নাইটিংগেল পাখি ও একটি লাল গোলাপ (এক)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৭/১২/২০১২ - ১১:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘সে আমাকে কথা দিয়েছে যে আমি যদি তাকে লাল গোলাপ দেই তবে সে আমার সাথে নাচবে’- কান্না ধরা কণ্ঠে কথাগুলো ভেসে আসছিল একজন তরুন ছাত্রের কণ্ঠ থেকে; ‘কিন্তু কোথায়- আমার বাগানে তো কোন লাল গোলাপ নেই’।

পাশেই একটি ওক গাছের উপরের বাসা থেকে নাইটিংগেল পাখি ছেলেটির এই কান্না ভেজা আকুতির কথা শুনছিল এবং গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে বিস্মিত হল।

‘আমার বাগানে কোন লাল গোলাপ নেই! আহ, কি এক ছোট্ট জিনিষ যার উপর আমার সকল সুখ সমর্পিত! জীবনে আমি পড়িনি এমন কোন বিষয় নেই আর দর্শনের এমন কোন গোপন বিষয়ও আমার অগোচরে নয় কিন্তু তারপরও একটা লাল গোলাপের অভাব আমার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে’- কান্না ভেজা চোখে এগুলোই যেন বিড়বিড় করে সেই ছেলেটি বলে চলছিল।

‘যাক অবশেষে একজন প্রকৃত প্রেমিকের দেখা পেলাম’, নাইটিংগেল পাখিটি বলল। রাতের পর রাত এই প্রেমের জন্য আমি কত গান না গেয়েছি যদিও তার দেখা আমি আজও পাইনি, রাত জেগে জেগে আমি এই প্রেমের কথা আকাশের তারাকে অনেকবার বলেছি আর আমি তা এখন নিজ চোখে দেখছি। তার চুল যেন হায়াসিন্থের ন্যায় কালো, ওষ্ঠ যুগল যেন তার লাল গোলাপের ন্যায় লাল, কিন্তু প্রবল আবেগ তাকে বিষণ্ণতায় ছেয়ে দিয়েছে আর দুঃখরা তার চোখের ভ্রু তে যেন ছেয়ে গেছে’।

ছাত্রটি বলল, ‘আগামীকাল রাতে একটি বল নৃত্য হবে । আমার প্রেম সেখানে মেয়েটিকে সংগ দিতে পারতো। আমি তাকে একটি লাল গোলাপ দিলেই হয়তো সে ভোর অবধি আমার সাথে নাচতেও চাইতো। একটা লাল গোলাপ দিলেই হয়তো সে আমার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হত আর প্রবল আবেগে তার মাথা আমার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিত আর তার বাহুযূগল হত আমার কোমর বন্ধনী। কিন্তু আমার বাগানে যে কোন লাল গোলাপ নেই। কাজেই আমাকে বলঘরে একাই থাকতে হবে আর তার চলে যাওয়া চেয়ে চেয়ে আমাকে দেখতে হবে। আমার দিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ থাকবেনা আর ওদিকে আমার হৃদয় ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হতে থাকবে’।- বিড়বিড় করে এগুলোই সেই যুবক ছেলেটি বলছিল।

‘ছেলেটি তো আসলেই একজন সত্যিকারের প্রেমিক’, নাইটিংগেল পাখিটি বলল। ‘আমি এখন যাই গাইবো তাই তাকে ব্যথিত করবে, আমার কাছে এখন যা আনন্দের তাই তার কাছে এখন বেদনার। সত্যি ভালোবাসা এক বিস্ময়কর ব্যপার। এটা দামী হীরা জহরত আর চমৎকার বর্ণালী পাথরের চেয়েও দামী। এটাকে না মুক্তা ও ডালিম দিয়ে কেনা যায়, না এটাকে বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। এটা নিয়ে যেমন কোন ব্যবসা চলে না তেমনই সোনার পাল্লায় তাকে মাপাও যায়না’।

তরুণ ছাত্রটি বলল ‘বাদকেরা বিভিন্ন সুরে সেই সন্ধ্যায় তাদের তত যন্ত্র বাজাতে থাকবে আর আমার ভালোবাসা বেহালার সূরে নাচতে থাকবে। মেয়েটি এতটাই আলতোভাবে নাচবে যে তার উপস্থিতি বল রুমের মেঝেরাও টের পাবে না অথচ উপস্থিত অতিথিরা সবাই তার চারপাশ দিয়েই ভিড় করতে থাকবে।কিন্তু সে তো আর আমার সাথে নাচতে আসবে না যেহেতু আমি তাকে একটি লাল গোলাপ এনে দিতে পারিনি’; এগুলো বলতে বলতেই ছেলেটি তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

একটা সবুজ টিকটিকি তাকে জিজ্ঞাসা করলো’ ‘তুমি কাঁদছ কেন?’

সূর্যের আলোতে ভাসতে ভাসতে একটা প্রজাপতিও তাকে একই প্রশ্ন করলো।

হলুদ রঙয়ের ডেইজী ফুলও তার পাশের ফুলটিকে একই প্রশ্ন করলো।‘ সে কাঁদছে কেন’?

‘সে একটি লাল গোলাপের জন্য কাঁদছে- নাইটিংগেল পাখিটি উত্তর দিল।

‘একটা লাল গোলাপের জন্য! তারা বিস্মিয়ভরে একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো; বিষয়টা তাদের কাছে বেশ কৌতুকোদ্দিপক মনে হল’। আর ক্ষুদে টিকটিকিটা তো হতাশ হয়েই অনেকটা নির্জলা হাসি দিল।

কিন্তু নাইটিংগেল ছেলেটির গোপন ব্যথা অনুভব করতে পারছিল। আর তাই সে ওক গাছের উপর নিভৃতে বসে ভালোবাসার এই গূঢ় রহস্যের কথা ভাবছিল।

হঠাৎ করেই নাইটিংগেল তার পাখা মেলে আকাশে উড়াল দিল। সে ছায়ার মত ভেসে ভেসে বাগানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটতে থাকলো। উড়তে উড়তে সে ঘাসের উপর একটি গোলাপ গাছ দেখতে পেয়ে তার একটি ডালের উপর গিয়ে বসে পড়লো।

‘আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও তাহলে আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মধুর গানটা শোনাবে’- নাইটিংগেল বলল।

গাছ তার মাথা নাড়িয়ে বলল ‘আমার ফুল গুলো ঠিক সাগরের ভেসে যাওয়া ফ্যানা আর পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা বরফের চেয়েও সাদা। তবে তুমি আমার ভাইয়ের কাছে যেতে পারো যে কিনা সূর্যের রশ্মির নিচে বেড়ে ওঠে, সম্ভবত তুমি যা চাও সেই তা তোমাকে দিতে পারে’।

নাইটিংগেল দ্রুত সেই সূর্যের রশ্মির নিচে বেড়ে ওঠা গোলাপ গাছের কাছে এলো।

‘আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও তাহলে আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মধুর গানটা শোনাবো’- নাইটিংগেল বলল।

এবারও গাছটা মাথা নাড়াল। সে বলল ‘আমার গোলাপের রং হলুদ ঠিক যেমন হলুদ ওই অম্বর পাথরের সিংহাসনের উপর বসে থাকা মৎসকুমারির চুল। আর তৃণ ভূমিতে প্রস্ফুটিত হওয়া ডেফোডিলের চেয়েও এটা হলুদ। তবে তুমি আমার ভাইয়ের কাছে যেয়ে দেখতে পারো যার ফুল ওই ছেলেটির জানালার পাশেই ফোটে। সম্ভবত তুমি যা চাও সেই তা তোমাকে দিতে পারে’।

‘আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও তাহলে আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মধুর গানটা শোনাবে’- নাইটিংগেল বলল।

কিন্তু গোলাপ গাছটি এবারও মাথা নাড়াল।

সে বলল ‘আমার গোলাপ গুলো ঠিক ঘুঘু পাখির পায়ের তলা আর মহাসাগরের গর্ভে ভাসমান কোরালের চেয়েও লাল। কিন্তু শীতকাল আমার সকল শিরাগুলোকে জমাট বেঁধে ফেলেছে এবং হিম শীতল হাওয়া আমার কড়িগুলোকে নষ্ট করেছে, আর ঝড় আমার ডালপালাগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে। কাজেই এ বছর আমার কোন লাল গোলাপ হয়নি’।

‘কেবল একটা লাল গোলাপ চাই আমার একটাই লাল গোলাপ। কোন ভাবেই কি তা পাওয়া সম্ভব না’। নাইটিংগেল বলল।

‘একটা উপায় আছে কিন্তু তা এতটাই ভয়ানক যে আমার বলতে ভয় হচ্ছে। গোলাপ গাছটি বলল।

‘আমাকে বল তুমি। আমি ভীত নই’- নাইটিংগেল বলল।

‘তুমি যদি লাল গোলাপ চাও তবে তা চাঁদের আলোই তোমার সংগীত দিয়েই তোমাকে ফুটিয়ে নিতে হবে,আর তোমার হৃদয়ের রক্ত দিয়ে তাকে রঞ্জিত করতে হবে। আমার দেহের কাটায় তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করতে করতে তোমাকে গান গেয়ে যেতে হবে । এই গান সারা রাত ধরে চলবে আর কাটাগুলো একেবারে তোমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে। এরপর তোমার দেহ থেকে বের হবে তাজা রক্ত যা আমার শিরা দিয়ে প্রবাহিত হবে আর সেই রক্ত হয়ে যাবে আমার - একেবারেই আমার’- গোলাপ গাছটি বলল।

অমি_বন্যা


মন্তব্য

kanij fatima  এর ছবি

ভালো লাগলো।

অমি_বন্যা এর ছবি

ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থেকো। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অমি_বন্যা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ দিবাকর । ভালো থাকবেন।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

গল্পটি আগেও পড়েছিলাম বাংলাতেই, তবুও আপনার অনুবাদ বেশ লাগলো।
শেষটা যতদূর মনে পড়ে-- নাইটিংগেল বুকে কাঁটা ফুটিয়ে লাল গোলাপের জন্ম দিবে।
ছেলেটি সকালে গোলাপ দেখে খুব খুশি হয়ে সন্ধ্যায় মেয়েটির কাছে গোলাপ নিয়ে গিয়ে দেখবে মেয়েটি অন্য ছেলের সাথে নাচছে।
এই রকম তো ছিল মনে হয় শেষটুকু অমিদা, অনেক আগে পড়েছিলাম গল্পটি, সঠিক মনে নাই। আমার ভুল হতে পারে, একটু নিশ্চিত করবেন কি? হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অমি_বন্যা এর ছবি

ভুল না ঠিক আছে তবে বাকিটুকু এর পরের পর্বে বলবো। এটা আমার করা প্রথম অনুবাদ। যদি ভুল হয় তবে তা মার্জনীয়।

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

দুঃখিত অমিদা, খেয়াল করিনি আপনার গল্পের নামের শেষে যে "এক" লেখা রয়েছে। কিছু মনে করেননা প্লিজ গল্পটা আগে ভাগেই বলে দেবার জন্য। মন খারাপ

অমি_বন্যা এর ছবি

কস্কি মমিন!

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো।

''দিবাকর''

তাপস শর্মা এর ছবি
অমি_বন্যা এর ছবি

চলবে তাপস দা । আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।