‘একটা লাল গোলাপের দাম হল মৃত্যু যেখানে জীবন সবার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয়। আহা সবুজ গাছের ডালে বসে সোনালী রথের মাঝে সূর্যকে আর মুক্তোর রথের মাঝে চন্দ্রকে দেখার মাঝে কতই না আনন্দ। কি মিষ্টি সুবাসই না আসে গুল্ম জাতীয় লতার মাঝ থেকে যেমন মিষ্টি সুগন্ধ আসে উপত্যকার গায়ে লুকিয়ে থাকা নীল রঙের ব্লু বেল ফুলের মাঝ থেকে। আর পাহাড়ের উপর উড়তে থাকা গোলাপি ফুলের সৌরভও তো অনেক মিষ্টি। তারপরও জীবনের চেয়ে ভালোবাসা বড় । আর মানুষের সাথে তুলনা করলে পাখীর আবার হৃদয় কি?’ নাইটিংগেল চিৎকার দিয়ে বলল।
এবার নাইটিংগেল তার বাদামী ডানা প্রসারিত করে আকশে ভাসিয়ে দিল। সে ছায়ার মত করে বাগানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ভাসতে লাগলো।
সেই নবীন ছেলেটি তখনও সে ঘাসের উপরেই বসে ছিল ঠিক যেখানে সে তাকে দেখে গিয়েছিল। ছেলেটির মায়াবী চোখের জল তখনও শুকায় নি।
‘খুশী হও হে বালক খুশী হও’- নাইটিংগেল চিৎকার দিয়ে বলল। তুমি তোমার লাল গোলাপ পাবে। আমি গাইতে গাইতে আমার বুকের রক্ত বিসর্জন দিব চাঁদের আলোর কাছে যার বিনিময়ে নিয়ে আসবো লাল গোলাপ। তবে তার বিনিময়ে আমি শুধু এটুকু চাই যে তুমি একজন প্রকৃত প্রেমিক হও। কারণ দর্শনের চেয়ে প্রেম বিচক্ষণ যদিও দর্শনও প্রাজ্ঞ ,আর ক্ষমতার চেয়েও শক্তিশালী যদিও সে নিজেও অনেক শক্তিমান। তার ডানাগুলো যেন অগ্নিশিখার রঙে রাঙানো আর তার দেহ যেন অগ্নি বর্ণা। তার ওষ্ঠ যেন মধুর মতই মিষ্টি আর তার নিঃশ্বাস দিয়ে যেন সুগন্ধি ছড়ায়’।
ছেলেটি ঘাসের উপর থেকে চোখ তুলে তাকাল কিন্তু নাইটিংগেলের কোন কথায় সে বুঝতে পারল না কারণ সে তার বইয়ের ভেতর লেখা শব্দগুলোর দিকেই বেশী নিবিষ্ট ছিল।
কিন্তু ওক গাছ সব বুঝতে পারছিল আর সে কারণেই সে ব্যথিত হল। এত বছর ধরে তার উপর বাসা বেঁধে থাকা নাইটিংগেল পাখিকে গাছটি প্রচণ্ড ভালোবাসতো।
ওক গাছ নাইটিংগেল পাখিকে বলল ‘ আমার জন্য শেষ একটা গান তুমি শুনিয়ে যাও। তুমি চলে গেলে আমি বড়ই একা হয়ে যাবো’।
নাইটিংগেল ওক গাছের জন্য গান গাওয়া শুরু করলো। রুপালী জারে রাখা গরম পানির বুদবুদ কাপনির মত তার স্বর কেঁপে উঠছিল।
তার গান শেষ হলে ছেলেটা তার পকেট থেকে একটা পেন্সিল ও নোটবুক বের করলো।
ছেলেটি বলল,‘নাইটিংগেল এমন সুরে গাইল যা অগ্রাহ্য করার মত নয়’ কিন্তু তার কি কোন আবেগ আছে? আমার তো মনে হয় নেই। বস্তুত অন্যান্য শিল্পী থেকে সেও তো আলাদা নয়। সে অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে না। সে অন্যের মত শুধু নিজের কথাই ভাববে। আর শিল্পের স্বার্থপরতার কথা তো সবারই জানা। তারপরও তার কণ্ঠের মিষ্টতার কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য যে এসব আসলে কোন কাজে আসে না’। এই বলে ছেলেটি তার রুমে চলে গেল ।কিছুক্ষণ পরেই সে তার প্রেমের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
এরপর রাতের আকাশে চাঁদ উঠলে নাইটিংগেল পাখি সেই গোলাপ গাছের কাছে গিয়ে কাঁটার উপরে তার বুক রাখল। সারা রাতভর সেই কাঁটার উপরে বুক রেখে পাখিটা গান গাইলো। চাঁদ আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে তার গান শুনছিল। সারা রাত ধরে তার গান চলতে লাগলো আর এদিকে সেই গোলাপের কাঁটা আস্তে আস্তে তার বক্ষ বিদীর্ণ করতে থাকলো। নাইটিংগেলের দেহ থেকে রক্ত ঝরা শুরু হল।
সে শুরুতেই একটা ছেলে ও মেয়ের হৃদয়ে জন্ম নেয়া প্রেমের গান গাইল। এরপর ক্রমেই গোলাপ গাছের চূড়ায় একটি চমৎকার গোলাপ ফোঁটা শুরু হল। গানের সংখ্যা বাড়ার সাথেই গোলাপের পাপড়িও বাড়তে লাগলো। ভোরের কুয়াশা কেটে গেলে সকালের রং যেমন ফ্যাকাসে আর ভোরের পাখি যেমন রুপালী রং ধারণ করে তেমনই একটা রং ধারণ করেছিল সেই গোলাপ। একটা গোলাপকে রুপালী আয়নার সামনে ধরলে যে রং পানির চৌবাচ্চায় ধরলেও সেই একই রং ধারণ করে। আর এমনই একটা গোলাপ ফুটেছিল সেই গাছের চূড়ায়।
কিন্তু গোলাপ গাছ নাইটিংগেলকে আরও জোরে তার গায়ের কাঁটার উপর বক্ষ দিয়ে আঘাত করতে বলল। গাছ চিৎকার দিয়ে বলল ‘আরও জোরে আঘাত করো হে ক্ষুদ্র নাইটিংগেল পাখি ,তা নাহলে গোলাপ ফোঁটার আগেই দিনের আলো চলে আসবে।
নাইটিংগেল এরপর ওই কাঁটার উপর নিজের বক্ষ সজোরে আঘাত করে চলল আর আস্তে আস্তে বাড়িয়ে চলল তার গান। এবার সে একটা ছেলে ও মেয়ের হৃদয়ে জন্ম নেয়া আবেগ নিয়ে গান গাওয়া শুরু করলো।
গোলাপের পাপড়িতে হালকা গোলাপি রঙয়ের আভার ঝলকানি দেখা দিল ঠিক চুম্বন দেয়ার মুহূর্তে একজন বর কনের মুখের উপরে যে গোলাপি আভা পড়ে অনেকটা সেরকম। কিন্তু কাটা তো এখনও নাইটিংগেলের হৃদয় বিদীর্ণ করলো না। কাজেই গোলাপের হৃদয়ও এখনও সাদা রইলো। কারণ এই হৃদয় নাইটিংগেলের হৃদয়ের রক্তে রঞ্জিত না হলে টকটকে লাল আকার ধারণ করতে পারবে না।
গাছ চিৎকার দিয়ে বলল ‘আরও জোরে আঘাত করো হে ক্ষুদ্র নাইটিংগেল পাখি, তা না হলে গোলাপ ফোঁটার আগেই দিনের আলো চলে আসবে’।
নাইটিংগেল আবারও জোরে জোরে তার বক্ষকে সেই গোলাপের কাঁটার উপর আঘাত করতে বলল। সাথে সাথেই একটা দুঃসহ ব্যথা তার ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। সেই ব্যথা ছিল অসহনীয়। তার গানগুলিও ক্রমেই বেসামাল হতে থাকলো। এবার সে এমন এক প্রেমের গান গাইল যার পরিণতি হল মৃত্যু। এ এমন এক প্রেমের গান যার মৃত্যুতে কোন সমাধি হয় না।
এবার গোলাপ ফুল টকটকে লাল আকার ধারণ করলো, ঠিক পূবের আকাশের নিচে ফুটে ওঠা লাল গোলাপের মতো। পাপড়িগুলো লাল হবার সাথে রক্ত লাল হচ্ছিল নাইটিংগেলের হৃদয়।
তার স্বর ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছিল। ডানা যুগল কাপতে লাগলো। তার চোখের উপর একটা আবরণ পড়লো। গানের স্বর আস্তে আস্তে একেবারেই কমে গেল এবং তার শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল।
এবার নাইটিংগেল তার শেষ গানটি গাইল। রাতের রুপালী চাঁদ তার গান শুনে এতটাই মুগ্ধ হল যে রাতের শেষে ভোর আসার কথা সে ভুলে গিয়ে দিনের আকাশেও অনেক ক্ষণ ভেসে রইলো।
রাতের গোলাপ তার গান শুনে প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাপতে লাগলো। সে তার পাপড়িগুলোকে সকালের হিম হাওয়ার মাঝেও মেলে দিল। তার গানের শব্দ লাল পাহাড়ের গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হল যা স্বপ্নে বিভোর রাখালকেও তার ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। গানের সুতীক্ষ্ণ ধ্বনি ভাসতে ভাসতে নদী, আর নদী থেকে সাগরে পৌঁছে গেল।
গোলাপ গাছটি এবার চিৎকার দিয়ে বলল ‘ তোমরা দেখ -দেখ গাছে গোলাপ ফুল ফুটেছে’। কিন্তু নাইটিংগেল পাখিটি গাছের কথার কোন উত্তর দিল না। কারণ তার হৃদয়ে বিদ্ধ করা কাঁটা নিয়ে সে ঘাসের উপর মৃত পড়ে ছিল।
দুপুর বেলা সেই ছাত্রটি তার জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাল। সে চিৎকার দিয়ে বলল ‘ কেন, কিভাবে এমন সৌভাগ্য হল আমার; ‘ এ যে লাল গোলাপ! আমি আমার জীবনে এমন লাল গোলাপ আর দেখিনি। এটা এতই সুন্দর ,আমার মনে হয় নিশ্চয় এর অন্য কোন নাম আছে। সে গাছটির দিকে একটু ঝুঁকে গিয়ে লাল গোলাপটি ছিঁড়ে নিলো।
এরপর সেই ছাত্রটি মাথায় হ্যাট আর হাতে লাল গোলাপ নিয়ে প্রফেসরের বাসার দিকে রওনা দিল।
প্রফেসারের মেয়েটি দরজার পাশে বসে নীল রঙের সিল্কের কাপড় একটা রিলে করে পেঁচিয়ে রাখছিল। মেয়েটির পাশেই একটি কুকুর শুয়ে ছিল।
‘তুমি বলেছিলে যে একটি লাল গোলাপ এনে দিলে তুমি আমার সাথে নাচবে। এই নাও পৃথিবীর সবচেয়ে লাল গোলাপ’ ছেলেটি বেশ জোরে বলল।‘তুমি আজ রাতে এটি পড়বে আর আমরা যখন নাচবো তখন এই ফুলই বলবে যে আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি’।
কিন্তু মেয়েটি ভ্রুকুটি করলো।
সে বলল ‘এই ফুলটি আমার পোশাকের সাথে মানাবে না। তাছাড়া স্যাম্বারলিনের ভাইয়ের ছেলে আমার জন্য কিছু অলংকার পাঠিয়েছে। আর অলংকারের দাম যে ফুলের চেয়েও বেশী এত সবারই জানা’।
ছেলেটি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল ‘তুমি একজন অকৃতজ্ঞ। এই বলে সে লাল গোলাপটি ছুঁড়ে রাস্তায় নিক্ষেপ করলো যা একটি নালার ভিতরে গিয়ে পড়লো। এরপর একটি গাড়ীর চাকা এসে ফুলটিকে পিষে দিল।
‘অকৃতজ্ঞ’! মেয়েটি বলল।‘ আমি তোমাকে কী কথা দিয়েছি, তুমি এত রুঢ় হচ্ছ কেন; আর তুমিই বা কে? একজন মামুলি ছাত্র। আমার তো মনে হয় সেম্বারলিনের ভাইয়ের ছেলের জুতার বকলসের যোগ্যও তুমি নও’। এই বলে মেয়েটি সজোরে চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
ছাত্রটি প্রফেসরের বাসা থেকে বেরিয়ে বলল ‘ ভালোবাসা আসলেই এক নিছক জিনিষ’। যুক্তির কাছে এর অর্ধেকও দাম নেই কারণ এটা কোন কাজে আসে না। এটা এমন কিছু বলে যা কখনও ঘটবে না। এ এমন সব জিনিষকে বিশ্বাস করতে বলে যা আসলে সঠিক না। এটা আসলে অবাস্তব, আর আমার বয়সে বাস্তববাদী হওয়াটাই বেশী জরুরী। আমার আসলে দর্শনে ফিরে যাওয়া উচিৎ আর অধিবিদ্যা চর্চায় মনোনিবেশ করা উচিৎ’।
এই বলে সে ঘরে ফিরে এলো এবং ধুলা মাখা একটি বই বের করে পড়া শুরু করলো।
সমাপ্ত
অমি_বন্যা
আগের পর্বের লিংক
মন্তব্য
এইবার ঠিক ঠিক কমন পড়েছে।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
হুম
ভালো হয়েছে।
তোমাকে অসংখ্য
#ভাল লেগেছে পড়তে, শুভেচ্ছা আপনাকে
আশরাফুল কবীর
ধন্যবাদ আপনাকে
নতুন মন্তব্য করুন