দুর্ভাগ্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০২/২০১৩ - ১২:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শাহবাগ বাসস্ট্যান্ডের একটু সামনের দিকেই যেই পেট্রোল পাম্পটা, আনিস প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে সেইখানে দাঁড়ানো। চেহারায় বিরক্তি এবং উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। এমনিতেই বাসা থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছে, তারউপর একটাও ক্যাব পাওয়া যাচ্ছেনা।

সাথে বড় ব্যাগটা আছে বলে বাসে করে চলে যাবে সেই উপায়ও নেই। আর এমনিতেও সন্ধ্যা হয়েছে বেশ অনেকক্ষণ, ওদিকে বাসও তেমন পাওয়া যাবেনা। ক্যাব ড্রাইভারদের দোষ দেওয়া ঠিক না। একে তো অনেক দূরের পথ, তারউপর আনিসের চেহারা দেখেও বিশেষ ভক্তি হবার কোন কারন নেই। অনেকবার পড়তে পড়তে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া হলুদ শার্ট, ভুসভুসে বাদামি রঙের প্যান্ট, কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর ডানহাতে ঢাউস সাইজের একটা ব্যাগ নিয়ে তাই আনিসকে আরো কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কে জানে!
আরো মিনিট পনের অপেক্ষা, এবং দুইজন ক্যাবচালকের সাথে ভাড়া নিয়ে বাক-বিতন্ডার পর আনিসের মেজাজ যখন একদম চরমে, ঠিক তখন অবশেষে একটা কালো ক্যাব পাওয়া গেলো। গাড়িটার অবস্থা বিশেষ সুবিধার না, চলার সময় পুরো বডি থিরথির করে কাঁপছে, একটু জোরে মোড় ঘুরতে গেলে মাঝখান থেকে দুইভাগ হয়ে যাওয়ারও বেশ ভালো একটা সম্ভাবনা আছে বলে মনে হলো আনিসের। কিন্তু এখন এইসব নিয়ে চিন্তা করার সময় একেবারেই নেই। ভাড়া নিয়ে বনিবনা সেরে নিয়েই আনিস চট করে গাড়িতে উঠে পড়লো। একবার হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে একটু চোখ বুজতে যাবে, ঠিক তখন আনিস বুঝতে পারলো এই গাড়িতে ওঠা বিশাল ভুল হয়েছে।
সমস্যা হচ্ছে যে গাড়ির চালক একটা এক নম্বরের বাচাল। এই ব্যাপারে আনিসের একটা সহজাত প্রতিভা আছে। অনেক সময় বা অনেক কথা বলার প্রয়োজন হয়না, একজন মানুষ মুখ খোলার প্রায় সাথেসাথে আনিস ধরতে পারে লোকটা বেশি কথা বলে কি না। এমনিতেই আনিসের বাচাল মানুষ পছন্দ না, তারউপর এই মুহুর্তে ওর মাথায় অনেক চিন্তা। ভদ্রতা রক্ষা নিয়েও সে বিশেষ আগ্রহী না, কিন্তু এইটুকু একটা গাড়িতে আরেকজনের কথায় একেবারে সাড়া না দিলেও চলেনা। তাছাড়া এই ব্যাটা একেবারে আদর্শ বাচাল, আনিস তার কোন কথার পিঠে শ্বাস নিলেও সে কথা চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেয়ে যাচ্ছে! কাজেই আনিসের জোর চেষ্টা স্বত্তেও কথোপকথন চলতেই থাকলো। আরো হাজার রকম বিষয় নিয়ে কথা হতে হতে শেষপর্যন্ত ব্যাটা এসে ঠেকলো আনিসের নিজের জীবন নিয়ে।
“তা ভাই কি স্টুডেন্ট? নাকি চাকরি?”
“বেকার।”
“ওহো! দেখে মনেই হয়না পড়াশোনা শেষ করসেন! তা ভাইয়ের দেশ কোথায়?”
“ঢাকা।” আনিস বেছে বেছে এমন উত্তর খুঁজে বের করছে যেগুলোর পিঠে কথা চালানো মুশকিল। যদিও তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে বলে মনে হয়না। এই লোক এক বিরল প্রতিভা!
“ঢাকা! ঢাকা একটা শহর হইলোরে ভাই? এই আজকে বিকালেও গুলশান থেকে ধানমন্ডি যাইতে লাগসে তিন ঘণ্টা! রাস্তা কিন্তু তিরিশ মিনিটেরও না, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামেই আটকা পইড়া থাকা লাগে!”
আনিস চুপ করে শুনছিলো, কিন্তু এইটুকু বলার পর লোকটা রিয়ার ভিউ মিররে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে আর না থাকতে পেরে অস্ফুট গলায় একটা “হুম” জাতীয় শব্দ করলো। এই সামান্য সাড়াতেই আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে ড্রাইভার আবার কথা বলা শুরু করলো।
“এমনেই জিনিসপত্রের যা দাম! তারউপর একবার সিএনজির লাইনে দাঁড়াইলেন তো এক-দেড় ঘণ্টা শেষ! সব খরচ শেষ করে হাতে কিছু টাকা যদি রাখতে চান, তাহলে দিনে অন্তত পাঁচটা ট্রিপ দেওয়া দরকার। কিন্তু একটা বড় ট্রিপেই যখন আধাবেলা চলে যায়, তখন সেইটাই বা কেমনে করবেন? তারপর এই যে ধরেন আপনারে নিয়া যাচ্ছি এয়ারপোর্ট, সিউর থাকেন খালি ফিরতে হবে! একটাই ভরসা, যদি বিমানবন্দর স্টেশনে সময়মত যাইতে পারি তাইলে প্যাসেঞ্জার পাইতেও পারি, কিন্তু তাও তো তেমন বড় ট্রিপ হবেনা। আসল কথা কি জানেন ভাই, এই শহরে আর ভালো মানুষের ভাত নাই!”
এতক্ষন ড্রাইভার একটানেই কথা বলে গেছে, আনিসের কাছ থেকে উত্তর তো দুরের কথা, ও শুনছে কি না তা নিয়েও বিশেষ গা করেছে বলে মনে হয়না। কিন্তু এই শেষ কথাটুকু বলে আবার রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে আনিস এইবারে একটু যেন উৎসাহ নিয়েই বললো, “তা ঠিক। ঢাকা শহর কেন, এই দেশেই আসলে আর সৎভাবে বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই।”
কথাটা বলেই শাহবাগ থেকে উত্তরার পথে ওরা এখন ঠিক কোন জায়গায় আসলো দেখার জন্য আনিস একটু বাইরে খেয়াল করছে, ঠিক তখন গাড়িটা হঠাৎ করে গতি কমাতে কমাতে সাইড করে দাঁড়িয়ে পড়লো। আনিস অবাক হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ড্রাইভার নিজে থেকেই বললো “ইঞ্জিনটা কেমন জানি সাউন্ড দিতাছে ভাই, একটু দেইখা নেই।” ড্রাইভার নেমে বনেট উঁচু করে কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে আনিস এই প্রথম খেয়াল করলো জায়গাটা একেবারে অন্ধকার আর নির্জন। একটা জরুরী কাজে যাচ্ছে, আর আজকেই একের পর এক বাঁধা! আনিস দরজা খুলে নামতে যাবে, এমন সময় এক হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে দুইজন যুবক গাড়িতে উঠে পড়লো। আনিস যদি নিজে থেকে নাও বুঝতো যে এরা ছিনতাইকারী, একসাথে এক জোড়া ছুরি বুকে আর পেটে ঠেকাতেই আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। আনিস কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলছিলো, কিন্তু ভয় এবং বিস্ময় মিলে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো।
দুই যুবকের একজন ধমক দিয়ে উঠলো, “মানিব্যাগ আর মোবাইল বের কর! আর হাতের ঘড়িটাও খুলে ফ্যাল! তাড়াতাড়ি, এত টাইম নাই!”
দুইজন দুইপাশে বসা, আশেপাশে কোন মানুষ নেই। ড্রাইভারেরও কোন আওয়াজ নেই, হয়তো বিপদ বুঝতে পেরে পিঠটান দিয়েছে। আনিস তাই কথা চালাচালি না করে সব চুপচাপ ওদের হাতে তুলে দিতে লাগলো। ঠিক এমন সময় অন্য ছেলেটি বলে উঠলো, “বস দাঁড়ান! এর কাছে দেখি দুইটা ব্যাগও আসে!” কথা বলতে বলতেই ছেলেটি ব্যাকপ্যাকটা ছোঁ মেরে তুলে নিলো। এতক্ষন আনিস একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি, কিন্তু দুই যুবকের নজর তার ব্যাগগুলোর উপর পড়াতে সে একটু যেন উসখুস করা শুরু করলো। ব্যাকপ্যাক হাতে ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ওর চোখ পড়লো অন্যজনের দিকে, যে তখন আনিসের পায়ের কাছ থেকে বড় ব্যাগটা টেনে বের করছে। একরকম কোন কিছু চিন্তা না করেই আনিস খপ করে ছেলেটার হাত চেপে ধরলো, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্যজনের হাতের কড়া কয়েকটা থাপ্পড় খেয়ে আবার সেই আঁটুনি ছুটতেও বেশীক্ষণ লাগলো না।
প্রথমজন ব্যাকপ্যাক, আর দ্বিতীয়জন ব্যাগ দখলে নিয়ে, আনিসের কাছে নেওয়ার মত আর কিছু নেই নিশ্চিত হয়ে ওকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামালো। একজন আনিসকে চেপে ধরে রাখলো আর অন্যজন ওর চোখে কি যেন ঘষে দিতেই চারপাশের যেই সামান্য আলো এতক্ষন আনিসের চোখে পড়ছিলো তাও নিভে গেলো। একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ওকে গ্রাস করে ফেললো। অন্ধের মত হাঁতড়ে হাঁতড়ে যেন যুবক দুজনের ধরার চেষ্টা করছে, এমন সময় বেকায়দা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে ও রাস্তার পাশে নিচুমতো জায়গাটায় পড়ে গেলো। পুরো শরীরটা বাঁ পায়ের উপর পড়ার ব্যাথায় কাতরে উঠতে গিয়েই আনিস একটা হাসির আওয়াজ শুনে থমকে গেলো। এইটা ওই দুজনের কারো গলা নয়। এই গলা ওই বাচাল ড্রাইভারের! যেন আনিসের সন্দেহ দূর করতেই এবার ড্রাইভার কথা বলে উঠলো, “কিছু মনে কইরেন না বস! আপনে নিজেই তো বললেন, এই শহরে আর সৎভাবে বেঁচে থাকার উপায় নাই!” যেন খুব বড় ধরনের একটা রসিকতা করা হয়েছে এমন ভঙ্গিতে তিনজনই এবার হাসতে শুরু করলো। হাসির আওয়াজ আস্তে আস্তে একটু দূরে সরে গেলো, আর তার পরপরই দরজা বন্ধের আওয়াজে বোঝা গেলো তিনজন গাড়ি নিয়ে কেটে পড়ার পাঁয়তারা করছে।
এইদিকে আনিস পাগলের মতো ব্যাস্ত হাতে নিজের শার্টের বোতাম খুলছে। দুই চোখে নিকষ অন্ধকার, কিন্তু তাও কি এক অজানা কারনে ওর উপর যেন এক নতুন উদ্যম এসে ভর করেছে। গাড়িটা স্টার্ট হওয়ার আগেই যা করার করতে হবে। একবার বেশিদূর চলে গেলে আর উপায় থাকবেনা। শার্ট খুলে ফেলতেই আনিসের হাতে ঠেকলো একগোছা তার আর একটা সুইচ। গাড়ি এখনো ছাড়েনি, ব্যাগটা নিশ্চয়ই এখনো পিছনের সীটেই আছে। আর ব্যাগের ভিতরে আছে ওদের নিজেদের তৈরি বোমা। হয়তো চোখে দেখতে পারছেনা বলেই গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ার আওয়াজ প্রচণ্ড জোরে এসে আনিসের কানে লাগলো, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ওর আঙ্গুল সুইচের উপর পড়লো। নির্জন অন্ধকার রাতের বুক চিরে একটি বিস্ফোরণের শব্দ চারপাশ কাপিয়ে তুললো।

হাম্মাদ আলি
জানুয়ারী ২০১৩, ঢাকা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক গল্পের টোনা

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।