগেছে।
ফারাসাত
আপনার গল্পটা খুব ভালো লাগলো। সেই সাথে মনে করিয়ে দিল, প্রতিদিন কত কত অক্ষমতা আর অসহায়ত্ব নিয়ে আমরা মৃতের কাতারে সামিল হই।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
আমাদের মননের পচাঁ গন্ধ দিন দিন বেড়েই চলছে এবং কেমন জানি সবকিছুর সাথে এই গন্ধেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আপনার গল্পটি ভালো লাগলো।
মানসিক বিকারগ্রস্থ
মন খারাপ হয়ে গেল। লেখা ভালো লাগলো।
অমি_বন্যা
অসাধারণ লাগলো। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক অবস্থার সাথে একদম মানানসই।
ধন্যবাদ শাকিল
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
"পচন কেবল দেহ নয় স্বত্তারও হয়"। গল্পটা খুব ভালো লাগলো।
চমৎকার লেখা
ধন্যবাদ
আমার পরামর্শ, শোনা বা না শোনার পূর্ণ অধিকার আপনার আছে।
(ক) শেষের অনুচ্ছেদ (অর্থাৎ অধ্যায় ৪ পুরোটা) বাদ দিন। এর বদলে আগের সাথে ভাষা ও স্পিরিটে সামঞ্জস্য মিলিয়ে অন্য কিছু লিখুন, আপ্তবাক্য জাতীয় কথা বাদ দিন।
(খ) কিছু কিছু জায়গায় শহীদুল জহিরের প্রভাবটা চোখে পড়ে, আগামী লেখাগুলোয় সেগুলো কাটিয়ে উঠুন।
(গ) প্রহ্লাদ সাহার প্রসঙ্গটা শুরুতে না এনে শেষে আনতে পারেন, নয়তো পাঠক গল্পের শুরুতেই কাহিনী নিয়ে একটা যান্ত্রিক সরলীকরণে চলে যাবে।
এই গল্পের সাথে কোন ভাবে সম্পর্কিত নয় এমন একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেলো। এটা আমার পড়া সচলের সেরা গল্পগুলোর অন্যতম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ষষ্ঠ পাণ্ডবের পরামর্শ তথ্য ভান্ডারে যুক্ত করা হল । পড়ার জন্য ধন্যবাদ
দারুণ!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন