এই কংক্রিটের ঢিপিগুলোতে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হয়। যেই না পথে পা বাড়ানো হয়, একটা অনুভূতি হয়। পথটা বুক পেতে দিয়েছে। দালানগুলো শোষক শ্রেণী; নিষ্ঠুর রাজা। আর পথগুলো প্রজা। খানাখন্দে জল নিয়ে যেন মলিন কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে শত শত গলি। মনটা বরাবরের মতই ধুলোমাখা কিন্তু সরল সোজা। কপট রাজার সাথে প্রজার এটাই পার্থক্য।
পথকে আপন মনে হয়। কাল থেকে পৌষ শুরু হলো। পাতাঝরার দিন। পুষ্পবৃষ্টির দাবি করিনা। খুব ভোরে শহরের একটা নির্জন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেছি। গাছ ছিল তার দুইপাশে। পাতাগুলো রাশি রাশি ঝরে পড়লো আমার উপর, রাস্তার উপর। সেই দৃশ্য ভোলার না। এই শুকনো পাতাগুলোর দাবীদার একমাত্র আমরা রাস্তার মানুষেরা আর ঐ রাস্তাটা। এই অঞ্জলি পেয়েই তো আমরা পুষ্ট হই। মনটাকে তখন রাজা বানিয়ে দেই। উদার রাজা।
রাস্তার মোড়ে কতগুলা কুকুরছানা খেলে, লাফালাফি করে। এতো অবোধ উচ্ছ্বাস দেখে আমি স্নেহের হাসি হাসি। আমাকে দেখলে দৌড়ে ছুটে আসে। হাত বাড়িয়ে আদর করতে গেলে দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চায়। হাতে খাবার আছে মনে করে বারবার বড় বড় চোখে চায়। আমি শুধু আদরটুকু দিয়েই হাঁটতে থাকি। পিছু ফিরে দেখি- নির্বিকার তাকিয়ে আছে। ওরা আশা ছাড়েনি।
একটা বড় কুকুর দেখছিলাম। একচামচ খাবারের জন্য শিশুর মত অবোধ চাহনি, দুই পা গুটিয়ে বসে আছে। দেখেই কেন জানি ভাবলাম- এ বড় হয়নি। এ এখনও ওর কুকুরপরিবারে, বন্ধুমহলে হাসির পাত্র হয়- বড় হয়েও শিশুমনটা ধরে রাখার অন্যায়ে। আসলেই কি অন্যায়!
তেমনি কতগুলা মানুষ আছে বড় হয়েও ছোট থেকে যায়। একটু অবুঝ, একটু মিশেল, একটু বেশি অভিমানি। একটু অপরিপক্ক। সবাই ওদের দেখতে না পারলেও কিছু কিছু মানুষ ওদের ভালোবাসে। এই ইটের শহরে কিছু মাটির মানুষ আছে যারা ঐ অবুঝদের ভালোবাসে। কম কি!
শহরতলী ষ্টেশনটাকে ভালোবাসি। চিরযুবা রেলের পাতগুলোকে, পাথরের টুকরোগুলোকে মনে মনে কি বলি নিজেও জানিনা। দুই প্লাটফর্মের মাঝখানের আকাশে তারা দেখি ঘাড় উঁচু করে। ৩টাকা দামের অস্বাস্থ্যকর পাঁপড় হাতে আমি পুরো প্লাটফর্ম চক্কর দেই। যে বোঝে না তাকে বোঝানো যাবেনা। দুনিয়ার ভেতর এটা আরেক দুনিয়া। একমুহূর্তে ভিড়, পরক্ষনেই নির্জন...... এই খেলা চলছেই......
টিএসসি’র পাঁচ টাকার চা, মধুর ক্যান্টিনের পাঁচ টাকার ডালপুরি- পথিকের রাজভোগ। বড় বড় বই পড়িনি, আকাট মূর্খ। কিন্তু প্রতিরাতে শহরের রাস্তায়, একটু দূর্বাঘাসে যে পাঠশালা বসে- সেই শিক্ষাটাই বা কম কিসে! মাঝে মাঝে স্ট্রিটলাইট আর চাঁদের মাঝে ফারাক খুঁজে পাইনা। আমি এতোটা সম্মোহিত হতে চাই এই রাস্তার বুকে যেন শীতের কাঁপনেও আমার ভাবান্তর না হয়। এই শহর তো আমাকে আধুনিক বানাতে পারেনি। আমাকে সাধারণ বানিয়েছে। পথের মলিনতা দিয়ে আমার অন্তরের মলিনতা মুছে দিয়েছে।
গভীর রাতে শহরের গাছেঘেরা জায়গায় হয়তো বিভূতিভূষণ হাঁটতে বের হন। আরেকটা উপন্যাস লিখতে বসেন হয়তো পার্কের বেঞ্চে বসে। যেই উপন্যাস ছাপানো হবেনা, বইমেলায় বিক্রি হবেনা। কিন্তু আমি দেখতে পাবো। রাতের চাঁদে, শিশিরের বিন্দুতে, বাতাসের অণুতে, পাতার বুকে ওগুলো লেখা থাকবে। কে জানে! হয়তো একরাতে নির্জনে তাঁকে দেখেও ফেলতে পারি। আবদার করে বসবো- আমার মনটা তো আপনার জানা। আমাকে দ্বিতীয় অপু বানিয়ে একটা ছোটগল্প লিখে দেবেন তো?
উনি হয়তো শুধু হাসবেন। কোন কথা না বলে আবার লেখায় মন দেবেন। আমি পাশে বসে সম্মোহিত হবো। এর চেয়ে বড় পাঠশালা, এর চেয়ে বড় শিক্ষক কি আর কেউ হতে পারে!!
শহরটা শুয়ে আছে বুক পেতে। ওর উদার বুকে শত শত বৃদ্ধা মা হাঁটছে খালি পায়ে। সকাল থেকে রাত অব্দি। ছেঁড়া কাপড়, মাথায় এখনও পুরনো অভ্যাসের ঘোমটা। দোকানে দোকানে ঘুরছে একটু খাবার পেতে। না, ওরা ক্লান্ত হয়না। শহরের নগ্ন বুক ওদের খোলা পাদুটোকে আগলে রেখেছে। কিছুতেই ফোস্কা পরতে দেবেনা।
মনখারাপের সময়েও আমি হেঁটে চলবো কোনো গলি ধরে। সব কথা তো বলতে পারিনা! অক্ষমতা আমার। কিন্তু পথ বুঝে নেয়। শহর বুঝে নেয়।।
যাক! আমার তবে আর কথা বলতে হবেনা। চোখে খানিক জল আর মুখে হাসি নিয়ে আমি বরং হাঁটতে থাকি। ঐতো আবার ভোর হয়েছে। সূর্যস্নান সারতে হবে। আবার হাঁটতে হবে। শহরের বুকে.........
মন্তব্য
নাম কই?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
নতুন মন্তব্য করুন