‎"আমার দ্বিতীয় কিংবা সহস্র জন্ম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০৩/২০১৩ - ২:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মার জন্ম আজ থেকে দুই যুগের কিছু কম মতো আগে, কোন এক বিমর্ষ অক্টোবরে ! অক্টোবর আগে বিমর্ষ ছিল না, আমার জন্মের দুঃখে বিমর্ষ হয়ে গেল। আমার জন্মানো ছাড়া জন্ম সঙ্ক্রান্ত আমার আরও যে বৃহৎ আফসোসটা ছিল তা হলো আমার জন্মের সাথে বাংলাদেশের জন্মের কোন সম্পর্ক নেই। জাতীয় কোন দিবসে জন্মদিন হলে বন্ধুরা অনেক মজা টজা করে, যাকে আলোচিত কিংবা বিশেষত্বপূর্ণ জন্ম বলা যায় আর কি! আমার জন্মতারিখ নিয়ে কোন মাতামাতি নেই, না থাকারই কথা। ১৬ ডিসেম্বর কিংবা ২৬ মার্চ আমার জন্ম হলে জন্মদিনের কেক টা হয়তো অনেক গর্ব নিয়ে কাটতাম। কেকের উপরে লাল সবুজে লেখা থাকতো, “শুভ জন্মদিন সিয়াম এবং সিয়ামের বাংলাদেশ!”

আমার বিশেষত্বহীন জন্মের শুন্যতা ঘোচাতে তারপর আমার আবারো জন্ম হল ! তারিখটা ছিল ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ !

আমার দ্বিতীয় জন্ম হল শাহবাগে, রাজপথে ! বড় নন্দিত সেই জন্ম! বড় আকাঙ্ক্ষিত সেই জন্ম।

আমার সাথে দ্বিতীয়বার জন্মালো একটি জাতি ! কিংবা জাতির সাথেই জন্মালাম আমি। জন্মালো বিপ্লব, জন্মালো তারুণ্য।

জন্মালো প্রজন্ম, আরও একবার !

কোন রাজাকারকে কখনো ধন্যবাদ দিতে হবে ভাবাই যায় না। ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। তারপরও আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি রাজাকার কাদের মোল্লাকে। এই পাকদেশীয় (সঙ্গত কারনেই দেশের নাম উল্লেখ করলাম না) বীর্যের ভি চিহ্নিত আঙ্গুলদ্বয় সমগ্র বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে, অহংবোধকে ওভাবে পিষে না ফেললে আজকের এই জাগরণ হয়তো পিছিয়ে যেত না জানি আরও কতগুলো বছর। আমরা আগুন জ্বালাতে গ্যাস সরবরাহের অপেক্ষায় প্রদীপ না জ্বেলে অন্ধকারে বসে থাকতাম আরও কয়েকটা যুগ। কারো মনে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর ইচ্ছা জাগত না।

আমরা পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতেও জানি। একাত্তরে জ্বালিয়েছি, সেই আগুনে জ্বলেছে শত সহস্র মশাল ! আবারো জ্বালিয়েছি, শাহবাগ জ্বালিয়েছে ! ঘাতকের ভি চিহ্নিত বিষাক্ত দুই আঙ্গুল জানেনা বাঙালি যেমন ভালবেসে জীবন দিতে পারে, ঘৃণায়ও পারে। বাঙ্গালির ভালোবাসা ও ঘৃণা দুই-ই কঠিন জিনিস!

পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামান্য (সংশোধিত, বিকৃত, “পরিবর্তিত” এবং পরিমার্জিত) হলেও যা কিছু গল্প, কাহিনী এসেছে, তা পড়ে স্বাভাবিকভাবেই কোন শিশুর মনে এই প্রশ্ন জাগার কথা, কোন উন্মাদনায় একটা জাতি শুধু একটি ফুল কে বাঁচাতে যুদ্ধ করবে ? মৃত্যু নামক বিভীষিকা আস্তাকুড়ে ফেলে, পরিবার স্বজন সবকিছুকে মৃত্যুকূপে ফেলে রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে বেরিয়ে পড়বে ? মা এর বারণ তাকে আটকাবে না, বাবার কঠিন আদেশ তাকে বাধা দেবে না। কিংবা প্রিয় মানুষটার অনিশ্চিত জীবনের শঙ্কা টার পথরোধ করবে না? কি সেই শক্তি ? কোন সেই মাদকতা ? আমার জেগেছিল। উত্তর নিজের মনেই সাজিয়ে নিয়েছিলাম, বুঝে নিয়েছিলাম। উত্তর পাইনি কখনো। উত্তর বোঝা এবং উত্তর পাওয়া এক কথা নয়। ভাবিনি এভাবে উত্তর উপলব্ধির রূপে পাবো। অভিজ্ঞতার রূপে পাবো।

শাহবাগ জন্ম দিয়েছে আমার ভেতর এক অন্য মানুষের। এক সৈনিকের, এক বাঙ্গালির, এক বাংলাদেশীর। এক মুক্তিযোদ্ধারও। আজ আমি জানি কি সেই শক্তি, কি সেই উন্মাদনা, কি সেই মাতাল হাওয়া যেই হাওয়ার স্পর্শে সদ্য বিবাহিত কৃষক নবপরিণীতাকে একলা ঘরে রেখে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। নবপরিণীতার সম্ভ্রমের দুশ্চিন্তা তাকে আটকায়নি, স্ত্রীসঙ্গের এক মুহূর্তের কামনাও তাকে আটকায়নি, অনাগত জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয় না হোক বেঁচে থাকার তুমুল আকাঙ্ক্ষা তাকে আটকায়নি। কি সেই উন্মাদনা ? কি ভর করে রক্তে ?

আমি জানি। হয়তো প্রতিটা বাঙ্গালিই জানে। জানেনা শুধু পাকদেশীয় বীর্য। দুঃখের কথা, সেই বিষাক্ত দু আঙ্গুল কাটতে গিয়ে দেখা গেল আঙ্গুল নয়, সে তো বিরাট এই দৈত্যাকার বিষবৃক্ষের শেকড় ! ৪২ বছরে সেই শেকড় এমন ছড়ানোই ছড়িয়েছে যাকে উৎপাটন করা মানে বাংলার কিছু ছাল চামড়া সহ তুলে ফেলা। ধর্মানুভূতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, সবখানে সেই বিষ ! যেখান দিয়ে তোলা হোক না কেন, লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবে সব। সেই সাথে আছেন বাংলার যুগে যুগে জন্মানো মীর জাফররা ! বাংলায় যেমন ক্ষুদিরামরা জন্মেছেন, মীরজাফর ও জন্মেছে, এটাই সত্যি ! ক্ষুদিরামকে ধরিয়ে দিয়েছিল এক বাঙ্গালিই, কোন ইংরেজ নয়!

বিষবৃক্ষ উৎপাটনের সাথে সাথে বাংলার এখানে ওখানে ক্ষত হচ্ছে। রক্তাক্ত হচ্ছে, বাংলা মায়ের আর্তনাদে হঠাৎ হঠাৎ ভারী হয়ে উঠছে বাংলার বাতাস ! একাত্তরেও তাই হয়েছিল। দেশ লণ্ডভণ্ড হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছে পদ্মা মেঘ্না যমুনায় ! তাতে যুদ্ধ থামেনি। বিপ্লব থামেনি !

বিপ্লব অত সহজ জিনিস না। বিপ্লব এত সহজে থামে না।

বিপ্লব চলবে। বাংলার বাতাস রাজাকারের নিঃশ্বাসের বিষাক্ত বায়ুমুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত চলবে, তা একাত্তরের রাজাকারের হোক কিংবা তেরোর। কতদিন আর এই বিষাক্ত দুষিত বাতাস ফুসফুসে নেয়া যায় ! ফুসফুসে করে বিষাক্ত বাতাস নিয়ে আত্মায়ও পচন ধরেছে। পচা গলা আত্মা আপস জানেনা। জানে শুধু প্রতিশোধ, জানে শুধু বিপ্লব !

প্রথম জন্মটি না হলেও দ্বিতীয় জন্মটি আমার জাতির সাথেই হয়েছে। এই সৌভাগ্য কম কি ! প্রথম জন্মে আমার মৃত্যুভয় ছিল, দ্বিতীয় জন্মে আমার আজ মৃত্যুভয় নেই। আমি জানি নিঃশ্বাস যদি বন্ধ হয়ে যায়, আমি আবারো জন্মাবো। হয়তো অন্য কোন শরীরে, অন্য কোন নামে। তবু বিপ্লব হয়ে জন্মাব, আবারো, সহস্রবার।

বিপ্লবের মৃত্যু নেই !

--- সামিউল আজিজ সিয়াম

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

গুরু গুরু

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ !

সৃষ্টিছাড়া এর ছবি

মনের গভীরের পবিত্র আবেগকে ছুয়ে গেল আপনার তিব্র লেখা^:)^

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যা, এইটারে কয় লেখা। গতকাল থেইকা আজকে পর্যন্ত্য হাতেগোণা যে ৫টা দুর্দান্ত লেখা পাইলাম সচলে এইটা নিঃসন্দেহে তার একটা। কিছু বলার নাই। আপনার আবেগের আপাদমস্তক আমার পরিচিত। কাজেই বেশী কিছু বলবো না, শুধু একটাই কথা-
"এই দেশটা তোমার আমার, এই দেশটা তাদের না,
এই দেশটা কোনো জামাত, শিবির-রাজাকারের না।"
সালাম কমরেড। গুল্লি চলছে, চলবে।

সামি

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ !

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সামি

অতিথি লেখক এর ছবি

জন্ম থেকে জন্মান্তরে শাহবাগ প্রজন্ম অন্তরে।
ধন্যবাদ সিয়ামকে।
স্বাধীনতার মাস, উত্তাল মার্চ,
অগ্নিঝরা মার্চে বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলুন
একাত্তেরর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।
প্রজন্মের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।
তুমি কে আমি কে
বাঙ্গালী, বাঙ্গালী।
তোমার আমার ঠিকানা,
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।
রাজাকারের ঠিকানা ফাঁসির পর পাকিস্তানের মোহনা।
একটাই দাবি ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই।
কসাই কাদের সহ অন্যান্য সকল মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, ফাঁসি।
ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হবে।
জয়বাংলা।

তুহিন সরকার।

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

জয়বাংলা !

বন্দনা এর ছবি

অসাধারণ একটা লেখা। গুরু গুরু

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

ধন্যবাদ!

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

অসাধারণ একটা লেখা। গুরু গুরু

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

ধন্যবাদ!

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার দ্বিতীয় জন্ম হল শাহবাগে, রাজপথে !
আমার সাথে দ্বিতীয়বার জন্মালো একটি জাতি ! কিংবা জাতির সাথেই জন্মালাম আমি। জন্মালো বিপ্লব, জন্মালো তারুণ্য। কোলাকুলি

বিজন কথক

অমি_বন্যা এর ছবি

খুব ভালো লাগলো। মন ছুঁয়ে গেছে আপনার লেখা।

তবু বিপ্লব হয়ে জন্মাবো চলুক

সামিউল আজিজ সিয়াম এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।