তিন পুরুষের স্মৃতি চারণঃ প্রথম পর্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/০২/২০১৩ - ১০:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার জন্ম সত্তুরের দশকের শেষের দিকে, স্বাধীন বাংলাদেশে। আমি বাহান্নর ভাষা আন্দোলন দেখিনি, ঊনসত্তুরের গনআন্দোলন দেখিনি, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমি দেশের ইতিহাস পড়েছি বইয়ে। কিন্তু এসব ঘটনা আমার মনে জীবন্ত হয়ে আছে অন্য একটি কারনে। স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের আর সবার মতো, আমি ছোটবেলা থেকেই এসব ঘটনার কথা শুনেছি বড়দের মুখে। ইংরেজিতে যাকে বলে, first-hand account; বাংলায় “প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ”।
আমার কাছে যা হল ‘গল্প’ আর বইয়ে পড়া ইতিহাস, একদিন আমার আব্বা, আম্মা, নানা, নানি, দাদির কাছে তাই ছিল বাস্তবতা। তাদের মুখে শোনা এই ‘গল্পগুলো’ কখনো সাহসের, কখনো আনন্দের, আবার কখনো তীব্র কষ্ট ও ত্যাগের। এমনই জীবন্ত, যে তারা গেঁথে গেছে চায়ের পিরিচে চুমুক দেয়া শিশুটির মগজে আজীবনের মতো। এসব উপ্যাখান অসাধারণ কিছু সময়ের, যখন ব্যাক্তি এক হয়ে গেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে। স্বভাবতই, এসব কাহিনী স্মৃতির দুর্বলতা আর আবেগে কিছুটা দুষ্ট। কিন্তু এইটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, বড়দের স্মৃতিচারণ ছিল স্বার্থহীন, সরল ও জীবন্ত। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের খাতিরেই এসব ‘গল্প’ রক্ষা করা প্রয়োজন। দেশপ্রেম শুধু ইতিহাসের বই পড়ে গড়ে উঠে না। ব্যাক্তিগত সংগ্রাম আর ত্যাগ, ইতিহাসের মোটা বইয়ের পাতায় ঠিক কেমন যেন ধরা পড়ে না। লাঞ্ছিতা এক বীরাঙ্গনার কথা শুনে তারা কাদুক, শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের গল্প শুনে তাদের ছোট ছোট বুক ভরে উঠুক শ্রদ্ধা ও গৌরবে। কাছের মানুষের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কথা জানলেই না তারা হবে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। যাদের হাতে একদিন এদেশের ভার তুলে দিয়ে আমরা ঘুমিয়ে যেতে পারবো নিশ্চিন্তে।

“এক কুত্তা জমিন পর লেটা হ্যায়”।
বঙ্গানুবাদঃ একটি কুকুর মাটিতে শুয়ে আছে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্কুলে উর্দু শেখানো ছিল বাধ্যতামুলক। এই প্রসঙ্গে উপরোক্ত উর্দু বাক্যটি হুমায়ুন আহমেদ বা জাফর ইকবালের বইয়ে আমার প্রথম পড়া। আম্মাকে জিজ্ঞেশ করেও একই কথা জানলাম। গজ গজ করে বললেন, “যে ভাষা পশ্চিম পাকিস্তানেও বেশি মানুষ বলতো না, সেটা আমাদের শিখতে হয়েছে পাকিস্তানের নামে। তুমি আর তোমার ভাই যদি মনে কর স্কুলে তোমাদের বাংলা আর ইংরেজি শিখতেই অনেক কষ্ট, আমাদের কথা ভেবো, আমাদের উর্দুও শিখতে হয়েছে।” আলোচনা পড়াশুনা বিষয়ক বিপদজনক মোড় নিতে যাচ্ছে দেখে সেবার আর কথা বাড়ালাম না।

এই বিষয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্পটি শুনলাম আমার নানার মুখে। নানার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, যৌবন কেটেছে পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে, আর আটচল্লিশ বছর বয়সে তিনি যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছেন বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলের ছাত্র। সদ্য বিয়ে করেছেন। হোস্টেলে থাকা সেই যুবকের মন পড়ে থাকে গ্রামের বাড়িতে। এমন সময় খবর পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঘোষণা করেছেন, “উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”।
উপস্থিত ছাত্র শিক্ষকেরা তাৎক্ষনিক জবাব দিলেন “না, না, না”।
এর পরের ঘটনা গুলো ইতিহাস হয়ে গেল। ঢাকা মেডিকেলের সামনে ভাষার দাবিতে গুলিতে প্রাণ দিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। পরদিন এ ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে আমার নানা ও তার সহপাঠীরা মিছিল বের করলেন। পুলিশ তাদের ভ্যানে উঠিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অনেক দূর নিয়ে গেল। নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে যেতে বললো, “এইবার পায়ে হেঁটে ফেরত যা”।
জায়গাটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই, ‘in the middle of nowhere’; আমার নানা ও তার বন্ধুরা সারাদিন হেঁটে হোস্টেলে ফিরলেন সন্ধ্যায়। আন্দোলন দমনে চট্টগ্রামের সেই পুলিশের গান্ধী-মার্কা অহিংস পদ্ধতির কথা ভেবে অবাক যতটা হলাম, তার থেকে অনেকগুন বেশী গর্ব হল আমার নানার জন্য যিনি আমার মুখের ভাষার দাবীতে সেদিন পথে নেমেছিলেন।

ছোটবেলায় এরপর প্রতি বছর বিশে ফেব্রুয়ারী রাতে আমাদের বাড়ির উঠানের এক কোনায় আমি আর আমার ভাই ছোট একটা শহীদ মিনার বানাতাম। আব্বা শিখিয়েছিলেন। খুব সহজ একটা কাজ; দরকার তিনটি ইট আর লেপার জন্য সামান্য কাদামাটি। ফুল দিয়ে আমরা গাইতাম, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো...”।
সকালে খালি পায়ে প্রভাত ফেরী।

পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেলে ছাত্র হবার পর আমি প্রথম যে কাজগুলো করেছিলাম তার মধ্যে একটি হল, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি জড়িত গেইটটি দেখতে যাওয়া। যেখান থেকে সালাম বরকতেরা দৃপ্ত কণ্ঠে মিছিল বের করেছিলেন, “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”।
সেখানে শত শত রোগী আর লোকের ভিড়ে দাড়িয়ে সেদিন মনে হয়েছিল, আমি অনেক বড় কিছুর অংশ।
এই চেতনার নামই বাংলা ভাষা,
এই চেতনার নামই একদিন হল, বাংলাদেশ।

...চলবে।

গোলাম খন্দকার
২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৩


মন্তব্য

lopamudra এর ছবি

দারুন

গোলাম খন্দকার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, লোপামুদ্রা।

কৌস্তুভ এর ছবি

বেশ, বেশ। চলুক।

গোলাম খন্দকার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, কৌস্তভ।

সুদীপ  এর ছবি

চলতে থাকুক।

গোলাম খন্দকার এর ছবি

ধন্যবাদ, সুদীপ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।