কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১১/০৩/২০১৩ - ১০:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সারা দেশে মন্দির পোড়ে, হিন্দুদের বাড়িতে হামলা হয়, রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা হলো, এরকম অনেক ঘটনাই অতীতে ঘটেছে- কোনটিরই বিচার হয়নি, দায়সারা তদন্ত হলেও দোষীদের ধরা হয়নি। অথচ ব্লগে-ফেসবুকে ইসলামের কটূক্তিকারীদের শনাক্ত করতে কমিটি হয়ে গেছে। কার কোন কথাটি উগ্র, কার কোন কথাটি ধর্মপ্রাণ মানুষের কোমল ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছে- সেসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসবেন সরকার। বেশ ভাল কথা- কিন্তু এই কাজটি এমন সময়ে করা হচ্ছে যখন ধর্মান্ধ মোল্লার দল ইসলামের তথাকথিত কটূক্তিকারীদের ফাঁসির ধুয়া তুলে বিক্ষোভ মিছিল, শোডাউন, লংমার্চ করার ঘোষণা দিয়েছে এবং তাতে বাধা দেয়া হলে লাগাতার হরতাল দেয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে। কাঠমোল্লাদের লংমার্চ বা বিক্ষোভ সমাবেশ যে শান্তিপূর্ণ হয়না তার প্রমাণ ইতোমধ্যে সবাই দেখেছে। বাংলাদেশের বিপরীত প্রান্তে ইসলাম ধর্মের প্রচারককে নিয়ে একটি নিম্নমানের ছবি বানানোর খবর যখন ছড়িয়ে পড়ল, তখন এরাই দেশে হরতাল ডেকে গাড়ি পোড়াল, মানুষকে আহত করল, দেশের সম্পদ নষ্ট করল, যদিও এদেশের মানুষের বা সরকারের ওই ছবির সাথে কোন সম্পর্ক নেই। তাদের কথায় সরকারও ইউটিউব বন্ধ করে দিল, যদিও তাদের বেশির ভাগই হয়তো জীবনে কোনদিন ইউটিউবের নামও শোনেনি, ইন্টারনেট কম্পিউটারের নাম শুনলেও হয়তো এটাকে শয়তানের বাক্স বলেই মনে করে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা হয়েছিল নিরীহ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদেরই, যারা নিয়মিত ইউটিউব ব্রাউজ করত। তখন বিনা কারণে এদের প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে, তারপরও এরা হরতাল করেছে। এখনও এদের প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে- ধর্মানুভূতি আহত হওয়ার অযুহাতে।

দেশের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। প্রতিদিন মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে, গৃহহীন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ খুন হচ্ছে। কারা এসব করছে, তাদের চিহ্নিত করা, প্রতিরোধ করা, বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করাও কর্তব্য। সে দায়িত্ব পালনে মনোযোগ না দিয়ে সরকার এখন মৌলবাদীদের আবদার রাখতে ফেসবুকে ব্লগে আক্রমণকারী উগ্র লেখা খোঁজার কমিটি গঠন করেছে। ফেসবুক-ব্লগের লেখা কি বাংলার ষোল কোটি মানুষ পড়ে? নিশ্চই তা নয়, খুব কম সংখ্যক মানুষই এদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তাহলে মৌলবাদীদের উস্কে দিয়েছে কে, যার জন্য তারা বিক্ষোভ-সমাবেশের নামে মানুষের জান-মালের ক্ষতি করে দেশদ্রোহী জামাত শিবিরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে? কোনটা বেশি ক্ষতিকর, ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্মের কটূক্তি করা, নাকি সেই কটূক্তি কোটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা? আমাদের মনে রাখতে হবে- ইউটিউব কিন্তু “ইনোসেন্স অব মুসলিম” তৈরি করেনি, কিছু মানুষ ইউটিউবে এর ভিডিও আপলোড করে রেখেছিল। ইউটিউব বাংলাদেশের খুব কম মানুষই ব্যবহার করে। তাই ইউটিউবের মাধ্যমে ভিডিওটি সবার কাছে পৌঁছে যাবে, এমন কোন সম্ভাবনা ছিল না। তাছাড়া ইউটিউব কোন পত্রিকাও নয় যার প্রথম পৃষ্ঠায়ই এই ভিডিও দেয়া ছিল। তারপরও এই ইউটিউব নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অথচ ধর্মকে কটাক্ষ করে লেখাগুলো যখন কিছু নির্দিষ্ট পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশে ছড়িয়ে দিল, তারপরও সরকার নির্বিকার থাকল। এই কি সেই সরকার যারা ইউটিউব এদেশে বন্ধ করেছিল ধর্মানুভূতিতে আঘাতকারী ভিডিও ডিলিট না করার দায়ে? বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হয়, যখন গণমানুষের চাওয়া উপেক্ষা করে জামাতে ইসলামকে এখনো নিষিদ্ধ করার কোন পদক্ষে নেয়া হয়না সরকারের পক্ষ থেকে। আর কতগুলো লাশ পড়লে, আর কতগুলো মানুষ গৃহহারা হলে, আর কতগুলো সরকারি অফিস পুড়লে জামাতে ইসলামকে একটি সন্ত্রাসী দল বলা যাবে। একটি যুদ্ধাপরাধী দল দেশদ্রোহীতা করেও যথারীতি সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার তাদের মোকাবেলা যেমন যথেষ্ট প্রস্তুত নয়, তেমনি তাদের সৃষ্ট এত ধ্বংসযজ্ঞের পরও যেন সব বিষয়ে উদাসীন।

ধর্মানুভূতি নামক জিনিসটি কি শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? অনলাইনে ইসলাম ধর্মের সাধারণ সমালোচনা করলেও সেটাকে ইসলামের প্রতি কটাক্ষ হিসেবে দেখা হতে পারে, সেটা খুঁজে বের করার জন্য বিশেষ কমিটিও গঠন করা যেতে পারে। তবে হিন্দু-বৌদ্ধদের মন্দির-প্যাগোডা ভেঙ্গে ফেললেও তাতে কারো কোন অনুভূতি আহত হয় না, আহত হলেও কারও কিছু আসে যায় না। তারা জান-মাল সব হারিয়েও বিচার পাননা। মন্দির পোড়ালে ধর্মানুভূতিতে নয়, সরাসরি ধর্মেই আঘাত করা হয়। ধর্মীয় উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলা নিঃসন্দেহে সরাসরি ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আঘাত এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। তবে সেদিকে সরকারের তেমন কোন নজর নেই। সরকার হয়তো ভেবে নিয়েছে, তাদের যেহেতু যাওয়ার জায়গা নেই, তারা তো এই সরকারকেই বারবার নির্বাচিত করবে। সুতরাং, ভোট বেহাত হবে না। কিন্তু একটা জিনিস কি কেউ খেয়াল করেছে, এই যে নির্যাতিত মানুষগুলো ভয়ানক সব স্মৃতি বয়ে বেড়ান সারা জীবন, এমনকি তারা শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন বাঁচাতে ভিনদেশেও পাড়ি দেন? যদি এমন করে আস্তে আস্তে সবাই চলে যেতে থাকে, তাহলে সরকারের ভোট ব্যাঙ্ক দুর্বল হবে বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া নিজের দেশের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে না পারা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা। সরকারের সামনে এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতির চেয়ে লোক দেখানো কাজ করতেই যেন সরকার বদ্ধ পরিকর। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারকে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করার দায়িত্বও তারা কখনো নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে, কখনো কোর্টের ঘাড়ে ফেলছেন, যেন তাঁরা খুবই অসহায়। মানুষ সরকারকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার করতে। এখনো মানুষই গণজাগরণ আন্দোলনকে জাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু দেশের সকল অকাজে ছাত্রলীগকে দেখলেও যখন হায়েনাদেরকে প্রতিরোধ করা দরকার, তখন তাদের পাত্তা নেই। তারা শুধু নিরীহ ছাত্র-শিক্ষককে পেটাতে পারে আর চাঁদা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মাঝে মারামারি করতেই পারে। এক সময় শিবির প্রতিরোধের জন্য যে ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট ছিল, এখন কাজের সময় তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না। নীতি-আদর্শহীন একটি ছাত্র সংগঠনের এই পরিণতিই বুঝি হয়।

বিরোধি দল ভোটের লোভে আর টাকার লোভে বিক্রি হয়ে গেছে, সরকার বিরোধিতা করে সরকারের পতন ঘটানোই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। দেশ গোল্লায় গেলেও তা নিয়ে তাদের তেমন কোণ ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। বিরোধী দলের যে ভূমিকাটি পালন করা প্রয়োজন ছিল, সেই ভূমিকাটি নিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রেও জনগণের দাবিগুলো মেনে নেয়ার দিকে নজর দিচ্ছে না, হয়তো ভাবছে এসব বাচ্চা ছেলেপেলেরা আর কী করবে? বরং জামাত শিবিরকে আরো বাড়তে দেয়া যায়, দেখা যাক তারা কতগুলো লাশ ফেলতে পারে। এই লাশের সংখ্যা দেখিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে জামাত বি এন পি’র বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে। শাহবাগ আন্দোলন থেকে ফায়দা নিতেই পারে তারা, কিন্তু শাহবাগ তথা গণজাগরণকে ধোঁকা দিয়ে এ ফায়দা নিতে চাইলে তার জবাব দিতেও মানুষ কার্পণ্য করবে না। পাবলিক সেন্টিমেন্ট যে কোন সময় যে কোন দিকে হেলে পড়তে পারে, অশান্তি মানুষ চায় না। দেশে অশান্তি বেশি হলে মানুষ হয়তো পরবর্তীতে মৌলবাদী শক্তিকেই ক্ষমতায় আনবে আবার! আর সেটা হলে সরকারের ওভারকনফিডেন্সের মাশুল দিতে হবে, খুব বড় মাশুল।

১৯৭২ সালেও এদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি ছিল। তখনও মানুষ ধর্মপ্রাণ ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করা হলে তার ফল হবে ভয়াবহ। তাই সংবিধান হল ধর্মনিরপেক্ষ, জামাত শিবির হল নিষিদ্ধ। কিন্তু এই ২০১৩ তে এসে আওয়ামিলীগ বারবার যেভাবে মৌলবাদী শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেটা বেশ আশঙ্কাজনক। ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেও রাষ্ট্রধর্মকে ঝুলিয়ে রেখেছে। এখন জামাত শিবিরসহ অন্যান্য মৌলবাদীদের তাণ্ডবে দেশের অবস্থা ভয়াবহ। অথচ এমন সময়ে অনলাইনের প্রগতিশীলদের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার জন্য কমিটি গঠন করে প্রকারান্তরে মৌলবাদীদেরই উৎসাহ দেয়া হল। ইউটিউব নিষিদ্ধ করার পরও তারা যেমন হরতাল করেছিল, বাংলাদেশের সকল মুক্তমনাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলেও তারা এই তাণ্ডব চালিয়েই যাবে। কারণ, তাদের আপত্তি এ দেশটার বিরুদ্ধেই। তাই তাদের চাপে নতিস্বীকার করা একটি স্ট্র্যাটেজিক ভুল বলেই মনে করি। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন বোধহয় খুব দূরে নেই, যেদিন বাংলাদেশ আফগানিস্তানের মত একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তবু স্বপ্ন দেখতে চাই, সোনার বাংলা সোনার মানুষে ভরে উঠুক। জয় বাংলা।
- ক্ষুদ্র সত্তা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লেখা

স্যাম এর ছবি

ইউটিউব নিষিদ্ধ করার পরও তারা যেমন হরতাল করেছিল, বাংলাদেশের সকল মুক্তমনাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলেও তারা এই তাণ্ডব চালিয়েই যাবে। কারণ, তাদের আপত্তি এ দেশটার বিরুদ্ধেই। তাই তাদের চাপে নতিস্বীকার করা একটি স্ট্র্যাটেজিক ভুল বলেই মনে করি।

চলুক চলুক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তবু স্বপ্ন দেখতে চাই... সোনার বাংলা সোনার মানুষে ভরে উঠুক...

ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক এর ছবি

মানে কী ভাই?

শামীমা রিমা এর ছবি

কোনটা বেশি ক্ষতিকর, ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্মের কটূক্তি করা, নাকি সেই কটূক্তি কোটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা?
চলুক

Zia এর ছবি

কোনটা বেশি ক্ষতিকর, ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্মের কটূক্তি করা, নাকি সেই কটূক্তি কোটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা?

উত্তম জাঝা!

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

দিকে দিকে ঠিকানা টানানো
কে যাবে কোথায় দায় তারই
উত্তরের খেয়া তৈরি রেখ মাঝি
প্রশ্নের সাগর দিতে হবে পাড়ি॥

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রতিদিন লোকাল বাসে উঠলে বাসে স্টাফ বলে "মামা পিছনের দিকে আগান"।
প্রতিদিন এভাবে আমরা আসলে পিছনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি !

বিজন কথক

NIPON এর ছবি

ঠিক জাগাতে আঘাত করেছেন,

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।