বেশ কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের একজন বর্ষীয়ান লেখক সহ আরো কয়েকজন লেখক-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ঢাকার একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বাংলা সাহিত্যের একটা সম্মেলনে যেখানে বাংলাদেশী লেখকদেরই প্রাধাণ্য ছিল মূলতঃ। হোটেলে উনাদেরকে উঠিয়ে সব গোছগাছের পর বর্ষীয়ান লেখক জানতে চাইলেন এই সাহিত্য সম্মেলন কী এবং কেন (যদিও এটা উনাদের সবাইকে আমন্ত্রনের সময়ই বলা হয়েছে)। আমি কাঁপা কাঁপা বুকে শুধু এটুকু আবারো বলতে পারলাম যে এই সাহিত্য সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য খুব সরলঃ একটি ইংরেজী-মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে ক্লাসে পাঠদান থেকে শুরু করে, পরীক্ষা, শ্রেণীকক্ষের বাইরের বেশীরভাগ এ্যাকাডেমিক আলোচনা বা সেমিনার ইংরেজীতে হয়, সেখানে বাংলাকে সাহিত্যের ভেতর দিয়ে একটু উস্কে দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। মনে এই দুঃসাহসিক আশাটুকুও ছিল যে বাংলা হয়ত একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেও একটু জায়গা করে নেবে। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে গল্প-কবিতার আলোচনার মদিরার পানপাত্রটুকু যাতে বাংলা হয়-এই সামান্যটুকুই চাওয়া। এর বেশী চাইতে সাহস হয়না। বর্ষীয়ান লেখক গ্লাস থেকে পানি খেলেন ঢকঢক করে, ধুতির খোঁটে মুখ মুছলেন, প্রায়-অভিব্যাক্তিহীন গলায় বললেন, “উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু কথাটা হচ্ছে তুমি বাংলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব না বাড়াতে পারলে তোমার এই উদ্দেশ্য শুধু ভালোই থেকে যাবে। কেজো কিছু হবেনা।”
কী কঠিন অথচ কী ভীষণ সত্য কথা।
এ প্রসঙ্গে আর একটু বলিঃ কিছুদিন আগে আমার ইংরেজী স্কুল-পড়ুয়া এক ছাত্রী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পটির একটি লাইন “প্রদীপের ঘুমের পাতলা সরের ঊপর টুপটাপ ঝরে পড়ে ভোরের শিশির” পড়ে অভিভূত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “স্যার বাংলায় এত্তো সুন্দর গল্প লেখা হয়?” আমি লজ্জায় পড়ে যাই। পাঠক, আপনিও কী একটু লজ্জা পেলেন এই ভেবে যে আমাদের ইংরেজী-মাধ্যমের শিক্ষার পাঠ্যসূচীতে কেন আমরা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মানটুকুকেও চেনাতে পারি না?” না-কি আপনি স্মার্টলি বলবেন, “ওয়েল, শুধু পাঠ্যবই পড়লে তো হবেনা। এর বাইরেও পড়তে হবে। একটা রিডিং হ্যাবিট গড়ে তুলতে হবে। তবেই না...”
ওয়েল, পাঠক, আপনি যদি এরকম একটি মন্তব্য করেন, আপনার সাথে পুরোপুরি একমত হয়েও আমি পুনশ্চঃ তে বলব যে অবশ্যই শুধু পাঠ্যবই যথেষ্ঠ নয়; কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর পাঠরুচি তৈরীকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাক্তিগত পাঠাভ্যাসের উপর চাপিয়ে দেয়া শুধু দায় এড়ানোই নয়, খুব নির্লজ্জভাবে দায় এড়ানো।
ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে সেমিনার বা আলোচনা অনুষ্ঠানগুলো করে থাকে তার বেশীর ভাগই ইংরেজী ভাষায়। আমি ইংরেজী-বিরোধী নই; এই অসম ‘বিশ্বায়নের’ যুগে, ইংরেজী শুধু একটা ভাষা নয়, একটা অস্ত্রও বটে, টিকে থাকার। এসব কথা বড় বড় উত্তর-উপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা বলেছেন আরো বলিষ্ঠভাবে। আমি শুধু এটুকু ভয় পাই যে ইংরেজীর ব্যাঘ্র-পরিবেষ্টিত শিকারী জঙ্গলে বাংলা যাতে শুধু একটি হরিণ শাবক না হয়ে যায়। অথচ তাই হচ্ছে। যেভাবে এগুচ্ছি আমরা তাতে মনে হয় সামনে আরো হবে এবং হতেই থাকবে।
কী করণীয় হতে পারে এক্ষেত্রে? আমার কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। আমি আপনাদের মতামত শোনার পাশাপাশি আমারটা দিতে চাই।
মন্তব্য
১। আপনি ভাষার কথা বলছেন নাকি সাহিত্যের কথা বলছেন? ভাষা আর সাহিত্য এই ধরণের আলোচনায় ভিন্ন বিষয় বলে মনে করি। লেখা থেকে আপনার 'কন্সার্নের' ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি।
২। বাংলাদেশে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার অফিসিয়াল মাধ্যম ইংরেজি, যদিও সেটা খুব কঠোরভাবে মানা হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিকল্প নেই, কিন্তু সেটার জন্যে যথেষ্ট লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকলে সেটাকে বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই দুই-চারজন বিদেশি (নেপালি, তুর্কি, আরও থাকতে পারে) ছাত্র থাকে। সেসব ক্ষেত্রেও দেখেছি বাংলায় পড়ানো হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। এরকম অবস্থায় বাংলায় সেমিনার আয়োজন করা কতটা পলিটিক্যালি কারেক্ট হবে সেটা ভেবে দেখতে হবে। চাইলেও বোধহয় এসব ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের খুব একটা সুযোগ নেই।
৩। বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম এবং সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা পুরা বাংলাদেশের বিশাল স্পেক্ট্রামের খুব ছোট একটা অংশ। তাদের বাংলা সাহিত্যের সাথে পরিচিত করানোটা জরুরী মনে করি। কিন্তু তাদের বাংলার ব্যাপারে উন্নাসিকতা বাংলাকে হরিণ-শাবক বানানোর মত মনে করিনা। তাদের সিলেবাসে বাংলা নামে একটা বিষয় থাকার কথা । সেখানে কী থাকে আমার কোন ধারণা নেই। আলোকিত করুন।
৪। একটু অফটপিকঃ বাংলা মাধ্যমের বিষয়ে আমার একটা কন্সার্ন আছে। আগে ইংরেজি বিষয়ের সিলেবাসে ইংরেজি সাহিত্য তুলে দেয়া হয়েছে। এই ব্যপারাট আমার কাছে খুবই দুঃখজনক লেগেছে।
৫। লেখকের নাম কই!
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
১। মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি মূলতঃ ভাষার কথাই বলেছি। আর সাহিত্যের কথা এসেছে ভাষা চর্চার একটা গতিশীল মাধ্যম হিসেবে। তবে মানছি যে এ ধরণের আলোচনায় দু’টো বিষয় আলাদা রাখলে ফোকাসটা পরিষ্কার থাকে।
২ ও ৩। আমার উদ্বেগটা ভাষার এই ‘অফিসিয়াল’ মাধ্যম নিয়েই। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম কেন ইংরেজী হবে এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হচ্ছে ইংরেজির আন্তর্জাতিক গুরুত্ত্ব যেটা বাংলার অনেক কম এবং প্রায় ক্ষেত্রে প্রায় নেই বললেই চলে। আমার প্রশ্নটা ছিল কীভাবে এই অবস্থায় বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করা যায় (একমাত্র না হলেও)। এই উদ্বেগের কারণ হচ্ছে একটা ভাষাকে উচ্চশিক্ষা থেকে সরিয়ে দেয়ার মানেই হচ্ছে সেই ভাষার প্রকাশক্ষমতাকে একটা আলোকিত গণ্ডীর বাইরে বের করে দেয়া। যার মধ্যে আছে চিন্তা, ভাব বিনিময়, লেখা, গবেষণা। কাজেই বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমের সাথে সরাসরি যুক্ত করতে না পারলে বাংলা হয়ে থাকবে শুধুই মুখের ভাষা (আমি স্বাধীন চিন্তা, লেখালেখির কথা বলছিনা)। তবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ইংরেজী মাধ্যম থাকতে পারে; একটা দেশের মূলধারার উচ্চশিক্ষার ভাষার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই শুধু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে নেয়া হয়না। আর হরিণ শাবকের কথা বলেছি ইংরেজীর দাপুটে পদচারণায় উচ্চ-শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলার এই অপ সৃয়মাণ ছায়ার কারণে।
এটা সত্য যে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ইংরেজী মাধ্যম খুব ছোট একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে সেখানে বাংলা নামে যেটা থাকে সেটা শুধুই নাম-মাত্র বাংলা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে ইংরেজী মাধ্যমের অনেক শিক্ষার্থীই এখনো বাংলায় লিখতে গেলে লেখে সাধু বাংলায়। আমার পরিচিত এক শিক্ষার্থী তার একটি রচনায় লিখেছে, “সমুদ্রের তীর হইতে মধুর বাতাস বহিতেছিল। আর উহা খাইতে বড়ই মজা লাগিতেছিল।”
৪। ইংরেজী সাহিত্য তুলে দেয়াটা খুব বড় ভুল বলে আমি মনে করি। কোন ভাষাই সাহিত্য ছাড়া ভালোভাবে শেখা যায়না।
৫। লেখকের নাম রাজীব মাহমুদ।
আপনি সচলায়তনে নিবন্ধন করেছেন কি? না করে থাকলে, করে ফেলুন।
কিছু একটা ভুল হচ্ছে কোথাও। আমার মন্তব্য কেটে যাচ্ছে। পুরোপুরি আসছে না। দুঃক্ষিত সেজন্য।
নিবন্ধন করেছি। এখন সব ঠিকঠাকই দেখাচ্ছে। ধন্যবাদ।
লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ নয়। আপনি মতামতগুলো একই সঙ্গে দিয়ে দিলে পারতেন, পাঠকেরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারত।
ঠিকই ধরেছেন। লেখাটা সম্পূর্ণ নয়। এগুলো কিছু অসম্পূর্ণ চিন্তার বুদ্বুদ। ভেবেছিলাম নিজের মতামতগুলো একেবারে না দিয়ে আপনাদের সবার একেকটা মত শুনে সেই প্রেক্ষিতে আমারটা দিব। টিপিক্যাল রচনা টাইপ কিছু না লিখে একটা ইন্টারেক্টিভ ডায়ালগ শুরূর ইচ্ছা ছিল। যাই হোক, ওভাবে যেহেতু হলনা, আমি বড় একটা লেখা হিসেবেই চিন্তাগুলোকে প্রকাশ করব অচিরেই। আপাততঃ এই লেখার মতামত অংশে বলতে চাই যে আমি মনে করি বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে একটা জায়গা করে নেয়ার জন্য ইংরেজির সাথে কোয়ালিশনে আসতে দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ যেহেতু এই ‘বিশ্বায়নের’ যুগে পুরোপুরি বাংলা মাধ্যমে আমরা আপাততঃ যেতে পারছিনা, সেহেতু ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকেও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করা যেতে পারে। পঠিত বিষয়ের কিছু অংশ বাংলায় আর কিছু অংশ শিক্ষার্থীরা ইংরেজীতে পড়বে। এর পাশাপাশি থাকবে দু’টি ভাষায়ই দক্ষতা অর্জনের জন্য আলাদা আলাদা কোর্স। এতে করে বিশ্বায়নের ভাষা ইংরেজীর সাথে সাথে মাতৃভাষায় চিন্তা, ভাব বিনিময়, পরীক্ষায় অংশগ্রহন, গবেষনার মাধ্যমে ভাষাটা পুরোদুস্তর চর্চিত হবে, একটা এ্যাকাডেমিক ভাষা হিসেবে ডালপালা নিয়ে বেড়ে উঠবে। আর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে থাকলে যথারীতে আমরা পাব ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব সহ অন্য সব বিষয়ের উপর নিয়মিত গবেষণা-গ্রন্থ। তখন বাংলা শুধুই মুখের ভাষা হিসেবে নয়, মাথা উঁচু করে টিকে থাকবে এ্যকাডেমিক লেখালেখি এবং গবেষণার ভাষা হিসেবে।
উত্তর-উপনিবেশীক অনেক দেশই এখন (যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা)তাদের মাতৃভাষাকে ইংরেজীর পাশাপাশি টিকিয়ে রাখার জন্য উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এরকম বাইলিঙ্গুয়াল পলিসি প্রণয়নের কথা ভাবছে। আমি মনে করি এটা খুব আদর্শ অবস্থা না হলেও একটা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। আমি আরও মনে করি এটা একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় যার সম্পর্কে ভাবার সময় এসেছে। এ বিষয়ে সচলের সচল এবং অতিথিদের সবার মত শুনতে চাই। শুভকামনা। সবাই ভালো থাকবেন।
যেখানে সেখানে ইংরেজি শব্দের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এড়ানো দরকার।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এখানে শুধু একটিই ইংরেজী শব্দ যা সচেতনভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে স্বতস্ফূর্ত একটা কথনভঙ্গী তৈরীর চেষ্টা হিসেবে। কিছুটা শ্লেষও ছিল বটে এই ভঙ্গীটির প্রতি। ইংরেজি শব্দ হিসেবে শব্দটাকে ব্যবহার করা হয়নি। অনেক পাঠকই হয়ত সেটা ধরতে পেরেছেন। অতএব এটাকে বোধহয় যেখানে সেখানে ব্যবহার বলা যায় না। আর অপ্রয়োজনীয় তো নয়-ই। অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন