আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, এ প্রশ্ন করাই যেতে পারে। তবে তা বহুল ব্যাবহারে এত বেশি জীর্ন আর সেকেলে হয়ে উঠেছে যে,একে আর প্রশ্ন মনে হয় না ইদানিং। বরং এটি আক্ষেপ বা এরকম আর কিছু যা অনুদ্দিষ্ট ছুড়ে দিয়ে আমরা নিজের মত করে যাপন করতে পারব আমাদের তথাকথিত জীবন। মানে এক ধরনের পলায়ন আর কি। তথাকথিত মানে সেই নটা- পাঁচটা,খবরের কাগজ, চায়ের দোকানে দেশোদ্ধার, খাতা-কলম, জলছাপ মারা ময়লা অথবা নতুন নোট, গোনা- গুনতি, সন্ধ্যায় অথবা রাতে রিমোটের ভ্রমন, টক শো দেখে দ্বয়িত্ব পালন, একান্তে ক্ষরণ ইত্যাদি।
মহামূল্যবান এইসব কাজ আর তার চলমানতার ফাঁকে কখনো কখনো আমরা হাসি, গান গাই, নাচিও কেউ কেউ, ফুঁশেও উঠি মাঝে মাঝে যখন এড়ানো যায় না আর কিছুতেই। ফুঁশে ওঠাটা অস্বাভাবিকতা। তাই আমরা খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে যাই আবার। নিজস্ব বৃত্তায়নে নিজেকে দেখি আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি মাঝে মাঝে। এই ফাঁকে কারা কারা বিপন্ন হলো তার দায়তো আমাদের নয়। কাজ সেরে ফেরার পথে কে অপহৃত হয়ে শোধ করলো একা একা লৈঙ্গিক দায় আমরা জানার প্রয়োজন বোধ করি না। হ্যাঁ লৈঙ্গিক দায়, মানে প্রচলিত অর্থে যাকে ধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যদিও বাংলা একাডেমির অভিধান ঘেঁটে অর্থ পাওয়া গেল, অত্যাচার বা নিপিড়ন। একমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই এই শব্দটি দিয়ে লৈঙ্গিক অত্যাচার বিষয়টিকে বোঝায়। শব্দার্থ পর্যালোচনা এই লেখার দায় নয়।
দেশে ক্রমাগত ঘটে যাচ্ছে একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা আর আমরা বেশ স্বাভাবিক আছি। সহমতের কারো সাথে একটু আধটু আলোচনা করে দায় সারছি কেউ কেউ। আর যারা এই নির্যাতক মনোভঙ্গিরই তারা এ নিয়ে মেতে উঠছি সরস আলোচনায়, কেউবা দায়টা ছুঁড়ে দিচ্ছি নির্যাতিতর ঘাড়েই। তার পোষাক থেকে শুরু করে আর সব কিছুরই ব্যবচ্ছেদ করছি মনে মনে নয়তো সরবে। হ্যাঁ আমরাই, পুরুষ বা নারী যাই হই না কেন, আমরা এর কোনো দায় নিচ্ছি না। দু একটা মানব বন্ধন, প্রেসনোট, মিছিল, মিটিং, বিবৃতি হাস্যকর সব উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড এর বেশি কী। এ যেন এক করুণ তামাশা চলছে রাষ্ট্রজুড়ে। এতো তামাশাই, না হলে এক দিনে দেশের পাঁচ পাঁচটি অঞ্চল থেকে একই সংবাদ আসছে কি করে। বছরের প্রথম ৯ দিনে সারা দেশে ১৪ টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যার ভেতর ৭ জন ভিকটিম মারা গিয়েছে। আর আমরা আঙুল চুষছি বসে বসে, হা হুতাশ করছি, বিবৃতি দিচ্ছি। যে শিশুটি মাত্র এর শিকার হলো তার কাছে এইসব তামাশাই কেবল। হ্যাঁ শিশুই, তিন থেকে শুরু করে কোন বয়সী শিশু নেই এ তালিকায়। আর আমরা স্বাভাবিক আছি যেমন ছিলাম।
আর আমাদের প্রশাসন দু একটি গ্রেফতার করেই খালাস। এইবার হলো ভেবে আমরাও তৃপ্তিতে চোখ বুঁজে দিবানিদ্রা যাচ্ছি। ইদানিং এ বিষয়ক আলোচনায় কেউ কেউ আঙুল উঁচিয়ে ভারত দেখিয়ে দিচ্ছে। মানে হলো এরকম সব দেশেই হয়ে থাকে। হ্যাঁ হয়ে থাকে, তারা এর প্রতিবাদও করে থাকে। সে প্রতিবাদ নিয়মরক্ষার নয়, দু একদিনের নয়। সে প্রতিবাদ কিছুটা হলেও ফলদায়ি, আমাদের মতন তামাশার নয়। আর যদি নাও হয়, যদি কোনো দেশে এর চেয়েও বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এবং নির্যাতক পার পেয়ে যায় তা কেন উদাহরণ হিসেবে মানব। প্রশ্নটা সহজ তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?
সংবাদে জানা গেল দু একটা স্কুলে মেয়েদের কারাতে শেখানোর কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে আত্মরক্ষার জন্যে। তবু এ ভালো রাষ্ট্র ব্যার্থ তাই আমরা নিজেরাই রক্ষা করতে চাইছি নিজেদের। এখানে বলা প্রয়োজন, কারাতে বা খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশলের যাত্রা শুরু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে। যারা তৎকালীন সনাতনদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছিল। এটা সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালের ঘটনা। বৌদ্ধ নির্যাতনে স্বয়ং গুপ্ত শাসকদের ইন্ধন ও সমর্থন ছিল। এ কারণে ভিক্ষুদের কাছে নিজেদের রক্ষার্থে আর কোনো উপায় ছিল না। ওটা ছিল সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। এও কি নয়? নারী বা পুরুষ এ বিভাজন কি লৈঙ্গিক সম্প্রদায়ে বিভাজন নয়? যদি হয়ে থাকে তাহলে এতো সাম্প্রদায়িক নির্যাতনও বলা চলে। আত্মরক্ষার্থে ছোট ছোট শিশুরা যারা স্কুলে পড়ছে এখনও তারা নিজেরাই কৌশল রপ্ত করতে শুরু করেছে। তাদের মনোজগতে আমরা প্রবেশ নাইবা করলাম। এটা কি রাষ্ট্রের বা ব্যাবস্থার প্রতি পূর্ণাঙ্গ অনাস্থা প্রকাশ নয়? এটা কি অন্য অর্থে এই বলে দেয়া নয় যে, রাষ্ট্র তুমিই জড়িত এই ঘটনাপুঞ্জির পেছনে। বরং আমরা এই সত্য মেনে নেই। তাতে আরো কিছুকাল দায়হীন সুখনিদ্রা যেতে পারবো।
আমরা যারা নিজেদের সচেতন বলে দাবি করছি হরহামেশাই তারাই পুরোনো বন্ধু আড্ডায় অনায়াশে গল্প (আদি রসাত্মক, গল্পগুলোর এমন নামের কার্যকারণ বোধগম্য নয় যদিও) করছি বা শুনছি বা জানিয়ে যাচ্ছি মৌন সমর্থন। অনায়াসে খিস্তি খেউড় করছি অথচ ভাবছি না এদেরই কেউ কেউ হয়তো উজ্জিবিত হয়ে উঠবে এতে। আর এই ফাঁকে মোল্লার দল সামনে হাজির করছে চিরাচরিত নিদান। ঢেকে রাখ নিজেকে। আহা ঐশ্বরিক নেকাবতত্ত্ব। দেশে যে কোনো সময়ের তুলনায় নেকাবের সংখ্যা বেড়েছে আর আমরা অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তচিন্তা, মুক্ত জীবনের কথা বলছি। দিন শেষে আমরা ভাল থাকছি, স্বাভাবিক থাকছি।
স্বয়ম
মন্তব্য
এটা কি হলো? প্রথম দুই প্যারা দুইবার দেখায় কেন? ঠিক করা কি সম্ভব?
স্বয়ম
লেখাটা ভাল হয়েছে। সচলায়তনের মানের সাথে যায়ও বটে। কিন্তু আমার ১৪টি শিশু নিয়ে যতবার এই ঘটনা বুঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে বোধ করি বিজ্ঞ, অনবিজ্ঞ চক্ষুষ্মান সকল পাঠকের জাবর কাটায় একটা অপমান বাজে কেবল। জানি না অপমানটা কার?
লিখতে গিযে শব্দের সঙ্কটে পড়েছি বারবার। অপমানটা সবার, অন্তত তাই হওয়ার কথা, যদিও ধন্দ্ধ লাগে। আদৌ কি অপমানিত হচ্ছি আমরা? হয়ে থাকলে কোথায় কিসে তার প্রকাশ বা যন্ত্রনা? বাস্তবতা এর বিপরীতেই যায় স্পষ্টত। গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথেই হয়ত আমরা বিবৃতি সর্বস্ব হয়ে উঠছি ভীষণভাবে। চেহার, কথা বা নিদেনপক্ষে নিজের নামটা প্রকাশিত হতে দেখলেই আমাদের চলে। আর এ জন্যে একটা কোনো ইস্যু হলেই চলে। ঘটনাগুলো আমাদের কাছে ইস্যু হযে উঠছে আর আমরা তার চমৎকার ব্যবহার করে চলেছি।
স্বয়ম
__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
স্বয়ম
ভালো লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন