খবরটা পেলাম দুপুরের দিকে, ফেসবুকে। কসাই কাদেরের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। প্রথমে ভাবলাম হয় আমি ভুল দেখছি না হয় যে শেয়ার করেছে সে ভুল করেছে। সাথে সাথে বিডি নিউজে চেক করে দেখলাম কাহিনী আসলেই এইরকম; বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে কসাই হারামজাদার ভি সাইন ওয়ালা ছবি দেখে আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তখনো শাহবাগের খবর পাইনি আমি। সেদিনই বই মেলায় যাওয়ার কথা ছিলো।
আটটার দিকে সি,এন,জি নিয়ে রওনা দিলাম। বার্ডেম পর্যন্ত এসে দেখি রাস্তা বন্ধ। শ'খানেক মানুষ রাস্তা বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছে। একজন ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বললো কসাই কাদেরের রায়ের প্রতিবাদ চলছে। কি মনে করে আমিও বসে পড়লাম উনাদের সাথে। এখান থেকেই আমার শাহবাগ সংগ্রামের শুরু। তবে এদিন বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। মা সাড়ে দশটার দিকে ফোন দিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরিয়ে আনল। তখনও আমি জানতাম না পরবর্তী ৭২ ঘন্টা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তাল সময়।
পরেরদিন অফিসে বসে ফেসবুকে শাহবাগের দিনের ছবি দেখে একটু নড়ে চড়ে বসলাম। শ'খানেক মানুষের জটলাটা এখন হাজার খানেক মানুষের ভিড়ে পরিণত হয়েছে। একটু আশার আলো দেখলাম, আমরা কি তাহলে স্বতস্ফূর্ত কোন মুভমেন্ট করতে যাচ্ছি। বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আজকেও যেতে হবে। সেদিন আর দেরি করলাম না। পাঁচটা বাজার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়লাম শাহবাগের রাস্তায়। সন্ধ্যার একটু পরে শাহবাগ পৌঁছে আবারো বিস্মিত হলাম, দুপুরের ছবির তুলনায় কয়েকগুন বেশি মানুষ আছে ওখানে। মঞ্চ থেকে শ্লোগান আসছে "ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই - রাজাকারের ফাঁসি চাই"। ভিড়ের মধ্যে বসে পড়ে আমিও শ্লোগান দিতে থাকলাম - জীবনে প্রথমবারের মতো। প্রতিটি শ্লোগান দিচ্ছি আর রক্তের সাথে একটি অনুভূতি মিশে যাচ্ছে - আমার প্রতিটি রক্তকণাও যেন আমার সাথে শ্লোগান দিচ্ছে। । সে অন্যরকম অপার্থিব অনুভুতি। কখন যে রাত বারোটা বেজেছে খেয়ালই করি নাই, শুধু মনে আছে একবার আম্মুকে ফোন করে বলেছিলাম আসতে দেরি হবে। ফিরে আসার সময় মনে হলো শাহবাগে একটি ভীতু ছেলে হয়ে এসেছিলাম, ফিরে যাচ্ছি জাগ্রত জনতা হয়ে।
বাসায় এসেই টিভি খুলে বসলাম, শাহবাগকে কে কিভাবে দেখাচ্ছে দেখার জন্য। কিন্তু কোন চ্যানেলই তেমনভাবে দেখাচ্ছে না। এসে ফেসবুকে বসলাম। ততোক্ষণে ছাগলগুলার ম্যাৎকার শুরু হয়ে গেছে। শাহবাগে যাওয়ার সুবাদে নাস্তিক, গাঞ্জাখোর আর বাম-রামের খাতায় নাম উঠে গেলো। রাত তিনটার দিকে মনে হলো, এই গণজাগরণকে সবাইকে দেখার ব্যাবস্থা করতে হবে। কয়েকটা গ্রুপে গিয়ে বললাম লাইভ স্ট্রিমিং করার কথা, কিন্তু কেউ তেমন পাত্তা দিলো না। তখন মাথায় একটা অদ্ভুত রকমের জেদ চেপে বসছে। আমাকে এটা দেখাতেই হবে। ভোর পাঁচটার দিকে USTREAM [www.ustream.tv/channel/shahbag-mor-love] channel ক্রিয়েট করে, ল্যাপ্টপ আর ওয়েব ক্যাম আর বাংলা লায়নের ১ এম,বি,পি,এস এর একটা ইন্টারনেট লাইনের ব্যবস্থা করে একটা অসীম প্রাণ শক্তির একটি ছেলেকে দুপুর পর্যন্ত স্ট্রিম করানোর দ্বায়িত্ব দিলাম। আমি আফিসে এসে দেখি স্ট্রিমিং শুরু হয়ে গিয়েছে। ২ ঘন্টায় ৬০০০ ভিউ। সেদিন আর কোনভাবেই পুরোদিন অফিস করতে পারলাম না। অর্ধেক বেলার ছুটি নিয়ে আবার শাহবাগ চলে এলাম। বাসায় জানায়া দিলাম অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি রাতে বাসায় যাবো না।
তিনটার দিকে শাহবাগ পৌঁছালাম। এখন আর শাহবাগে মানুষের ভিড় নেই, শাহবাগ তখন জন সমুদ্র। মঞ্চ থেকে লাকির অগ্নিকন্ঠের শ্লোগান ভেসে আসছে। আবারো সেই অনুভুতি। শ্লোগান দিতে থাকলাম। শ্লোগান দিতে একটা দলের সাথে বসে বসে পোস্টার বানাচ্ছি কখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা এলো টের পেলাম না। সন্ধ্যার পরে যেনো মানুষের ঢল নামল শাহবাগে - সব বয়সের, পেশার, ধর্মের, শ্রেণীর মানুষ। কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করলাম আমি একটা ছোট দলে শ্লোগান পরিচালনা করছি - ক - তে কাদের মোল্লা - তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। জয় বাংলা, জয় বাংলা। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এভাবে রাত আরেকটু গভীর হলো, দেখি একজন টাকা তুলছে যারা রাতে থাকবে তাদের খাবারের জন্য। কিছু টাকা উঠল কিন্তু সেটা দিয়ে খাবার হবে না। ওই ছেলেটা আর আমি গিয়ে ৪০ প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে আসলাম। কেউ কাউকে চিনি না, কিন্তু সবাই এমনভাবে ওই বিরিয়ানী গুলো ভাগ করে খেলাম যেন আমরা বহুদিনের আত্মীয়। সারারাত আমরা শ্লোগান দিলাম, গান গাইলাম, কবিতা আবৃত্তি করলাম। কয়েকশ মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখলাম।শাহবাগ চতুর্থ দিনে পদার্পন করল।
আমি সকালে আবার অফিসে আসলাম। শুক্রবার আমার উইকডে। কিন্তু আজকেও কোন কাজ করার ইচ্ছা বা মানসিকতা ছিলো না। তার উপর আজকে মহাসমাবেশ। কিন্তু ছুটি ম্যানেজ করতে পারলাম না। দূর থেকেই আমাকে মহাসমাবেশ দেখতে হলো। অফিস শেষ করেই আবার ছুটে এলাম শাহবাগে। এখন শাহবাগে মানুষের মহা সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। স্লোগান দিতে গিয়ে দেখলাম গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। তারপরও শ্লোগান দিতে লাগলাম, নিশব্দ শ্লোগান। দশটার দিকে আর না পেরে বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় আম্মু আমার গলার অবস্থা দেখেই ঘটনা বুঝে ফেললো কিন্তু কিছু বলনা। শুধু সকালে যখন ঘর থেকে হতে নিলাম, আম্মু কোথা থেকে যেন একটা পতাকা নিয়ে এসে আমার মাথায় বেঁধে দিল আর বললো, "সাবধানে থাকিস।" আর এভাবেই আমি ২০১৩ -এর গণ জাগরণের সাক্ষী হয়ে গেলাম।
যুগল বন্দী সংগ্রামে,
প্রেমিকার চিবুকের তিলে,
আর প্রেমিকের দীপ্ত কন্ঠে-
বেঁচে থাকুক ভালবাসা।
গর্জে উঠুক স্বাধীনতা-
জয় বাংলা...।। -------- বিজন শারিয়ার (১৪/০২/২০১৩)
মন্তব্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
াপনাকে কি বলে বাহাবা দিবো জাগরনের লাল সালাম। ছাগুদের দিলাম ধিক্কার --------
নতুন মন্তব্য করুন