এই তো সেদিন ছেলেটা পিচ্চি একটা বাবু ছিল; ধেই ধেই করে বড় হতে হতে আজ কত্ত বড় হয়ে গেছে চোখের সামনে, তবুও আমার কাছে সে বাবুই হয়ে আছে। যেন এক টুকরো সবুজ স্বপ্ন বড় এক পর্বতের শুভ্র শৃঙ্খ হতে চলেছে। আজকাল ছেলেটা কোথায় কখন কী করে, ভবিষ্যতে কী করবে- এইসব স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মাঝ দিয়েই ভোর-রাত পার করি। যদি দুই ভাই-বোনের জন্য সুস্থ সুন্দর একটা ভবিষ্যত্ না রেখে যেতে পারি, যদি এরা কষ্ট আর মলিন জীবন-যাপন করে,- এই আশংকায় রাত যাপন করি। জানি, দুও জনই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, পড়ছে সেরা এক স্কুলে; সব সময় মার্ক থাকে ৯৫, হয়তো এই কারণে প্রত্যাশাও বেশি বেশি। যে আশংকায় থাকি তা হয়তো ওদের জীবনকে স্পর্শ করতে পারবে না, তবুও শেষ বিন্দুতে পৌঁছার আগপর্যন্ত অহেতুক একটা চিন্তা ভাবনা থেকেই যায়|
কেন, জানি না। বেশ কিছুদিন আগে, আমি ঘরে বসে আছি; প্লাবন স্কুল থেকে ফিরে আমাকে আবদারের সুরে বলছেঃ: মা, একটা কথা বলি? কিছু মনে করবে নাতো?
: না, বল...
: আমার ক্লাসের একটা মেয়েকে আমার ভালো লাগে।
: কে?
: আমি যে স্কুলে চান্স পেয়েছি, সেও ঐ স্কুলে চান্স পেয়েছে। ওর সাথে প্রেম করব। কিছু বলবে নাতো তুমি, মা?
আজকাল ঢাকা শহরটা অনেক যান্ত্রিক হয়ে গেছে। সবাই রোবট যেন। ভাঙ্গা কলের ছাঁচে ঢালাই করা রোবট। এইতো, ১৭ বছর আগেও এত গাড়ি-ঘোড়া, যান-জট, ধোঁয়া আর এত মানুষ ছিল না। তখন শহরটার একটা প্রাণ ছিল। এই শহরের যেসব রাস্তা-ঘাট আর চার দেওয়ালের মাঝে আমরা বেড়ে ওঠেছি, সেইসব জায়গায় আজো হয়তো বালিকা বয়সের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। খুঁজতে যাই ওসব আর। খোঁজার ইচ্ছেও করে না। 'হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কে আর ভালোবাসে?' প্রিয় শহর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে নাগরিক যান্ত্রিক শহরে প্রতিদিন রুটিন মাফিক জীবন যাপনের অবসরে যখন কিছু সময়ের জন্য একটু পিছন ফিরে তাকাই, ফেলে আসা কতশত বন্ধু-বান্ধবের মাঝে অন্য কোন একজনের স্মৃতি হয়তো উঁকি দেয় মনে। হ্যাঁ, কল্পনায় প্রতিদিন আমি আমার ঘরটা একটু একটু করে সাজাতাম। ইট বালি সিমেন্ট রড দিয়ে গড়ে তোলা ঘরটাতে প্রতিদিন আমরা রং মাখতাম। কল্পনার রং। আকাশী রঙের ঘরটা যেদিন খাড়া করতে পারলাম, সেদিন মনে হলো, রঙটা আরেকটু গাঢ় হলে, ভালো হতো। এইভাবে প্রতিদিন আমাদের স্বপ্নের ঘরটা ভাঙতাম আবার গড়তাম, আর প্রতি মুহূর্তে ক্লান্তি রঙ পাল্টাতাম। আকাশি থেকে গোলাপি, গোলাপি থেকে সর্ষের ফুলের মত হলুদ, আবার কখনো বা জাফরানি! আমার এই ভাঙা গড়া আর রঙ মাখামাখি কখনই শেষ হতো না, তার আগেই একদিন ঘরখানার রং ধুসর হতে থাকে, অবশেষে একদিন বালির বাঁধের মত ভেঙেই পড়ল। এতদিন আমি তার হাতধরে যে রাস্তা বরাবর হাঁটছিলাম, হঠাত্ করেই যেন টের পেলাম, গন্তব্যে পৌঁছার আগেই রাস্তাটি শেষ হয়ে গেছে। সামনে এগুবার আর রাস্তা নেই। পেছন ফেরারও কোন জো নেই। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাশ ফিরে দেখি আমি একা, আমার ছায়াটির মতই একা। ততোক্ষণে রঙিন স্বপ্নের জায়গায় ধূসর দুঃস্বপ্নরা ভিড় জমিয়েছে...
একই ছাতায় দুটি মাথা; চারপাশে বৃষ্টি পড়ার অবিরাম শব্দ। আর গল্প। নির্জন রাস্তায় পায়ে পায়ে হেঁটে চলা সাথে কথার ঝুড়ি। বদ্ধ কেবিনে মুখোমুখি। সবদুঃস্বপ্ন এখন। মনে হলো, আমার আর কোনো বর্তমান নেই, ভবিষ্যত্ নেই;- আছে শুধুই বিষাদমাথা অতীত। তাকে ঘিরে যে স্বপ্নটাকে একটু একটু করে আপন মনে গড়ে তুলছিলাম, যা কোনোদিন ভেঙে যাবে- ভাবি নি; সত্যি যখন ভেঙে গেল, আর সমস্ত স্বপ্নই নিমিষে ফিকে হয়ে গেল। নিজেকে এত অসহায় আর কখনই বোধ করি নি। ভয়াল এক শূণ্যতার গহ্বরে পা পিছলে যেন পড়ে গেলাম। হাত ধরে উপরে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস যে নেব এমন কারোর হাত খুঁজে পেলাম না। একাকীত্বের ঘন কালো জল অন্ধ কূপে টলমল করতে লাগল। সবার মাঝে থেকেও অসহায়...
আমার বাবুটারও যদি এমন হয়? যদি মেয়েটা একদিন চলে যায়? তবে তো আমার এই লক্ষ্মীটাও একদিন ভেঙে পড়বে। তার একান্ত নিজস্ব ভুবনে নেমে আসবে অনন্ত রাত্রি! কষ্টে বিষন্নতায় একদম ভেঙে চুরে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোন সুখই তাকে আর তেমন করে সুখী করতে পারবে না। হয়তো একদিন তার মনে মেয়েটা ফিকে হয়ে আসবে কিন্তু মন ভাঙার দাগ সারাজীবনে কেমনে সারাবে?
কিন্তু তার হাসিখুশি মুখ দেখে তাকে মানা করতে পারলাম না। মনের ভেতর যে সুখটা এখন খেলে বেড়াচ্ছে, আমার একটা 'না' শব্দের কারণে যদি তা থেমে যায়, তবে তো এইটুকুন বয়সেই বিষন্নতা নেমে আসবে তার একান্ত পৃথিবীতে। তাই আর কিছু না ভেবেই আমি রায় দিলামঃ
: আচ্ছা, রাগ করব না বাবা। তবে, কথা দাও, কোনোদিন মেয়েটা যদি তোমাকে ছেড়ে চলে যায় তবুও তুমি মন খারাপ করবে না।
: আচ্ছা মা।
: শোনো বাবা, ওমন একটা মেয়ে গেলে আরো দশটা মেয়ে আসবে তোমার লাইফে। ওটা নিয়ে কখনও মন খারাপ করবে না কিন্তু?
আমার এই সম্মতিতে বাবুটার মুখে যে খুশির রেখা ফুটে ওঠল, আমার সমস্ত অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য তা যথেষ্ট; চাইলেই শুধু ছেলেটার এই হাসিখুশি মুখখানার দিকে তাকিয়ে হাজারটা বছর কাটিয়ে দিতে পারি।
-কিঙ্কর আহসান
মন্তব্য
এখানে মনে হয় একটা 'না' এর অভাব আছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ভাই। পোস্ট করার সময় খেয়াল ছিল না।
-কিঙ্কর
নতুন মন্তব্য করুন