টিকটিকিটা কী সুন্দর দেয়ালের গায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে! পায়ে নিশ্চয় চুম্বক আঁটা আছে। দেয়ালের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত বীরদর্পে হেঁটে বেড়ায়। মাঝে মাঝে থেমে যায়, যেন, যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর বেরিকেডে আটকে পড়ে গেছে আর এই মাত্র জেনে গেল তার সব শেষ হতে চলেছে। হতাশ হয়ে সব আশা ভরসা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। নাহ! সে নিজেই তো দেখছি আরেকজনকে বধ করার জন্য শিকারে আছে!... শুধু শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে টিকটিকিটাকে আর ল্যাম্পের চারপাশে উড়ে বেড়ানো মশাগুলো;- অথচ এই কয়েকদিন আগেও এদের টিক টিক শব্দের যন্ত্রণায় টেকা দায় ছিল। হাতের কাছে যা ই পেতাম তা ই ছুঁড়ে মারতাম। আর মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে মশার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতাম।
পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ গায়ে মেখে সারাটা মাঠ ঘুরে ফিরতে ইচ্ছে করছে। কয়েকজনকে দেখলাম মুখ গোমড়া করে কোথায় যেন চলেছে... পাশ ফিরে তাদর চলে যাওয়া দেখলাম; কী সুন্দর একটা বিকেল অথচ এদের মুখ এত ভারি কেন?
আরে ধ্যাত্! আজকে সময় যেন খেয়ে না খেয়ে একেবারে দৌঁড়িয়ে দৌঁড়িয়ে চলছে। এই একটু আগে বিকেলে বারান্দায় বসে ছিলাম আর দ্যাখো, বেয়াদপ সন্ধ্যা পা টিপে টিপে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিকেলের গা জড়িয়ে ধরছে... আচ্ছা আজ কী কারোর আসার কথা ছিল? আশ্চর্য কে আসবে আবার এই মুখপোড়া হনুমানটাকে শেষবারের মত একটু দেখতে? জানি, কেউ আসবে না। যার আসার কথা ছিল সে যে আজ পৃথিবীর কোন কোণায় পড়ে আছে তার ই খোঁজ রাখি না বহুকাল...
সন্ধ্যাটা যে আলগোছে রাত্রির পায়ের পাতায় জেঁকে বসেছে, ঠিক খেয়াল করিনি। আর মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা... বড় জোর ২ ঘন্টা!
আর হয়তো দেখা হবে না চিরচেনা এই আকাশ আর এই অগণিত তারা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি শেষ হয়ে যাবে তবুও একা একা কেউ রাতভর সন্ধ্যাতারার সাথে জমিয়ে গল্প করবে না- প্রিয়তম তারা তুমি ভালো থেকো।
হয়তো নাগরিক কোলাহলের ভিড়ে একদিন ভুলে যাব, আমিও রাত্রি নামার সাথে সাথে জোকানাকির পিছু পিছু ছুটতাম; আর কাঁচের বোতলে পুরে দেখতাম আলোয় আলোয় বোতলটা ভরে ওঠেছে কিনা। তখন বন্দী জোনাকিরা বেদনায় যে নীল হয়ে যেত, তা আর নজরে আসে নি। তাদের কষ্ট পুড়ে আলোকিত হত চারপাশ- শুধু তার রূপ ই দেখেছি। আজ অনেককাল পর যখন তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি, কাঁচের বোতলের গায়ে লাফিয়ে বেড়ানো সাদা সাদা আলোকগুচ্ছের গভীরে আসলে নীল আলোর ফোয়ারা। নাগরিক কোলাহলে একদিন হয়তো প্রিয় জোনাকির এই নীল কষ্টও আর স্পর্শ করতে পারবে না। সময় সবুজ ডাইনির মত- রূপ গন্ধ মায়ায় ফেলে একদিন অতীতের প্রতি সমস্ত আবেগ অনুভূতি ভুলিয়ে দ্যায়। আজ যা জীবন্ত বর্তমান কাল যখন এই বর্তমান অতীত হয়ে যাবে- তখন তা জীবনের একমুঠো গল্প হয়ে যাবে- অথচ, কালই এই গল্পটা ছিল আমাদের জীবন!
তাহলে জীবন আসলে কী? কোনো গন্তব্যের দিকে ছুটা কোনো মিশন? নাকি জাস্ট সময়ের যোগফল? হয়তো বিয়োগফল। শূন্য হতে জন্ম শূন্যেই বিলীন। আমরা কি তবে আমৃত্যু শূন্যতার বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছি? "যেখানে ফুল আর পশুর পায়ের দাগ একই অর্থবহ!" জীবনের তবে কোনো অর্থ নেই? কী কুত্সিত একটা প্রশ্ন! বোকা, অর্থ থাকবে কেন জীবনের? অর্থ ছাড়াই জীবনটা কত সুন্দর। আর এই সকল সৌন্দর্য কদর্যের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে শূন্যতায় বিলীন।
কে যেন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলোঃ
'মৃত্যু কী?'
'জন্মের জারজ জমজ ভাই!'
'উহ!'
'আমার মনে হয়, ঘুম। সব ভুলে তলিয়ে যায় মহাশান্তির গহ্বরে।'
'আমরা কি তাহলে প্রতিদিন মারা যাচ্ছি?'
'স্বপ্নহীন ঘুমন্ত অবস্থায় আমরা মরে যাই। ঐ ঘুমের মাঝে আমাদের কোন বোধ থাকে না। আমরা যে মানুষ, ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমরা হেসেছি কেঁদেছি কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করেছি ঈর্ষায় জ্বলেছি কাল কি করব এই চিন্তায় মুখ কালো করে রেখেছি- এসবের কোনো বোধ থাকে না। আছে শুধু সুখের যন্ত্রণা আর দুখের যন্ত্রণার বোধহীন সুখ। নিশ্চিন্তির সুখ। জীবনের ভার আর বহন না করার নিশ্চিন্তি। বোধহীন শীত্কারের শিহরণ!'
'তাহলে এই যে রাজনীতি সমাজনীতি দেশনীতি জগতনীতি- এইসব নীতি নিয়ে নেতাগিরি ফালাফালি?'
'স...ব বা..ল!'
'জীবন হচ্ছে, জীবনানন্দের কবিতা। শীতরাতে যা নক্ষত্রদের ওমে জেগে থাকে।'
২.
আরে ধুর! কীসব আবুল তাবুল ভাবনারা এসে যে ভীড় জমায়! আসুক সময়। আমি চাইলেও আসবে, না চাইলেও আসবে। বরং সেই আগত সময়ের জন্য নিজেকে তৈরি রাখা ই ভালো।...
আহ কী সুন্দর বাতাস! চোখের পাপড়িদুটি পরস্পর পরস্পরকে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠছে....
চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় ঘুমিয়ে পড়া এক মুহূর্তের ছবি।... একটা পিচ্চি পুকুরে সাঁতার কাটছে। তার মা কন্চি হাতে পুকুরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কী যেন বলছে! কী বলছে?
'ওঠ আইজ! আইজ তোর একদিন কী আমার একদিন!'
ছেলেটি ভয়ে কয়েকটা মেয়ের মাঝে লুকায়। কী ভালো আপাগুলো! তারা তাকে লুকিয়ে রাখে...
'কারে খোঁজেন জেঠি? নাই তো এইখানে। কহন ওইঠা গেছে!'
আচ্ছা, আপাগুলা আজ কোথায়? কতদিন দেখে না সে তাদের!
অনেক ছবি। জল রংয়ের। তেল রংয়ের। স্কেচ। রং ওঠে এখন সবই ধূসর। যেন পেন্সিলে আঁকা নিরর্থক আঁকিবুকি।
'এখনো বসে আছো? ওঠ!'
ধ্যানমগ্ন খেয়ালি ভবঘুরে ধ্যান ভাঙে। ওহ! তা ই তো! আমাকে তো ছুটতে হবে। গল্প হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছুটতে হবে। সাদা কাগজে অহেতুক আঁকিবুকি হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত হাঁটতে হবে... মহাশূন্যতার বুকে চিরতরে বিলীন হবার আগ পর্যন্ত দৌড়াতে হবে... কিন্তু আমি যে জীবনের ইঁদুর দৌঁড়ে অংশগ্রহণ করতে চাই না। আমি ভবঘুরে হয়ে দেওয়ার টিকটিকির শিকার দেখতে চাই।
-কিঙ্কর আহসান
মন্তব্য
ভালো লাগলো-------
ধন্যবাদ পদব্রজী ভাইয়া
-কিঙ্কর
ধন্যবাদ পদব্রজী ভাইয়া
-কিঙ্কর
ভালো লেগেছে।
ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। ভাইয়ার নামটা তো জানা হলো না
-কিঙ্কর
নতুন মন্তব্য করুন