ম্যারি লুইস পণ্ড

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৮/০৩/২০১৩ - ৬:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের এখানের বাসার ভিউ খুব সুন্দর। সামনে বড় লন, সুমিংপুল, বাচ্চাদের প্লে গ্রাউনড! ছবির মত সব কিছু। সব কিছু ছবির মত হওয়া সত্ত্বেও আমার আপন আপন লাগে না। এটা মনে হয় মানুষ টু মানুষ নির্ভর করে। কত মানুষকে দেখছি গাল ভরা হাসি দিয়ে প্রবাসী জীবন খুব ভাল লাগে বলে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে দেশের দুর্দশার গল্প করে। আমি নিজে নিজে একটা এনালাইসিস করেছি। তুমি যদি শক্ত মনের মানুষ হও, তোমার যদি বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি টান কম থাকে তাহলে এই বিদেশ তোমার। আফসোস আমি তেমন না। আমার দিনের অর্ধেক সময় যায় পুরানো কথা মনে করতে করতে। কিন্তু আমি এতটাই নরম মনের না যে সামনে কী হয় তা না দেখে কেঁদে-কুটে দেশে চলে যাব। মানুষ খুব তাড়াতাড়ি খাপ খাওয়াতে পারে। আমিও পারছি। আমি এখন আমেরিকান মানুষের মাঝে নিজের আত্মীয়দের মিল খুঁজি! সমিকের এক কলিগ আছেন জন নাম, রসিক মানুষ আমি তার মাঝে আমার শাহীন মামার মিল পাই!

এখানে এসে লনে আমি আমার নানুর বয়সী একজন মহিলাকে দেখি। প্রায়ই বিকেলে তাঁর নাতিকে নিয়ে খেলতে আসেন। লনের একটা জায়গা একটু ঢালু নাতি ওখানে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থেকে নানুকে ডাকে। নানু দেখেও ‘কই গেল, কই গেল’ বলে। ঠিক তখন আমার ছোটবেলার কথা মনে পরে যায়। যদিও আমার কিছুই মনে নেই, নানুর মুখে শোনা। আমি যখন ছোট তখন নাকি নানুর সাথে লুকোচুরি খেলতাম। একবার পর্দার পিছনে লুকিয়েছি নীচে পা বের হয়ে আছে। নানু আমাকে দেখে বললেনঃ ‘পাদুটো রেখে অমি গেল কই?’ আমি নাকি হাসতে হাসতে বের হয়ে এসে মাকে বললামঃ ‘মা, নানু কত বোকা পা-র উপর যে আমি আছি তা বুঝে নি।’ আমার সেদিন এত মন খারাপ লাগল যে আমি ওই নানু আর নাতির দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিলাম। এই দেশের একটা খুব ভালো দিক হচ্ছে কেউ কারও দিকে তাকায়ে না। কাজেই আমি যে বারান্দায়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলাম তা কেউ বুঝল না।

গত পরশু আমি আর সমিক এপার্টমেন্টের কিছু ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে অফিসে গেলাম। তখন খুব বৃদ্ধা এক মহিলা এলেন। ছোট খাটো সাইজ খুবই কিউট দেখতে। এখানকার বৃদ্ধ মানুষ কিউট হয় না। এরা এত দিন বাঁচে ফলে এদের মুখে এত বলি রেখা পরে যায় যে চেহারাতে মায়া মায়া ভাব আর থাকে না। এই মহিলার মাঝে আছে। সেই মহিলাও কোন এপার্টমেন্টের সমস্যা বলতে এসেছেন। বিদেশে এলে অনেককে বাংলাদেশ কই চিনাতে বহু উদাহরণ টানতে হয়। ধন্যবাদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এবং সাকিব আল হাসানকে এদের কল্যাণে তবু দেশেকে চিনাতে সুবিধা হচ্ছে নইলেতো সেই বন্যা দুর্গত এলাকা হিসাবে যুগ যুগ ধরে শুনে আসছি। এই বৃদ্ধা মহিলা একবারেই বাংলাদেশ চিনে গেলেন। সবচেয়ে যেটা ভাল লেগেছে বাংলাদেশকে ‘ব্যাংলাদেশ’ না বলে বাংলাদেশই বললেন। বৃদ্ধা মহিলা একা বাসায়ে থাকে, একা রাঁধে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম চার্চের পাশে এক রুমে বসে তারা গান গায়, তিনি পিয়ানো বাজান। আমি দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। উনি বার বার বললেন, ‘এটা বুড়োদের জায়গা কোন ইয়াং মানুষ তাতে যায় না।‘
আমি বললাম, ‘তোমাদের বাঁধা না থাকলে আমার যেতে কোন আপত্তি নেই।’ তার সাথে আমি সেখানে গেলাম। উনি খুবই খুশি। বিশাল ভারী ব্যাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুলো নিলাম। নিয়ে দেখি বিরাট ওজন! উনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে আমারই ভয় লাগে। হুট করে হাতটা ধরে ফেলি। উনি প্রতিবারই ‘সো নাইস অফ ইউ’ ‘সো কাইন্ড অফ ইউ’ জাতীয় বাক্য ব্যবহার করেন। সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মিলন মেলাতে তিনি চমৎকার পিয়ানো বাজালেন। ৮৫ বছর ধরে সে পিয়ানো বাজায় কাজেই আমার বলার প্রয়োজন নেই তিনি কেমন বাজান। সবাই গান গাচ্ছে তিনি পিয়ানো বাজাচ্ছেন। আমি মুগ্ধ! আমাকেও গানের কপি দেয়া হল। সবচেয়ে মজা লেগেছে আমার নাম সবাই অপলা উচ্চারণ করেছে আমি ‘উপুলা’ ‘অপালা’ হয়ে যাই নি। আমি লিখার শুরুতে বললাম না এখানের আমেরিকান মানুষের মাঝে নিজের আত্মীয়দের মিল খুঁজি। আমার প্রবাস জীবনের প্রথম ৯০ বছরের বন্ধু ম্যারি লুইস পণ্ডের মাঝে আমি আমার নানুর মিল খুঁজে পাই।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি

বাপ্পীহায়াত এর ছবি

চমৎকার লাগল - কথাগুলো খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লিখেছেন

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ! হাসি

ফ্রুলিংক্স এর ছবি

খুবই ভালো লাগলো।
মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে থেকেও বছরে ১/২বার দেশে উড়াল দেই। এইবার বিমানবন্দরে বেশ ভালো অভিক্ষতা হলো। একজনকে তো ভালোই ঝাড়ি দিলাম। কানাডার পাসপোর্ট হাতে আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলেন। ঝাড়ি দিয়ে ইংরেজির বাংলা অনুবাদ করালাম।
নানুর কথা বলায় চোখে পানি চলে আসলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের টাকা জমলে আমরাও আগামী বছর দেশে যাব ইনশাল্লাহ। ধন্যবাদ। হাসি

বেচারাথেরিয়াম এর ছবি

কথা ঠিক বলেছেন দেশের সবার জন্য টান কম থাকলে বিদেশ তোমার। প্রায়ই চেষ্টা করি বিদেশ আমার বানানোর জন্য। কিন্তু হয় না। দেশটাই আমার, বিদেশটা না।

সুন্দর লিখেছেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

''দেশটাই আপনার'' কী সুন্দর গর্বের কথা!! মনটা ভরে গেল। হাসি

 সাম্পানওয়ালা এর ছবি

গুরু গুরু চমৎকার গোছানো লেখা। পরে ভাললাগল। কিন্তু ছোট হয়ে গেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

টেনে লিখা বড় করার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই নেই। দেঁতো হাসি তবে আপনার মন্তব্য মাথায়ে রাখব। অনেক ধন্যবাদ। হাসি

অচল এর ছবি

মন খারাপ সকাল সকাল মনটা খারাপ করে দিলেন। আমার দিদার কথা মনে পড়ে গেল। অনেক সুন্দর লাগছে আপনার লেখা।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ আমারও মাঝে মাঝে এত মন খারাপ লাগে। ভাল থাকবেন। হাসি

আব্দুর রহমান এর ছবি

লেখা ভালো লাগলো। কিছু কিছু জায়গাতে ইংরেজির ব্যাবহার একটু চোখে লাগে। যেমন , "এটা মনে হয় মানুষ টু মানুষ নির্ভর করে"।

আপনার প্রবাস জীবন কত বছরের ? এই নরম অনুভূতি সাধারণত শুরুতে বেশি থাকে, ধীরে ধীরে ভেতরটা ভোঁতা হতে শুরু করে। তবে আপনি ব্যাতিক্রম হতেই পারেন।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

অতিথি লেখক এর ছবি

"এটা মনে হয় মানুষ টু মানুষ নির্ভর করে" এইকথাটি লিখার সময় কেন জানি কোন বাংলা খুঁজে পাই নি। ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ। হাসি

বনজোছনা এর ছবি

আমি মাবাবা-আত্মীয় স্বজন নিয়ে দেশেই আছি , তারপরও লেখাটা পড়ে মনটা কেমন কেমন করছে ! ভীষণ মায়াবী লেখা ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক
বেশ লাগল তো। মনের কথাটা সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। বিদেশে কমবেশি সবারই মনে হয় এমন অনুভূতি হয়। হঠাৎ করেই কোন একদিন আকাশ দেখে, বৃষ্টি দেখে, রোদ দেখে, কোন মানুষ দেখে, কোন দৃশ্য দেখে ফেলে আসা দেশ, মানুষ আর দিনগুলোর জন্য মনটা বড্ডও কেমন করতে থাকে। ফেলে আসা সহজ, ফিরে যাওয়া সহজ নয়।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি আপনার ''ফেলে আসা সহজ, ফিরে যাওয়া সহজ নয়'' লাইনটি পড়ে আমার মনটা কেমন কেমন করছে। মন খারাপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

- লেখার শেষে নিজের নাম বা নিক দিন। তাহলে আমরা বুঝতে পারবো কার লেখা পড়লাম। অপলা আর অমি_বন্যা নামে দুইজন সচল আছেন, তাই এই দুইটা নাম সরাসরি ব্যবহার করতে পারবেন না।

- ইংরেজী নামের বাংলা করতে গেলে 'পন্ড' হবে, 'পণ্ড' নয়।

- এই আকারের লেখা দিলে তাতে একটা টপিকে কনসেনট্রেট করুন। তাহলে লেখাটা জমবে ভালো।

সচলে স্বাগতম। লেখালেখি চালিয়ে যান।

অটঃ আমার একটা ব্যক্তিগত মত আছে। যাদের পক্ষে আর দেশে ফিরে আসা সম্ভব হবে না, তাদের পক্ষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ দেশের মূলধারায় মিশে যাওয়াই উত্তম। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে গেলে শুধু কষ্টই বাড়ে, আর কিছু হয় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার আসল নামই অপলা। ডাক নাম অমি। কারও এই নাম থাকলে আমি কী করব? মন খারাপ বাপ-মা র দেয়া নামতো বদলাতে পারি না। দেঁতো হাসি লিখার মাঝেই নিজের নাম আছে তাই আর শেষে দেই নি। নেক্সট টাইম নিচে লিখে দিব ইনশাল্লাহ। আপনার লাস্টের গুড়ি গুড়ি লিখা পড়তে পারি নি। ইয়ে, মানে... 'পন্ড' আর 'পণ্ড' এর পার্থক্য ষষ্ঠ পাণ্ডব ই ভাল বুঝবে। গুরু গুরু

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সেক্ষেত্রে আপনি আপনার পুরো নাম (ফার্স্ট মিড্‌ল্‌ লাস্ট) দিয়ে লিখতে পারেন। তাহলে আর ঝামেলা থাকে না।

ন + ড = ন্ড আর ণ + ড = ণ্ড। বিদেশি শব্দে 'ণ্ড' হবার কথা না।

Ctrl++ চাপুন তাহলে গুড়ি গুড়ি লেখাও পড়তে পারবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার পুরো নাম অপলা হায়দার। ইনশাল্লাহ এর পর থেকে নিচে দিব। এবার ইচ্ছা করে দেই নি।Ctrl++ ব্যাপারটা আমি জানতাম না, ধন্যবাদ। হাসি

বেচারাথেরিয়াম এর ছবি

অপলা হায়দার বেশি লম্বা লাগলে শুধু হায়দারও ইউজ করতে পারেন দেঁতো হাসি

[মজা নিলাম]

অতিথি লেখক এর ছবি

খাইছে

এলোমেলো এর ছবি

খুব সম্ভবত আপনি হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবাল স্যারের ভাগ্নি? আর শাহীন মামা সম্ভবত আহসান হাবীব। প্রথম আলোতে আপনার একটা লেখা পড়েছিলাম। এই লেখাটাও ভালো লাগলো। আমার নানুর কথা মনে পড়লো। আর আমার সন্তান এই প্রবাসে হলেও যেন নানুর আদর পায় মনে মনে সেই প্রার্থনা করলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

জি আমি বড়মামা এবং ইকবাল মামার ভাগ্নি। শাহীন, আহসান হাবীবের ডাক নাম আর আমরা ওই নামেই ডাকি। শাহীন মামা আমাদের বেশি প্রিয় দেখে ওনার কথা বেশি মনে পড়ে। মন খারাপ ঈশ্বর আপনার প্রার্থনা কবুল করুক। ধন্যবাদ। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।