গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে এত বড় দুর্ঘটনাটা আর সবার মত নাড়িয়ে দিয়ে গেছে আমাকেও। মনে হচ্ছে এত দূর থেকে হাহুতাশ করা ছাড়া কিছুই মনে হয় করার নাই। কিন্তু আমরা হতাশ হয়ে, শোক দিবস পালন করে, গার্মেন্টস মালিক কিংবা পোষাক ক্রেতাদের গালি দিয়ে একজন শ্রমিককেও যেমন ফিরিয়ে আনতে পারব না, ভবিষ্যত মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতেও কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না। বরং কিছুদিন পর আমরা সবই ভুলে যাব, আবার আগুন লাগবে কোন কারখানায়, আবার পুড়ে ছাই হবে মানুষ।
কিন্তু কেন হচ্ছে এগুলো? গার্মেন্টস মালিকদের সীমাহীন লোভ? লোভ তো অবশ্যই। কিন্তু লোভ কার নেই? আর লোভকে দোষ দিয়ে যদি থেমে যাই তাহলে লোভ কখনোই কমবে না। বরং আমাদের এমন কিছু একটা চিন্তা করতে হবে যাতে গার্মেন্টস মালিকদের সীমাহীন লোভ থাকা সত্বেও আমাদের শ্রমিকরা নিরাপদ থাকতে পারে।
প্রথমে দেখি শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের কি কি কারনে মাথাব্যাথা থাকতে পারেঃ
১। আমাদের গার্মেন্টস ক্রেতাদের অনেকেই পোষাকের মানের সাথে সাথে কি অবস্থায় পোষাক তৈরী হল সেটা নিয়ে সচেতন। ইয়াহু নিউজ এ অগ্নিকান্ডের খবরে দেখলাম প্রচুর মানুষ মন্তব্য করছে শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে। আবার বড় বড় ব্র্যান্ড গুলো যখন আমদানী করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন ক্রেতাদের এই সচেতনতার কথা নিশ্চয় মাথায় রাখে। এখন বাংলাদেশের কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তামান মানবেতর এটা জেনে বিদেশী ক্রেতারা যদি বাংলাদেশের পোষাক কেনা কমিয়ে দেয়, তাহলে আমাদের লোভী গার্মেন্টস মালিকদের মুনাফায় টান পড়বে, সেটা নিশ্চয় তারা জানেন।
২। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা যত কম হবে, শ্রমিকের কারখানায় কাজ করার সুযোগ ব্যয় (opportunity cost) তত বেড়ে যাবে। সুতরাং শ্রমিক নিয়োগ করতে গার্মেন্টস মালিকদের বেশি মজুরি দিতে হবে। এটা আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে খুব একটা কাজ করবে না কারন আমাদের শ্রমবাজারে এখনো উদ্বৃত্ত শ্রমিক রয়েছে। সুতরাং কারখানার মান খারাপ হওয়ার কারনে শ্রমিকব্যয় বেড়ে যাওয়া এখনো সম্ভব নয়।
তাহলে দ্বিতীয় কারনটা নাহয় উদ্বৃত্ত শ্রমের জন্য কাজ করছে না, কিন্তু প্রথম কারনটা কাজ করছে না কেন? এখানেই আমার মনে হয় সমন্বয় একটি সমস্যা হতে পারে। ভেবে দেখুন, একজন বিদেশী ক্রেতা যখন একটা কাপড় স্টোর থেকে কেনেন, সেটাতে লেখা থাকে “মেড ইন বাংলাদেশ”, কখনোই কিন্তু লেখা থাকে না “মেড ইন অমুক ফ্যাক্টরী ইন বাংলাদেশ”। বাংলাদেশের ফ্যাক্টরীতে যদি শ্রমিকদের নিরাপত্তার মান খারাপ হয়, আর সে কারনে যদি বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশের পোষাক কেনা কমিয়ে দেয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে সবগুলো ফ্যাক্টরী। এখন কোন একটা ফ্যাক্টরী যদি তাদের কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়ায়, তারা কিন্তু কোন সুবিধা পাবে না। কারন, বিদেশী ক্রেতাদের কাছে তাদের পোষাক ও বাংলাদেশের গার্মেন্ট হিসেবেই বিবেচিত হবে। যতক্ষন পর্যন্ত না অন্য গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীরাও তাদের কারখানার মান উন্নত করছে, কোন একটি কারখানা তাদের মান উন্নত করতে চাইবে না। যদিও সব গার্মেন্টস কারখানার পরিবেশ উন্নত হলে সেটা হয়ত সবার জন্যই ভাল হত।
একটা সহজ উদাহরন নিয়ে দেখি। মনে করুন শুধুমাত্র দুটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী আছে। “আজিম গার্মেন্টস” আর “নাজিম গার্মেন্টস”। প্রত্যেকে তাদের কারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তার মান ভাল রাখতে পারে অথবা খারাপ রাখতে পারে। কারখানার মান ভাল করতে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। আবার কারখানার লাভ বেশী হয় যদি ক্রেতারা মনে করে কারখানার পরিবেশ ভাল। কিন্তু ক্রেতারা “আজিম গার্মেন্টস” আর “নাজিম গার্মেন্টস” চিনে না, তাই বাংলাদেশের সব কারখানার পরিবেশ ভাল বলে যদি পত্রিকায় রিপোর্ট আসে, তাহলে তারা বেশী বেশী অর্ডার করে বাংলাদেশ থেকে। কোন একটা খারাপ থাকলে, সেখানে দুর্ঘটনা হয়, সেটা পত্রিকায় আসে, আর ক্রেতারা সবগুলো ফ্যাক্টরী থেকেই কম কেনে। মনে করি, ভাল রিপোর্ট হলে প্রত্যেক গার্মেন্টস এর লাভ হয় ২ কোটি, আর খারাপ রিপোর্ট হলে লাভ হয় ১ কোটি। তাহলে গার্মেন্টস গুলোর সিদ্ধান্ত কি হবে সেটা নিচের টেবিল থেকে দেখা যাকঃ
দুটো গার্মেন্টস ই যদি খারাপ হয়, তাহলে প্রত্যেকের লাভ হয় ১ কোটি টাকা। দুটো গার্মেন্টস ই যদি ভাল হয়, তাহলে ক্রেতারা বেশি অর্ডার দেবে তাই লাভ হবে ২ কোটি টাকা করে, কিন্তু কারখানার পরিবেশ ভাল করতে গিয়ে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যাবে, তাই নিট লাভ থাকবে ১.৯ কোটি টাকা করে। অন্যদিকে যেকোন একটা গার্মেন্টস ও যদি খারাপ থাকে, তাহলে ক্রেতারা কম অর্ডার দেবে, তাই প্রত্যেকের লাভ হবে ১ কোটি টাকা করে। কোন একটা গার্মেন্টস যদি কারখানার পরিবেশ ভাল করে, তারা এর জন্য কোন অতিরিক্ত লাভ পাবেনা, কিন্তু খরচ হবে ১০ লাখ টাকা, তাই তাদের নিট লাভ হবে ০.৯ কোটি টাকা। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এক্ষেত্রে সুস্থিতি বা ইকুইলিব্রিয়াম হয় দুটো। হয় উভয় গার্মেন্টসই কারখানার মান ভাল করবে, অথবা কেউই করবে না। কারন, অন্যজন যদি মান ভাল না করে, তাহলে শুধু একটি গার্মেন্টস কারখানার মান ভাল করে কোন লাভ নেই।
এক্ষেত্রে সমন্বয় সমস্যা একারনেই হচ্ছে যে, উভয় গার্মেন্টসই ভাল কারখানা চায় যদি সেটা তাদেরকে ভাল লাভের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু কোন একটি গার্মেন্টস একক প্রচেষ্টায় ভাল লাভ নিশ্চিত করতে পারে না। তাই আমরা যদি এমন একটি অবস্থান থেকে শুরু করি যেখানে উভয় গার্মেন্টসই খারাপ, তাহলে সেটা কখনোই পরিবর্তন হবে না, যেহেতু এটি একটি সুস্থিতি। এটার পরিবর্তন সম্ভব শুধুমাত্র যদি বাইরে থেকে এমন একটা কিছু করা হয় যেটা এই সুস্থিতিকে পরিবর্তন করে বিকল্প ভাল সুস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে।
কি হতে পারে সেই পরিবর্তনকারী শক্তি? আমার মনে হয় এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সরকার। আমাদের স্বল্প সময়ের জন্য হলেও গার্মেন্টস কারখানার নিরাপত্তা ও পরিবেশ নিয়ে খুবই কঠোর ও স্পষ্ট নিয়মকানুন এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন দরকার। এবং সেটা প্রচলিত আইনের দোহাই দিয়ে হবে না। এটার জন্য বিশেষ আইন এবং বাস্তবায়ন এর জন্য আলাদা সুবিধা দরকার। কি কি নিয়ম করতে হবে সেটা অগ্নিনিরাপত্তা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন। এটা করা খুব কঠিন বা ব্যয়সাপেক্ষ বলে আমার মনে হয়না। কিন্তু নিয়মগুলো সুস্পষ্ট হতে হবে। পর্যাপ্ত সিঁড়ি থাকতে হবে না বলে কতজন শ্রমিকের জন্য ন্যুনতম কতগুলো এবং কতটুকু প্রশস্ত সিঁড়ি থাকতে হবে সেটা নির্ধারন করতে হবে। এবং নিয়মগুলো তৈরী হয়ে গেলে প্রথমত সেটার ব্যাপক প্রচার করতে হবে এবং সরকার নিয়োজিত কোন সংস্থা কর্তৃক কারখানাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষন করতে হবে। অবশ্যই সব কারখানাকে সবসময় পর্যবেক্ষনে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু যেকোন নিয়ম ভঙ্গ করার শাস্তি যদি অনেক বেশী হয়, তাহলে মুনাফাখোর গার্মেন্টস মালিকরা মুনাফার স্বার্থেই নিরাপত্তার মান উন্নত করবেন।
প্রশ্ন থেকে যায়, সরকারী দুর্নীতির কি হবে? সেটার যেমন কোন ভাল সমাধান নেই, কিন্তু এটাও তো সত্য যে কিছু কিছু সরকারী কাজ তো হয়। এটা আমার মনে হয় অগ্রাধিকার এর ব্যাপার। সরকার যদি মনে করে, এই নিয়ম বাস্তবায়ন করা জরুরী, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব বলে আমি মনে করিনা। আর সরকারের এই অগ্রাধিকার নির্ধারনের ক্ষেত্রে নিশ্চয় আমাদের, জনগনের, কিংবা অনলাইন এক্টিভিস্টদের কিছু করার আছে। আমরা যদি মনে করি, এটা করতেই হবে, তাহলে সরকারের উপর কিছুটা চাপ প্রয়োগ নিশ্চয় করাই যায়। কিন্তু আমাদের আরো হাজারটা সমস্যার মাঝে এটাকে আরো একটা ধরে নিয়ে যদি হতাশ হয়ে বসে থাকি, অথবা সরকার কিংবা গার্মেন্টস কে গালিগালাজ করতে থাকি, তাহলে নিশ্চিন্ত থাকা যায় এর একটা সমস্যাও সহজে সমাধান হবে না।
এবার আসি কেন এই সমস্যাটা অন্যগুলোর থেকে আলাদা? যেকোন সমস্যা সমাধান করা কঠিন হয়ে যায় যখন অনেক বেশী স্বার্থের বিরোধ থাকে। শ্রমিক স্বার্থ আর মালিকদের স্বার্থ যদি অনেক আলাদা হয় তাহলে যেকোন আইন কোন একপক্ষকে বেশী সুবিধা দেবে এবং সেই আইন বাস্তবায়ন করা তত কঠিন হবে। কিন্তু এখানে শ্রমিক স্বার্থ আর মালিকদের স্বার্থ খুব একটা আলাদা বলে আমার মনে হয়না। অনেক গার্মেন্টস মালিকই হয়তো চাইবেন তাদের বিদেশী ক্রেতাদের সন্তুষ্ট রাখতে, বাজার ধরে রাখার জন্য। আর কারখানায় ভাল পরিবেশ বজায় রাখার খরচটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এককালীন এবং হয়তো খুব বেশী নয়। কিন্তু বিদেশী ক্রেতাদের সন্তুষ্ট থাকাটা যেহেতু তার নিজের কারখানার পরিবেশের উপর নির্ভর না করে বরং দেশের ভাবমূর্তির উপর নির্ভর করে, তাই সেই গার্মেন্টস মালিকের আসলে কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে সরকার সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীকে ভাল পরিবেশ বজায় রাখতে বাধ্য করলে অধিকাংশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর জন্য সেটা লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এবং একবার যখন শ্রমিক নিরাপত্তার নিরিখে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভাল হয়ে যাবে, তখন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলো তাদের মুনাফার লোভের কারনেই কারখানার পরিবেশ ভাল রাখতে চাইবে, আইনের কঠোর বাস্তবায়নের খুব বেশী দরকার পড়বে না তখন।
সুহাস শিমন
মন্তব্য
বিডিনিউজ২৪ ডট কমে খবর এসেছে [সূত্র],
আগুন লাগার পর তালা না লাগাতে তো কোনো টাকা খরচ হয় না। মায়ের কোক থেকে বের হয়েছে এরকম যে কোনো মানুষই জানে এই কাজ করতে হয় না।
তালা আটকে মানুষকে পুড়িয়ে মারার জন্য তাজরিন ফ্যাশনসের মালিক ও পরিচালকের ফাঁসি চাই।
প্রতিটা অগ্নিকাণ্ড কেইসে অবিলম্বে বিচার করলে লেখায় দেখানো প্রিজনার্স ডিলেমাটা আপসেই সমাধান হয়ে যেতো।
আইন বদল না করে প্রচলিত ব্যবস্থায় বিচার করে খুব কিছু কি হওয়া সম্ভব? আমরা যতই হত্যা বলি না কেন, এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখানো খুব কঠিন হয়তো হবে না। আর শাস্তি হলেও হবে দেখা যাবে পরিচালকের সহকারীর। সেটা হয়তো পরিচালকের সহকারীদেরকে ভবিষ্যতে সাবধান করবে, কিন্তু পর্যাপ্ত সিঁড়ি অথবা উপযুক্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা যেগুলো এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে, সেটা নাও হতে পারে।
এই সমস্যাটা প্রিজনার্স ডিলেমা নয়, এধরনের গেম কে বলে স্ট্যাগ হান্ট। এক্ষেত্রে আইন প্রনয়ন এবং প্রয়োগ অন্যান্য সমস্যার মত এত কঠিন হওয়ার কথা না, কারন এখানে গার্মেন্টস মালিকদের প্রেফারেন্স অ্যালাইন্ড।
তাই তো। যদিও দুটোর মাঝে মিল আছে, কিন্তু স্ট্যাগ হান্টে দুটো সাম্যাবস্থা, প্রিজনার্স ডিলেমায় একটা। অনেক ধন্যবাদ শুদ্ধির জন্য।
আপনার বিশ্লেষণের অনেক অংশই চমৎকার লেগেছে। এরকম লেখা চালিয়ে যাবেন।
শাস্তি অবশ্যই চাই। তালা যে লাগিয়েছে আর এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাউকে এত গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত যে নিতে দিয়েছে, উভয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যাটা তো শুধু তাজরীন ফ্যাশন এর নয়। এরকম গার্মেন্টস নিশ্চয় আরো আছে, সেখানেও যেকোন দিন আগুন লাগতে পারে, সেখানকার পরিচালক ও তালা লাগিয়ে মানুষ পুড়াতে পারে। এবং এটা বন্ধ হবেনা যতদিন না এমন কিছু করা হচ্ছে যা গার্মেন্টস মালিকদেরকে দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করছে।
তালা যে লাগিয়েছে সেও হয়ত মাইনেভোগী সাধারণ কর্মচারীই।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
এই মানসিকতাটাই আসল নষ্টের মূল। বিদেশী ক্রেতাকে খুশি রাখতে কেন কারখানার নিরাপত্তা বাড়াতে হবে? যেই মানুষগুলো সেখানে সকাল সন্ধ্যা কাজ করে তাদের নিরাপদ রাখাটাই প্রধান।
বিজিএমই কেন এক বছরের একটা সময়সীমা বেঁধে দেয় না? একবছরের মধ্যে যারা ন্যুনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করবে, তাদের কারখানা বন্ধ।
এই মানসিকতা যে সকল নষ্টের মূল, সে ব্যাপারে আমি একমত। পৃথিবীটা আরো অনেক সুন্দর হত যদি আমরা একে অন্যের জন্য চিন্তা করতাম। কিন্তু সেটা অনেক সময়ই যেহেতু আমরা করি না, তাই আমি মানুষের জীবন অন্য মানুষের বদান্যতার উপর ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতি নই। মানুষকে স্বার্থপর ধরে নিয়েই অন্য মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে বিজিএমইএ র চাইতে সরকারের ভূমিকা বেশী হওয়া উচিত বলে মনে হয়। আর ন্যুনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি সেটাও আমরা জানতে চাই। কারখানা বন্ধ করার মত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা আসলেই দরকার।
কিছু করা লাগবে না, আপনে গার্মেন্টস মালিকরে ফাসি ঝুলান, শ্রমিকরা গার্মেন্টস না ভাইঙ্গা মালিকের বাড়িতে আগুন দিক তিন মাসের মধ্যে সব গার্মেন্টস ঠিক হয়া যাবে। মিডিয়া যদি ইমোশনের বিজনেস না কইরা জাস্ট এই গার্মেন্টস মালিকের ফ্যামিলির ছবিটা ছাপাইয়া দেয়, আর মানুষ সামাজিকভাবে এদের বয়কট করে, তাইলেও রেজাল্ট পাওয়া যাবে। এইখানে গেম থিওরি দিয়া লাভ নাই, এইটা নৈতিকতা আর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
যে মালিকের নৈতিকতা ভালো, সে এমনিতেই এইটা করবে আর পশু শ্রেনীর মালিকরে এইটা করা্ইতে হবে চিপা দিয়া।দুর্ভাগ্য চিপা দেয়ার কাজটা সরকার মিডিয়া কেউই করতেছেনা। বিদেশী কিছু কোম্পানি কমপ্লাইন্স অফিসার বসাইছে, কিন্তু তাদের মধ্যে ও নাকি দুই নম্বর আছে।
গার্মেন্টস মালিকরে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলাতে চাইনা। এমন তো হতে পারে, সব গার্মেন্টসের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই একই রকম। এই গার্মেন্টস মালিকের দুর্ভাগ্য ছিল যে তার কারখানায় আগুন লাগসে। আমরা গার্মেন্টস মালিকদের ঝুলাতে পারি, শত্রু বানাতে পারি, সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারি, সেটা সমস্যার সমাধান করবে বলে মনে হয়না। বরং তখন ভাল উদ্যোক্তারা এই শিল্পে আরো কম আসবে, তাতে নৈতিকতা আর দায়বদ্ধতা বাড়বে বলেও মনে হয়না।
আমার মতে ভাল আর পশু শ্রেনী সবাইকেই করাইতে হবে চিপা দিয়া। কে ভাল আর কে পশু শ্রেনী এটা বিচার করা আরো কঠিন। যার গার্মেন্টসে আগুন লাগসে সে পশু আর যারটাতে লাগে নাই কিন্তু লাগতে পারত সে ভাল, এটা মনে করার কোন কারন নাই। নৈতিকতা আর দায়বদ্ধতা থাকলে ভাল, কিন্তু এটার উপর ভরসা করে বসে থাকলে কি হতে পারে সেটা কি আমরা আমাদের চারপাশে দেখছি না?
বিনা বিচারে কেনো? বিচার করেই ঝুলান। এই রকম যে কয়টা গার্মেন্টসের অবস্থা, তাদের মালিকদের ফাসি না দেন, ১০-১৫ বছরের জেল দেন। দেখেন ঠিক হয় কী না।
যার কারখানায় আগুন লাগছে, সে খারাপ তা না, খারাপ প্রায় সবাই। যেই শ্রমিকগুলো কপাল খারাপ, তাদের গার্মেন্টসে আগুন লাগে, তাদের জান যায়, মালিকের ক্ষতি শুধু লাভ কমে যাওয়া।
এই শিল্পে টাকা আছে, উদ্যোক্তারা হামাগুড়ি দিয়া আসবে, কোরিয়ানরা, ইন্ডিয়ানরা, জাপানিরা আসছেনা? গ্যাস নাই তারপরও কি গার্মেন্টস বানানো কমছে?
কে ভালো আর কে পশু এইটা বের করা কঠিন কেন বলতেছেন?
"এই রকম যে কয়টা গার্মেন্টসের অবস্থা, তাদের মালিকদের ফাসি না দেন, ১০-১৫ বছরের জেল দেন। " আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি। গার্মেন্টসের কোন অবস্থা ভাল আর কোনটা ভাল না, সেটা নির্ধারন করার জন্য স্পষ্ট নীতিমালা দরকার। আগুন লাগা না লাগার ক্ষেত্রে সম্ভাবনার ব্যাপার আছে, কিন্তু কার প্রস্তুতি কতটুকু সেটা নিশ্চিতভাবে বিচার করা যায়। সুতরাং, আগুন লাগলেই শাস্তি হবে আর না লাগলে হবে না, এধরনের বিচার দিয়ে এটা বন্ধ করা যাবে বলে আমার মনে হয়না।
কে ভাল আর কে পশু বের করা কঠিন বলছি কারন এ দুটোর মধ্যে ব্যবধান অনেক সময় খুবই সামান্য। একটা ছোট সিদ্ধান্তের হেরফের অনেক সময় একজনকে ভাল আর আরেকজনকে পশু বানিয়ে দিতে পারে। এজন্য আমি মানুষের ভালত্ব অথবা পাশবিকতা কোনটার উপরই ভরসা রাখতে চাইনা। বরং মানুষকে মানুষ হিসাবেই চিন্তা করি, দোষ-গুন মিলিয়ে। আর এধরনের মানুষের কাছ থেকে সঠিক কাজটা বের করে আনার জন্য সবসময়ই সঠিক প্রনোদনা (Incentive) তৈরী করা দরকার।
বাংলাদেশের গারমেন্টস ব্যবসায় কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগ আনার খুব একটা উদ্যোগ নেই। কিছু গারমেন্টস মালিকের এ বিষয়ে মতামত এখানে পাওয়া যাবে। সোজা কথায়, বিদেশীরা দেশে ফ্যাক্টরি খুললে শস্তা শ্রমিকদের মাইনে বেশী দিয়ে নিয়ে যাবে - এরকমটাই তারা ভয় করছেন।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
চমৎকার একটা অবজার্ভেশন। এই লেখাটা আগে দেখিনি। আসলে গার্মেন্টস মালিকরা বিদেশী বিনিয়োগ চাইবে না এটা খুবই স্বাভাবিক। শ্রমিকের জন্য, অর্ডারের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়লে সেটা এখনকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর জন্য খারাপ। এমনকী আরো বেশী দেশী বিনিয়োগ ও হয়তো বর্তমান মালিকরা পছন্দ করবেন না। কিন্তু দেশী বিনিয়োগের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি নেই বলে হয়তো বিদেশী বিনিয়োগের পেছনে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন।
বিদেশী বিনিয়োগ গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ক্ষতিকর হলেও অর্থনীতির জন্য লাভজনক কিনা সেটা মনে হয় আরেকটু ইনভল্ভড প্রশ্ন। প্রতিযোগিতা বাড়া ভাল কিন্তু প্রতিযোগিতায় দেশীয় ফ্যাক্টরী টিকতে না পারলে সেটা হয়তো দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ভাল নাও হতে পারে। আবার, এই পর্যায়ে এসে আমাদের দেশীয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করা উচিত। সুতরাং উত্তর যাই হোক, এই ইস্যুটা আরেকটু পর্যালোচনার দাবী রাখে।
আমার মনে হয় বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে যখন বিদেশী পুঁজি এসে দেশী শিল্প-সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দেয়। বিদেশী বিনিয়োগ এলে চাপে পড়েও হলে ফ্যাক্টরি-মালিকদের অনেকেই শ্রমিকদের মাইনে বাড়াবেন, অনেকে উঠেও যাবে। কিন্তু যারা টিঁকে থাকবে তারা অনেক উন্নতমানের ইন্ডাস্ট্রি-প্র্যাকটিস নিয়ে থাকবেন। সুতরাং, এখন বিনিয়োগের ব্যাপারটা ভেবে দেখা উচিত। উলটে সরকার এখন আবাসন শিল্পে বিনিয়োগ আনার চেষ্টায় --
তবে জেনে রাখুন, দেশী শিল্প গড়ে তোলার একটা জানা রিস্ক হল দেশী শিল্পপতিদের ব্ল্যাকমেইল। তারা বিদেশী বিনিয়োগের তুলনায় বেশী সুবিধা নেবে, কিন্তু সবসময়েই "আরও চাই" ভাব দেখাবে। দিনের শেষে প্রশ্নটা আসে যে আপনি কার ভাল চান আর কতটা চান। শ্রমিকদের ভাল চাইলে বিনিয়োগের প্রতিযোগিতা ভাল। শিল্পের ভাল চাইলে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ভাল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
নতুন মন্তব্য করুন