আবদুশ শাকুর চলে গেলেন, বড্ড আগেই। অনেক কিছু দেবার বাকি ছিল, বলার বাকি ছিল তাঁর। তাঁকে নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি বা উপলদ্ধি এখানে সাজাবার চেষ্টা করেছি মাত্র।
নাতনি শুমাইসার সাথে
১
তাঁর "বাঙালির মুক্তির গান" বইটির নতুন এক সংস্করণ বেরুবে কলকাতার প্রতিভাস প্রকাশনা থেকে। এটিসহ আরো ছয়টি বইয়ের কাজ নিয়ে তখন তিনি মহা ব্যস্ত। এমন এক সময় হঠাৎ রাত এগারোটার দিকে ফোন দিলেন আমাকে, খুব রাত জাগতেন কিনা, জেগে লেখা ও পড়ার কাজ করতেন। তো, ফোন ধরতেই বললেন : "দিগন্ত, একটা সাহায্য লাগবে যে। তোমাদের প্রিয় কিছু দেশাত্মবোধক লিরিকের রক বা মেটাল ধাঁচের গান আমাকে পাঠাতে পারো? আমার বইতে আগে জেমসের গান, ফিডব্যাক ও রেনেসাঁ ব্যান্ডের গান শুধু এসেছে। হালের দুটি-তিনটি ব্যান্ডের গান শুনে লিরিক অন্তর্ভুক্ত করতে চাই এই এডিশানে।" আমি জানতাম, তিনি বিরাট উদার মনের মানুষ। অন্যান্য সিনিয়ার সংগীতজ্ঞরা যেখানে রক-মেটালের নাম বা গন্ধ পেলেই দূরদূর করে তাড়িয়ে দেন, নাক সিঁটকান, সেখানে আবদুশ শাকুর তাঁদের আমলের থেকে যেকোনোরকম ভিন্ন ধাঁচের মিউজিককে উৎসাহ যোগান, ব্যান্ডদলগুলোর লিরিকের গভীরতা ও নতুনত্বের প্রশংসা করেন। আমি পরে তাঁকে ওয়ারফেইজ ও ক্রিপটিক ফেইটের তিনটি তিনটি করে গান পাঠাই। এসবের মধ্যে থেকে ওয়ারফেইজের "স্বাধীকার" ও ক্রিপটিক ফেইটের "বিদায়" - এই গান দুটির লিরিক তিনি তাঁর বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণে গ্রন্থনার জন্য বেছে নিয়েছিলেন পরে।
২
অনুজদের লেখা পড়ার বেলায় তাঁর আগ্রহ ছিল অনেক। নিয়মিতই বলতেন ফোনে, শাহাদুজ্জামানের নতুন গল্প বা কলামের জন্য মুখিয়ে আছেন। প্রায়ই তাঁর "চিরকুট" পড়ে মেইল করেন। আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প উপন্যাস ব্যক্তিগত রচনা বা প্রবন্ধের অনুরাগী ছিলেন সবসময়, কামাল ভাইয়ের লেখা "কান্নাপর্ব" উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধতা জানিয়েছিলেন বহুবার। আবার, টোকন ঠাকুরের উচ্ছ্বল কোনো কবিতা বা পিয়াস মজিদের চিত্ররূপময় কোনো কবিতা পড়েই বলতেন, এই তো খাঁটি কবিতা, ঋজু, সংক্ষিপ্ত, ঘোর-লাগানো, সুন্দর। ভালোবাসতেন মঈনুস সুলতানের ভ্রমণকাহিনি, রম্যরস ও বৈঠকী জবান ব্যবহারের দিক থেকে তাঁকে মনে করতেন খুবই আপন। ওয়াসি আহমেদের গল্প পছন্দ করতেন খুব, ''কালাশনিকভের গোলাপ'' গল্পটি বিশেষ প্রিয় ছিল তাঁর।
৩
খুব করে বলতেন মীজানুর রহমানের কথা। তাঁর কল্যাণেই আবদুশ শাকুরের সুবিখ্যাত গোলাপনামা গ্রন্থের সূচনা। দ্বিজেন শর্মাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন, তাঁর লেখাও খুব ভালোবাসতেন। আর শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী ও রফিক আজাদ ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি, প্রিয় তিন মানুষ। শহীদ কাদরী তাঁর প্রথম গল্পটি একটি সংকলনে ছাপার ব্যবস্থা করেছিলেনও সেই ষাটের দশকে। বেলাল চৌধুরী ছিলেন তাঁর বৈকালিক আড্ডার নিত্যসঙ্গী। গোলাপ বিষয়ক আবদুশ শাকুরের একটি দীর্ঘ ও অসামান্য সাক্ষাৎকারও তিনি নিয়েছিলেন। রফিক আজাদের তাড়ায় আবার জন্ম হয়েছিল তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্পের। "অসুখ" গল্পটার কথা বারবার মনে পড়ছে আমার। একদিন মনে হয়েছিল, গল্পটার নেপথ্য কাহিনি শোনা দরকার। আবদুশ শাকুরের সাথে আরেক গল্প শুরু হলো ফোনালাপে। ইউরোপের তিন বছরের প্রবাসজীবন থেকে ঢাকায় ফেরার পর একদিন কবি রফিক আজাদ তাঁর বাসায় এসে হাজির, বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকারের জন্য গল্প চাই। আবদুশ শাকুর ইতস্তত বোধ করছিলেন খানিকটা। একে তো প্রবাসে থাকার কারণে অনেকদিন গল্প লেখেন নি, তার ওপর তখন আবদুশ শাকুরের পরিচিতি রম্যরচনাকার হিসেবে উল্টো কিছুটা বেশিই ছড়িয়ে পড়েছিলো। রফিক আজাদকে এসব বলার পরও তিনি গল্প আদায়ের সংকল্পে অটল। আবদুশ শাকুর অবশেষে রাজি হলেন। কয়েকদিন পর তাঁর বাসভবনে রফিক আজাদ ঢুকেই হাঁক ছাড়লেন : "ওস্তাদ! আমার গল্প কই?"(রফিক আজাদ আবদুশ শাকুরকে ওস্তাদ বলেই ডেকেছেন সর্বক্ষণ।) আবদুশ শাকুর কিছুটা থতমত হয়ে বললেন, গল্প তো শেষ করে এনেছি প্রায়, কিন্তু শিরোনামটা এখনও ঠিক করতে পারি নি। রফিক আজাদ তখন প্রস্তাব দিলেন, আপাতত গল্পটা আমাকে দিয়ে দিন, শিরোনামটা না হয় আমিই দিয়ে দেবো। আবদুশ শাকুর দিয়ে দিলেন। গল্পের শেষ লাইনটি ছিলো এমন : "আমরা সবাই আজ অসুস্থ"---এখান থেকেই রফিক আজাদ গল্পটির নামকরণ করলেন "অসুখ"।
গল্পটি বের হবার পর রশীদ করিম আবদুশ শাকুর ও সৈয়দ শামসুল হককে তাঁর তেল কোম্পানির অফিসে একদিন দুপুরে লাঞ্চের জন্যে ডাকলেন। খাওয়াদাওয়া পর্ব সাঙ্গ হবার পর তিনি আবদুশ শাকুরকে বললেন, আপনার এই অসুখ গল্পটি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ চিরায়ত গল্পগুলোর একটি হয়ে রইবে---এ আমার বিশ্বাস। তারপর রশীদ করিম সৈয়দ হককে গল্পটির একটি কপি দিয়ে বললেন, তোমাকে অনুরোধ করছি--- যেন এই গল্পটি অবলম্বন করে একটি স্বতন্ত্র নাটক বা কোনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্ততকৃত নাট্যাংশ প্রচারিত হয় বিটিভিতে। সৈয়দ শামসুল হকের ওপরেই রশীদ করিম সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কারণ তখন সৈয়দ হক বিটিভিতে নানারকম অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন বেশ ভালোভাবেই। যদিও পরে সৈয়দ হক তাঁর নানারকম ব্যস্ততার কারণে দায়িত্বটি অর্পন করেন আরেক সুযোগ্য মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব গোলাম মুস্তাফাকে। পরে তাঁরই নির্দেশনা ও চিত্রনাট্যে গল্পটি অবলম্বনে নির্মিত নাট্যাংশ প্রচারিত হয় একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে। মূখ্য চরিত্রে ছিলেন লাকী ইনাম ও আবদুশ শাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইনামুল হক।
৪
আবদুশ শাকুর প্রতি সপ্তাহেই আজিজ সুপার মার্কেট বা কনকর্ডে যেতেন বই কিনতে। বিদিত, তক্ষশিলা, প্রথমা বা মধ্যমা--এই দোকানগুলো থেকে একাধিক বই কিনতেন নিয়মিত। শুধু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করার জন্যই প্রায় দুইশ'র মতো রবীন্দ্র-সংশ্লিষ্ট বইপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি যেমন অসামান্য এক লেখক ছিলেন, তেমনই ছিলেন অসামান্য একজন পাঠক। তাঁর কল্যাণে আমি নতুন করে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুজতবা আলী, লীলা মজুমদার বা কমলকুমার মজুমদার পড়া শুরু করি। এতে যে আমার কী উপকার হয়েছিল, তা বলে বোঝানো মুশকিল। এবং তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রযুক্তিবান্ধব এক মানুষ। ফেসবুক, ব্লগ থেকে শুরু করে কম্পিউটারের সব ক্রিয়াকর্ম ছিল তাঁর দখলে। নিজের বইয়ের মেক আপ নিজেই দিতেন, ট্রেসিংও বের করে দিতেন নিজের প্রিন্টার থেকে। এমনকি বহু আগের সব লেখাও ওয়ার্ডে তুলে রেখেছিলেন আর্কাইভিংয়ের উদ্দেশ্যে।
৫
ওয়াহিদুল হক(হায়, তিনিও আজ নেই) আবদুশ শাকুরের ''মহান শ্রোতা'' বইটির ফ্ল্যাপে লিখেছিলেন : "শাকুর গানে-গোলাপে-সাহিত্যে এক ঈর্ষণীয় জীবন কাটালেন, কিন্তু দেবার তাঁর অনেকই বাকি রয়ে গেল এখনও।...আমি সারাক্ষণ পথ চলি, সারাক্ষণ পথ হারাই। সম্ভবত দিশা ঠিক থাকে। এইমত বিভ্রমসংকুল তত্রাচ আক্ষেপহীন, এবং পরিণামহীন, একটি মানুষের শুভেচ্ছায় যদি শাকুরের পথচলায় কিছুটাও পাথেয় হয়, তবে আমার অন্তরের সবটা মেলে তাই আমি শাকুরকে দিই।"
সত্যিই, আবদুশ শাকুরের দেবার অনেক বাকি রয়ে গেলো। তাঁর সংগীত বিষয়ক বই " হিন্দুস্তানি যন্ত্রসংগীতের পঞ্চপ্রদীপ", ছয় ঋতু নিয়ে বই "নৈসর্গিক" বা মরমী ও দ্রোহী প্রাচ্যকবিতার ধারা নিয়ে "প্রগতিবাদী প্রাচ্যকাব্য" আর লেখা হলো না। কিন্তু, তিনি যা দিয়ে গেছেন আমাদের, তাই যুগ যুগ ধরে আলো দেবে সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীতের অঞ্চলে।
দুই বছর আগে লিখেছিলেন বইমেলার এক কলামে, "বইজঙ্গল হয়ে উঠছে বইমেলা"। আসন্ন বইমেলার বইজঙ্গলে আপনার বইগুলো থাকবে, থাকবে তিন-চারটি প্রকাশিতব্য বইও(যা তিনি দেখে যেতে পারলেন না), কিন্তু তিনি, আবদুশ শাকুরই রইলেন না। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার বেদনাভারাতুর শ্রদ্ধা।
=======
দিগন্ত
মন্তব্য
চমৎকার স্মৃতিচারণ দিগন্ত। সংক্ষিপ্ত কিন্তু মর্মস্পর্শী। ভালো লাগলো। উনার সম্পর্কে অনেক নতুন কিছু জানাও হল।
-মনি শামিম
আবদুশ শাকুরের রসবোধ ও পরিমিতিবোধ অতুলনীয় ছিলো।
তাঁরই একটি লেখায় তিনি মানুষের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশের পত্রিকাসম্মত ভাষার সমালোচনা করে লিখেছিলেন, মানুষ ইনতেকাল করে না, মুনতাকাল হয়। অসময়ে মুনতাকাল হয়ে তিনি অনেক পাঠককে বঞ্চিত রেখে গেলেন।
আবদুশ শাকুর-কে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই
মন্টা খারাপ হল বড় অসময়ে চলে গেলেন ।
উনাকে জানতাম কিছুটা, আমার এক নিকট আত্মীয়ের বাসায় আডডা দিতে আস্তেন, দূর থেকে দেখেছি, তখন বয়স অল্প ছিল সে জন্যে কাছে ভিড়ার সাহস পাইনি - তাঁর মেয়েদের ও দেখতাম সে বাসায় আসতে । একজন বোধ হয় আশির দশকে বিটিভিতে খবর পড়তেন । দীর্ঘ দিন বিদেশে থাকায় তাঁদের আর কোন খবর জানতাম না ।
অসাধারণ পরিমিতবোধ সম্পন্ন জ্ঞানী একটা মানুষ ছিলেন। অসময়ে চলে গেলেন
কেন যেন উনার পরিমিত কথা বলা খুব ভাল লাগতো। আমি উনাকে প্রথম চিনি গোলাপ বিশেষজ্ঞ হিসেবেই। পরে দেখলুম, উনি তো "একের ভেতর অনেক"।
শ্রদ্ধাবনত....................
_____________________
Give Her Freedom!
ওনার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা।
ছবিটা আপনার তোলা? কী অসাধারণ একটা ছবি।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
খবরটা জানার পর থেকেই মনটা ভারি খারাপ।
বয়সের বিপুল তফাৎ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মত। দেশ ছেড়ে আসার হপ্তাখানেক আগেও আমার বাসায় এসে রাত অব্দি আড্ডা মেরে গিয়েছিলেন। স্বভাব অনুযায়ী হাসিঠাট্টা, হল্যান্ডের স্মৃতিচারণ আর সাহিত্যের আলোচনার পাশাপাশি গানও হয়েছিল। গুণী শিল্পী ছিলেন, অথচ এতটুকু অহঙ্কার ছিল না, হারমোনিয়াম বাগিয়ে ধরলে গান শুরু করে দিতেন। গান শেষ হলে গানটির লেখার ইতিহাস আর রাগবিচার সম্পর্কেও দু’চার কথা জুড়ে দিতেন। আগাপাশতলা পণ্ডিত লোক ছিলেন, বিপুল ছিল তাঁর পাঠপরিধি। কথা বলতেন বিশুদ্ধ সাহিত্যের বাঙলায়, যেমনটা তিনি লিখতেন। শেষদিকে প্রবন্ধ আর রম্যরচনার পাশাপাশি উপন্যাস লেখার প্রতি ঝোঁক পড়েছিল। তাঁর তখনকার সদ্য প্রকাশিত একটি উপন্যাস ছিল আফ্রিকার উপনিবেশবিরোধী তাত্ত্বিক ফ্রানয ফানোঁর ‘রেচেড অভ দ্য আর্থ’–এর তত্ত্বকে ঘিরে, আফসোস করে বলেছিলেন, দেশের সাহিত্য সমালোচকেরা উপন্যাসটিকে বুঝতে পারল না।
বহুদিন যোগাযোগ ছিল না, আজ করব কাল করব করতে করতে কতদিন মেইলও করা হয়নি। বুঝতে পারিনি এভাবে চিরকালের জন্য ফাঁকি দিয়ে চলে যাবেন।
শাকুরের ওপর লিখলেন বলে ভাল লাগল।
নিতান্তই গেরস্ত মানুষ, চারপাশে কেবল
শস্যের ঘ্রাণ পাই।
ছবিটি বড় মায়াভরা!
চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ দিগন্তকে।
এখন তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হবে, যেটা দেখে যেতে পারলে অনেক খুশি হতেন। কেবলমাত্র প্রাবন্ধিক এই ধারণা তাকে নিয়ে অনেকের যার এবার তার শিল্পকর্মের নানাদিক গুলো দেখলে তাদের ভুল ভাঙবে। বেশ ক'বার বলেছিলে দেখা করতে যাওয়ার কথা। কোনো না কাজে আটকে গেছি। হয়ত কিছু কিছু জায়গায় আমাদের কখনো যাওয়া হয় না, আর কিছু যায়গায় সবসময় চলে যেতে হয়
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ওনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আপনার স্মৃতিচারণ খুব সুন্দর হয়েছে।
নতুন মন্তব্য করুন