“প্রিয় আকাশী, গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি।” – এই আবৃতি দিয়ে গান শুরু হল।
“প্রিয় আকাশী, গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি। ঠিকানা লেখনি। ঠিকানা পেলে কোথায় তা লেখনি! আকাশী, আমার আকাশী।”
মামা কিন্নর কণ্ঠে গাইছেন। আমি তন্ময় হয়ে শুনছি। খালি গলায় এত চমৎকার গাইতে দেখিনি কাউকে। অবশ্য আমার জগত খুবই সীমিত। তবে আমার এই সীমিত জগতেই আমি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। একেবারে নিজের একটা আদালা জগত। সেই জগতে কিরণ মামার মত গায়ক আছেন। শত শত ভালোলাগা গানের অ্যালবাম আছে। প্রিয় কিছু বই আছে। প্রিয় কিছু মানুষ আছে। এরই মাঝে আমি আবর্তিত হচ্ছি। আর এই আবর্তনের কেন্দ্রে আছে ‘প্রিয়তা’। কিরণ মামা সব কিছুতেই সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ান। তিনি প্রায়ই বলতেন, আনন্দের যেমন এক অপরূপ সৌন্দর্য আছে তেমনি কষ্টেরও আছে। আমি প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবতাম, কষ্টের আবার সৌন্দর্য কি?
কিরণ মামা গাইছেন ... ‘সুদীর্ঘ প্রবাসের অর্ধেকটা কাটিয়েছি বোহেমিয়ানদের মত ঘুরে ঘুরে। মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ, নিউ ক্যাসেল, নেপোলি, বুখারেস্ট, মেসিডোনিয়া। প্রিয় আকাশী, আমার আকাশী। ফ্র্যাংকফুটের বইমেলায় নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তোমায়। সিস্টাইন চ্যাপেলে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর (Michelangelo) মহান সৃষ্টি পিয়েতা’র ( Pietà) সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে মনে পড়েছে। এথেন্সে কফিশপে প্রিয় আকাশী, জমজমাট কবিতা পাঠের আসরে মনে পড়েছে....’।
‘প্রিয় আকাশী’ গানটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবারও অনুরোধ করলাম গাইবার জন্য। এই একটা গান এত প্রিয় হয়ে উঠবে ভাবিনি কখনও। ছন্নছাড়া এই গানের ভেতর জীবন এতটা মূর্ত হয়ে উঠতে পারে জানা ছিল না! গানটি শোনার পর আমি আরও এলোমেলো হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম ‘কষ্টই কি তবে জীবনের ঐশ্বর্য?’। কিরণ মামার কাছ থেকে জানলাম গানের শিল্পী ‘জেমস্’। অ্যালবামের নাম ‘পালাবে কোথায়’, জেমসের সলো অ্যালবাম। ফিলিংস ও জেমসের অনেক অ্যালবাম শুনেছি। ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘জেল থেকে বলছি’, ‘স্টেশন রোড’, ‘অনন্যা’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’, ‘ঠিক আছে বন্ধু’ সহ অনেক অনেক মিক্সড অ্যালবাম। তোলপাড় করা সব গান। কিন্তু ‘প্রিয় আকাশী’ গানটি কখনোই শোনা হয়নি। এমনকি ‘পালাবে কোথায়’ নামে জেমসের একটি একক অ্যালবাম আছে সেটাও জানা ছিল না আমার।
সেদিনই কিনে আনলাম ‘পালাবে কোথায়’। টানটান উত্তেজনা নিয়ে বার বার শুনলাম ‘প্রিয় আকাশী’। এই গান আমাকে এক অদ্ভুত মাদকতায় ডুবিয়ে দিল। এই গানটি প্রিয় থেকে প্রিয়তম হয়ে উঠলো আমার কাছে। প্রায়ই আমি ভেবে অবাক হতাম, এই গানের সমস্ত কথায় আছে না-পাওয়ার হাহাকার, এক ভবঘুরে জীবনের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে শুধু ভুলতে না পারার কষ্ট, তবে কেন এই গানটিই এত প্রিয় হয়ে উঠলো আমার কাছে! আমিতো এমনটি চাইনা। প্রিয়তা আমার হৃদয়ের গভীরের চির সবুজ বনভূমিতে বিচরণ করে নিত্য নিয়ত। আমার দু’চোখের গভীরের অতল সমুদ্রের পার ঘেঁষে আমার হাত ধরে হেঁটে বেড়ায় সারাটি বিকেল। জোছনা লুটালে আপন মনে নেচে উঠে মন মন্দিরে। আমি মুগ্ধতায় চেয়ে থাকি সেই কিশোরীর কাজল-কালো চোখের পানে। সেই মায়াবী চোখে তাকালে মনে হতে থাকে, শুধু চোখে চোখ রেখেই একটি জীবন অনায়াসে পার করে দেয়া সম্ভব।
এক বিকেলে প্রিয়তাকে শুনিয়েছিলাম অসম্ভব প্রিয় এই গানটি। গানটি শুনে সে হেসে কুটিকুটি হল। আমি ভেবে পেলাম না এত হাসি কেন? ভ্যাবাচ্যাকা এই আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘হাসলে কেন?’ কোন রকমে হাসি থামিয়ে উত্তর দিল ‘আপনার প্রিয় আকাশী গানের কিছুই বুঝিনি’- এইটুকু বলে আবার হাসি! যখনই সুযোগ মিলতো ক্যাসেট প্লেয়ারে চালিয়ে দিতাম ‘প্রিয় আকাশী’। যতক্ষণ গান চলত শুধু তার হাসির শব্দ পেতাম। সেই হাসির লোভে কতই-না রাত কাটিয়েছি শুধু ‘প্রিয় আকাশী’ শুনে শুনে। একদিন আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘কতটুকু ভালোবাসেন আমাকে?’। উত্তরে বলেছিলাম “তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি বলতে পারবো না, তবে প্রিয় আকাশী’র মত ভালোবাসি তোমাকে”। ভালোবাসার উপমা হিসেবে শুধু বলতাম, ‘হে, ভাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মত তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর। তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে উঠো। সুন্দর ... সুন্দর। তুমি ভালো থেকো আকাশী, আমার আকাশী’।
সময় কেটে গিয়েছে। তেমনি যাচ্ছে এখনও। হৃদয়ের সবুজ বনভূমি আজ উজার হয়ে পরিণত হয়েছে শ্মশানে। দু’চোখের গভীরে যে অতল সমুদ্র তাও গিয়েছে শুকিয়ে। বৃষ্টি খড়ায় ভুগছে আমার দু’চোখ। এখন মাঝেমধ্যেই শুধু জ্বালাপোড়া করে। সব কিছুই বড় বেশী বদলে গেছে। বড় বড় চুলে ঢেকে যাচ্ছে সারা মাথা। ক্রমাগতই বদলে যাচ্ছি এই আমি। আমার চারপাশের মানুষগুলোও বদলে যাচ্ছে। প্রিয়তাও বদলে গেছে। প্রায় এক যুগ ছুঁয়ে গেল, কত দিন দেখা হয় না! তবে এতসব পরিবর্তনের মাঝে কষ্টগুলোই শুধু বদলে যায় নি। বদলে যায় নি ‘প্রিয় আকাশী’-ও। এখনও চির তরুণী। ঐশ্বর্যের সবটুকু উজার করে দখল করে আছে হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে।
*** আমি একজন গানের পোকা। গানের মাঝেই ডুবে থাকি সারাক্ষণ। সৃজনশীল সবকিছুই ভালোলাগে। আর তাই প্রিয় গানের তালিকাটি অনেক বেশী দীর্ঘ। তবে আমাকে যদি একটি গান বেছে নিতে বলা হয় আমি ‘প্রিয় আকাশী’ গানটিই বেছে নেব। ‘প্রিয় আকাশী’ গানের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী। বাংলাদেশের ৯০-দশকের অনেক তুমুল জনপ্রিয় গানের গীতিকার এই লতিফুল ইসলাম শিবলী। ‘প্রিয় আকাশী’ গানটি মূলত লতিফুল ইসলাম শিবলী’র ‘প্যারিসের চিঠি’ শিরোনামের কবিতা থেকে নেয়া। পরিকল্পনা, সুরবিন্যাস ও সঙ্গীতায়োজনে জেমস নিজেই। ২১-শে ডিসেম্বার রবীন্দ্রসরোবরে অনুষ্ঠিত হবে শিমুল মোস্তফার একক আবৃতি। অনেক অনেক কবিতার ভিড়ে ‘প্যারিসের চিঠি’ কবিতাটিও আবৃতি করবেন তিনি। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ভাবলাম আপনাদেরকেও জানিয়ে দিই। ‘প্রিয় আকাশী’র ভক্তরা আবৃতির ফাঁকে মিলিত হব এক সন্ধ্যায়। পাশাপাশি বসে থেকে শুনবো ‘বদলে যাওয়া কষ্টের অপর নাম স্মৃতি.....’
#প্রিয় আকাশী#
মন্তব্য
গানটা খুব প্রিয়, লতিফুল ইসলাম শিবলী অবশ্য ইউরোপ আসার আগেই কবিতাটি লিখেছিলেন।
গনের উল্লেখিত একধিক জায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, এবং যেয়ে মনের ভিতরে গুনগুন করে উঠেছিল গানটি।
facebook
আপনার ক্ষেত্রে অনুভূতিগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম তাহলে। আপনার ভ্রমণ পোষ্টগুলো দেখে বিমুগ্ধ হই।
ধন্যবাদ অণু দা।
লেখাটা ভাল লাগলো। এর একটা কারণ অবশ্য এই গানটা আমার অতিপ্রিয় একটা গান
গানটা আটকে দিলাম।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
গানটা আপনারও প্রিয় জেনে ভালোলাগাটা বেড়ে গেল।
গানটা খুব প্রিয়। নিয়মিত লিখতে থাকুন।
''দিবাকর''
আমি আবার আসবো ফিরে ....... (হ্যাপি আখন্দ)
ধন্যবাদ।
আবৃতি নয়, শব্দটা 'আবৃত্তি'।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কারেকশানের জন্য ধন্যবাদ তিথীডোর।
আমার Dyslexia আছে।
লেখার আবেগটা স্বচ্ছ। ভালো লাগল
০২
জেমস এর এই পর্যন্ত যত গান শুনেছি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আপনার এই পোস্ট থেকেই 'পালাবে কোথায়' এবং 'প্রিয় আকাশী' গানটা সম্পর্কে জানলাম আজ প্রথমবার। আজ দুপুরে 'পালাবে কোথায়' -- গোটা এ্যালবাম শোনার পর মিশ্র অনুভূতি হল। 'প্রিয় আকাশি' গানটা যথাযথ লেগেছে আমার কাছে, বাকি গান শোনার পর মনে হয়েছে জেমস এর থেকে অনেক বেশী ভালো গান গেয়েছেন। যদিও এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত অনুভূতি। কার যে কোনটা ভালো লেগে যায় সেটা আপেক্ষিক হয়
০৩
আরও লেখালেখি আসুক
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ তাপশ দা।
প্রিয় আকাশী গানটা আপনার ভালোলেগেছে, এই সংবাদটা আনন্দের। শুনতে থাকুন ভালোলাগাটা বাড়বে।
পালাবে কোথায় অ্যালবামটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখার মত অ্যালবাম নয়। তবে এটা একটি ব্যতিক্রমী অ্যালবাম। গানের লিরিক ও বিষয়বস্তুতে ভ্যারিয়েশন আছে। 'হ্যারেমের বন্দিনী', 'ভালোবাসার যৌথ খামার', 'ভুলবো কেমন করে', 'সাদা অ্যাশট্রে', 'পূর্ণিমা নৃত্য' গানগুলো অবশ্য আমার ভালোই লাগে।
লেখা খুব ভাল লাগল। একটা সুন্দর গান নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর লেখা।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ধন্যবাদ।
শব্দের শরীরে রাখি সময়ের চিহ্ন ....... (সময়-এবি)
গানটি ভাল লাগে খুব। পছন্দের গান নিয়ে লিখার জন্য ধন্যবাদ।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
আপনাকেও ধন্যবাদ।
পুরোটা দেয়া গেলনা।
জেমসের সবচাইতে পছন্দের গানগুলোর ভেতর এটা তীব্রতম পছন্দের গান। এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গাওয়ার গান। মনে আছে, শিবলী ভাইয়ের কবিতার বইটা বেরিয়েছিল যে বইমেলাতে, সেবার আমরা বাচ্চু ভাইয়ের ‘আমার বাংলাদেশ’ গানটা দিয়ে পোস্টার করেছিলাম বইমেলাকে সামনে রেখে। এই গান ঘিরে কত স্মৃতি!
“...ভিয়েনার তারাজ্বলা রাত্রিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছে... তোমার প্রিয় গায়ক জিম মরিসনের শেষদিনগুলি কেটেছে এই প্যারিসে... তোমার প্রিয় কবি ‘আন্ডার দ্য ওয়াইড এন্ড স্টারি স্কাই, ডিগ এ ডিপ গ্রেভ এন্ড লেট মি ডাই... বাইজানটাইন সম্রাজ্ঞীর মত তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ.........”
পুরাই নস্টালজিক হয়ে গেলাম!
ধন্যবাদ আপনাকে। লেখার সময় আমিও নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিলাম। এবং যতবার গানটা শুনি ততবার হই।
কবিতার কিছু অংশ আপনার জন্যই তুলে দিয়েছিলাম।
অন্যমনস্ক থাকায় সেটা উপরের মন্তব্যের প্রতিউত্তর হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
জেমস -এর ফিলিংস আমলের গানগুলোর আবেদন আমার কাছে অন্যরকম। এই গানটা ত বারংবার কিশোর মনের বিবাগী অনুভূতিকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে যেত একসময়। মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। আপনার অন্য প্রিয় গানগুলো নিয়েও লিখুন। দেখি মিলে যায় কিনা আবারো ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আমিও ফিলিংসের জেমসের ভক্ত। নগর বাউলের জেমস্ পুরোনো ফিলিংসের জেমস্কে ছাড়িয়ে আমায় মুগ্ধ করতে পারেনি। অবশ্য ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামগুলোর কথা ভিন্ন। মিক্সড অ্যালবামগুলোতে অন্যের সুরেই গাইতে দেখেছি জেমস্কে।
এই গানটা সবসময়ের পছন্দের গান!! আরো লিখুন এই গানগুলো নিয়ে।
ফারাসাত
নতুন মন্তব্য করুন