শীত আসি আসি করা বছরের এই সময়টায় দুপুরগুলোর একটা ঝিম ধরানো ওম থাকে।
কুসুম কুসুম রোদ, রিক্সার অবিরাম ঝাঁকুনি আর রাস্তার সহস্র খুঁটিনাটি দৃষ্টিকে ক্লান্ত করে একটা স্বচ্ছ পর্দা নামিয়ে দিচ্ছিল রতনের সামনে। দু’ধারের দোকানগুলো মন্থর গতিতে সরে সরে যাচ্ছে। কোনটাকেই নজর করে দেখা হচ্ছেনা।
রতনের মাথার চারপাশে একঝাঁক ভাবনা নাছোড়বান্দা মাছির মতো ঘুরছে। বসছে, সুড়সুড়ি দিচ্ছে, আবার ঘুরে ঘুরে উড়ছে।
শুরুতে রিকশায় আম্মার পাশে বসে আসতে বেশ খানিকটা অস্বস্তি লাগছিল রতনের। শেষ কবে এভাবে বেরিয়েছে মনেও পড়েনা। এখন বেশিরভাগ সময় পুতুলকে নিয়ে বেরোয় আম্মা। রতন থাকতো আরো অন্তত পাঁচ-ছ’ বছর আগে। তখন সিটটায় মাঝখানে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা থাকতো। কখনো কখনো ঘুমিয়ে পড়ে টাল খেত রতন। একটা হাত দিয়ে ধরে রাখতো আম্মা।
আজকের সিটটা ভীষণ আঁটোসাঁটো।
এবং আজকের ব্যাপারটা বিশেষ কিছু। বাসার কোন ব্যাপারেই আগ্রহ না দেখানোর একটা অভ্যাস করছে রতন বেশ কিছুদিন। তারপরও কীভাবে যেন কোন কিছুই চোখ-কান এড়ায় না। স্বাভাবিক একটা সতর্কতা বোধহয় মজ্জাগত হয়ে গেছে। তবে আজকের ব্যাপারটা ওর ভাল জানা নেই। মনোয়ারা ফুপু’র সঙ্গে আম্মার গুজুর গুজুরে কোথাও একটা যাবার কথা কানে এসেছে কয়েকবার। এর বেশি এখনো জানেনা রতন। এটুকু বুঝতে পারছে, যেখানেই যাক সেখানে পুতুল বা রুবেলকে নিতে চায়নি আম্মা।
আপাতত তার দায়িত্ব ফকিরাপুল পানিরট্যাঙ্কির কাছে একটা পাঁচতলা লাল রঙের গেটওলা বাসা খুঁজে বের করা।
ছুটির দিন বলে রাস্তায় যানবাহন কম। মাঝখান দিয়ে ফেঁড়ে ফেলা রাস্তাগুলোও আজ তাই কিছুটা চওড়া ঠেকছে। অথচ এই রাস্তাগুলো সত্যিসত্যিই কি বিশাল মনে হতো একসময়! এপার-ওপার করা যেন সমুদ্র পাড়ি! দুপাশের বিল্ডিংগুলো পাহাড়ের মতো মেঘ ছুঁই ছুঁই! আর ঐ শাপলাটা ছিল একটা বিষ্ময়!
ঢাকায় রতনের প্রথমবার আসা এই পথ দিয়েই। কমলাপুর রেল স্টেশন- সেও এক ময়দানবের কাণ্ড! আব্বার আঙুল ধরে রাস্তা পার। আঙুলটা মুঠোয় ধরা যেত তখন। আর আব্বার পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির অবয়বটাকে মনে হতো দীর্ঘ! এমনকি মধ্য বাড্ডার আঁটো গলিতে হাঁসফাঁস করা ৫২৭/৩ এর পাঁচতলা বাসাটাকেও সেদিন অনেক উঁচু মনে হয়েছিল। মফস্বল শহর দেখা ছয় বছরের চোখ ততদিন শুধু বিস্তার দেখেছে- উচ্চতার মাপে ছিল আকাশের শুণ্যতা।
৫২৭/৩-এর নিচতলার ভেজাভেজা অন্ধকার ঘরটায় এসে রতনের চেনা পৃথিবী প্রথমবারের মতো একটা মাপজোক করা খাপের ভেতর ঢুকে পড়ল। এরপর সে বড় হয়েছে একটু একটু করে, চারপাশটা হয়েছে ক্রমশ ক্ষুদ্র, ঘিঞ্জি। মতিঝিলের শাপলাটাকে এখন বেঢপ, কুচ্ছিত লাগে। রাস্তাগুলোকে মনে হয় শহরের গায়ে কালশিটে দাগ। উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো যেন পিশে মারছে শহরটাকে। আর ৫২৭/৩- ঠিক একটা মুরগির ঘুন্ডিয়া।
দুপুরে থাকতে হবে, কাল রাতেই বলে রেখেছিল আম্মা। নইলে পারতপক্ষে এসময় বাসায় থাকেনা রতন। কলেজের পর ভাত খাওয়ার জন্য একবার ফেরে। বসার ঘরের খাটটা খালি পেলে একটু গড়িয়ে নেয়। বিকেলের আগেই আবার বেরিয়ে যায়। বেশিরভাগ দিন পল্টুদের ছবি তোলার স্টুডিওতে গিয়ে বসে থাকে । কাউন্টারে গম্ভীর মুখে বসে কম্পিউটারে নিষিদ্ধ সিনেমা দেখে দু’জনে। খদ্দেররা টের পায়না। ছবি তোলার সঙ্গে মোবাইলের রিচার্জও থাকায়, মাঝে সাঝে ব্যালান্স ভরতে মহল্লার কোন মেয়ে এসে পড়লে ওদের নিস্তরঙ্গ উত্তেজনায় ঢিল পড়ে।
তিন মাস আগেও অবশ্য বিকেলগুলো ঠিক এরকম ছিলনা। পাঁচটা থেকে সপ্তায় তিনদিন ছিল ননীগোপাল স্যারের কাছে ম্যাথ প্রাইভেট । নটরডেম কলেজের নামকরা টিচার। যারা পড়তে আসে তারাও মাশাল্লা মাথায় আর চেহারায় তুখোড় । শরিফের বুদ্ধিতে সে কিনা ওখানেই পড়তে গিয়েছিল! অল্পদিনেই ব্রাহ্মণদের মাঝে শূদ্র হওয়ার মজা টের পেয়ে গিয়েছিল রতন। শেষে জাতে উঠতে না পেরে ‘এইখানে পোষাবেনা-আরো ভাল কোন স্যার ঠিক করতে হবে’ মনস্থির করে কাট্টি। কিছু কিছু জিনিস ছেড়ে দেয়ার মধ্যে যে একটা হাওয়া খেলানো স্বস্তি আছে, সেই স্বস্তিতেই তিন মাস কেটে গেছে, আরেকজনের কাছে যাওয়া হয়নি।
প্রাইভেট অবশ্য এখনো আছে, মঙ্গল আর বিষ্যুৎবার। কেমিস্ট্রি। সবাই ফিজিক্সটাও পড়ে কারো না কারো কাছে। কেউ কেউ হায়ার ম্যাথ, বায়োলজিও। রতনের পক্ষে এর বেশি নেয়া সম্ভব নয়। বাসা থেকে অ্যাতো দেবে না, অতো সময়ও নেই! সব মিলিয়ে পড়াশোনাটা এখন একরকম শিকেয় তোলা ।
আম্মাকে এসবের কিছুই বলেনি রতন। উপরন্তু মাস শেষে ননীগোপাল স্যারের বেতনটা নেয়ার জন্য হাত পাতছে। কোন কোন মাসে ৭ তারিখ হয়ে গেলেও বেতন দেয়ার কথা মুখে আনেনা আম্মা। হাত খালি থাকে বোধহয়। এইসময়গুলোতে আম্মা আসলে কী ভাবে? রতন কোনভাবে টাকাটা যোগাড় করে নেবে? কীভাবে! টিউশানি-টানি করার জন্যও তো কিছু এলেম লাগে। নিদেনপক্ষে ভাল কলেজের মার্কা। কোনটাই কি ওর আছে!
মাঝে মাঝে একটু যে অপরাধবোধ হয়না, এমন নয়। কিন্তু এসব খারাপ লাগালাগিকে বিশেষ পাত্তা দিতে চায়না রতন। বাসা থেকে তো আর কোন হাতখরচ পায়না সে। বাইরে চলার যে কত খরচা বাসার লোকদের সেটা মনেই থাকেনা। রিকশা-বাস ভাড়া থেকে শুরু করে কলম কেনার টাকা পর্যন্ত! অ্যাতো চাইতে কার ভাল্লাগে! নেহাত সিগারেট টিগারেটের অভ্যেস নেই। আগে বেতনের অঙ্কটা দুই স্যারের জন্য দুই-দুই, চারশো’ বাড়িয়ে বলে সে ম্যানেজ করতো। এখন পুরোটাই পকেটে। চায়ের দোকানের আড্ডায় আগে বন্ধুদের কেউ মানিব্যাগ বের না করা পর্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। দু’চার বেলা এখন রতনও দামটা দেয়ার জন্য পকেটে হাত দেয়। ঘরের সব কিছুতেই আসলে এখন এই নাই নাই অবস্থা । তারপরেও আম্মা চালিয়ে নিচ্ছে না? চলছে তো সব। এমনকি আত্মীয়-প্রতিবেশীর বিয়ে-আকিকায় র্যাপিং পেপারে মুড়ে কাচের গ্লাস সেট নিয়ে দাওয়াত খেতে যাওয়াও। ওপরে নামটা মাঝে মাঝে রতনকেই লিখে দিতে হয়।
কাগজ বোঝাই মাঝারি আকারের একটা ট্রলার বাঁদিকের গলিটা থেকে আচমকা বেরিয়ে এলো। অপরিসর রাস্তাটাতে হঠাৎ বেশ একটা গোল বেঁধে গেল তাতে। কিছু রিক্সা, বাইক আর দুটো প্রাইভেট কার অদ্ভুত প্যাটার্নে দাঁড়িয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণের গালাগাল-চেঁচামেচির পর ধীরে ধীরে ট্রলারটাকে রাস্তার একধার ঘেঁষে সরিয়ে নিল চালক। এবার শুরু হয়ে গেল কে কার আগে যাবে- তার প্রতিযোগিতা।
পাশে বোরকায় পুরোটা ঢেকে রিক্সার ঝাঁকুনিতে কালো পাথরের মূর্তির মতো অল্প অল্প দুলছে আম্মা। কোন অভিব্যক্তি বোঝার উপায় নেই। চোখের কাছটায় শুধু চারকোনা একটা অংশে মশারির মতো ফুটোফুটো। দেখে গ্রামের বাড়ির মুখাড়ি পরা গরুটার কথা মনে পড়ে যায়। বিচ্ছিরি তুলনাটা মনে আসায় একটু লজ্জ্বা পায় রতন।
বোরকা পরার কারণেই কি না কে জানে, আম্মাকে ইদানিং একটু যেন বুড়োটে দেখায়। আগে বেশ গুছিয়ে শাড়ি পরতো আম্মা। চমৎকার সব শাড়ি ছিল তার। মানে এখনো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ইদানিং আর পরতে দেখা যায়না। বাসাতেও ম্যাক্সি নামের ঢোলা একটা জামা পরতে শুরু করেছে। শাড়িতে নাকি ঠিকমতো পর্দা হয়না। রতনের আগে ধারণা ছিল শুধু বয়স্ক মহিলারাই বোরকা পরে। যেমন, মনোয়ারা ফুপু। নতুবা আব্বা-আম্মার বুড়ো হওয়ার ভাবনাটা কোনদিন মাথাতেই আসেনি। যেন, বয়স বাড়া আর বড় হওয়ার ব্যাপারটা রতন, রুবেল আর পুতুলের জন্য বরাদ্দ। আব্বা-আম্মা’র ঠিক একইরকম থাকাটাই প্রাকৃতিক সত্য। আম্মার এই পরিবর্তনের সবটাই নিশ্চয়ই মনোয়ারা ফুপুর প্রভাবে নয়! রতনের কেমন মনে হয়, বোরকার ভেতরে আম্মা যেন নিজেই আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
রুবেল, পুতুল বা আত্মীয় স্বজনের অনেকেই এখনো জানেনা আব্বা গার্মেন্টসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। ওটারই ভরসায় পাঁচ বছর আগে আব্বা ঢাকায় পরিবার এনে তুলেছিল। জেলা শহরের ক্রমশ পড়ন্ত মুদির দোকানদারির চেয়ে ওতে ঢের বেশি সম্ভাবনা দেখেছিলেন তুলু কাকু। আব্বা তার কিছুই কাজে লাগাতে পারেনি। পাঁচ বছরে কোন পদোন্নতি নেই। শুরুতে তুলু কাকু অভিভাবকের দায়িত্বে খোঁজ খবর নিতেন। অনেকদিন হলো তিনিও আর এমুখো হননা।
তুলু কাকু আব্বার ছেলেবেলার বন্ধু। তার কথা মনে পড়তেই কতগুলো ছবি সিনেমার রিলের মতো পরপর ঘুরে যায় রতনের মাথার ভেতর। চকচকে জুতো, বুক ভার করা পারফিউমের গন্ধ আর মসৃন শেভের আলো পিছলানো সবুজ সবুজ চিবুক-গাল। সবটা মিলিয়ে চমৎকার একটা বিপরীত ছবি। নেগেটিভ,পজিটিভ। সরকারি চাকরি আর কোয়ার্টার নিয়ে কল্যাণপুরে দিব্যি সংসার তুলু কাকুর। একবার গিয়েছিল রতন আব্বার সঙ্গে। প্রায় ওর আর পুতুলের বয়সীই দুই ছেলে কাকুর। ফর্সা, টিপটপ-ঠিক লেমিনেটিং করা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হবেনা, রোদে ঘেমে চটচট করবেনা। রতনদের চেয়ে একদম আলাদা রকম। মনে আছে ফেরার সময় কাকি ওকে বলেছিলেন,- কাকির চুল ছেলেদের মতো করে কাটা ছিল তখন -‘তুমি জুতা পরোনা কেন? এখন থেকে বাইরে গেলে জুতা পরবে!’ কেন বাইরে গেলে জুতা পরতে হবে, রতন এখনো নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে পারেনি।
রতন যুক্তি দিয়ে বোঝে, বন্ধুর জন্য যতটুকু করার ছিল, কাকু করেছেন। এর চেয়ে বেশি করার থাকেনা আসলে! বাকিটুকুর দায়িত্ব আব্বার নিজের ছিল। তবু কেমন একটা গোঁয়ার অভিমান জমা হয় ভেতরে! মোজাইক করা ঝকঝকে মেঝে, আয়নার মতো চকচকে জুতো, স্যুটের গম্ভীর ছাই রং আর বয় কাট চুলের লালচে সোনালি আভা ক্রমশ একটা উল্টো মেরুতে ঠেলতে চায়। অস্তিত্বজুড়ে বেয়াড়া একটা জ্বালা ধরিয়ে রাখে।
চাকরিটা গেছে, নাকি আব্বা নিজেই ছেড়েছে- রতন জানেনা। তবে সে শুনেছে, মগবাজারে একটা বারে বারম্যান হিসেবে ঢুকেছে আব্বা। নাখাস্তা কাজটা কোত্থেকে জোটালো আল্লাই জানে! আব্বা-আম্মার ঝগড়ায় আব্বাকে একদিন বলতে শুনেছে সে, কাজটা টেম্পোর্যারি। তারপরও। কেউ জানতে চাইলে কী বলবে-‘আমার বাবা মানুষকে মদ ঢেলে খাওয়ায়’? রতনের ধারণা ওর চেনাশোনার মধ্যে কাউকে পাওয়া যাবেনা যার বাবা, মামা, চাচা বা আর কেউ এধরণের একটা অদ্ভুত চাকরি করে। বারম্যানের কাজটা ঠিক কী, সেসম্পর্কেও স্পষ্ট কোন ধারণা নেই ওর। মাঝে মাঝে ভাবে পল্টুকে জিজ্ঞেস করবে । আবার মনে হয়, জিজ্ঞেস করলেই ও ব্যাটা ঠিক বুঝে ফেলবে। সাংঘাতিক বুদ্ধি ওর! রতনের মতো আয়োডিনের অভাবওলা মাথা তো আর না। এই কথাটাও সে পল্টুর কাছেই প্রথম শুনেছে - উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েদের আয়োডিনের অভাবে বুদ্ধিশুদ্ধি কম থাকে। বারম্যানের মানেটা সুতরাং নিজেই আন্দাজ করে নিয়েছে রতন। ঐ মদ ঢেলে খাওয়ানো টাইপের কিছুই হবে! সেখানে মাতাল লোকগুলো কি আব্বাকে তুই তোকারি করে? বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলেগুলো - ‘মামা’ ‘মামা’ করে ডাকে? ‘অ্যাই...সালাউদ্দিন মামা...এইদিক!’ রতন যেমন, রিক্সাওয়ালা, বাসের কন্ডাক্টর, চায়ের দোকানদার আর কলেজের দারোয়ানকে ‘মামা’ ডাকে!
তুলু কাকু ছাড়াও আব্বার পরিচিত, আধাপরিচিত, বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। এই মানুষটার ছেলে হয়েও সে কীভাবে এতোটা মুখচোরা, প্রায়-অসামাজিক হলো, রতন ভেবে পায়না। নতুন চাকরিটা নিশ্চয়ই আব্বার ঐসব বন্ধুদেরই কারো বুদ্ধি কিংবা যোগাযোগে পাওয়া। আগে বাসাতেও আব্বার বন্ধুরা আসতো। সন্ধ্যা থেকে বেশ রাত অব্দি চলত আড্ডা। পুতুল হওয়ার পর আম্মা অনেক রাগারাগি করে বাসার আড্ডা ছুটিয়েছে। আড্ডা মানে অবশ্য মদ ফদ কিছু না। তাস চলতো। জুয়াও হতে পারে। রতন অতশত বুঝতোনা তখন। তবে আব্বা যে মদ খায় সেটা সে বুঝছিল ঐ বয়সেই। পুতুল তবু কিছু কিছু বুঝতে শিখেছে, রুবেল তখন এইটুকুন পিচ্চি। একেক রাতে পাশের ঘরে আব্বা-আম্মার তুমুল ঝগড়াঝাটিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো রতনের। মনে হতো এই বুঝি ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে গেল। আম্মার জন্য খুব ভয় আর মায়া হতো তখন। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শুনতে শুনতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়তো রতন।
ছেলেমেয়েদের থেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে চেঁচামেচি করার আড়টা এতদিনে ভেঙে গেছে। আব্বা ইদানিং আম্মার ওপর হাতও তোলে। একেকদিন রতনের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। ‘খবরদার! আর যদি কুনোদিন আম্মাকে মারছো!’....বা এইধরণের কিছু একটা আব্বাকে বলে আসতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ইচ্ছেটা কেন যেন বেশি জোর পায়না। এই কথাগুলো বলতে যতটা দরকার, কেন যে মনে হয় কণ্ঠটা ঠিক ততখানি কঠিন শোনাবে না! রতন খেয়াল করেছে, ইচ্ছেটা মরেও যাচ্ছে দিনদিন। আব্বার সঙ্গে কথাবার্তা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে আজকাল। যা খুশি হোক গে- ধরণের একটা মনোভাব চলে আসছে ওর মধ্যে।
রতন তো রতন, পুতুল-রুবেলও এখন আর গা করেনা। রতনের মাঝে মাঝে কৌতুহল হয়, ওদের এই নিরাসক্তিও কি একইরকম অগুণতি অসহায় রাতের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া? দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কেমন নির্বিকার হয়ে স্কুল করছে, খেলছে, নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করছে। স্কুল থেকে পিকনিক যাওয়ার জন্য আবদারও করছে। সবকিছু গা সওয়া।
শুধু আম্মার চোখে দিন দিন শ্যাওলা জমে। মেছতা পড়া গালগুলো আরো খসখসে দেখায়। প্রতিবার মারধরের পর একটা দিন অন্তত অপমানে কুঁকড়ে থাকে আম্মা। চোখে চোখ ফেলতে চায়না। রতন এসব খেয়াল করতে চায়না কখনো। কিন্তু, ঐ যে! চোখ পড়েই যায়!
নতুন আরেকটা উপসর্গ যোগ হয়েছে আজকাল, চাকরি বদলের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে, মাঝে মাঝেই রাতে বাসায় ফিরছে না আব্বা । এইসময়গুলোতে মোবাইলে ফোন করা হলে ফোন ধরে না। পরে কোন কৈফিয়তেরও ধার ধারে না। শুরুতে আম্মা খুব অস্থির করতো। রতনকে বেরুতেও হয়েছে কয়েকবার এখানে ওখানে খুঁজতে। সেটা নিয়েও আব্বার চূড়ান্ত রাগারাগি। এখন আর না ফিরলে উচ্চবাচ্চ হয়না। কিন্তু আম্মার চোখেমুখে এক পোঁচ কালি পড়ে প্রত্যেকবার।
আব্বার বিষয়টা নিয়ে আসলে ঘাঁটানোর রুচি হয়নি রতনের। নইলে একান ওকান করে কিছু কথা তো সেও শুনতে পায়। চুলোয় যাক! কোন একদিন এই সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে ভাগবে সে। আম্মার জন্যই যা একটু খারাপ লাগে। তার কি কোথাও যাওয়ার নেই? ছিলনা কোনদিন?
এইতো গত পরশু বাইরে কোথাও রাত কাটিয়ে কাল রাতে বাসায় ফিরলো আব্বা। এসেই হৈ চৈ। খবরের কাগজের একটা টুকরো সঙ্গে করে এনেছে। আম্মাকে দিয়ে স্টিল আলমারি খুলিয়ে প্রাইজবন্ডগুলো বের করালো। রতনের খৎনায় পাওয়া একতাড়া ম্যাজেন্টা আর সবুজ রং মাখানো প্রাইজবন্ড। মফস্বল শহরের স্বচ্ছল দিনগুলোর স্মৃতি ধরে রাখা অল্প ক’টা জিনিসের একটা। তুমুল উত্তেজনায় ঘণ্টাখানেক ধরে একটা একটা করে নম্বর মেলালো। তারপর বরাবরের মতো ব্যাঙ্ক, সরকার, দেশ-একেক করে সবার গুষ্টি উদ্ধার! মুহূর্তেই বাসা সরগরম।
আশ্চর্য! বিতৃষ্ণা ছাপিয়েও আব্বার এই প্রবল উপস্থিতি এখনো একধরণের উষ্ণতা দেয় রতনকে। একটা নিরাপত্তাও!
রতনের মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, কোনদিন যদি সত্যি প্রাইজবন্ড মিলে যায় - বড় একটা টাকা পেয়ে যায় আব্বা - কী করবে? ঢাকার ব্যর্থ চাকরির ইতিহাসকে কলা দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে আবার দিনাজপুরে ফিরে যাবে? একটা ওয়ানস্টপ সুপার শপ দেবে সেখানে, যে স্বপ্নটার কথা বলতে বলতে আব্বার চোখ ঝিকমিক করতো একসময়? আম্মার ক্রমশ কঠিন হয়ে আসা রুক্ষ চেহারাটায় আবার কোমল সুখের রোদ খেলবে? সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো?
রতন টের পায় দিনাজপুরে ফেরার ব্যাপারে ওর মধ্যে আর কোন আবেগ কাজ করেনা। শুরুতে যেমন বুক হু হু করতো, বৃষ্টিতে ঘুমপাড়ানি শব্দ তোলা টিনের চালের বাড়িটার জন্য, সামনের উঠোন আর পেছনদিকের জলপাইগাছটার রোদে লাল হয়ে আসা পাতাগুলোর জন্য- প্রতিবেশি দু’পাঁচজন খেলার সাথীর জন্য- এখন সেসবের কিছুই আর টানেনা। বরং ঢাকা ছাড়তে হবে ভাবলেই একধরণের জড়তা পেয়ে বসে। এই শহরের নোংরা, ক্লেদমাখা জীবনের অবসাদে নিশ্চয়ই বিভৎস সুখ আছে কোন। ঝেড়ে কুচ্ছিত গালি দেয়ার মতো সুখ। ঢাকা শহরের শিরায়-উপশিরায় প্রবাহিত এই অবসাদের নেশায় কবে যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে রতন! এই নেশাতেই কোমল অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায় হয়তো!
পানির ট্যাঙ্কি পেতে সমস্যা হলোনা। রিকশাটা ছেড়ে দিয়ে সামনের বাসাগুলোর দিকে নজর করে দেখলো রতন। বাসা নম্বর নেই অনেকগুলোয়। থাকলেও চোখে পড়েনা। মনোয়ারা ফুপু বলেছিলেন বাসার সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। ফুল না থাকলে সজনে গাছ আর কৃষ্ণচূড়া গাছ রতনের কাছে সমান কথা। কোন গাছে ফুল নেই। মনোয়ারা ফুপু ওদের নিকটতম প্রতিবেশি। আম্মার দুর্যোগের সংসারের কাঁদুনে শোনার একমাত্র লোক। উনি সঙ্গে এলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত। জা-এর ছেলে না কার বিয়ের জন্য তাকে গ্রামে যেতে হয়েছে। কমকরেও সপ্তাহ দুয়েকের মামলা। আম্মারও আর তর সইলোনা।
মূর্তির মতোই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেছে আম্মা। তাকে কোথাও বসিয়ে রেখে ওপাশের বাসাগুলো দেখে আসতে পারলে হতো। বসার জন্য একটা চায়ের টং ছাড়া কিছু নেই। আম্মা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছে- দৃশ্যটা কল্পনা করা যায় না। ছোটবেলায় দেখা তার ব্যক্তিত্বের ছবিটা রতনের কাছে এখনো সোনার ফ্রেমে মোড়ানো । চাচী-ফুপুদের মধ্যে আম্মাকে সবচেয়ে আলাদা লাগতো । একটা সচ্ছন্দ কর্তৃত্ব ঘিরে থাকতো তাকে। মফস্বলের দিনগুলোর সেই গরিমার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওদের সংসারে। ঠোঁটের দুপাশে লেগে থাকা বিস্কিটের গুঁড়ো আর জিভে একটু মিষ্টি স্বাদের মতো কিছুটা শুধু রয়ে গেছে স্মৃতিতে। বুটিকের অর্ডার সাপ্লাই দিতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় ঘাড় গোঁজ করে থাকতে থাকতে আম্মার এখন স্পন্ডিলাইটিস হওয়ার যোগাড়। সারাদিন বাসায় সেলাই মেশিনের ঘর্ ঘর্।
শেষমেষ চায়ের দোকানদারের দিকেই এগিয়ে গেল রতন। খদ্দের না থাকায় সেও এতক্ষণ ওদেরকেই দেখছিল ।
-ভাই মদিনা মঞ্জিল বাসাটা চিনেন নাকি?
একসেকেন্ডও না ভেবে সামনেই কোনাকুনি একটা বিল্ডিং দেখিয়ে দিল লোকটা। জিজ্ঞাসাটা খুবই প্রত্যাশিত ছিল যেন। একটা অপ্রস্তুত হাসিমতো দিয়ে আম্মাকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে বাসাটার সামনে এলো রতন।
গেটটা হাট করে ভেতরের দিকে খোলা। সেকারণেই দূর থেকে লাল রং ঠাহর হচ্ছিলনা। ভেতরে কোলাপসিবল গেটের পাশে রংচটা দেয়ালে পুরনো শ্বেতপাথরের ফলকে নামটা পড়া যায়- মদিনা মঞ্জিল। দারোয়ান গোছের কাউকে দেখা গেলনা।
এই প্রথম কথা বলল আম্মা - “দুই তালায়”।
দোতলায় একটাই দরজা। বেশ কারুকাজ করা কাঠের দুইপাল্লা। তার সামনে আরেকটা কোলাপসিবল। খোলা। ওপরে টাইলসে আরবিতে একটা আয়াত লেখা। প্লাস্টারের দাগ দেখে বোঝা যায় নতুন বসানো হয়েছে। হরকত ছাড়া আরবি লেখা পড়তে পারেনা রতন। কোন কোনটার চেহারা শুধু ছবির মতো মুখস্থ হয়ে গেছে। এটা কলেমা তাইয়্যেবা। ছোটবেলায় মসজিদে কিছুদিন সে গিয়েছিল হুজুরের কাছে আরবি পড়তে। আমপারা ধরার পর পড়া আর এগোয়নি। কেন, এখন আর মনে পড়েনা। মনে পড়ল একসময় খুব নামাজও পড়তো সে। রীতিমতো পাঁচ ওয়াক্ত! ভোরবেলা উঠে পাশের বাসার টিপু, সুজনদের ডেকে তুলে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সেকি হুজ্জোত! পেট শুকিয়ে রোযাও করতো যতগুলো পারে। সেসবের পাট চুকেছে বহুদিন। এরপরেও অনেকদিন জুম্মার নামাজটা চলেছে। এখন তাও বাদ। একসময় পাড়ার মসজিদের হুজুরকে দেখলে আপনা থেকেই হাত কপালে উঠে যেত সালামের জন্য। কোনদিক দিয়ে যে এসব নিয়েও ঠাট্টা ইয়ার্কি করার ব্যাপারগুলো ঢুকে পড়ল! এইতো সেদিন, পল্টুর দোকানে এক লেবাস পরা হুজুর এসে পাসপোর্ট সাইজ ছবির প্রিন্ট নিয়ে গেল। যাওয়ার পরপরই পল্টু জিজ্ঞেস করলো-‘বল্ তো, খেজুর আর হুজুরের মধ্যে পার্থক্য কী?’ রতন হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে, বেশ সহজভাবে নিজেই জবাবটা দিয়ে দিল-‘খেজুরের একটা বিচি, হুজুরের দুইটা।’
বন্ধ দরজাটার সামনে আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেছে আম্মা। দীর্ঘদিন দেখলে সম্ভবত মানুষের শরীরের ভাষা, এমনকি নি:শ্বাসের দৈর্ঘ্যের সঙ্গেও বোঝাপড়া হয়ে যায়। বোরকার আড়াল সত্ত্বেও আম্মার অস্বস্তিটুকু তাই ঠিকই টের পাচ্ছিল রতন। একটু মায়া লাগল ওর। সেইসঙ্গে কৌতুহলটা জানান দিল আবার - ঠিক কী কাজে এইখানে এসেছে আম্মা?
রতন ডোরবেলটা চাপলো।
সহসা কেউ এলোনা ।
দরজার খোদাই করা নকশাতে কাবা শরিফের মতো গম্বুজ । মনে হচ্ছে বেশ আল্লাওয়ালা পরিবার।
ওদের বাসায় শুধু আম্মাকেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছ নিয়মিত নামাজ-রোযা করছে। নিজের মতো, চুপচাপ। ওদের ওপর কোন জবরদস্তি নেই। সেজন্যই হয়তো আম্মার ধর্মকর্মটা নিত্যকার নাওয়া-খাওয়ার মতো স্বাভাবিক মনে হয়েছে, আলাদাভাবে চোখে পড়েনি কোনদিন।
এত পরহেজগার হয়েও সংসারে শান্তি তো পেলনা বেচারা!
অন্যদিকে আব্বার এমনকি ঈদের নামাজ পড়তেও গড়িমসি। ঈদের দিন সকালে দেখা যেত কে কার আগে গোসলখানায় ঢুকবে এই নিয়ে রতন-রুবেলের হুড়োহুড়ি। আর আব্বা দিব্বি ঘুমুচ্ছে। শুধু ঈদের দিনই আম্মা যা একটু ঠেলাঠেলি করেছে আব্বাকে- নামাজ ছাড়া ঈদ হয় নাকি! শেষপর্যন্ত পাড়ার মসজিদের শেষ জামাতটা হয়তো ধরতে পারলো আব্বা, ময়দানে কোনদিনই যাওয়া হয়নি।
গত দু’ঈদে পুরনো দৃশ্যে ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন এসেছে। আব্বার পাড়ার জামাতও ছুটেছে। আম্মা কিচ্ছুটি বলেনি। রুবেল তার বন্ধুদের সঙ্গে ঠিকই ময়দানে গেছে। আর রতন নামাজ পড়েছে পাড়ার জামাতে।
রতন কি তবে ধীরে ধীরে আব্বার মতো হয়ে যাচ্ছে?
অস্বস্তিকর ভাবনাটাকে ওখানেই থামিয়ে দিল রতন।
দ্বিতীয়বার বেল চাপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। নাদুসনুদুস গোলগাল চেহারা, শনপাপড়ির মতো গায়ের রং। ছুটির দিনের আলস্য চোখে মুখে।
আম্মা তাকালো রতনের দিকে।
‘মনোয়ারা ফুপু আমাদেরকে পাঠিয়েছেন।’ বলল রতন।
লোকটা সামান্য সময় নিয়ে কিছু ভাবলেন। সম্ভবত মনোয়ারা ফুপুকে চেনার বা তার সঙ্গে হওয়া কোন আলাপ মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপর কোন কথা না বলে দরজাটা ছেড়ে দাঁড়ালেন। ওরা ভেতরে ঢুকলে দরজাটা আবার লাগিয়ে দিয়ে সামনে কিছুদূরে দুটো সোফা দেখিয়ে ‘বসেন’ বলে আরেকটা দরজা দিয়ে ভেতরে হারিয়ে গেলেন।
একটা বেশ বড় ড্রইংরুম। একপাশের দেয়ালজুড়ে মখমলের কাপড়ে আঁকা কাবা শরিফের বড়সড় একটা ছবি কাচ দিয়ে বাঁধাই করে ঝোলানো । অন্য দেয়ালে বিভিন্ন আকারের গোল গোল রুপার থালা। তাতে ফুল, লতাপাতা, আঙুর ফল এইসব নকশার মাঝে বিভিন্ন আরবি আয়াত খোদাই করা। বড়লোকদের বাসায় যে আলাদা একটা গন্ধ থাকে, সেই শিরশিরে গন্ধটাও পেল রতন। আর একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। শেষেরটাই সবচেয়ে সরব ঘরটায়। পনেরো, বিশ মিনিট, কিংবা তারো বেশি সময় বসে রইলো রতনরা।
আসরের আযান শোনা যেতেই সামান্য নড়ে চড়ে বসলো আম্মা। আযানের সুরটা কেমন মন খারাপ করা। যোহরের আযানেও কি এই মন খারাপের ব্যাপারটা থাকে? নাকি এই সময়টাতেই মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে বেলা শেষের বিষাদ ভর করে?
রতন যখন ভাবছে ভেতরে একবার খোঁজ নেয়া দরকার, ঠিক তখনই আগের সেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। এসে বসলেন রতনের ডানদিকের একলা সোফাটায়। বেশ নম্রভাবে বললেন,
‘আসলে আম্মা এখন বেশ বিরক্ত হন। আমরা তো কখনোই পছন্দ করিনি। তবু কেউ কেউ এমনভাবে রিকোয়েস্ট করে...মনোয়ারা চাচীকে আম্মা না করতে পারেননি..’ ।
আম্মা একদম চুপচাপ। রতন বুঝতে পারেনা কী বলা যেতে পারে।
ভদ্রলোকই আবার বললেন, ‘আম্মা নামাজে দাঁড়াবেন। আপনাকে ওজু করে ভেতরে যেতে বলেছেন। বাথরুম এইদিকে। যান।’ একটা দরজা দেখিয়ে দিয়ে উঠে আবার ভেতরে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
বিষয়টা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা রতন। ভদ্রলোক যাঁকে আম্মা ডাকলেন তাঁর নামই সম্ভবত মদিনা। রতনরা এসেছে ওঁর কাছেই। কিন্তু কেন?
আম্মা ভেতরে যাওয়ার পর একা একা বসে সম্ভাব্য কারণগুলো আন্দাজ করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু কোনটাই মহিলার বয়স, পারিবারিক অবস্থা, ইত্যাদির সঙ্গে যায়না।
শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে অন্দরসজ্জার দিকে আবার মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল। সোফার রুমালের এমব্রয়ডারি ছাড়া দেখার আর কিছু বাকি নেই। ছোটবেলায় আম্মার সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজও রতন বিস্ময় নিয়ে দেখতো। যে বয়সে এমনকি বাসার পেছনে পায়খানার জন্য হাউজ খোঁড়ার কাজও সমান আগ্রহের ছিল। রুমালের এমব্রয়ডারি আজ চোখে আটকালোনা।
আম্মার ভেতরে যাওয়ার পর ঠিক কতটা সময় পেরিয়েছে আন্দাজ করা মুশকিল। এই সময়ের মধ্যে ভেতর থেকে আর কেউ এদিকে আসেনি। একটা বেড়াল শুধু কিছুক্ষণ আগে গম্ভীর চালে হেঁটে গেছে।
ভেতরে কি হচ্ছে, জানার একটা মাত্রাছাড়া কৌতুহল হচ্ছিল রতনের। এত দেরি হচ্ছে কেন আম্মার?
সময়ের একটা অনির্দিষ্ট প্রসারণ ঘটছে এই ঘরটায়। রতনের সঙ্গে ঘড়ি নেই। আজকাল ঘড়ি কেউ পরেও না, মোবাইলে সময় দেখে। বাসায় রতনদের একটাই মোবাইল, আম্মার কাছে থাকে। আরেকটা আছে, আব্বার সঙ্গে। ঘড়ির জন্য চার দেয়ালে আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে আনল রতন। নেই। সময়ের যেন ওজন টের পাওয়া যাচ্ছে এই ঘরে। প্রকান্ড, ভারি একটা পেন্ডুলাম অনন্ত কাল ধরে একপাশ থেকে আরেকপাশে আসছে যেন।
অপেক্ষা অবশ্য রতনের জন্য নতুন কিছু নয়। মাঝে মাঝে পল্টুদের স্টুডিওতে ওর বড় ভাই এসে পড়ে। এইসময়গুলোতে রতনকে সাবলীল ভঙ্গিতে উঠে যেতে হয়। মিউনিসিপ্যালিটির পার্কে বসে সময় কাটাতে হয় তখন। গাছ না থাকায়, যা আছে তাও প্রায় ন্যাড়া হওয়ায়, ঘামতে হয় রোদে বসে বসে ।
কিন্তু আজ ভারি অস্থির লাগে রতনের! ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে কোনদিন আম্মাকে না দেখতে পেয়ে যদি শুনতে হতো, বাইরে গেছে, জলদি ফিরে আসবে -তখন প্রত্যেকটা দেরি হওয়ার মুহূর্ত যে বুকভার করা ওজন নিয়ে আসতো, ঠিক সেই অনুভূতিটা বহু বছর পর হচ্ছে আবার।
কিছুক্ষণ হলো ভেতর থেকে পোলাওয়ের সুবাস আসছে । পোলাওয়ের সুবাস আর উৎসব রতনের স্মৃতিতে একসঙ্গে গাঁথা।
দুই ঈদ ছাড়াও ওদের তিন ভাই বোনের জন্মদিনে পোলাও রান্না করাটা একসময় বাঁধা ছিল আম্মার। আব্বার পছন্দ মিষ্টি পোলাও। তার জন্মদিনে তাই মিষ্টি পোলাও হতো। ওটার গন্ধ অন্যরকম। বেশ কয়েকবছর ধরে ওসব বন্ধ। বাসার পরিবেশটাই কেমন বদলে গেছে। উৎসব ব্যাপারটাই ও বাসার সাথে আর যায়না।
গন্ধে অর্ধেক ভোজনের বদলে বরং খিদে পেয়ে গেল রতনের।
আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে শেষপর্যন্ত উঠে পড়ল সে। ভেতরের দিকের দরজাটা সরিয়ে উঁকি দিল ওপাশে।
একটা প্রশস্ত প্যাসেজ। শেষ মাথায় জ্বলা এনার্জি সেভিং বাল্বের সাদাটে আলোয় কিছুটা আলোকিত। ভেতরে কিছু ব্যবধানে দুপাশে দুটো ঘর। হাতের বামদিকের ঘরটা সম্ভবত ভেতর থেকে বন্ধ। ডানদিকের ঘরটার দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। ভেজানো দরজাটার পাশেই একটা গ্রিলের জানালা। কাচ টাচ নেই।
রতন জানালাটা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। ভেতরের ছায়াময়তায় চোখ সইয়ে নিয়ে দু’টো প্রাণীর অস্তিত্ব ঠাহর হতে সময় লাগল কিছুটা। একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে আম্মা। মুখের নেকাব তোলা। তার সামনেই একটা বিছানা, মশারি ফেলানো। মশারির ভেতরেও কেউ একজন বসে আছে বোঝা যায়। কারণ আম্মা খুব মৃদু স্বরে সেদিকেই কাউকে কিছু বলছে। আম্মার কথা শেষ হলে বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বললো না। এরপর মশারির ভেতর থেকে জবাবে কিছু একটা বলা হলো। কিছুই শুনতে পেলনা রতন। ওর মনে হলো দু’জন নিঃশব্দে ভাব বিনিময় করছে। শোনার জন্য কান পাতলো রতন । ভেতরে কোন ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে না। বিপরীত দিকের দেয়ালের খোলা জানালা দিয়ে বিকেলের আলো এসে ঘরের কিছুটা অংশ আলোকিত করেছে। সেই আলোয় আম্মার মুখের পার্শ্বরেখা দেখা যায়। এতক্ষণে মশারির ভেতরের জনকেও কিছুটা দেখতে পেল রতন। সাদা পোশাকে একটা নারী অবয়ব। মশারির আড়ালের কারণে এরচেয়ে বেশি কিছু বোঝার উপায় নেই। আম্মা আবার কিছু একটা বলল। কিছুক্ষণ কোন কথা শোনা গেলনা ওপাশ থেকে।
এরপরে একটা কান্ড হলো। রতন দিব্যি দিয়ে বলতে পারে, তার ষোল বছরের জীবনে এর চেয়ে অদ্ভুত ঘটনা সে ঘটতে দেখেনি।
ব্যাপারটা হলো একেবারে আচম্বিতে। আম্মার কথার পর আগের মতোই কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ। এরপর মশারির ভেতরে একটা মৃদু আলোড়ন। আর তারপরপরই রতনকে হতভম্ব করে দিয়ে ভেতর থেকে শোনা গেল একটা বাজখাঁই পুরুষালী কণ্ঠ, কণ্ঠের তীব্রতার কারণেই কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল রতন,
- কুফরি কালাম...কুফরি কালাম....পূর্ব কোণে... খুঁজবি.... লুকায় রাখা আছে...পুড়ায়া ফেলবি...পুড়ায়া ফেলবি...চিহ্ন রাখবি না...
পা দুটো পাথরের মতো মেঝেতে যেন গেঁথে গেছে রতনের। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে সে আম্মার দিকে তাকালো। এই ঘটনায় আম্মা তার জায়গা থেকে একচুলও নড়েনি। বিষয়টা হয় আগে থেকেই জানা ছিল তার, নতুবা রতন আসার আগেই নাটকের বাকি দৃশ্যগুলো অভিনীত হয়ে গেছে।
একটা অদ্ভুত হেঁচকির মতো আওয়াজ আসছে মশারির ভেতর থেকে। সেটা থামলে আবার সব চুপচাপ। এবার যেন আগের চেয়েও গাঢ় নীরবতা চেপে বসলো ঘরটায়।
হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রতন। পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে।
কিছুক্ষণ পর আম্মা একটু নড়েচড়ে বসল, কিন্তু উঠে গেলনা।
মশারির ভেতর থেকে আবার মৃদু গলায় কিছু শোনা গেল। একটা শব্দও কানে এলোনা রতনের ।
আম্মা এবার উঠে পড়ল। মশারির বাইরে থেকেই বিছানায় হাত ছুঁইয়ে সালাম করলো মহিলাকে।
ততক্ষণে রতন একটু ধাতস্থ হয়েছে। হতভম্ব ভাবটা নিয়েই দ্রুত ড্রই্ং রুমে এসে বসে পড়ল আগের জায়গায়। শরীর একটু একটু কাঁপছে তখনো। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে ভাববার বিশেষ সময় পেলনা সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে আম্মা এসে ঢুকলো। এসেই প্রায় ফিসফিস করে বললো -
‘একটা মিষ্টি নিয়ে আয় তো। সাদা মিষ্টি’
রতন একটা ঢোঁক গিলে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
-একটা মিষ্টি?
-হ্যাঁ! একটা। সাদা মিষ্টি আনবি। লাল, কালো না কিন্তু।
রতন আবার জিজ্ঞেস করল,
-একটা ক্যান? কি করবা?
এবার বেশ বিরক্ত হলো আম্মা।
-যা বললাম কর। নিচে ত্থেকে একটা সাদা মিষ্টি নিয়ায়। টাকা আছে?
কথা না বাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রতন।
সিঁড়ি দিয়ে নামছে যখন, তখন মাগরিবের আযান পড়ছে। সুরটা ভয় ধরানো। বুকের ভেতর ধড়ফড় করে।
অন্য কারো কাছে শুনলে এই পুরো বিষয়টাকে স্রেফ একটা বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিতে পারতো রতন। কিন্তু সে নিজের চোখে কিছুক্ষণ আগে যা দেখল তা কি এত সহজে হজম হবার? ঐ ভদ্রমহিলার ওপর কি তাহলে জ্বিনের আছর আছে? রতন এখন বুঝতে পারছে আম্মা সম্ভবত ভদ্রমহিলার কাছে এসেছে তার সাংসারিক সমস্যার কোন আধ্যাত্মিক সমাধানের আশায়। ওদের মতো আরো অনেকেই নিশ্চয়ই আসে। নিচের চা-ওলার কাছে সেকারণেই মদিনা মঞ্জিলের খোঁজ খুব সাধারণ ঘটনা।
শরিফকে বললেই সে কিছু না কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে এর পেছনে আসলে অলৌকিক কোন ব্যাপার স্যাপার নেই। কিন্তু ঐ মুহূর্তে যে ধাক্কাটা রতন খেয়েছে, সেটা কি শরিফের পক্ষে বোঝা সম্ভব?
তাছাড়া বন্ধুদের সামনে যত বারফাট্টাই করুক, একদম নিজের কাছে অনেককিছুই স্রেফ নাকচ করে দেয়ার মতো মনের জোর রতন এখনো পায়না। নামাজ-রোযা নেই, ধর্মের নানান বিষয়ে হাজারটা প্রশ্ন মনে, দিন দিন সংশয়, তারচেয়েও বেশি উদাসীন নিষ্ক্রিয়তাই বেশি অস্তিত্বমান হতে চাইছে। তারপরও রতন বুঝে দেখেছে, মনের অনেক গভীরে বিশ্বাসী থাকতেই আসলে তার স্বস্তি। ভাত খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বলার অভ্যাস না হলেও, খাওয়া শেষে প্রায়ই অস্ফুটে আলহামদুলিল্লাহ বেরিয়ে যায় মুখ থেকে। আযানের সময় হঠাৎ খেয়াল হয়, মনে মনে হাইয়া আলাল ফালাহ’র পর জবাবে লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলছে। পুরনো অভ্যাস ভেবে পাশ কাটায় রতন ।
কিন্তু মিষ্টির ব্যাপারটা কি? মদিনা মঞ্জিলের মালিক নিশ্চয়ই একটা মিষ্টি খেতে চাইবার মতো হ্যাংলামো করবেনা। মিষ্টি কি তবে ঐ জ্বিনের জন্য?
কাজল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায় রতনের। মেঝ মামার ছেলে কাজল ভাই রতনের চেয়ে বছর আটেকের বড় ছিল। সবাই বলতো ওর সঙ্গে জ্বিন থাকে। এমনিতে সুস্থ। শুধু লেখাপড়াটা করতোনা, নিজের মতো থাকতো আর প্রায়ই একা একা কথা বলতো। তার পকেটে সবসময় থাকতো বাতাসা আর কদমা। কি একটা অসুখ হয়ে হুট করে একদিন মরে গেল কাজল ভাই। রতন তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ে। কাজল ভাই-ই বলেছিল একবার, জ্বিনেরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে। তাই সে পকেটে বাতাসা নিয়ে ঘোরে।
নিচে আশপাশে কোন মিষ্টির দোকান দেখা গেলনা। অগত্যা সেই চায়ের দোকানির কাছেই আবার গেল রতন। চা-ওলা এবারও প্রায় যান্ত্রিক অভ্যস্ততায় পাশের গলির শেষ মাথায় মিষ্টির দোকানের হদিস জানিয়ে দিল।
মিষ্টির দোকানের সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। লালচে সাদা চামড়ার এক ফরেনার মহিলা দুই হাত ভ’রে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রতনকে পাশ কাটিয়ে গাড়িটায় গিয়ে উঠলো। মহিলার হাতের বড় বড় সাইজের প্যাকেটগুলো দেখে রতনের মনে পড়ল সে এসেছে মাত্র একটা মিষ্টি কিনতে। আড়ষ্ট বোধ করলো রতন। আম্মার কান্ডজ্ঞান না থাকতে পারে, ওর তো আছে। একটা মাত্র মিষ্টি চাওয়া যায় নাকি! রতন ঠিক করলো, তিনটা মিষ্টি চাইবে। দুটো মিষ্টি আগে এখানে বসে খাবে, তারপর একটা বেঁধে নেবে কাগজে।
কাউন্টারের কাছে গিয়ে মিষ্টির কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল রতন। মুখ থেকে কথা সরলোনা। কয়েকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল পরপর। বোকার মতো চেয়ে রইল মিষ্টি রাখার শো কেসটার দিকে।
অ্যালুমিনিয়ামের লম্বা কতগুলো ট্রে পরপর সাজানো। কোন কোনটাতে মিষ্টির গুঁড়ো আর শিরা লেগে আছে। বাকি সবগুলো ট্রে ভোঁ ভোঁ।
শুধু সবচেয়ে বাঁয়ের ট্রে-টার এক কোণে পড়ে আছে একটামাত্র মিষ্টি। সাদা রঙের।
... ... ...
রতনের তখনো ঘুম ভাঙেনি। গতরাতের ঘর ওলট পালোট করা পরিশ্রমের পর ঘুমের খোঁয়ারি কাটছে। পূর্ব কোণ শেষ পর্যন্ত, উত্তর, দক্ষিণ হয়ে পশ্চিম পর্যন্ত ঘুরেছে। রুবেল, পুতুলের অবাক চোখ-মুখের পর আম্মার গভীর হতাশা ঘাম হয়ে টপটপ করে গড়িয়েছে। সবশেষে ঘুমের আশ্রয়। ঘুমই বুঝি সমস্ত জাগতিক আলোড়ন থেকে মানুষের সাময়িক মহাজাগতিক মুক্তি।
খুব ভোরে একবার উঠেছিল রতন। ঘর, বিছানা, জানালা আর মশারিগুলো তখনো ঘুমন্ত। কাউকে জাগায়নি। ঘুমাক। আরো কিছু ঘুম ওদের পাওনা।
শুধু পূর্বকোণের ঘুমটা ভেঙেছিল রতনের সঙ্গে। যেদিক দিয়ে ঘুলঘুলি পথে সূর্য উঁকি মারার চেষ্টা করে বসার ঘরটায়। আরো বছর পাঁচেক আগে যেখানটায় লুকানো থাকতো রতনের সবচেয়ে দামি মার্বেলগুলো। সবসময় বন্ধ থাকা জানালার গ্রিল ধরে উঠতে হতো তখন।
রতন আবার ঘুমোতে গেছে। নিশ্চিন্ত হয়ে আরো গাঢ় ঘুমে। ঘুমের মধ্যেই জেগেছে ওদের ঘর-দোর, রান্নাঘরের ধোঁয়া, হাড়িকুড়ির আওয়াজ, টুথপেস্টের টিউব। আর একটা সুবাস। বহুদিনের ঘুম ভেঙে উঠে ভেসে ভেসে ঘুরে দেখেছে ঘরের সবকটা কোণ- উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ এরপর পূর্বে এসে থমকেছে খানিক, রতন যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ আগেও।
ঘি, জাফরান, কিসমিসের সুবাস এরপর ঝাড়পোঁছ করতে শুরু করেছে বহুদিনের জমা বিষাদকালো ঝুল-জঙ্গল।
রতন ঘুমোচ্ছে, ততক্ষণ, যতক্ষণ না আম্মা এসে ঠেলে তুলে ফিসফিস করে বলছে- রতন! রতন! শুন!...পাওয়া গেছে...পূর্ব দিকের ঐ যে ভেন্টিলেটরটা আছে না .......’ !
রতনের মতোই দরজার পাপোশ, আলনার হ্যাঙার, সোফার হাতল আর মিষ্টি পোলাওয়ের সুবাসের অপেক্ষা-আজ সকাল সকাল ডোরবেল বাজবে। হৈ চৈ আর জীবনের উত্তাপ নিয়ে আসবে একটা মানুষ, গতরাতেও যে বাসায় ফেরেনি, রতনের মাথাটা এখন যাকে ছুঁয়ে ছাড়িয়ে যেতে চায়। অনেকদিন আগে একবার কাকি, যার চুল ছেলেদের মতো করে কাটা ছিল, রতনের কোঁকড়ানো চুলে আঙুল চালিয়ে বলেছিল- ‘একেবারে বাপের আদলটাই পেয়েছে’। আজ তুলু কাকু, কলেজের দারোয়ান, রতন, আরো কত কত মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে পল্টুর স্টুডিওর একটা পজিটিভ প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে।
ঘুমের আলো-আঁধারিতে রতন অপেক্ষা করতে থাকে। মঙ্গল ধ্বনির মতো বেজে উঠবে দরজার ঘণ্টা। বিকেলে খেলা ভাঙার সংকেত দেওয়া ছেলেবেলার সেন্ট ফিলিপসের গীর্জার ঘণ্টার মতো।
নাহ্! গীর্জার ঘণ্টা বড় বেশি বিষন্ন। অন্যকিছু। আনন্দময় কিছু। জীবনের উত্তাপ ধারণ করা কিছু।
ঘুমের মধ্যেই রতন খুঁজতে থাকে ঠিক ঠিক শব্দটা । #
________
# সারওয়ার রেজা
মন্তব্য
সচলে প্রথম পোস্ট? খুবই ম্যাচিউর লাগলো ভাষা, বলার ভঙ্গি। কিপিটাপ!
নীড়পাতায় নিয়মিত হবেন আশা করি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বেঢপ আকারের লেখাটা (স্পেসিং-এর সমস্যার কারণে নিজেরই বিরক্ত লাগছে দেখতে, এডিট করার সুযোগ নেই বলে লাগছে অসহায়) কষ্ট করে পড়েছেন, অশেষ কৃতজ্ঞতা!
এটা আমার ৩য় পোস্ট। ২য় গল্প।
পেশাগত ডামাডোলে নিয়মিত লেখা মুশকিল হয়ে পড়ছে।
ভাল থাকবেন।
ভালো লাগলো খোঁজ -দ্য সার্চ । শব্দের গাঁথুনিতে বেশ পারদর্শিতার ছাপ রয়েছে। আরো লেখা চাই। ইয়া খিপিঠাপ !
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ভালো লাগলো, লিখতে থাকুন।
''দিবাকর''
অশেষ ধন্যবাদ
খুব ভালো লেগেছে। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
কৃতজ্ঞতা জানবেন
ভালো লাগলো। বেশ বড় গল্প, কাহিনীতেও প্রতিনিয়ত নতুন কিছু ঘটেনি। তারপরেও বলার ধরন, কয়েক জায়গায় উপমা, দৃশ্যকল্প বেশ সুন্দর।
এত বড় লেখাটাও কেউ কেউ কষ্ট করে পড়ছেন এবং মন্তব্য করছেন দেখে ভীষন কৃতজ্ঞ হচ্ছি।
#দারুন! খুব সুন্দর লিখেছেন,শুভেচ্ছা আপনাকে
#এগিয়ে চলুন,দ্রুত সচল হয়ে উঠুন সুন্দর আর এরকম বলশালী লেখার মাধ্যমে
#ভাল থাকুন।
আশরাফুল কবীর
আপনার জন্যও নিরন্তর শুভেচ্ছা... অশেষ কৃতজ্ঞতা...
পড়লাম, বেশ ভালো লাগল। স্পেসিং দিয়ে প্যারা করে লিখলে পড়তে আরও আরাম হত।
লেখা চলুক।
নতুন মন্তব্য করুন