কোন গোল্ড মাইনের(সোনার খনির) কাছে যাবার সেই দুর্লভ ক্ষণ কখনও যে আসবে তা ছিল কল্পনাতীত। যদিও কল্পনারাই বা একটু ভিন্নভাবে বললে স্বপ্নেরাই এক সময় বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। তবে আশা ছাড়া যাবে না কখনই। কারণ কঠোর নিয়ম কানুন আর কড়া প্রহরাই থাকা এই স্পর্শকাতর জায়গাটিতে যাবার আশা ছিল বহুদিন ধরেই। সেই আশা পূরণ হল এই মাত্র কদিন আগে। তবে সেজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কয়েক মাস। সেই সাথে অবশ্য আমার নিজস্ব সময় বের করারও একটা ব্যাপার ছিল। আর সেই সময় বের করে যখন অনেক দিনের প্রতীক্ষার এক অজানা বিষয়কে জানার সুযোগ পেলাম তখন খুশীতে হত বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম।
একটি ছোট জায়গার নাম যে এত বড় করে চেনা যায় তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ হল ইতি। ইতি আসলে একটি গ্রামের নাম যেখানে এই সোনার খনিটি অবস্থিত।
আর তাই এই মাইন ফিল্ডের নাম হল ইতি গোল্ড মাইন। তবে এটি এস এম আই( SMI ) নামেও পরিচিত ফরাসী ভাষায় যাকে বলে ‘শোষিতে দে মিন দিতি’ ইংরেজিতে যাকে বলে 'কোম্পানি অফ মাইনস অফ ইতি'।
১৯৯০ সালে পঁচিশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই গোল্ড মাইন তার যাত্রা শুরু করে। মাত্র ছয় মিলিয়ন ডলার দিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এর বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ষাট মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এত ব্যয়বহুল একটা প্রকল্পে তাহলে ঘুরে আসা যাক। এখানে যাবার পূর্বেই লাল মাটির স্তরের বুকে গাড়ী চাপাতে হয়। যাবার সময় ধুলার মাত্রা এতটাই বেশী যে মাস্ক না থাকলে একটু অসুবিধায়ই পড়তে হয়। মাইন ফিল্ডের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে জি ফোর এস এর সিকিউরিটি গার্ড। বেশ কড়া প্রহরায় এক একজন শ্রমিককে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করে তবেই বাইরে অথবা ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে এই সব নিরাপত্তা কর্মীরা।
(৩)
তেমনই একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই রাস্তার দু পাশে দেখলাম বেশ কয়েকটি উঁচু পাহাড়। এদেশের অধিকাংশ পাহাড় একটু পাথুরে হলেও এই অঞ্চলের পাহাড়ে মাটির দেখা পেলাম।
(৪)
ইতি গোল্ড মাইনে স্বর্ণ নিষ্কাসনের এই প্রক্রিয়া আসলে বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপটি হল পরীক্ষিত জায়গা থেকে মাটি কাঁটা।
(৫)
(৬)
(৭)
তাই প্রথমেই আমরা চলে এলাম যেখান থেকে মাটি কাঁটা হচ্ছে সেখানে। মূলত এই মাটি থেকেই বের করা হয় সোনা। মাটি কাঁটার ফলে ওই জায়গাটি দেখতে অনেকটা অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট খাঁদের মত হয়ে গেছে। খুব সতর্কতার সাথে একেবারে স্তরে স্তরে বিশাল ডেজর মেশিন দিয়ে চলছে এই মাটি কাঁটার কাজ।
(মাটি খনন চলছে)
একেবারে সকাল থেকে পড়ন্ত বেলা পর্যন্ত চলে এই খনন কাজ। দূর থেকে এই ডেজিং পয়েন্ট অনেকটা যত্ন করে বানানো সিঁড়ির মত মনে হবে।
মাটি কাঁটার পর তা বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটি মেশিন দিয়ে গুড়া করা হয়। গুড়া করা সেই মাটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে স্তূপাকারে লম্বাকারে মাটির বেড বানানো হয়।
(৯)
( এই মেশিনে মাটি গুড়া করা হয়)
(১০)
( মাটি ফেলে বেড তৈরি করা হচ্ছে)
প্রতিদিন এভাবে প্রায় ২০০০ টন মাটি ফেলা হয়। মূলত এই মাটির সাথেই মিশে আছে ছোট ছোট স্বর্ণের কণিকা বা গোল্ড ডাস্ট। আর মাটি থেকে সেই কণিক আলাদা করতে ব্যবহার করা হয় সায়েনায়েট দ্রবণ।
(১১)
(ছেটানো হচ্ছে সায়েনায়েট দ্রবণ)
(১২)
(১৩)
এরপর বিশেষ কিছু পাইপের সাহায্যে অনেকটা বাগানে স্প্রে করা পানির মতই এই সায়েনায়েট ছিটিয়ে দেয়া হয় মাটির বেডের উপর।
(১৪)
(সায়েনায়েট ছেটানোর বিশেষ পাইপ)
(১৫)
(১৬)
ছিটিয়ে দেয়া এই সায়েনায়েটের সাথে মিশে দ্রবীভূত হয়ে যায় স্বর্ণ কণিক। স্বর্ণ কণিক যুক্ত এই সায়েনায়েট দ্রবণকে নালার সাহায্যে নিয়ে আসা হয় খনন করা একটি পুকুরে।
(১৭)
(নালার সাহায্যে আসছে সায়েনায়েট দ্রবণ)
এখানে এইরকমের বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে। মূলত এই পুকুরের মত চৌবাচ্চায় দেখতে পাওয়া পানি আসলে পানি নয় । এরা সায়েনায়েট সলিউশান।
(১৮)
(এটা কিন্তু পানি না সায়েনায়েট দ্রবণ)
(১৯)
( বেশ কয়েকটি পুকুর)
স্বর্ণ কণিকা যুক্ত এই সায়েনায়েট দ্রবণকে এরপর প্রবেশ করানো হয় কয়লা ভর্তি সিলিন্ডারের মধ্যে। এই কয়লা মূলত নারকেলের মালা পুড়িয়ে তৈরি করা হয় যা ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসা হয় ।
(২০)
(বস্তা ভর্তি কয়লা)
(২১)
(নারকেলের মালা পুড়িয়ে তৈরি কয়লা)
এভাবে বেশ কিছুদিন রাখার ফলে সায়েনায়েট দ্রবণ থেকে স্বর্ণ কণিক কয়লার খণ্ডের মধ্যে ঢুঁকে যায়। এরপর স্বর্ণ কণিক যুক্ত কয়লাকে এলকোহল ভর্তি সিলিন্ডারের মধ্যে প্রবেশ করানো হয় । এলকোহল দ্রবণে বেশ কিছুদিন রাখার ফলে স্বর্ণ কণিক গুলো কয়লার খণ্ড থেকে এলকোহল দ্রবণের সাথে মিশে যায়।
(২২)
(সিলিন্ডার যার মধ্যে রয়েছে কয়লা)
এরপর স্বর্ণ কণিক যুক্ত এলকোহল দ্রবণকে টিন শেডের মধ্যে অবস্থিত ইলেক্ট্রোলাইসিস সেল বা তড়িৎ বিশ্লেষণ সেলে প্রবেশ করানো হয়।
সেখানে ক্যাথোড ও এনোডের সাহায্যে এই দ্রবণকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করা হয়। ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহৃত হয় লোহার জালিকা যেখানে স্বর্ণ কণিকাগুলো জমা হয়। কাঙ্ক্ষিত মাত্রার স্বর্ণ এই লোহার জালিতে জমা হতে সময় লাগে পনের দিন। পনের দিন পর পর একটি বিশেষ চুল্লিতে এই লোহার জালিকা এনে এক হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় জালানো হয়।
(২৩)
(বিশেষ চুল্লি)
জালানোর পর গলিত স্বর্ণ একটি বিশেষ ছাঁচনিতে ঢালা হয়।
(২৪)
(ঢালা হচ্ছে গলিত স্বর্ণ)
(ছাঁচ)
এই গলিত স্বর্ণের মধ্যে কিছু গলিত লোহাও থাকে। কিন্তু স্বর্ণের ঘনত্ব লৌহের ঘনত্বের চেয়ে বেশী বলে গলিত লৌহ ছাঁচ থেকে উপচে পড়ে যায়। আর তখন ছাঁচে থেকে যায় গলিত স্বর্ণ। তাপ নিরোধক একটি বিশেষ পোশাক পরিধান করে টেকনিশিয়ানরা এই চুল্লিতে কাজ করে থাকে।
(২৫)
(বিশেষ পোশাক)
(উপচে পড়ছে লৌহ )
ছাঁচে গলানো স্বর্ণ জমাট বাঁধার পর একটা আস্ত ইটের আকার ধারণ করে যার ওজন প্রায় আটাশ কেজির মত।
(২৬)
( সোনার বার)
জমাট বাঁধা গরম স্বর্ণের এই বার কে পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়।
(২৭)
(এভাবে ঠাণ্ডা করা হয়)
প্রতি পনের দিন পর এই খনি থেকে এরকম তিনটি বার উৎপাদন করা হয়। এভাবে আহরিত স্বর্ণ শতকরা নব্বই ভাগ খাঁটি। অধিকতর পরিশোধনের জন্য তা আবার সুইজারল্যান্ডে পাঠানো হয়।
প্রতি বছর এখান থেকে প্রায় ১.৫ টন স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়। উত্তোলন কৃত স্বর্ণের ৪৯ ভাগ পায় ফ্রান্স আর ৫১ ভাগ পায় আইভরিয়ান সরকার। ইতি গোল্ড মাইনের দিকে গেলে চোখে পড়বে একেবারে লাল মাটি,লাল পাহাড়। মনে হয় যেন সোনার কণিকা যেন ছড়িয়ে আছে এই এলাকার চারপাশ জুড়ে। সোনার খনি যেই দেশে, যে এলাকার মাটি খুঁড়লেই বের হয় স্বর্ণ অথচ ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাসে তারা আটকে আছে দারিদ্রের করাল গ্রাসে। কথিত আছে এই প্রাকৃতিক সম্পদই হয়েছে তাদের জীবনের জন্য এক অভিশাপ।
পশ্চিমা লোলুপ দৃষ্টি, অন্ত কলহ, জাতিগত সংঘাত যেন বারবার ফিরে আসে এদেশের নামের সাথে।
( লেখাটি আমার স্ত্রীর জন্য যার অনেক আগ্রহের ফলেই আজকের এই লেখাটি)
অমি_বন্যা
মন্তব্য
অনেক ধন্যবাদ স্যাম দা।
চমৎকার।
ডিসকাভারি চ্যানেলে জাঙ্গল গোল্ড নামে একটা অনুষ্ঠান দেখাতো। দেখানে কিছুটা দেখছি।
আমি স্বচক্ষে দেখলাম এবার। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ প্রকৃতিপ্রেমিক ভাই।
দারুণ একটা টপিক নিয়ে লিখেছেন। চিন্তা করা যায় প্রায় অর্ধেকটা সোনা ফ্রান্স নিয়ে নিচ্ছে।
মাইন ফিল্ড ঘুরে আসার পর মনে হয়েছিল লিখবো । আর তাই লিখে ফেললাম। আসলেই অচিন্তনীয় ব্যাপার।
দারুণ লেখা।
তোমাকে অসংখ্য
এক্সক্লুসিভ পোষ্ট অসংখ্য ধন্যবাদ।
দারুন হয়েছে। আপনার কল্যানে একটা স্বর্ণের খনিও দেখতে পেলাম।
কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝিনা। এই ধাতুটার জন্য মানুষ এত উতলা কেন?
ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমারও মাথায় আসেনা এই ধাতুর জন্য এই উতলার কারণ। তবে বিবাহ করার সময় পাত্রী পক্ষের চাহিদার সামনে এই উদ্বিগ্নতার বেগ বুঝতে পারবেন।
আমারও একবার সুযোগ হয়েছিল এই গোল্ড মাইন দেখার।
লেখা
আপনাকে ভাগ্যবান বলতে হয় মামুন ভাই। মন্তব্যের জন্য
অজানা তথ্য জানতে পারলাম, অনেক ধন্যবাদ
পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ শাফায়েত ভাই।
"উত্তোলন কৃত স্বর্ণের ৪৯ ভাগ পায় ফ্রান্স আর ৫১ ভাগ পায় আইভরিয়ান সরকার। " - ফ্রান্সের সাথে আইভরি কোস্ট সরকারে কোনো চুক্তি আছে কি এই বিষয়ে নাকি এটা ইনভেস্টমেন্টের কারণে?
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আমার জানা মতে একটা চুক্তির ভিত্তিতেই এই পারসেন্টেজ নির্ধারিত ।
আপনাকে ধন্যবাদ ফারাসাত।
দারুণ!
ফারাসাত
এতদিন 'সেবা ওয়েস্টার্নে' পড়েছি সোনার খনির কথা। (অবশ্য সেই খনির প্রক্রিয়া অন্যরকম ছিল।)
আপনার কল্যাণে নতুন প্রক্রিয়া দেখা হল।
ধন্যবাদ।
আপনাকেও ব্যাঙের ছাতা ।
বাংলাদেশেরও কিছু কিছু অঞ্চলের মাটি এরকমই লাল। আহারে! আমরা সোনা চিনলাম না।
আব্দুল্লাহ এ.এম.
আপনাকে রংতুলি।
দারুণ!
দারুন অমি ভাই। চমৎকার তথ্যবহুল পোস্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। সোনার খনি নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকবেন।
নতুন মন্তব্য করুন