রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরে ভয়াবহ নির্যাতন চলে, অসংখ্য তাজা প্রান ঝরে যায়, জোহা হলকে বানানো হয় টর্চার সেল, অনেক নারী সম্ভ্রম হারান, এতই নির্যাতন চলে যে অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি কিংবা লাশ পেলেও চিনে নেয়া সম্ভব হয়নি, জোহা হলের পেছনে পাওয়া গেছে দেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পিশাচ শিক্ষক এই নির্যাতনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অনেক স্বাধীনতাকামী, প্রগতিশীল এবং সাহসী শিক্ষকদের তারা অনায়াসে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেন। এই কাহিনীগুলি কম বেশী আমাদের সকলেরই জানা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্ত্রীর শিক্ষকতার সূত্রে প্রাপ্ত উকিল শরিফ রাজাকারের বাড়িতে আশির দশক থেকেই আমরা বিভিন্ন দিবসে ঢিল ছুঁড়ে জানিয়ে দিতাম, তুই রাজাকার। কিন্তু খুব দুঃখের সাথে এও দেখেছি অনেক শিক্ষকদের সাথে তার আন্তরিক সম্পর্ক। প্রত্যেক পয়লা ফেব্রুয়ারিতে পাখি শিকার করা ছিল তার বিশেষ নেশা। তারই গুনধর পুত্র যে কিনা কোনদিনই পিতার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হন নি, ক্যাম্পাসের অনেকের কাছে সহসাই হিরো হয়ে ওঠেন, অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন। বয়কট করা তো দুরের কথা, ক্রমে ক্রমে এইসব রাজাকার বাহিনী আমাদেরই বাবা-মার দুর্বলতার সুযোগে সমাজে তাঁদের অবস্থান জোরদার করতে সচেষ্ট হন।
এইসব দেখে শুনে তিতিবিরক্ত হয়ে আজ থেকে এক যুগ আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র, আমাদের প্রানপ্রিয় সংগঠন, একটি রাজাকার বিরোধী পোস্টার প্রকাশ করার প্রয়াস নেয়। ২০০০ সালে রাজশাহীর একটি প্রেসে শ'খানেক পোস্টার ছাপানো হয়। এবং এই কাজগুলো করে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের স্কুলগামী অকুতোভয় ছেলে মেয়েরা। পোস্টার ছাপা থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের হোস্টেলগুলোতে তা সাঁটানো পর্যন্ত সব কিছুই তাঁরা নৈপুণ্যের সাথে করে ফেলে এক দিনের ব্যাবধানে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের ঘাঁটি জেনেও কেউ তাঁদের এই উদ্যোগকে আটকাতে পারেনি।
আজ সারা দেশে রাজাকার বিরোধী সমাবেশ হচ্ছে, আমরা কি নতুন প্রজন্মকে জানাতে পারিনা এই রাজাকারদের নাম ঠিকানা। হয়ত তারা জাঁকিয়ে বসেছেন আমাদেরই পাড়ায় মহল্লায়, আমাদেরই বাড়ির কাছাকাছি, হয়ত তাদের সাথেই ঘটতে চলেছে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। শুধু প্রচারের অভাবে আমরা এই নরঘাতকদের চিনে নিতে পারিনি। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইটি তো রয়েছেই আমাদের হাতের মুঠোয়। তাঁদের আমরা উন্মুক্ত করতে পারি অনায়াসেই। আমরা প্রত্যেক বছর এই রাজাকারের তালিকা পোস্টার আকারে প্রকাশ করে মিছিলে স্লোগানে রাজপথে তা সহজেই বয়ে নিতে পারি।
উক্ত পোস্টারটি এখানে উন্মুক্ত করার একটা ছোট্ট প্রয়াস নিলাম।
আমাদের বক্তব্য
'রাজাকার'- পরিচিত এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ কি আমরা সবাই জানি? এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু ১৯৭১ সালে অদম্য বাংলাদেশ যখন লড়ছে মুক্তির লড়াই সে সময় এই দেশেরই একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর জঘন্য মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে নতুন চেহারা পায় রাজাকার শব্দের অর্থ। এখন রাজাকার বলতে বোঝায় নরঘাতক, যুদ্ধাপরাধী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অসন্তোষ্ট একটি সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতা পরবর্তী কোনও সরকারই রাজকারের বিচারের দাবীর প্রতি আন্তরিকতা দেখায়নি। উপরন্তু তাদের মধ্যেই কেউ কেউ রাজাকারদের বসিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে, রাজাকার শ্রেষ্ঠ গোলাম আজমকে দিয়েছে বাংলাদেশে বসবাসের বৈধ স্বীকৃতি। আবার কেউবা ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যাবহার করেছে এইসব দেশদ্রোহীদের। এভাবেই দিনে দিনে এই রাজাকার গোষ্ঠী এবং অন্যান্য ধর্মধ্বজী মৌলবাদী সংগঠনগুলো হয়ে উঠেছে দুর্বিনীত, যার ফলে তারা হুমকি দিতে পারছে বাংলাদেশকে আফগানিস্তানে পরিনত করার, পারছে জাতীয় শোক দিবসে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করতে, এমনকি জাতীয় সঙ্গীতের প্যারোডি রচনা করতেও। ধর্মের মুখোশ পড়ে ধর্মেরই অপব্যাখ্যা করার মাধ্যমে এই নরপিশাচরা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে, তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় রাজনীতির মন্ত্র শেখাচ্ছে। সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। তাই শুধু সভা-সেমিনার করে রাজাকারদের বিচার দাবী করলেই আর চলবে না, এদের বিচারের ভার আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে। আসুন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই সকল যুদ্ধাপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করব, সব ধরণের উৎসব- অনুষ্ঠান থেকে তাদের দূরে রাখব, তাদের কোনরকম রাজনীতি করাকে সমর্থন করবনা। সুতরাং আমাদের মূলমন্ত্র হবে-
"যেখানেই রাজাকার, সেখানেই প্রতিরোধ"
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের' ৭১ এর এইসব ঘৃণ্য পশুদের চিনে নিন।
ডঃ আব্দুল বারী, উপাচার্য এবং চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, উপাচার্য
আব্দুর রহিম জোয়ারদার, রেজিস্টার
সৈয়দ ইবনে আহম্মদ, ডেপুটি রেজিস্টার
শরিফ আহমেদ, উকিল, স্ত্রী ইতিহাস বিভাগের শিক্ষিকা
সোলায়মান মণ্ডল, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ডঃ জিল্লুর রহমান, অধ্যাপক, আইন বিভাগ
কলিম এ সাসারামী, অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্ব বিভাগ
মকবুল হোসেন, অধ্যাপক, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ ও ডিন, বানিজ্য অনুষদ
খন্দকার আজিজুল হক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
শেখ আতাউর রহমান, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
অধ্যাপক মোহাম্মদ প্যাতেল, অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ
আহাম্মদ উল্লাহ খান, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ডঃ ওবায়দুল হক, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রশিদ খান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ওয়াসিম বারি, অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ডঃ গোলাম সাকলায়েন, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
ডঃ শরিফ উদ্দিন, অধ্যাপক, গণিত বিভাগ
তৈয়ব আলী, স্টেনো, উপাচার্য দফতর
উল্লেখ্য, ডঃ আব্দুল বারী, মকবুল হোসেন ও ডঃ শরিফ উদ্দিন পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান কর্তৃক গঠিত প্রাদেশিক শিক্ষা সংস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন।
সুত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী, একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়
মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
-মনি শামিম
মন্তব্য
ভাল লাগল আপনাদের প্রচেষ্টা। রাজাকার নিপাত যাক।
মজার ব্যাপারহল রাজাকারদের পূর্ণবাসনে বহু বহু প্রগতিশীল, নাস্তিক, বাম, সমাজতন্ত্রী জান-প্রাণ দিয়ে সহযোগীতা করেছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে আগামীতে লেখার ইচ্ছা রাখলাম। অনেক রাজাকার মারা গেছে যদিও, কিন্তু ইতিহাসের এই বাকটা তার পরেও অনেক মজার।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ধন্যবাদ মনি
দারুণ!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও এমন লিস্ট করে সেটা প্রচার করা জরুরী।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন