দেশের টিভি চ্যানেল দেখা হয় না বলাই ভালো। মাঝে-মধ্যে একটু-আধটু। গতকাল অনলাইনে ঢাকার হরতালের খবর পড়ে খানকয়েক সচিত্র প্রতিবেদন দেখার আশায় জাগোবিডি.কম-এ ঢুঁ মারলাম। বেশ কিছু চ্যানেল ধরার বৃথা চেষ্টা করে অবশেষে মাহফুজ সাহেবের এটিএন নিউজ-এর বেলায় ভাগ্য 'সুপ্রসন্ন' হলো। দেখলাম টক শো চলছে। মুন্নী সাহার অতিথি দেশের দু'জন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। কিছুক্ষণ দেখার পর মালুম হলো এটাকে বরং মুন্নী'স শো বলা উচিত। বাকিরা শো-পিস। যেকোন প্রশ্ন সরাসরি এবং সংক্ষেপে করার ধাত নেই একেবারেই। যেকোন ইস্যুতে নিজের জ্ঞানগর্ভ ও আবেগমথিত মন্তব্যখানা ঝেড়ে দেন শুরুতে। সেইপথ বেয়ে তারপর আসে প্রশ্ন। কখনো কখনো মন্তব্য, প্রশ্ন, আবেগ, আর জ্ঞান মিলেমিশে এমন 'গুগলি' হয় যে অতিথি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। মুন্নী আপা দয়ার্দ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, "প্রশ্নটি কি খুব জটিল করে ফেললাম?"
এই তামাশার পর খানিক বিরতি। জ্যাকি শ্রফ এবং গোবিন্দ দু'জনে মিলে একটি 'অলমোস্ট' সর্বরোগ নিরাময়কারী তৈলের গুণাগুণ যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন। বুঝলুম, 'নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখিজল।' এরপর খবর। শুরুতেই ঢিলেঢালা হরতালের ওপর ঢিলেঢালা রিপোর্ট। বিএনপির নয়াপল্টন অফিসের তালাবদ্ধ কলাপসিবল দরজার ওপাশে সাঙ্গপাঙ্গসহ রিজভি সাহেব বসে আছেন। মুখ বেজার। রিপোর্টের বাকি অংশ দেখে বুঝলাম, অবস্থা কেরোসিন। প্রায় সবাই চার-পাঁচ দিন ধরে অবরুদ্ধ। রিজভি সাহেব একখানা চৌকিতে রাত্রিযাপন করেন। চৌকির পাশে একটি প্লাগ পয়েন্টে মোবাইল চার্জ করেন আর অবসরে 'আমার দেশ' পড়েন। বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। রিপোর্টারের বদান্যতায় হেঁশেলের চিত্রও উঠে এল। একজন মাঝবয়েসি ভদ্রমহিলা বিশাল কড়াইতে রান্না বসিয়েছেন। অনুযোগ করলেন, প্রায় সারাটা দিন হেঁশেল ঠেলেই চলে যায়।
এরপর যা চাইছিলাম, সেই অ্যাকশনধর্মী রিপোর্ট। আধলা ইট হাতে পিকেটার ছুটে যাচ্ছেন বাসের দিকে। ব্যানার হাতে মিছিল করে আসা কর্মীরা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে 'রিট্রিট' করলেন। পেছনে ভুলুন্ঠিত ব্যানারের এককোণ ধরে একজন কিছু সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলেন। কেউ কেউ টায়ার পুড়িয়েছেন। কেউ কেউ ককটেল ফুটিয়ে জনসাধারণকে হরতাল সফল করতে সহায়তা করছেন। যে যেভাবে পারছেন করছেন আসলে। মহিলা কর্মীরাও পিছিয়ে নেই। একজনকে দেখলাম পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে একটি সিএনজির কাঁচে 'বাড়ি' দিচ্ছেন। কাঁচ ভাঙ্গার এই তরিকা কি কার্যকরী নাকি এটা প্রতীকী ভাঙ্গাভাঙ্গি, বুঝলাম না।
সরকারি দলও ফ্লোর পেল একসময়। আর্মচেয়ারে দোল খেতে খেতে মখা আলমগীর সাহের বললেন, বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই একেবারেই। বিশ্বজিৎ কেসে আগে ৮ আর পরে ৩, এই মোট ১১ জনকে লাল দালানে চালান দেয়া হয়েছে। কারা কারা গ্রেফতার হয়েছে সেই বাহুল্যে গেলেন না। যদিও এত এত চ্যানেলের ভিডিও ক্লিপ, সংবাদপত্রের ছবি ইত্যাদি রয়েছে, তা সত্ত্বেও পুলিশকে যে একটি 'আইনি পকরিয়া'র মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয় তার ওপর জোর দিলেন। বেচারা বিশ্বজিৎ! রক্তাক্ত অবস্থায় সবকিছু ছাপিয়ে যে অবাক অভিব্যক্তি তার মুখে ছিল, তা এখনো মুছে যায়নি নিশ্চিত।
সবশেষে এলো লাকি'র কথা। ছোট্ট একটি ছেলে আর স্বামী নিয়ে তাঁর সংসার। অনেক স্বপ্ন নিয়ে লাকি বাঁচতে চাইতেন, কিন্তু টানাপোড়েনের জীবন তাঁকে বেঁধে ফেলেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। জীবনের দুঃখগাঁথা দিন-তারিখ দিয়ে লিখে রাখতেন একটি ছোট খাতায়, মুক্তোর মত অক্ষরে। স্বামীর সাথে মনোমালিন্য হলেও লিখে রাখতেন। স্বামীকে বলতেন, 'একদিন তুমি আমার কথা মনে করবা।' তাজরীন গার্মেন্টস-এর এই নিবেদিত কর্মী ঐদিনের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন। হতভাগ্য স্বামী প্রিয়তমা স্ত্রীর দেহাবশেষ খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছেন। পাননি। শোকে বিহ্বল এই ভদ্রলোক চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ছেলেকে সময় দিচ্ছেন, প্রবোধ দিচ্ছেন - 'তোর মায় বিদেশ গেসে, অনেক টাকা পাঠাইবো।' সময় পেলেই ঐ খাতার পাতায় পাতায় স্ত্রীর স্মৃতি খুঁজে ফিরছেন। মোমবাতির আলোয় একটি প্রায়ান্ধকার, ছোট্ট ঘরে ছেলেকে ধরে বসে আছেন। কোথাও কোন আলো নেই।
আজ ১৪ই ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমাদের সূর্যসন্তানদের কোন জানোয়ারের দল ঐদিন হত্যা করেছে আমরা তা জানি। তাই শুরু থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের। শহীদ বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বজিৎ, লাকি - এঁদের সবার হত্যাকারীর বিচার একে একে হতে হবে। ক্ষতের উপর ক্ষতের প্রলেপ দেয়ার দিন শেষ। এবার বিচার। ম্যানিলা রোপের কমতি নাই।
বি
মন্তব্য
"শহীদ বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বজিৎ, লাকি - এঁদের সবার হত্যাকারীর বিচার একে একে হতে হবে"
এসব ভাবতে বসলে কেমন যেন বোধ ও ভোতা হয়ে আসে আজকাল,তালগুল পাকিয়ে যায় সব,মগজে আর নেবার ক্ষমতা নেই
সব বিচার হবে, কিন্তু এই বিচারেই কি সব শেষ? এত সহজ শাস্তি পাবে এরা? শুধুই ম্যানিলা রোপ? আমি মানি না, মানি না। এদের বিচার হবে বাচিঁয়ে রেখে।
যাঁরা সময় নিয়ে মন্তব্য করেছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ।
বি
নতুন মন্তব্য করুন