হুতাশন সর্বত্র হুতাশন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৩/০৩/২০১৩ - ১২:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বসন্ত কাল। জ্বলন্ত হলুদে ঝলসে আছে প্রকৃতি। চারপাশে এতো হলুদ যে চোখ ঝাঁঝিয়ে যায়। কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে থাকা বন। হঠাৎই গাছে গাছে বিদ্রোহ শুরু হল। চারপাশ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। হুতাশন, সর্বত্র হুতাশন। নাকে এসে পোড়া গন্ধ জ্বালা ধরায়। ধড়মড় করে জেগে উঠলেন রংবালা। ততক্ষণে আগুন স্নানঘর, রান্নাঘর ছাড়িয়ে পাশের ঘরের পূবদিকের আলমিড়া পর্যন্ত চলে এসেছে। স্বপ্ন ও জাগরণের দ্বিধান্বিত সাঁকো পার হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল রংবালার। সচকিত হয়েই ডাক পাড়লেন- ‘সুবি , ওওওও সুবি’।

পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরের পাশে মাটির ঢিবির উপর স্থাণু হয়ে বসে আছেন রংবালা। কিছুই ভাবতে পারছেন না। ঘটনা এতোটা আকস্মিক যে সব বোধ শক্তি জমাট বেঁধে মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। অনেকেই আসছে, জানতে চাচ্ছে কখন হলো, কিভাবে হলো, কে করল। কি জবাব দিবে রংবালা! সুব্রতই সামাল দিচ্ছে লোকদের। মহিলারা এসে সান্ত্বনা দিতে লাগল রংবালাকে। অথচ রংবালা কাঁদছিলেন না। সকাল থেকে কোন খাবার গ্রহণ করেননি। সবাই তাই পিড়াপিড়ি করতে লাগল একটু খাবার মুখে নিতে। কিন্তু রংবালার খিদে নেই। দু চোখের পাতা এক হতে না হতেই নিমেষেই সব পুড়ে ছাই! বড় বড় অবাক চোখে তাই শুধু তাকিয়ে দেখছেন রংবালা।
পুব দিকে স্নান ঘরের পাশেই পায়খানা ছিল। সুব্রতর বাবা হরিপদের কোমরে বাতের ব্যথা। পায়খানায় একবার বসলে উঠতে বড় কষ্ট হয়। তার ভিতর শেষ বয়সের হাজারো ছন্নছাড়া উপসর্গের ভিতর ছিল ঘুম পাওয়া রোগ। যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তেন। প্রতিদিন রাত দেড়টায় পায়খানায় যাওয়া চাই। গতরাতেও গিয়েছিলেন। তাকে পায়খানায় বসিয়ে উঠোনে বসে জিড়োচ্ছিলন আর এতেই চোখ লেগে এসেছিল রংবালার।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন স্নান ঘরের পাশের জায়গাটায়। এখন সেখানে পোড়া কাঠ আর টিনের স্তূপ। কিছুক্ষণ আগেও মানুষটা এখানে ছিল। যদিও তাকে চেনা যায়নি। কালো লিকলিকে ধোয়া উঠা শক্ত কাঠির কুণ্ডলের মতো। ঘুমের ভিতরেই কি লোকটা গেল! চিতাতেও উঠতে হল না! চারপাশের ছাই এর ভিতর হরিপদের মাংস অস্থির ছাই খুঁজতে লাগলেন রংবালা। খালি চোখে বুঝা যায় না কোনটা কয়লা কোনটা হাড়! সব মিশে একাকার। হাওয়া এসে পোড়া ছাই উড়িয়ে নিয়ে যায়। আকাশের গায়ে বিলাপ করে তারা। আকাশ তার বিশাল ডানা মেলে গ্রাস করে নিতে লাগল সব।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এলো। অথচ সুব্রত সকাল বেলা দু মুঠো ভাত খেয়ে সেই যে বেরুল এখনো ফিরল না। নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে এটা। সুব্রত কোথায় যাচ্ছে কি করছে তাতে রংবালা তেমন গা করেন না। লোকমুখে শুনেছেন গ্রামের কিছু মানুষ এই আগুন লাগিয়েছিল। কারা? বলতে পারবেন না। সুব্রত বলে ইসলামপন্থী দলের কাজ। ওরা ঘর কেন পুড়াতে যাবে, তাতে তাদের কি লাভ রংবালা বুঝতে পারেন না। সুব্রত বলেছে ওরা নাকি হিঁদুদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। রংবালা বা হরিপদ কেউই কখনও গ্রামের কারো সাথে ঝগড়া বাঁধাননি। এরপরেও কেন এই বিদ্বেষ বুঝেন না রংবালা।
জ্বালা ধরিয়ে যাওয়া আগুন আর কতক্ষণ জ্বলে! একসময় সব পুড়িয়ে, নিঃশেষ করে থেমে যায়। বৃষ্টি এসে সব চিহ্ন মুছে দিয়ে যায়। আর যতটুকু রয়ে যায়, আর্তনাদ ও হতাশার টুকরো টুকরো অনুভূতি, তা গিলে খায় সময়। গ্রাম্য মাতব্বরেরা কিছু টাকা উঠিয়ে দিয়েছিল। তাই দিয়ে কোনমতে বাঁশের চেলা উঠিয়ে বসবাস। ঘরে তো মানুষ মাত্র দুজন। সুব্রত কাজ নিয়েছে খবির ভাইয়ের ইলেকট্রিকের দোকানে। দিন তো চলে যায়। কিন্তু রংবালার চোখের আগুন নিভে না। হুতাশন, সর্বত্র হুতাশন! কৃষ্ণচূরায় লেগে থাকা সেই আগুন এখনো লেপটে থাকে রংবালার ধূসর চোখে। মাঝে মাঝে মনে হয় সেদিনের দুঃস্বপ্ন বুঝি শেষ হয়নি। রংবালা বাস্তবে এখনো ফেরে নি হয়ত। যা ঘটেছে যা ঘটতে যাচ্ছে সবই দুঃস্বপ্ন, ভগবানের নিষ্ঠুর কৌতুক!

ছোটকাল থেকেই সুব্রত অসম্ভব জেদি। এবং বরাবরই শান্ত ছেলে। হরিপদ রংবালাকে বলতেন, তোমার ছেলের পেটে ভালোমতো ভাত ঠেসো যাতে পেট থেকে কিছু কথা বেরোয়। সুব্রত হাসত। লেপটে থাকা চুলে বড় চোখের গোলগাল মুখে সে হাসি চমৎকার মানাতো। চেহারা পালটে গেছে সুব্রতর। আয়নায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে খুটে খুটে দেখে নিজেকে।এখন আর সেই সরল হাসিটি নেই, চামড়ায় রোদে পোড়া রুক্ষ্ণতার ছাপ, চোখ ঘোলাটে। এই ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি অস্থির। অস্থির চোখের চলাফেরার আড়ালে আগ্নেয়গিরি চাপা পরে আছে। মনের ভিতর কোথাও অসম্ভব টানাপড়েন। মাঝে মাঝে ফুসে উঠে, সুব্রত স্পষ্ট টের পায়। যেই কোন মুহূর্তে চোখের ধার ঘেঁষে উপচে পড়বে। কখনই কারো সাতে পাঁচে থাকেনি সে। তবুও কার দোষে কেন ওরা এমন করল! অন্য ধর্মের অনুসারী সেটাই কি ওদের দোষ! রাজনীতির মারপ্যাঁচ কম বুঝে সুব্রত। তাই সবসময় দূরে দূরে থেকেছে। তবুও দূরে থাকত পারল কই! সেদিনের আগুনের উত্তাপ এখনো ছুঁয়ে আছে শরীরের চামড়ায়, প্রতিটি গ্রন্থিতে। চাইলেও মুছে ফেলতে পারছে না। কিংবা রংবালা দিচ্ছেন না।
আশ্চর্যরকম বদলে গেছেন রংবালা। কথা কম বলছেন। যেন সংসারের দায়টুকু জোর করে কাঁধে বইছেন। বাসায় থাকতে তাই মন চায় না। সেদিন সাঁঝের বেলা বাড়ি ফিরে সুব্রত দেখল ঘরে আলো জ্বালানো হয়নি। উঠোন থেকে শুকনো কাপড় ঘরে তোলা হয়নি। কাপড়গুলি সন্ধ্যার আধারে অশরীরীর মতো নেতিয়ে আছে দড়িতে। এমন হবার কথা নয়। রংবালা সুচারু গৃহিণী।
হরিপদ এ নিয়ে দুষ্টুমি করতেন, ‘তিন গ্রাম জুড়ে তোর মায়ের সুনাম ছিল। নেহায়েত হিঁদু বলেই না মাতব্বরের ছেলেটি সটকে গেল। নয়ত কোথায় এমন রাজকপাল যে তোর মা আমার বউ হয়ে ঘরে আসে। আমি তখন কাছা সামলে মুলা পটল নিয়ে হাটবাজারে দৌড়চ্ছি।‘
কপট রাগ দেখাতেন রংবালা, ‘এমন মিনমিনে চিপসে বদনখানিতে কি দেখল বাপু কে জানে! এমনই কপাল আমার! থালাবাসন আর কাপড় ধুতে ধুতে হাতের ছাল উঠে যাচ্ছে। এই বয়সে এসেও যদি রক্ষে পেতাম!’
হরিপদ জবাব দিতেন, ‘আরে! এই সংসারে আছো বলেই তো রক্ষে। নয়ত আলেয়ার মায়ের মতো হস্তিনী হয়ে বসে থাকতে। খাটছ বলেই তো শরীরখানা দিব্যি আছে। এখুনি মরে গেলে ভালো কাউকে দেখে অনায়াসে মণ্ডপ সাজিয়ে নিতে পারবে।’ মুখ ঝাপটে চলে যেতেন ঘর থেকে রংবালা। আর খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতেন হরিপদ।
পূবদিকে বাঁশের ঝাড়ের দিকে মুখ করে বসে আছেন রংবালা। প্রদীপ জ্বালাতে ভুলে গেছেন। বেদীতে অবহেলায় পড়ে আছেন নারায়ণ। অনেক কিছুই ভুলে গেছেন রংবালা। আশ্চর্য এক বলয় গড়ে নিয়েছেন চারপাশে। সুব্রত চেষ্টা করেও পারেনি সেখানে জায়গা করে নিতে। বড্ড অভিমান হয় সুব্রতর। রংবালা ছাড়া সুব্রতর কে আছে! সুব্রত ছাড়া রংবালারই বা কে আছে! অথচ একই বাড়িতে দুজন কত বিচ্ছিন্ন! দিশেহারা বোধ করে সুব্রত। চুল খামছে ধরে। কোথায় কোন জিনিসটি ভুল হয়ে আছে! কোথায় সংশোধন করতে হবে! বিদ্যুতের মতো একটি চিন্তা খেলে যায় সুব্রতর মাথায়। ফিরিয়ে আনতে হবে সেই সময় যেই সময়ের ফ্রেমে রংবালা আটকে আছেন, ফিরতে পারছেন না।

কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে আছে আগুন। পাতায় পাতায়, ডালে ডালে হলুদ যুদ্ধ! হুতাশন সর্বত্র হুতাশন। ধরমড়িয়ে জেগে উঠলেন রংবালা। চারপাশে তাকালেন। কোথাও কিছু নেই। ঘেমে গেছেন রংবালা। মগ থেকে জল পেটে ঢালতে গিয়ে দেখলেন উঠোনের পশ্চিম দিকের পাশ ঘেঁষে আগুন! উঠোনে নেমে দেখলেন পাশের বাড়ির আলেয়াদের বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে। সুব্রতকে ডাকতে গিয়ে মনে পড়ল বাসায় ফেরেনি এখনও। ঠিক তখনই আলেয়াদের বাসার পিছন থেকে পুকুরের পাড় ঘেঁষে সুব্রত উঠোনে উঠল। সুব্রতর হাতের ছোট কাঠটিতে তখনও আগুন জ্বলছে। নিভিয়ে ফেলল আগুন গাছের আড়ালে ছুড়ে ফেলল। আলেয়াদের বাসায় তখন হুলুস্থুল। সুব্রত ও রংবালা উঠোনে মুখোমুখি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। মৌনতা ভেঙে রংবালা বললেন, যা স্নান করে আয়। অনেকদিন খিচুড়ি রাধা হয় না। খিচুড়ি বসাচ্ছি। সুব্রত হাঁসে। রংবালার চোখের সেই আগুন আর নেই!

---নন্দিতা শঙ্খ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চোখের বদলা চোখ দিয়ে নিলে একসময় দেখবো আমরা সকলেই অন্ধ। এভাবে কি সমাধান আসবে? আমার মনে হয় না। তবে হ্যা, আপনি যা বললেন এরকম ঘটনা ঘটবে। স্বাভাবিক। কারন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যখন আর পিছানোর পথ থাকে না তখন মানুষ সামনে আগায় বৈকি। সে চুপচাপ হোক, বা আগুন জ্বেলেই হোক।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।
এটা শুধুই গল্প। কোন সমাধান নয়। নির্যাতিত এক জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ার একটি রুপ মাত্র।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও জানি এটা সমাধান নয়। কিন্তু সেই সাথে এটাও জানি যেকোনো মুহূর্তে ফুঁসে উঠতে পারে নিপীড়িত জনগোষ্ঠিও। সেটাই বললাম।

সামি

অতিথি লেখক এর ছবি

একেবারে সঠিক। আর সেক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনা যেন এক চোখা না হয়!

আচার্য এর ছবি

ভাল লেগেছে গল্প! তবে সমাধানের পথ এটা নয়। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে এটাই কাম্য।

============================
কত আর রবে দেশ রাহু গ্রাস কবলে?
সমূলে উপড়ে ফেলি দূর্নীতি সবলে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
আমি কোন সমাধান দেবার চেষ্টা করি না। একটি বিশেষ দৃষ্টিকোন থেকে কিছু মানুষের অনুভুতি দেখার চেষ্টা করেছি।
সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক!

নরাধম এর ছবি

আপনার গল্প মনে দাগ কেটে গেল। আলেয়ারা ধরেই নিয়েছে অন্যের ভিটেই আগুন লাগানো সুব্রতরা এখনো শিখেনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
আলেয়ারা এখানেই অন্ধ! আর তাদের চোখ খুলে দিতে পারে এইরকম হুতাশন! তাই সাবধান!

---নন্দিতা শঙ্খ

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাগুলো বড় হওয়ার কারণে পড়তে অনেক সময় লাগছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।