[ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কয়েলহো বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লেখদের একজন। তার লেখায় আছে মানুষকে বদলে দেয়ার যাদুমন্ত্র। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার যার মধ্যে আছে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের ক্রিস্টাল এওয়ার্ড, ফ্রান্সের লিজিয়ন দ্যা অনার ইত্যাদি। তার বিখ্যাত বই অ্যালকেমিস্ট আন্তর্জাতিক বেষ্ট সেলার ও বিশ্বের বহুল পঠিত বইগুলোর একটি। তার ক্ষুদে গল্পগুলো বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ সংযোজন। কয়েক লাইনের এসব গল্পগুলো পাঠককে গভীর চিন্তায় উদ্দ্যোগী করে, জীবনকে নির্দেশনা দেয় নিখুঁতভাবে]
লোকনাথ আর ভোলানাথ দুইজন কম বয়স্ক সন্যাসী। তারা একদা এক কর্দমাক্ত পিচ্ছিল দুর্গম রাস্তা দিয়ে সামনে এগোচ্ছিল। পথিমধ্যে এক সুন্দরী কম বয়স্ক যুবতী রাস্তা পারাবারের চেষ্টা করছিল। সে পা ঠিক মত ফেলতে পারছিল না। দেখে লোকনাথ এগিয়ে গেল। তার কোমল কবজি ধরে তাকে রাস্তা পারাবারে সাহায্য করল, অতঃপর তারা দুইজন আবার যাত্রা শুরু করল। তারপর থেকে ভোলানাথ, লোকনাথের সাথে আর কথা বলছিল না। তার মধ্যে ছিল চাপা ক্ষোভ। যখন তারা বড় মঠের মন্দিরে গিয়ে পৌঁছুল তখন ভোলানাথ মুখ খুলল, 'তুমি জান সন্যাসিদের নারীকুল থেকে তফাতে থাকতে হয়, বিশেষত অল্পবয়স্কা যুবতী হলেত তা ভীষণ অন্যায়। তারপরেও তুমি কেন ওই কাজটি করতে গিয়েছিলে?'... হেসে উত্তর করে লোকনাথ, 'ও ওই মেয়েটি? আমিত তাকে কবেই রেখে এসেছি...আর তুমি যে তাকে এখনও বহন করে চলছ' (পাওলো কোয়েলহোর ক্ষুদে গল্প, 'দ্যা মাডি রোড' এর ভাবানুবাদ)
মি নামে আমার এক জাপানী বন্ধু যে ছিল একজন অর্থনীতিবিদ, একবার তার সারা জীবনের সকল শিখন ও অর্জন বিসর্জন দিতে মনঃস্থ করল শুধুমাত্র পেইন্টিং আত্মস্থ করার জন্য। বছরের পর বছর ধরে সে পেইন্টিং এ সুদক্ষ আর্টিস্ট ও মাস্টার খোঁজতে থাকল যতক্ষন না এক তিব্বেতিয়ান মহান শিল্পীর সাক্ষাত না পেল। এই শিল্পী ছিলেন অতন্ত্য মশুর বিশেষ করে মিনিয়েচারে বিশেষজ্ঞ সেইসাথে অত্যন্ত দরিদ্র। মি পাকাপাকি ভাবে জাপান ত্যাগ করে এই শিক্ষকের সাথে তিব্বতের পাহাড়ের চুড়ায় থাকা শুরু করল। মি’র এই শিক্ষা জীবনের প্রথম বর্ষের শেষের দিকে সে কয়দিনের জন্য জাপান গেল ও এক স্যুটকেস গিফট নিয়ে ফিরে আসল। এই সব সামগ্রী দেখে মাস্টার কাঁদতে শুরু করল এবং মি’কে তার বাড়ি আসতে নিষেধ করল। সে কাঁতর কণ্ঠে বলল, ‘তোমার ফিরে আসার আগে আমাদের সম্পর্ক ছিল সমতার ও ভালবাসার। তোমাকে দিয়েছিলাম থাকার জায়গা, খাবার আর পেইন্টিং। এখন তুমি এইসব উপহার এনে আমাদের মাঝে সামাজিক দেয়াল তুলে দিলে। এই দেয়াল যতক্ষন থাকবে তুমি ততক্ষণ শিল্পের স্বত্বাকে অনুধাবন করতে পারবে না, শিল্পের কাছে আত্বসমর্পন করতে পারবে না’। (পাওলো কোয়েলহোর ক্ষুদে গল্প, দ্যা রং গিফট এর ভাবানুবাদ)
একজন সুতার ও তার শিক্ষানবিস শিষ্যরা এক রাজ্যে ভ্রমন করতেছিল এবং নির্মান সামগ্রী খুজতেছিল। তারা একটা বিশাল বৃক্ষ দেখতে পেল। বৃক্ষটি এতই বিশাল ছিল যে তারা পাঁচ জনে পরস্পর হাত ধরে গাছে পরিধিকে অতিক্রম করতে পারল না, অন্যদিকে গাছটি দৈর্ঘ্যেও ছিল আকাশচুম্বী যার শীর্ষদেশ প্রায় মেঘের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
‘বাদ দাও, আমাদের আর এটার পেছনে সময় নষ্ট করা উচিৎ হবে না’ বলল প্রধান সুতার। ‘একে কেতে ফেলতে আমাদের সারা জীবন লেগে যাবে; উপরন্তু এটি তেমন কিছু করা যাবে না। যদি এর গুড়িটি দিয়ে জাহাজ বানাই তবে তা অত্যধিক ভরে ডুবে যাবে আবার যদি একে ব্যবহার করে ছাদ বানাই তবে তার ভার বহনের জন্য দেয়ালকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী করতে হবে’।
যাত্রীদল চলা পুনরায় শুরু করল। ‘এত বড় বৃক্ষ, অথচ কোন কোন কাজেই আসবে না’ এক শিক্ষানবিসের চোখে মুখে বিস্ময় দেখা যায়। ‘এই সিদ্ধান্তে তুমি একেবারে বেঠিক’ মন্তব্য করে প্রধান সুতার। ‘বৃক্ষটি তার গন্তব্যের পথে সফলভাবে ধাবমান। বৃক্ষটি তার লক্ষ্য চিনে নিয়েছে, যদি সে সাধারণ কোন বৃক্ষের মতই হতো তবে আমরা তাকে কেটে ফেলতাম, কিন্তু এখন তার বিশালতার কারনে তথা অন্যরকম হবার কারনেই সে জীবিত থেকে গেল’ (পাওলো কোয়েলহোর ক্ষুদে গল্প, দ্যা জায়ান্ট ট্রি এর ভাবানুবাদ)
নাসরুদ্দিন একবার এক গুহার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে ভেতরে এক যোগী সাধককে গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখতে পেল। সে সাধককে জিজ্ঞেস করল সে আসলে কিসের উদ্দেশ্যে ধ্যানমগ্ন। সাধক তাকে বলল, ‘আমি প্রাণীর আচারন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছি এবং ইতোমধ্যে এমন কিছু আচারন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেছি যেগুলো মানুষের জীবনে স্থানান্তরযোগ্য’
‘একটা মাছ একবার আমার জীবন বাঁচিয়েছিল’ নাসরুদ্দিন জবাব দেয়। ‘সেই ঘটনাটা আমি তোমাকে বলব, যদি তুমি যা আয়ত্ব করেছ তা আমাকে শেখাও তবে’
সাধক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায়; একজন পবিত্র ধার্মিক ব্যক্তিরই কেবল কোন মাছের দ্বারা জীবন রক্ষা পেতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নেয় নাসরুদ্দিনকে সব শেখাবে।
অর্জিত সকল বিদ্যা নাসরুদ্দিনকে শেখানোর পর সাধক বলল, ‘এখন আমি যা কিছু শিখেছিলাম সব তোমাকে শিখায়ে দিয়েছি। এখন মাছটা কিভাবে তোমার জীবন বাঁচিয়েছিল তা জানালে কৃতার্থ হব’
‘খুব সোজা’ নাসরুদ্দিনের ঝটপট উত্তর। ‘আমি যখন মাছটি ধরলাম তখন আমি ছিলাম ক্ষুধায় মৃতপ্রায়, ওই মাছটিকে ধন্যবাদ, সে আমার তিন দিনের খাবারের যোগান দিয়েছিল’ (পাওলো কোয়েলহোর ক্ষুদে গল্প, দ্যা ফিশ হো সেইভড মাই লাইফ এর ভাবানুবাদ)
বাবাটি পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার ছোট্ট ছেলেটি তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতেছিল। অবশেষে বাবা একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেল, সে একটি পত্রিকার পাতা ছিঁড়ে পৃথিবীর মানচিত্র আঁকল এবং কয়েক টুকরা করে ছেলেটির হাতে দিল। ‘নাও, তোমার করার জন্য আমি কিছু একটা পেয়েছি। আমি তোমাকে একটি পৃথিবীর মানচিত্র দিয়েছি। একে ঠিকঠাক জোড়া দিয়ে আমার কাছে নিয়ে আস’
মানচিত্র জোড়া দিতে ছেলেটির সারাদিন লেগে যাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সে আবার পত্রিকা পড়া শুরু করল। কিন্তু মাত্র ১৫ মিনিট বাদে ছেলেটি মানচিত্র হাতে ফিরে আসল। বাবা যারপরনাই অবাক, ‘তোমার আম্মু কি তোমাকে ভূগোল শিখিয়েছিল?’ সামান্য দ্বিধাগ্রস্থ ছেলেটি উত্তর দেয়। ‘আসলে আমি জানিনা কি করেছি। মানচিত্রের উল্টা পীঠে একজন মানুষের ছবি আছে, আমি শুধু ওই মানুষকে জোড়া দিয়েছি আর একইসাথে উল্টা পিঠের পৃথিবীটাকেও এক করতে পেরেছি’। (পাওলো কোয়েলহোর ক্ষুদে গল্প, রিবিল্ডিং দ্যা ওয়ার্ল্ড এর ভাবানুবাদ)
মৃত্যুর অব্যবহিত পরক্ষনেই জয়ান নিজেকে খুবই অভিজাত জায়গায় আবিষ্কার করল। যেখানে ছিল সকল ধরণের সুবিধা ও সৌন্দর্য যা এতদিন শুধু পাওয়ার কল্পনাই করত সে। সাদা পোশাকধারী একজন ওস্ব তাকে বলে গেল ‘এখানকার যাবতীয় সকল কিছুর উপরেই আপনার অধিকার, আপনার ইচ্ছামত আপনি খাদ্য, পানীয়, আনন্দ সবকিছু গ্রহন করতে পারেন’
বিষ্ময়াভুত জয়ান সব কিছুই উপভোগ করল যা সারাজীবন সে কল্পনাই করে আসছিল। কয়েক বছর আনন্দ উপভোগের পর সে ক্লান্ত হয়ে সাদা পোশাকধারীকে বলল, ‘আমি যা চেয়েছিলাম তার সবকিছুই উপভোগ হয়ে গেছে। এখন এসবকে অর্থবহ ও বেশি উপভোগ্য করতে আমি কোন কাজ করতে চাচ্ছি’
‘আমি খুব দুঃখিত’ বলল সাদা পোশাকধারী, ‘এখানে সবই পাবেন, শুধু এই সুবিধা পূরণের ব্যবস্থা এখানে নেই’
‘কি সাংঘাতিক’ জয়ান বিরক্তের সাথে জবাব দেয় ‘তাহলে কি আমি শুধুমাত্র বিছানায় বসে এই অন্তহীন সময় কাটাব? এর চেয়ে নরকইত ঢের ভাল’
সাদা পোশাকধারী তৎক্ষণাৎ গলা নিচু করে জয়ানের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তাছাড়া আপনি কোথায় আছেন বলে আপনার মনে হচ্ছে?’ (পাওলো কোয়েলহোর ক্ষুদে গল্প, আই উড রেদার বি ইন হেল এর ভাবানুবাদ)
ভাবানুবাদঃ
সোয়াদ আহমেদ
মন্তব্য
দারুণ! দারুণ! চারপাশের কত মানুষকে যে ব্যাখ্যা করা যায় এই লাইনটি দিয়ে!
'দ্য ফিস হু সেইভড মাই লাইফ' কি মৌলিক (যেহেতু নাসরুদ্দিনের কাহিনি রয়েছে)?
অসাধারণ সব গল্প, অসাধারণ সব মেসেজ, আর তার অসাধারণ অনুবাদ। সবচেয়ে ভাল লেগেছে 'রিবিল্ডিং দ্য ওয়ার্ল্ড'!
সোয়াদ আহমেদকে অনেক অনেক ধন্যবাদ নতুন বছরের প্রথম দিনে এমন কিছু দুর্ধর্ষ ,চিত্তাকর্ষক ও চিন্তাদোলক গল্প উপহার দেয়ার জন্য। আরও অনুবাদ পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকলাম।
অশেষ ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।
প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে ভালো হয়েছে।
"এক বিশাল বৃক্ষ" গল্পটা খেয়াল করুণ। ভাষায় আরো যত্নবান হতে হবে। গল্পটাই বোঝা যাচ্ছে না।
কোথাও লিখছেন "করতেছিলো" আবার কোথাও "করছিলো", এই ব্যাপারগুলো দূর করতে হবে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ।
সোয়াদ আহমেদ
অনুবাদ ভালো হয়েছে। উপরে স্পর্শ ভাই যেমন বলেছে, "করতেছিলো" আবার কোথাও "করছিলো", এই ব্যাপারগুলো দূর করতে হবে। আমি যদিও বানানবিদ নই, কিন্তু "ন" আর "ণ" তে অনেক গড়মিল দেখছি, উদাহরণঃ ভ্রমন>নির্মান>কারনে>আচারন>গ্রহন। "আয়ত্ব", "আত্বসমর্পন" বানান দুটিও মনে হয় ভুল। অভ্রের একটা স্পেল চেকার আছে, অনেক কাজের।
অশেষ ধন্যবাদ।
বানানের বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখব।
অনেক ধন্যবাদ।
বানান সতর্কতা আবশ্যক।
ভালো থাকুন।
- ওস্ব মানে কী? এটা কি বাংলা শব্দ?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ওস্ব শব্দটা ভুলে কোনভাবে এসেছে। আমি পরে খেয়াল করেছি।
ধন্যবাদ।
সোয়াদ আহমেদ
অশেষ ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।
পাওলো কয়েলহো ভালু পাই। অনুবাদ ভাল্লাগসে। চলুক।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
অশেষ ধন্যবাদ
গল্পের মেসেজগুলা ভালো লাগল, গল্প ভালো লাগল, অনুবাদ ভালো লাগল। প্রথমটি সবচেয়ে বেশী ভালো লাগল
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অশেষ ধন্যবাদ
অশেষ ধন্যবাদ।
কোহেলহ, আমার খুব প্রিয় লেখক। প্রায়, সব কটি উপন্যাস পড়েছি। ছোট গল্প পড়া হয়নি। পড়তে পেরে আনন্দিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ।
অশেষ ধন্যবাদ।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
অশেষ ধন্যবাদ
গল্পগুলো চমৎকার। অনুবাদ কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট। বানানের ব্যাপারে আরেকটু সতর্কতা অবলম্বন করবেন আর সাধু-চলিত ভাষার ব্যাপারেও একটু খেয়াল রাখবেন। লেখালেখি চলুক।
ফারাসাত
নতুন মন্তব্য করুন