তখন অনেক ছোট আমি, বয়স আর কতয়বা মেরে কেটে আট বা নয় হবে। পড়ি ক্লাস থ্রী তে। সে সময় আমি আমাদের পুরো পাড়ার বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত চরিত্র ছিলাম। স্কুলের সময় বাদে সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াতাম পাড়া জুড়ে। সমবয়সী বা কিছু বড় বন্ধুদের কাছে আমার তখন বেশ কদর। আমি তো ছিলাম সকল কাজের কাজি, সব খেলাতেই রাজি ।পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলা থেকে শুরু করে ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, মার্বেল, মাছ ধরা... পারি অথবা না পারি সব কিছুতেই- ”প্রেজেন্ট প্লিজ”।
মাঝে মাঝে কপালে বরাদ্দ ছিল ”খিচুড়ির মধ্যে আচারের” মত মুরুব্বীদের স্নেহ মিশ্রিত বকুনি। সবাই বেশ আদর করত আমাকে সেসময়। সবাই আদরের বকুনি দিলেও শুধু একজনের বকুনি ছিল খুব কদর্য, অমার্জিত, নোংরা।
সেই ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল আমরা যে মাঠে খেলতাম তার উত্তর পাশে, সেই সময়ের ঝা চকচকে আলিশান বাড়ি। বাড়ির নাম ছিল মদিনা বাড়ি, আর সেই লোক নিজের নাম বলতেন খুব কায়দা করে ঠোঁট বেকিয়ে- আল মাদানি। হমম তার নাম ছিল মাদানি। সবার কাছে শুনতে পেতাম সে নাকি খুব আলেম লোক, মাদ্রাসার শিক্ষক, হাফেজ, ডাবল হাজি, মানুষকে হজ করতে যেতে সাহায্য করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি! আসলে সাদা বাংলায় মাদানি ছিলেন হজের দালাল। হজ করতে যাবার কথা বলে কত নিরীহ মানুষের যে টাকা মেরে খেয়েছে, হিসেবের বাইরে- যদিও এসব পরে জানতে পেরেছিলাম। মানুষের কষ্টের টাকা মেরে গড়ে উঠেছিল তার আলিশান বাড়ি। পাড়ার সবাই তাকে ভয় পেত,এত আলেম মানুষ, হাদিস কোরান ভেজে খেয়েছেন, মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান, এত কামেল মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলবে কার এত সাহস! ইহকাল, পরকাল দুই কালই ঝরঝরে হয়ে যাবার ভয় রয়েছে তাতে করে।
তার ছেলে ফারুক ছিল আমার সমবয়সী, ফারুকের সাথেও খেলতাম যদিও তাকে আমার তেমন পছন্দ ছিলনা। একদিন ফারুকের কাছে শুনতে পেলাম তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে, ধর্মে নাকি জায়েজ আছে। তারপর নিজেও ফারুক দর্পভরে ঘোষণা করল- সে বড় হলে, সেও দুটো বিয়ে করবে। ছোট মানুষ তখন ধর্ম, দুটো বিয়ে এসব তেমন একটা বুঝিনা, শুধু ফারুকের কথার অতি দর্পিত ভঙ্গিমা পছন্দ হয়নি সে সময়।
তো যা বলছিলাম আরকি, এই মাদানি সাহেবের চক্ষুশূল ছিলাম আমি। আমাকে দেখলেই মাদানি রেগে উঠতেন-
”মেয়ে মানুষ, সারাদিন ছেলেদের সাথে খেলিস, বাপ মা কিছু শিখায় না? এত বড় হয়েছিস এখনও ফ্রক পড়ে ঘুরিস, পায়জামা পড়তে পারিস না, সবার সামনে ঠ্যাং দেখিয়ে ঘুরে বেড়াস, ছিহ ছিহ? কিরে দেখা হল সালাম দিলিনা ? কালেমা শাহাদাত বল দেখি? সেপারা, আমপারা কিছুই তো পারিসনা দেখি। ইত্যাদি ইত্যাদি! “
সেই সময় কেউ আমাকে তুই করে বললে আমার খুব মেজাজ খারাপ হত, মাদানির কথা শুনলে খুবই রাগ হত, ভয় পেতাম মাদানি কে ,তাই কিছু বলার সাহস পেতামনা, কিন্তু মনে প্রানে চাইতাম যেন দেখা না হয় উনার সাথে। দূরে দূরে থাকতাম, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম।
কোরবানি ঈদের কিছুদিন আগের কথা। ফারুকের কাছে শুনলাম তার বাবা নাকি ইয়া বড় এক ছাগল কিনেছে কোরবানি উপলক্ষে। ছাগলের নাকি বিরাট শিং মাথায়, কালো কুচকুচে, গায়ের লোমে নাকি তার বাবা দুই বেলা তেল মাখায়, ছাগলের সাথে মুহাব্বত বেশি তৈরি করে কুরবানি দিলে নাকি সওয়াব বেশি পাওয়া যায়। এই সব হাবিজাবি রোজ রোজ ফারুকের কাছে এত বেশি শুনতাম একদিন খুব লোভ হল ছাগল দেখতে যাবার। গেলাম ছাগল দেখতে পুরা দল ধরে, আট দশ জনের দল - দূর থেকে দেখি মাদানি সাহেব ছাগলের দড়ি ধরে দাড়িয়ে আছে। সত্যি ইয়া বড় এক ছাগল, কুচকুচে কালো, রামছাগল ছিল মনে হয়। কাছ থেকে দেখতে পাবার আশায় ফারুকের সাথে গুটি গুটি পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই মিলে।
মাদানি সবসময় কালো জোব্বা পড়তেন, মাথায় কালো টুপি, মুখ জুড়ে বেশ ঘন দাড়ি, আগে দাড়ির রঙ ছিল সাদা, সেদিন দেখি কালো রঙের দাড়ি, কলপ করিয়ে রেখেছিলেন হয়তবা নতুন বউকে মুগ্ধ করাবার জন্যই। ছাগলের সামনে দাড়িয়ে তাকিয়ে দেখি ছাগলের মাথায় আসলেই বেশ বড় শিং, সারা শরীর সর্ষের তেল দিয়ে চকচকে করা। পাশাপাশি মাদানি আর ছাগলকে বেশ মানিয়েছিল, দুজনেরি কালো অবয়ব, জাতভাই। তখনও তো আর জানতাম না অনেক পরে এই প্রজাতির মানুষদের সবায় ছাগু নামেই চিনবে। পাশাপাশি দুই জনকে এত বেশি একরকম লাগছিল দেখতে দেখতে আমি হেসে ফেলেছিলাম। ছোট মানুষ তো!
আমাকে হাসতে দেখে মাদানি হঠাৎ তেড়ে ফুড়ে উঠল-
”ঐ ছেমড়ি তুই হাসিস ক্যান? নামাজ নাই, রোজা নাই, কোন শিক্ষা সহবত নাই, মুরুব্বীদের সম্মান করতে জানে না, খালি ইস্কুলে গেলেই হবে?
ঐ ফারুক, তরে যদি আর কোনদিন ঐ বেয়াদপটার সাথে খেলতে দেখেছি, ছেলে হয়ে এক মেয়েমানুষের সাথে খেলতে তোর লজ্জা লাগেনা।“
সবার সামনে অপমানে, তীব্র ঘৃণায় আর রাগে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল সেদিন, ইচ্ছে করছিল মাদানির টার দাড়ি টেনে ধরি, তাকিয়ে দেখি আসল ছাগলটা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ফুঁপাতে ফুঁপাতে এক ছুটে বাড়ি চলে এসেছিলাম। রাতে স্বপ্নে দেখি দুই ছাগল মিলে আমাকে তেড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। সেই ঘটনার পর থেকে আর কোনদিন ফারুকের সাথে কথা বলিনি, দুই একবার মাদানি আমাকে দেখে কাছে এগিয়ে এসেছিল কিছু বলার জন্য। আমি পাত্তা দেইনি তাকে। তখন এতটাই ছোট ছিলাম, প্রতিবাদের ভাষা জানা ছিলনা আমার! তবে বেশ কিছুদিন পরে আর কিছুটা বড় হয়ে উপযুক্ত জবাব দিয়েছিলাম মাদানি আর তার ছেলেকে। সে গল্প অন্য কোনদিন বলা যাবে, আজ নাহয় ছাগলের গল্পই বলি শুধু।
সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে ছাগল দেখলেই আমার মাদানির কথা মনে পড়ত। তাই সযতনে ছাগল এড়িয়ে চলতাম।
বছর তিনেক পরের কথা। ছোট থেকে দেখছি, আমার মায়ের গৃহপালিত পশু পাখির প্রতি বিশাল টান। উনি সুযোগ পেলেই কিছু না কিছু পুষতে চান। মাঝে যখন কিছুদিন নানা বাড়িতে ছিলাম, একগাদা মুরগি পোষা শুরু করেছিলেন তখন। যাই হোক, আমরা ততদিনে ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে এসেছি। ফ্ল্যাট বাড়িতে তো আর মুরগি পোষা যায়না, গরুও পোষা যায়না। তাহলে কি পোষা যেতে পারে... কি আর?! এক এবং অদ্বিতীয় ছাগল।
আমার তখনও ছাগলে চরম অ্যালার্জি। আমি প্রাণপণ আন্দোলন শুরু করেছিলাম ছাগলের বিরুদ্ধে। সকল প্রতিবাদ, অনশনের মুখে ছাই দিয়ে একদিন দেখি হালকা খয়েরি রঙের এক নাদুসনুদুস ছাগল এসে হাজির আমাদের বাসায়! আমার ছোট ভাই বোন তো সাথে সাথেই আহ্লাদ করে ছাগলের নাম রাখল জেলি। ছাগলের নাম যে জেলি হতে পারেনা ওদের অনেক বুঝালাম- কে শুনে কার কথা! ছাগলের জেলি নামটায় স্থায়ী হয়ে গেল।
যাই হোক জেলি আমাদের বাসার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেল। বাসার নিচে কলাপসেবল গেটের সাথে বেঁধে রাখা হত তাকে। আম্মা বিশাল ট্রেনিং দিয়েছিলেন জেলিকে। সে কখনও যেখানে সেখানে প্রাকৃতিক বর্জন কর্ম সারত না। খুব ইয়ে পেলে ব্যা ব্যা করা শুরু করত, আর আমরাও অবস্থা বুঝে তাকে বাড়ির পাশের মাঠে নিয়ে যেতাম। নিয়ম ছিল সকালে সবার আগে যে ঘুম থেকে উঠবে সে জেলিকে ভোরের প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের জন্য পাশের মাঠে নিয়ে যাবে। আমার কপাল ছিল এতটাই ভালো যে, প্রতিদিন সকালের সবার আগে উঠা ব্যাক্তিটি ছিলাম আমি! সকালে স্যারের কাছে অংক করতে যেতাম কিনা। অনেক দেন দরবার করেও কাজ হয়নি, যেহুতু আমি সবার আগে ঘুম থেকে উঠি তাই আমাকেই জেলির দায়িত্ব নিতে হবে।
কি আর করা, উপর মহলে তদ্বিরেও লাভ না হওয়াতে আমার দিন শুরু হত ছাগলের প্রাকৃতিক বর্জনীয় কর্ম কাণ্ড দেখতে দেখতে... রোজ সকালে আমি জেলির দিকে অগ্নি দৃষ্টি বর্ষণ করতাম আর জেলি বেচারা নিরীহ দৃষ্টি নিয়ে তাকাত আমার দিকে। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। আমার বিরক্তি সত্ত্বেও জেলির আসন পোক্ত হচ্ছিল ভাই বোনের মনে।
একদিন ভাইকে নিয়ে আম্মা গেছে ডাক্তারের কাছে। বাসায় আমি ,বোন আর জেলি। এই অবারিত স্বাধীনতা কিভাবে কাজে লাগান যায় ভাবছিলাম, হঠাৎ মনে হল আমি এক কল্প নগরীর রাজকন্যা, বন্দী হয়ে আছি অন্তঃপুরে, মুক্তি চাই, বাইরের স্বাধীন পৃথিবী ডাকছে আমায়। আমার হাতিশালে হাতি নাই তো কি হয়েছে, ঘোড়াশালে তো জেলি রয়েছে। যে ভাবনা সেই কাজ। সাথে সাথে জেলির দড়ি ধরে মাঠে হাজির হলাম। বোনকে বললাম সে হল সহিস আর জেলি হল রাজকন্যার প্রানপ্রিয় ঘোড়া। এখন রাজকন্যা জেলির পিঠে চড়বে, সহিস যেন শক্ত করে দড়ি ধরে রাখে। বোন তো তখনও বেশ ছোট, অত কিছু বুঝেনা, আর তাছাড়া বড় বোনের প্রতি তার অগাধ আস্থা, সব সময় নানান রং বেরংয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে তার অতি প্রিয় বড়বোন।
রাজকন্যা তখন ভাব নিয়ে তার বাহন পঙ্খিরাজের পিঠে চড়ে বসে পা দিয়ে পেটে দিল এক গুঁতা। কিন্তু রাজকন্যার পঙ্খিরাজ তো আর সত্যিকারের পঙ্খিরাজ নয়,আসলে নিতান্তই এক ছাগল! হঠাৎ এমন অনাহূত অত্যাচারে জেলি বেচারা ভয় পেয়ে ঝেড়ে দৌড়।
মাটিতে পড়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছিলাম কোমরে। নিজের ব্যাথা সামলানোর আগেই বোনের আকাশ ফাটানো চিৎকার। জেলির দড়ি ছিল তার হাতে, জেলির ঝটিকা পালানোতে ঝটকা খেয়ে সেও মাটিতে পড়ে গেছে। কাছে গিয়ে দেখি ওর হাত কেটে বেশ রক্ত বের হচ্ছে। বাসায় তো বড় কেউ নাই, দুই বোনই আহত হয়েছি, ওদিকে জেলির ও কোন খবর নাই। বুঝতে পারছিলাম না কি করব, আগে বোনের চিকিৎসা না আগে নিখোঁজ জেলিকে খুঁজতে বের হব।
অনেক কাহিনীর পরে সেই দফা জেলিকে পাওয়া গিয়েছিল। বাসায় ফিরে আম্মা যখন দেখেন তার ছোট কন্যার রক্তাক্ত হাত,যা কিনা বড়জন গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে, আর পলাতক জেলি- তখন বড় জনের কপালে কি দুর্গতি ঘটেছিল নাই বা বর্ণনা করি আর। তবে তার পরে আব্বার হস্তক্ষেপে জেলির স্থান হয় শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত আমাদের মুরগির খামারে।
জেলি তো বিদায় হল, কিন্তু ততদিনে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। আমার ঘর সংলগ্ন প্রতিবেশীর মাথায় আম্মার ছাগল সংক্রান্ত ভূত ভালো মত চেপে বসেছে। যখন তখন তাদের বাসায় নতুন নতুন ছাগল এসে হাজির হয়। আমার গুরুত্বপূর্ণ সব পরিক্ষাগুলোর আগের রাতে নতুন আমদানিকৃত ছাগলের প্রাণান্তকর চিৎকারে সারারাত ঘুমাতে পারতাম না। পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষা আর কি দিব, মাথার মধ্যে ক্রমাগত শুনতে পেতাম ব্যা, ব্যা, ব্যা...!!!
আমার রেজাল্ট যে সব সময় মাঝারী মানের থেকে গেল... কখনও ভালো হলনা, তার দায়ভার যদি ছাগলকে দেই, কেউ কি আমাকে দোষ দিতে পারবে?
শেষ একটি ঘটনার কথা না উল্লেখ করলেই নয়। সদ্য এস এস সি পাস করেছি, তখনও কলেজ শুরু হয়নি। খুব ইচ্ছে করছিল শৈশবের ফেলে আসা গুরুদাসপুরে একবার ঘুরে আসি। কাছের প্রিয় বন্ধুটিকে বলতেই এক কথায় রাজি। দুই বন্ধু সাথে আমার বাবা, রউনা দিলাম গুরুদাসপুরের উদ্দেশে। ওখানে গিয়ে সেই কোন ছোট বেলার বন্ধু কিসমোর সাথে দেখা, সে তো মহা খুশি এতদিন পরে আমাকে দেখে। দুইজন হিসেবে বসেছিলাম কে কতটা বড় হয়েছি এই কয় বছরে। ইচ্ছা ছিল এক আঙ্কেলের বাসায় থাকব, কিসমোর জেদ ওর বাসায়, ভাগাভাগি করে থাকছিলাম দুই বাসায়। বেশ মজার সময় কাটছিল। রাজশাহীতে ফেরার আগের দিন সন্ধ্যায় শুনলাম গুরুদাসপুর ঘেঁষে নাকি ঢাকা -রাজশাহী বিশ্ব রোড তৈরি হচ্ছে। সে নাকি এক এলাহি কারবার। সেই সময় যা দেখি তাই রঙ্গিন লাগে। তাই তিন বন্ধু মিলে রিকশা তে চড়ে বসলাম, গন্তব্যস্থল বিশ্বরোড!
তখন ছিল বর্ষা কাল, যখন তখন কালো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। আগের দুই দিন জোর বৃষ্টি হলেও সেই বিকেলে বৃষ্টি ছিলনা, শুধু কেমন একটা ভেজা ভেজা ভাব। খুব ভালো লাগছিল রিকশা নিয়ে ঘুরতে। গিয়ে দেখি আসলেই বেশ হুলুস থুলুস কাণ্ড। বিশাল জায়গা নিয়ে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আমি তখন নব্য ফটুক তুলা শিখেছি। যা দেখি তার ছবি তুলি, এনালগ ক্যামেরার যুগ, বহু কষ্টে টাকা জমিয়ে ছবি প্রিন্ট করি। অন্য কেউ না হলেও নিজের তোলা ছবি দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই।
রাস্তা বানানো দেখতে গিয়ে রাস্তার চাইতে আশে পাশের প্রকৃতি তখন আমাকে বেশি মুগ্ধ করে, আকাশে আবার মেঘ জমেছে, দূরে তালগাছের সারি, চারিদিক বেশ কচি কচি সবুজ হয়ে আছে, রাস্তা কর্দমাক্ত। দেখতে দেখতে কখন যেন আনমনে বন্ধুদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কানে আসে ছাগলের ব্যা ব্যা আওয়াজ, চমকে ঘোর ভেঙে তাকাতেই দেখি, আমি এক ন্যাড়া তালগাছের নিচে দাড়িয়ে, হাতের ডানে বেশ জলা মতন তাতে ঘন কাদা আর সেই কাদায় এক ছোট ছাগলের বাচ্চা আটকে পড়েছে আর ভয় পেয়ে চিৎকার করছে।
খুব মায়া হল দেখে, আহারে ছোট ছাগল। না বুঝেই কাদায় ঝাঁপ দিয়েছে। ভাবলাম বেচারা কে কাদা থেকে টেনে তুলি। ভাবা মাত্র ডান পা সরাসরি কাদার মধ্যে বাড়িয়ে দিলাম ছাগলের বাচ্চা হাতের নাগালে পাবার জন্য। একবারও ভাবলাম না, যে কাদায় ছাগলের বাচ্চার মত ছোট প্রাণী আটকা পড়ে অতি সহজেই সেখানে আমার ডান পা খানার কি দশা হতে পারে! পা দেবা মাত্র সড় সড় করে পা খানি হাঁটুর ও বেশ উপর পর্যন্ত ডুবে গেল। আমার তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা, এক পা কাদাতে নিমজ্জিত প্রায় উরু পর্যন্ত, অন্য পা মাটিতে। কিছুক্ষন চেষ্টা করলাম ডান পা টেনে তুলার, লাভের লাভ এই হল কিছু সময় পর নিজেকে দেখলাম ছাগলের পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই পা প্রায় উরু অবধি ডুবিয়ে। কাদা এত বেশি আঠালো, কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছিলাম না। এতক্ষন ছাগলের বাচ্চা চিৎকার করছিল, এবার শুরু হল আমার পালা। পালাক্রমে দুইজন মিলে ব্যা ব্যা করি সাহায্যের জন্য। সম্মিলিত উদ্যোগের চিৎকার শুনে বন্ধুরা খুঁজে খুঁজে ডোবার পাশে এসে হাজির হল। সেদিন ঠিক করেছিলাম “বন্ধু যখন বেঈমান” নামে কোন বাংলা সিনেমা এখনও বানানো হয়ে না থাকলে আমি অতি সত্ত্বর বানানর উদ্যোগ নিব। আমার দুই বন্ধুর পেট চিপে ধরে সে কি হাসি। ভাগ্যিস ক্যামেরা খানা আমার গলায় ঝুলছিল!!!
হাসাহাসি পালা কিছুটা কমার পর ওদের চেষ্টা শুরু হল কিভাবে আমাকে উদ্ধার করা যায়। কাদা এত বেশি ঘন আর আঠালো ছিল, ওরা ঠিক সুবিধা করতে পারছিলনা। বড় কারো সাহায্য লাগবে। বিশ্ব রোড তৈরি হচ্ছিল শহর থেকে বেশ কিছু দূরে, তখনও মুঠোফোন এতটা জনপ্রিয় হয়নি, কিভাবে আমাদের উদ্ধার করা যায় তবে?।
আমার ফিচলে বন্ধু বুদ্ধি দিল, যেই সমস্ত মজুরেরা বিশ্ব রোড তৈরির কাজ করছে তাদের সাহায্য নেওয়া যাক। আমার প্রবল প্রতিবাদের মুখেও চার জন শ্রমিক বাঁশ এবং দড়ি দিয়ে কিভাবে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন সে কাদার জঞ্জাল থেকে, সে লজ্জার ইতিহাস আর নাইবা বললাম।
উদ্ধারপর্ব তো শেষ হল, আমার তখন কোমরের নিচ থেকে কাদায় মাখামাখি। কাদা ধুব কিভাবে, বাসায় ফিরবো কিভাবে? আশে পাশে পানি বলতে ছোট এক বন্ধ জলায় বৃষ্টির কাদা মাখা পানি। তাতেই চেষ্টা করলাম নিজেকে কিছুটা সভ্য করতে, লাভের লাভ হল এই যে ধৌত পর্বে গিয়ে পায়ের কাদা তো দূর হোলয় না উল্টা হাতেও কাদা লাগলো। বুঝলাম দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে।
অগত্যা এক রসিক রিকশাওয়ালার রিকশাতে চেপে বাজারের মধ্যে দিয়ে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন আমার নিচের অর্ধেক মৎস্য কন্যাদের মত কাদায় ঢাকা। আশে পাশের মানুষের বিস্মিত চাহনির সাথে সাথে মুচকি হাসি, খিল খিল হাসি, হি হি , হো হো, ফিচকে হাসি, ফাজিল হাসির সাথে সাথে বন্ধুদের সহ আরও অনেকের অট্টহাসি, সব রকমের হাসি শুনার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। রিকশাওয়ালার ছিল আবার ব্যপক গানের প্রতিভা, তাই মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রেখে মাঝে মাঝেই পিছন ফিরে আমাকে দর্শন পূর্বক গান শুরু হল-
”বন্ধু যখন বউ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া... ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়”
আমারও তখন বুকটা ফেটেই যাচ্ছিল। সেই দিন পরিস্কার বুঝলাম, আমাকে বাঁচতে হলে জানতে হবে, ছাগল দূরে রাখতে হবে। সেই থেকে আজ অবধি আমি ছাগু থেকে সাবধান থাকি, ছাগল থেকে সাবধান থাকি, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: কিছুদিন আগে নীড় পাতায় দেখি অনুদার পোস্ট ছাগলকে ভালবাসুন, ছাগুদের বর্জন করুন। পড়তে পড়তে আমার ছাগল বিষয়ক অভিজ্ঞতাগুলো বারবার মনে হচ্ছিল। সেখান থেকেই এই লেখার জন্ম। আমি অনুদার সাথে সম্পূর্ণ একমত যে, সবার ছাগুদের বর্জন করা উচিত আর ছাগল নামক নিরীহ প্রাণীটিকে ভালবাসা উচিত। শুধু আমি ছাগু আর ছাগল এই দুই দল থেকেই দূরে থাকতে চাই, নাহলে হয়ত আবারো আমার ”গিয়াঞ্জাম” বেধে যাবে!!! ]
সাফিনাজ আরজু
মন্তব্য
কিছুদূর এসেই বুঝলাম আপনার লেখা। আপনার লেখার স্টাইল দারুণ।
ছাগল কাহিনিতে মজা পেলাম
লেখা - পড়ার জন্য।
কেম্নে বুঝলেন যে এটা আমার লেখা?
স্টাইল থেকে।
ছোটখাটো কিছু বানানে সমস্যা বা টাইপো আছে, ঠিক করে নিয়েন।
আপনার ছাগল বিষয়ক লেখা দেখে আমার স্কুল লাইফের কথা মনে পরে গেল । আমাদের স্কুলের মাঠ ছিল ঘাসে ভরপুর ।প্রতিদিন মাঠে ১০-১২টি ছাগল থাকত । টিপিন পিরিয়ডে আমরা পালা করে ছাগল নির্যাতন করতাম,২টা ছাগলের মধ্যে গেয়াঞ্জাম লাগিয়ে মজা নিতাম, ইত্যাদি ইত্যাদি:)
নাম সৌরভ
ছাগল নির্যাতন তো মোটেও ভালো কিছু নয়!!!
ছোটবেলায় মানুষ আসলে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটায়।
পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
মজা পেলাম আপনার কাহিনি শুনে। আল-মাদানী টাইপ খাসি ছাগলগুলো বরাবর-ই অসহ্য, ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ।
আমি অবশ্য ছাগু আর ছাগল কোনটা নিয়েই কোনদিন ঝামেলায় পড়ি নাই। ছোট ছাগল বরাবর খুব ভাল লাগতো, মনে আছে নানা বাড়ীতে গেলে হয় কবুতর বা বাছুর বা ছাগলের বাচ্চা সব সময় কোলে নিয়ে ঘুরতাম আর ছাগুরা কোনদিন ই আমার কোন ঝামেলা করতে পারে নাই, পাত্তাই পাই নাই তবে কোন কোন ছাগুকে বাটে পেয়ে সেইরকম দিয়েছিও
এরা এত বেশি রকমের অসহ্য! আফসুস হয় কেন মাদানির দাড়ি টানি নাই সেইদিন!!!
আপনি ভাগ্যবান কোনদিন ছাগুদের ঝামেলায় পড়েন নাই, আসলে আমি ছোট বেলায় খুব দুরন্ত বাচ্চা ছিলাম, আর ছাগু প্রজাতির মানুষজন তো আমাদের চারপাশে অসংখ্য, ছেলেদের সাথে খেলতাম মানতেই পারতো না। এই নিয়ে অনেকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে, যখন একটু বড় হয়েছি, জবাব দিতে আমিও দ্বিধা করিনি।
ছাগলের বাচ্চা আসলেই খুব কিউট হয়।
লেখা পড়ার জন্য।
আপনার লেখার ভঙ্গী খুব ঝরঝরে, মাঝে মাঝে হিউমার মিশিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে।
কিন্তু আবার ছাগু আর ছাগল মিক্সড করে ফেললেন, জানেন একবার এক ছাগল কি ভাবে আমার প্রাণ বাচিয়েছিল তার ঝলসানো রান দিয়ে!
মাদানীর অভিজ্ঞতা জানতে ইচ্ছুক!
facebook
বিরাট খুশি হলাম অনুদা। অনেক অনেক
ছাগল তো খুবই উপকারী প্রাণী জানি আমি, কি আর করার, শুধু আমি গিয়াঞ্জাম লাগায় ফেলি ছাগলের সাথে।
মাদানিসহ আরও কিছু ছাগুর ছাগলামির গল্প একদিন লিখতে হবে।
ভালো থাকবেন।
আবারো অনেক ধন্যবাদ।
ঝরঝরে, প্রানবন্ত ও আকর্ষনীয় লেখনীভঙ্গী; পড়তে দারুন লাগলো, এবং আরো বড় হলেও ক্লান্তি আসতো না..
ভালো থাকা হোক।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
অনেক ক্রেসিডা ভাই, লেখা পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য।
ভালো থাকবেন!
কাঁদার ভেতরে দেবে যাবার কাহিনী পড়ে কাদায় দেবে যাবার ছোট বেলার দুই একটা ঘটনা মনে পড়লো। লেখা ভালু পাইলাম।
আবারো বলি ছাগলকে ভালবাসুন, ছাগুদের বর্জন করুণ।
সহমত।
ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও পরজন্মে ছাগল হয়ে জন্মাতে চাই - ভাবনা থেকে মুক্তির আশায়।
বুঝি নাই।
নতুন মন্তব্য করুন