দিন-রাত-দিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/০১/২০১৩ - ১:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দিন-রাত-দিন
আমার কলেজ-বন্ধু অখিল ছিল খুব চুপচাপ। বন্ধুদের আড্ডায় শুধু কথা শুনে যেত আর মিটিমিটি হাসত। আযফার বলত, “তুই শালা ভোন্দা...কোন কথাই তো বলিস না। আচ্ছা তুই আড্ডা দিতে আসস কেন বল তো?” উত্তরে সে আবারো হাসত। এতে করে আযফার আরো বিরক্ত হত, বলত, “গাধার মত হাসতেছিস কেন? আমি কি কোন হাসির কথা বলসি নাকি? তুই শালা পাগল না-কি?” আমি ওকে থামিয়ে বলতাম, “আহা থাক না! ওর পিছে লাগলি ক্যান? আমরা তো কথা বলতেছিই...ও চুপচাপ বইসা আছে থাক না”। ওর নীরবতা নিয়ে আমরাই ঝগড়া করে ফেলতাম অনেকটা সময়। অথচ অখিলের মুখে রা নেই। আমরা সাহিত্য, রাজনীতি, মেয়ে, সবকিছু নিয়েই কথা বলতাম মাঝে মাঝে কারো কারো মন্তব্য বা কথা শুনে চোখ তুলে হঠাৎ খুব গাঢ়ভাবে তাকাত। অথবা খুব যেন খুব খারাপ কথা শুনেছে এরকম ভাব করে লাল নীল বেগুনী হয়ে যেত। আড্ডা শেষ করে যে যার পথে বাড়ী ফিরতাম। অখিল আর আমি কিছুটা পথ একসাথে আসতাম। আমি চলে যেতাম ডানে, আর ও বাঁয়ে। একদিন বললাম,

“আচ্ছা দোস্ত তুই কোন কথা বলিস না কেন রে?”
“ভালো লাগে না।“ অখিলের উত্তর।
“তাহলে আড্ডায় আসিস কেন?”
“ভালো লাগে”
“কথা বলতে ভালো লাগে না অথচ আড্ডায় আসতে ভালো লাগে?”

উত্তরে সে উপরে নীচে মাথা নাড়ত। এইরকম চুপচাপ অদ্ভুত মানুষ ছিল অখিল। একদিন কলেজে ব্রেকের সময় অখিল বাথরুমে যাওয়ার পর আনমনেই ওর ডায়েরী উল্টাতে ঊল্টাতে শেষ পাতায় চোখ আটকে গেল। খুবই মেয়েলী ধরণের গোটা গোটা হরফে লেখা, “নীরবতাঃ ঈশ্বরের লেখার খসখস আওয়াজ।” কলেজ ছুটির পর বাইরে বের হতে হতে অখিলকে জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা দোস্ত তুই কি কবিতা লিখিস?” অখিল আকাশ থেকে পড়ে যাবার মত মুখ করে বলে, “না তো” কিন্তু কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে চেয়ে থাকে আমার দিকে। একবার ঝুম বৃষ্টিতে অখিলকে দেখলাম রিকশার হুড ফেলে বিড়বিড় করছে। আমাকে দেখেই থতমত খেয়ে হাসল। আমি বললাম, “ কি রে বৃষ্টিতে ভিজতেছিস কেন?” সে হাত তুলে একটা কালো পাথর দেখায়, “এইটার জন্য।”। বলে খুব সরলভাবে হাসে। পরে জেনেছিলাম ওই পাথরটা কারো বাড়ীর কোন একটা এ্যাক্যুয়ারিয়ামের ভেতর থেকে নিয়ে এসেছিল ও। পানির নীচে মোটামুটি পূর্ণ-জীবন কাটানো একটা পাথরের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার মজাই নাকি আলাদা। পাথরের অদ্ভুত নীরবতা ঝিম-ধরা নীরবতা ওকে টানত ভীষণ।

সেই অখিল আজ বহু বছর পর এই ঘন-তুষারের রাতে বাবা হয়েছে। লেবার রুমের ভেতর থেকে বাচ্চার কান্না শুনে বাইরে বসা অখিল হাতের গাছপাথরহীন পাথরটা শক্ত করে চেপে ধরে কেমন আনমনা হয়ে যায়। ভাবে কীভাবে যে কেটে গেল এতগুলো বছর। হাজার হাজার দিন ছিঁড়ে গিয়ে রাতে ঝরে পড়ল আর পরদিন আবার রোদ উঠলো। আর ও কীভাবে এই এত্তগুলো বছর কী এক অদ্ভূত ঘোরে একটু একটু করে বেঁচে থাকল।

রাজীব মাহমুদ


মন্তব্য

অচল এর ছবি

মাথার উপর দিয়া গেল ! চিন্তিত গল্পের শুরুটা ভাল লাগছে ।

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

মাঝে মধ্যে মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় খপ করে ধরে ফেলার চেষ্টা করবেন  পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

তবে ঐ ঘোরটাও কারও কাছে জীবন হতে পারে।
সে সুখ বা দুঃখ কেবল তারই।

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

জীবন তো বটেই। খুব গাঢ়-ঘন জীবন।

“ও সাঁই নিকট থেকে দূরে দেখা, যেমন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায় দেখ না”

কুমার এর ছবি

চলুক , শেষ প্যারাগ্রাফে একটু মেলবন্ধনের অভাব পেলাম।
"অখিল হাতের গাছপাথরহীন পাথরটা শক্ত করে চেপে" কি ঐটা?

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

গাছপাথর মানে সময় বা বয়সের হিসাব। ‘গাছপাথরহীন’ পাথর বলতে এখানে বোঝান হয়েছে অনেক পুরণো একটা পাথর। এখানে ‘গাছপাথর’ একটা বিশেষণ, শুধুই পাথরের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। তাই এখানে মেলবন্ধনের অভাব বলতে ঠিক কি বোঝালেন সেটা বুঝতে পারলাম না। বুঝিয়ে বললে লেখক হিসেবে উপকৃত হতাম। পড়ার জন্য এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

*‘গাছপাথরহীন’ একটা বিশেষণ

সৌরভ এর ছবি

হাসি

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

ধন্যবাদ মধুর হাসির জন্য ।

কৌস্তুভ এর ছবি

চলছিল বেশ, শেষ প্যারাটা গল্পের প্রবাহের সাথে মিলল না।

দীপ্ত এর ছবি

বেশ বেশ। ভালই তো লাগল।
ট্যাগ যেহেতু অণুগল্প, মানে বাস্তবের ঘটনা না (ধরে নিলাম), সেক্ষেত্রে শেষ প্যারাটা কি আরেকটু অন্যরকম হতে পারত, কিছু শব্দ যোগবিয়োগ করে বা বাক্যে? যাতে গল্পের ধাপান্তরটা আরেকটু মসৃণ হয়।

রাজীব মাহমুদ এর ছবি

ঠিক ই ধরেছেন কৌস্তভ আর দীপ্ত আপনারা দু’জনেই। আচম্বিৎ ‘ধাপান্তর’ আর এর সাথে চলমান প্রবাহটাকে ভেঙে দেয়াটা নিরীক্ষামূলকভাবে করা হয়েছে যেটা আমি জানতাম আপনাদের চোখ এড়াবে না। মনোযোগী মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দু’জনকেই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।