আইভরি কোস্টে এখন শীত। চারপাশ কেমন যেন শুকিয়ে এসেছে। প্রকৃতি একটু ভিন্ন রঙে নিজেদের সাজিয়ে নেয়ায় ব্যস্ত মনে হল। আসলে খরার দাবদাহে পাতা শুকিয়ে একেবারে চৌচির। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় যেন প্রহর গুনছে শুকনা পাতা, গাছ। এই সময় চারপাশ একটু তামাটে রং ধারণ করে। কেমন জানি হঠাৎ করেই সবুজ থেকে একটু তামাটে।
(১)
( গরুর পাল)
(২)
(একেবারেই তামাটে প্রকৃতি)
নভেম্বরের শেষের দিক থেকেই চারপাশ শুকিয়ে আসতে থাকে। শুকিয়ে আসা মানে কিন্তু একেবারে চারপাশের গাছের পাতাদের ঝড়ে পড়ার ঝনঝন শব্দ। এটা চলবে একেবারে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। সূর্যের প্রখরতার সাথে বাড়তে থাকে এখানকার লাল মাটির লালিমা। হঠাৎ করেই চারপাশ একেবারে লাল হয়ে আসে। এটাকে গাঁড় তামাটে রং বললেও ভুল হয় না। এই লালিমা বেশী চোখে পড়ে কারণ তীব্র সবুজের বুকে হঠাৎ করেই লাল আঁচড়। সেই আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হয় প্রকৃতি। গাছের শাখা থেকে শুরু করে পাতা পর্যন্ত দেখলে মনে হবে যেন কেউ পুড়িয়ে দিয়ে গেছে এদের। যদিও এদের পুড়িয়ে দেয়া খুব সাধারণ একটা ব্যাপার।
(৩)
(পোড়ানো হচ্ছে গাছ আর আগাছা)
তবে তার আগেই রৌদ্রের তাপ এদের সকল রস শুষে নিয়ে গা থেকে খসিয়ে দেয় সবুজের আস্তরণ। সবুজ থেকেই গাছের পাতা হয়ে যায় লাল, ডালপালা শুকিয়ে ধারণ করে বাদামী রং, আর গুল্ম লতিকারা খুব তৃষিত যেন কারো কাছ থেকে পানি পানের অপেক্ষায়। রাস্তার দু পাশ জুড়ে সবুজ আগাছারা মুহূর্তের মধ্যেই বৃক্ষ রাজী তাদের সবুজ খোলস থেকে বেরিয়ে যেন গাঁড় তামাটে রঙে নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
(৪)
(লালচে রঙের চারপাশ)
(৫)
(রাস্তার দু পাশ দিয়েই লালচে বাদামী রঙের সাজ)
এদেশে এই মৌসুমে গাছ থেকে শুরু করে আগাছা পুড়িয়ে মাঠ একেবারে ফাঁকা করে ফেলা খুব সাধারণ একটা রীতি। একেবারে নির্বিচারে চলে আগাছা নিধন। পুড়িয়ে ফেলা হয় আগাছার সাথে অনেক মোটা গাছ। জীবন্ত গাছ পুড়িয়ে এভাবে হত্যা করার দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি। এগুলো পোড়ানোর মূল উদ্দেশ্য হল মাঠ ফাঁকা করে পরবর্তী বছরের ফসল লাগানোর এক পূর্ব প্রস্তুতি। জানুয়ারির শুরু থেকেই চলে এই গুল্ম লতিকা তরুর প্রাণ দাহ। এই সময় রাস্তা দিয়ে গেলে অনেক দূর থেকেই এসব গাছ পোড়ানোর মড় মড় আওয়াজ কানে ভেসে আসবে। মাঠের এক পাশে একটু ধরিয়ে দিলেই হয় তারপর ক্রমেই চলে এই দহনের বিধ্বংসী খেলা। খুব কষ্ট লাগে যখন এভাবে পুড়িয়ে মারতে দেখি অনেক সতেজ তাজা বৃক্ষদের।
(৬)
(পুড়িয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে পাহাড়ের ঢাল)
(৭)
(পোড়ানো গাছ)
প্রায় জমিতেই এসময় ভেসে ওঠে কালো রঙের একটা প্রলেপ। সেই সাথে পুড়ে যাওয়া ছাই মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতি এক রুদ্র মূর্তি ধারণ করে। গাছের মচমচে পাতা মাটিতে পড়ে ঢেকে যায় তামার রঙের আস্তরে আর সেই সাথে ছোপ ছোপ হয়ে লেগে থাকে পুড়ে যাওয়া কালো ছাই।
(৮)
(বাদামী মাটির সাথে কালো ছাইয়ের একাত্মতা)
(৯)
এক ভিন্ন রূপ, এক নতুন রং, ভিন্ন রোদের তাপে যেন ঝলসে যায়।
(১০)
(ঝলসে যাওয়া সবুজ)
(১২)
( সবুজ থেকে তামাটে)
এই সময় উত্তরের দেশ মালির থেকে উড়ে আসতে থাকে লালচে ধূলি। হারমাটান এই সময় অর্থাৎ জানুয়ারি থেকেই শুরু হয় সেখানে। তবে মূল ধূলি ঝড় শুরু হয় জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে। নাকে মাস্ক না লাগিয়ে বাইরে যাবার উপায় থাকে না তখন। চারপাশে শুধু ধুলা আর ধুলা। গাড়িতে গেলে বিশেষ করে যদি জানালা খুলে বাইরের প্রকৃতি দেখে চলতে থাকেন তবে ফিরে এসে চেহারার যে কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি তা আসলেই দেখার মত। চোখের পাতা, গায়ের লোম থেকে শুরু করে সারা শরীর লালচে ধুলোর পাহাড়ের দেখা পাই। তবে ধূলি ঝড়ের এই সময় মনে হবে যেন চারপাশ মেঘে ঢেকে আছে। আসলে এগুলো মেঘ না ভাসমান ধুলা। যে কোন চলার পথেই জমতে থাকে এক ইঞ্চি ধুলার প্রলেপ। পায়ের ছোঁয়ায় উড়তে থাকে লাল পাউডারের মত ধুলা।
(১৩)
(ঝরা পাতা)
(১৪)
(ধুলোমাখা পথ)
সত্যি এক নতুন আইভরি কোস্টকে চেনা যেন নতুন কোন দেশের হঠাতি রংবদল। চারপাশে শুধু বৃষ্টির জন্য হাহাকার। একই সাথে সবুজকে ফেলে আসার এক বেদনার শোকগাথায় যেন গাইছে চারপাশের প্রকৃতি। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকে না এখানকার জীবন ধারা। এর মাঝেও ছুটে চলেছে মানুষের ব্যস্ত জীবন। সেই সকাল বেলা ধুলা মাড়িয়ে ঠিকই চলে গিয়েছে কোন মমতাময়ী মা তার ছোট্ট শিশুটিকে পিঠে পেঁচিয়ে লোহার ঠেলা গাড়ী চালিয়ে জীবিকার সন্ধানে।
(১৫)
( থেমে নেই জীবন)
বাইসাইকেল নিয়ে সন্ধ্যার সান্ধ্য ভোজের তাড়ায় বেশ কিছু লাকড়ি সাইকেল স্ট্যান্ডের পিছনে শক্ত বেঁধে ছুটে চলেছে কোন বাবা তার পরিবারের কাছে অথবা কোন রাখাল বালক ছুটেছে তার গরুর পাল গুলি নিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে। দল বেঁধে ধুলার মাঝে লুটিয়ে পড়তে পিছিয়ে নেই পুরনো সাইকেলে এক সারিতে চালিয়ে যাওয়া আড্ডা বাজের দল।
(১৬)
(ঘরে ফেরার পথে)
(১৭)
( দল বেঁধে ঘরে ফেরা)
জীবন এখানে থেমে নেই। হারমাটানের শ্বাস রুদ্ধকর ধুলা এখানে যেন চিরচেনা এক ধুলোমাখা বাতাস। সুন্দর করে তাকে গায়ে জড়িয়ে সামনের দিকে ছুটে চলেছে মানুষের জীবন। আর সেই সাথেই ফুটে উঠছে নানা রঙের নানা ঢঙে নিজেকে খুব কাছ থেকে অন্যের কাছে দেখিয়ে যাওয়া আইভরি কোস্ট।
(১৮)
(ছোট্ট এক রাখাল বালক)
(১৯)
(তামাটে মাঠের দুরন্তপনা)
(২০)
(ঝরা পাতায় লাল ফুলে শিমুল গাছ)
অমি_বন্যা
মন্তব্য
অনেক ভালো লেখা।অসাধারণ সব ছবি।
ভালো লাগার জন্য এই নাও
ছবিগুলো রুক্ষ আর আদিমতাকে সত্যিকার অর্থেই ফুটিয়ে তুলেছে। আশা করি প্রকৃতি আবার সবুজে ঢেকে যাওয়ার আগেই আপনি হাচল হয়ে যাবেন। আরো আসুক আইভরি কোস্টের প্রকৃতি, মানুষ, বন্যপ্রাণী, সংস্কৃতি আর জীবনধারা নিয়ে পোস্ট।
ফারাসাত
ফারাসাত ভাই, হাচল হই আর নাই হই লিখে যাবো। আর আইভরি কোস্টের খুঁটিনাটি বিষয় ফুটিয়ে তোলা, সেগুলো নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। ভালো থাকবেন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
আগের গুলোর ও পড়েছি! ব্যস্ততায় জানান দিতে পারিনি। এবার দিয়ে গেলাম; আপনার হাচালত্বের অপেক্ষায় আছি এখনো ।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ধন্যবাদ ক্রেসিডা। অনেকদিন পর আওয়াজ দিলেন। আপনার কবিতা কই?
আহা ! দারুণ সব ছবি আর বর্ণন।
ধন্যবাদ প্রৌঢ় দা । ভালো থাকবেন।
নাহ, বড্ড রুক্ষু
আসলেই রুক্ষু
লেখা ভালো হয়েছে অমি ভাই। ছবিও ভালো হয়েছে কিন্তু সবুজের অভাবে প্রান আই ঢাই করছে। এখানে রাতদিন সাদা দেখছি আর ওখানে রুক্ষতা।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ধন্যবাদ আপু। সবুজের অভাবে যেন সবকিছু জলে পুড়ে ছাই। এইরকম রুক্ষতা আমি এর আগে কখনও দেখিনি।
অসাধারণ সব ছবি---
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ভালো লাগল
নতুন মন্তব্য করুন