অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন ক্লাস এইটে। একদিন দেখি আমার এক চাচা ও তার বন্ধু 'লাল-সালু' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের সংলাপগুলো আওরাচ্ছে আর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমার ঐ চাচা তখন ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী ছিল। আমার মনে আছে, আমার ঐ চাচা যখন বিএ (ডিগ্রি)র শিক্ষার্থী ছিল, তখন এমনি করেই একদিন সৈয়দ আবুল মনসুর আহমেদের 'হুযুর কেবলা' নিয়ে দারুণভাবে আমোদিত হয়েছিল। কিন্তু আমার সেই চাচা এখন আর মজিদ বা হুযুর কেবলাদের দিয়ে বিনোদিত হন না। তিনি এখন জটিল সব চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকেন। আমার সদা-হাস্যমুখর চাচা এখন আর হাসেন না, গম্ভীরতার দুর্গম চাদরে ঢেকে রাখেন নিজেকে, সবার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকান, ছোঁক ছোঁক করে খুঁজে বেড়ান ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্র। সেদিন অনেক খুঁজে-পেতে এক তত্ত্ব হাজির করলেন আমাদের সামনে: আমাদের টেক্সটবুকে 'লাল-সালু' বা 'হুযুর-কেবলা'র মত উপন্যাস-গল্পের সংযুক্তি আর কিছু না, আমাদের ধর্ম নস্যাতের জন্য একটি সূক্ষ্ম ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্র!
কিন্তু যারাই পড়েছেন 'লাল-সালু' বা 'হুযুর-কেবলা'র মত লেখাগুলো, তারা জানেন, এখানে ধর্ম-বিদ্বেষের ছিটে-ফোঁটাও নেই, আছে ধর্মকে নিয়ে সীমাহীন ব্যবসার অনবদ্য চালচিত্র। তাহলে আমার চাচার এই নতুন বোধোদয় কেন? আমার চাচা তো এমন ছিলেন না। উনি সিনেমা দেখতেন, যাত্রা দেখতেন, মেলায় যেতেন, খাওয়া-দাওয়া-আড্ডায় কোন বাছ-বিচার করতেন না। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এখন তিনি হিন্দু বা তার ভাষায় অন্যান্য 'বিধর্মী'দের এড়িয়ে চলতে থাকেন সদা সতর্ক।
অথচ আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের মুসলিম উদার, সহনশীল আর অসাম্প্রদায়িক। এর কারণ লুকায়িত আছে ইতিহাসে, বাংলাদেশের নৃতত্ত্বে। ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে, বাংলাদেশের মুসলিমরা বিশ্বের এক অনন্য সম্প্রদায়। বিশ্বের মুসলিম মানচিত্রের তাকালে দেখা যায় তার রয়েছে এক অবিচ্ছিন্ন বিন্যাস ও ব্যাপ্তি। এমনকি পাকিস্তানও এই সীমানার বাইরে নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতের সাধারণ নৃতাত্ত্বিক চরিত্র ও ভৌগলিক উপাদানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কি করে বাংলায় (বা আরও স্পষ্ট করে বললে, পূর্ব বাংলায়) এক বিপুল মুসলিম অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটল তা সমাজতাত্ত্বিকদের কাছে কিন্তু সবসময়ই একটা বিস্ময়।
বস্তুত ভারতে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তকরন উল্লেখযোগ্য-ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল হিন্দু ধর্মের চরম রক্ষণশীলতা ও ব্রাহ্মন্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার তৈরি নিশ্ছিদ্র প্রতিরক্ষার কারণে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, হিন্দুরা বিদেশী সরকারের দ্বারা শাসিত হতে রাজী থাকলেও কিছুতেই খোয়াতে রাজি ছিল না নিজেদের ধর্ম। কিন্তু ভারতের পূর্বাঞ্চল বাংলায় এই বিধি কাজ করেনি। এর মূল কারণ হিসেবে অনেক ঐতিহাসিক পূর্ববাংলার দুর্বল গ্রাম সংগঠনের দিকে অঙ্গুলি হেলন করেন। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার বলেন:
বাংলার বিভিন্ন অংশে গ্রামের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। বিহারে, বিশেষত গঙ্গার দক্ষিণ গ্রামে দালান-কোঠা ঠাসাঠাসি করে গড়ে উঠেছে। সেখানে বৃক্ষ বা বাগানের কোন জায়গা নেই। যতই পূর্বদিকে এগোনো যায় ততই দৃশ্যপট বদলাতে থেকে; যদিও বাড়িঘর গ্রামের একটি বিশাল এলাকায় নির্মাণ করা হয়, তবু তা ছাড়া-ছাড়াভাবে, বসতবাটির জমির উপর। সেখানে শাকসবজির চাষ হয়; ফলের গাছ, বাঁশঝাড় গ্রীষ্মের খরতাপে সুশীতল ছায়া দিয়ে বাড়িঘর শীতল রাখে। আরও পূর্বদিকে এগুলে, পূর্ব বাংলার নিম্নাঞ্চলে, প্রায়শই গ্রামের কেন্দ্রীয় এলাকার কোন আলামত খুঁজে পাওয়া যায় না, লক্ষ করলে দেখা যায় যে, নদীর পাড়ে উঁচু জায়গায় সারিবদ্ধভাবে বাড়িঘর গড়ে উঠেছে, অথবা শুকনো মওসুমে সাময়িকভাবে যখন পানি শুকিয়ে যায় তখন কঠোর পরিশ্রম করে ১২ থেকে ২০ ফুট উঁচু মাটির স্তূপ গড়ে বিশৃঙ্খল সারিতে ছোট ছোট গুচ্ছে তৈরি করা হয়েছে বাড়িঘর।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে গ্রাম প্রধান বা সুসংগঠিত প্রশাসন ছিল না। গ্রামের নেতৃস্থানীয়রা জমি-জমি বা বিভিন্ন গোষ্টিগত বিষয়ের মীমাংসা করতেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যার কারণে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে অবস্থিত বাসযোগ্য ভূমির নজির কমই মিলত এবং এ কারণে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়ে গড়ে উঠত এক একটি জনবসতি। এ ধরণের সমাজে কেউ সমাজচ্যুত হলে সে ভেঙ্গে পড়ত না, সহজেই মাটি কেটে উঁচু জায়গায় বাড়ি তৈরি করত, এদিকে কাটা জায়গায় যে পুকুরের উদ্ভব হত, তা দিয়ে পানির যোগানও হয়ে যেত তার। গ্রাম সংগঠনের এইসব অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও শিথিলতা পূর্ব বাংলায় সৃষ্টি করে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও বিচ্ছিন্নতা। আর এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য-বাদী গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সুরক্ষার দীর্ঘ প্রাচীর গড়ে তোলে। পূর্ববাংলার মানুষের ব্যক্তি-মানস এমনভাবে গড়ে উঠে যেখানে কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং চরমপন্থার অবস্থান ছিল না, ছিল না কোন বিধিনিষেধের কড়াকড়ি। বহুমত চর্চা ও প্রসারের জন্য এক আদর্শ জায়গা ছিল পূর্ববাংলা, এর সমাজ সংগঠন। বাংলাদেশ যেকোন বিচিত্র ধর্ম বিশ্বাস প্রচারের জন্যই ছিল এক উর্বর-ক্ষেত্র। এর একটি ছোট উদাহরণ মিলবে সপ্তদশ শতকে জন্ম হওয়া কর্তাভজা সম্প্রদায়ের (যার গুরু ছিলেন রামস্মরণ পাল) একটি মতবাদে:
উচ্চ বা নিম্ন বর্ণ হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানের মধ্যে আচারের কোন প্রভেদ থাকেবে না। এই সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশক কোন বাহ্যিক চিহ্ন ধারণ আবশ্যক নয়। এই সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার জন্য হিন্দু তার পৈতা রাখতে পারবে, মুসলমানের দাঁড়ি কামানোর প্রয়োজন হবে না।
ফলে বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষষ্ট-দশ শতাব্দীর মধ্যে তেমন কোন বাধা ছাড়াই নতুন একটি বিশ্ব-ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে পারে। অথচ পূর্ব-বাংলায় বাধ্যতামূলক গণ-ধর্মান্তরকরণের তেমন উল্লেখযোগ্য নজির নেই। বা অভিবাসী মুসলমানরাও এখানকার মুসলিমদের এক ক্ষুদ্রাংশ ছিল মাত্র। বরং বর্ণ হিন্দুরা এবং কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মিলে এই মুসলিম জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে পূর্ণ করে। কিন্তু এই ধর্মান্তরিতরা ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন কেন? অসীম রায় ও রিচার্ড এম ইটন বাংলার ধর্মান্তরকরণকে দল বদল (বর্নপ্রথার বিভীষিকা থেকে বেরুনোর উপায়) হিসেবে দেখলেও অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ করেছেন, চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গুনে গুণান্বিত বাংলার মানুষের চেতনায় নতুন ধর্ম নতুন অর্থ, আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা বা আবেগের জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনভাবেই তারা ধর্মান্তরিত হয়েছে, কোন মোহ বা চাপে নয়। আবার এই স্বাধীনতার চেতনাই তাদেরকে নিজের মাটির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল রেখেছে, কখনোই অবহেলা করতে দেয়নি।
কিন্তু বাংলার এই স্বাধীন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল মুসলিমরা কি শোষিত হয়নি কখনো? ইতিহাস বলে, ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এরা শোষিত হয়েছে অভিবাসী মুসলমান (মুসলিম শাসকদের সরকারি কর্মকর্তা, সৈনিক প্রমুখ ) এবং হিন্দু ভূস্বামী (মুসলিম শাসকদের নিয়োগ-কৃত হিন্দু কায়স্থ জমিদার) কর্তৃক। মুসলিম শাসনের অবসান ঘটলে ব্রিটিশ শাসক ও উচ্চ বর্ণের হিন্দু অভিজাতদের দ্বারা শোষিত হতে থাকেন বাংলার মুসলিমরা। উভয় প্রতিপক্ষই অমুসলিম হওয়ায় এই সময় বাংলার মুসলিমদের ভিতর ধর্মিয় জাগরণ গড়ে তোলার প্রয়াস পান অনেক মৌলবাদী নেতা, এই সময়টিতেই অভিবাসী অভিজাত মুসলিম এবং স্থানীয় মুসলিমরা প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ হয়, কিন্তু এই মিলন বেশিদিন টিকেনি। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে অভিজাত মুসলিমকে তীব্র চ্যালেঞ্জ করে দাড়িয়ে যায় বাংলার মুসলিমদের একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী। গ্রামীণ জোতদার, মধ্য-স্বত্বভোগী এবং উদ্বৃত্ত কৃষকদের নিয়ে গড়ে উঠে এই শ্রেণী। এরা খুব দ্রুত শিক্ষিত হতে থাকে এবং চ্যালেঞ্জে ছুঁড়ে দেয় উচ্চবিত্ত অভিজাত মুসলিমদের দিকে । অভিজাত ও মধ্যবিত্ত মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল প্রকট। বাংলার আশরাফ মুসলমানেরা উর্দু ভাষায় কথা বলত, বাংলার স্থানীয় কৃষ্টি-কালচারর প্রতি নাক সিটকাতো , ধর্মিয় মৌলবাদকে সমর্থন করত, স্বভাবজাত-ভাবেই তারা জমিদারি ব্যবস্থার সমর্থক। অন্যদিকে, বাংলার দ্রুত বিকাশমান মধ্যবিত্ত মুসলিমরা বাংলায় কথা বলত, বাংলার সংস্কৃতিকে ভালবাসত, ইসলামের মূল নিয়মকানুনের সাথে স্থানীয় সংস্কৃতির সমন্বয় করার চেষ্টা করত, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ছিলেন তারা। এমনকি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের দুরকম ব্যাখ্যা ছিল উর্দুভাষী ও মধ্যবিত্ত মুসলিমদের কাছে। বাংলার উর্দুভাষী অভিজাত মুসলিমরা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের জন্য এমন একটি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন যার নেতৃত্ব থাকবে সামন্তবাদই গোষ্ঠী এবং যার অর্থনৈতিক চাবিকাঠি থাকবে অবাঙ্গালি ব্যবসায়ীদের হাতে। অন্যদিকে, বাংলার বাংলাভাষী মুসলিম মধ্যবিত্ত 'লাহোর প্রস্তাব'কে দেখেছিল বাংলায় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে।
বাংলার মুসলিমদের সত্যিকার প্রতিনিধি কারা ছিল? অভিবাসী অভিজাত মুসলিম নাকি মধ্যবিত্ত মুসলিম? একসময় আবেগজনিত কারণে অভিজাত মুসলিমরাই নেতৃত্বে থাকলেও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মধ্যবিত্তরা তাদের হঠিয়ে দিতে শুরু করে। যেখানে ১৮৮৫-১৮৬৪ সনে বাংলা থেকে পাট রপ্তানির গড় পরিমাণ ছিল ০.৮২, সেখানে ১৯০৫-১৯১৪ সনে তার পরিমাণ দাড়ায় ১৫.১৪। ফলে বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলিমরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়। এই স্বনির্ভরতা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলে তাদের। যেখানে ১৮৮২-৮৩ সনে মুসলমান ছাত্রের হার ছিল শতকরা ২৭.৬ জন, সেখানে ১৯১২-১৩ সনে তা দাড়ায় ৪০.৫ জনে। এই মুসলিম শিক্ষিতরাই গড়ে তোলে অতি সক্রিয় ও সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা এক পর্যায়ে নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়। কিন্তু তবু বাংলার মুসলিমরা স্বপ্নের বাংলাদেশ পায়নি ১৯৪৭ সনে । দুটি কারণ: (১) মুসলিম লিগ নেতারা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে নির্বাচন করলেও নিজেদের কায়েমি স্বার্থে ১৯৪৬ সনের আইনসভায় লাহোর প্রস্তাবের সাংবিধানিক কাঠামো পরিবর্তন করে একটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেন। (২) অন্যদিকে, যে হিন্দু নেতারা ১৯০৬ সনে বিপুল প্রতিরোধের মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ ঠেকিয়েছিলেন, তারাই আইন সভায় বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে ভোট দেন।
এভাবে প্রতারিত হয় বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত এবং তারা যাদেরকে প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই আপামর মুসলিম কৃষক ও আশরাফ সম্প্রদায়। প্রতারক অভিজাত মুসলিমদের সম্পর্কে প্রখ্যাত পাকিস্তানি লেখক তারিক আলী লিখেছেন:
মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের ধারণার প্রতি এরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন কারণ সেখানে অমুসলমানদের সঙ্গে কোন প্রতিযোগিতা থাকবে না এবং হিন্দু বাণিজ্যের অবর্তমানে উন্নতি সাধন করা যাবে। 'পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক' শ্লোগানের সত্যিকার অভিপ্রায় ছিল 'স্বাধীন ব্যবসা দীর্ঘজীবী হোক।
কিন্তু বাংলার মুসলিমের রক্তে মিশে ছিল যে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ এবং স্বাধীনতা, তা তসনস করে দেয় অভিজাত মুসলিমদের সাধের পাকিস্তানি স্তম্ভগুলো। '৫১, '৬২, '৬৬, '৬৯ পেরিয়ে এরাই জন্ম দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের। ধর্ম-কেন্দ্রিক জাতীয়তাকে ছিন্নভিন্ন করে এভাবে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। আর এভাবেই বাংলাদেশের মুসলিমরা প্রমাণ করে তারা সত্যি এক অনন্য জাতি।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সেই সংখ্যালঘু, ভোগবাদী এবং বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি শতভাগ অনুগত অভিজাত মুসলিম গোষ্ঠিটি অচিরেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, জাঁকিয়ে বসে বাংলার অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে। মৌলবাদী জাগরণের লক্ষ্যে তারা কয়েক দশক ধরে চালায় ব্যাপক আবাদ। বাংলার মুসলিমদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধ ও স্বাধীনতার ধারণাকে করা হয় ক্ষত-বিক্ষত।
আমার সরল থেকে ক্রমজটিলমান চাচা কি তাহলে এরই ফসল? আমার চাচা আগে খুব সরল ছিলেন। তিনি মনের আনন্দে কখনো গেয়ে উঠতেন, যেমনি করে মাওলানা রুমি মনের আনন্দে কখনো সখনো অবিরাম নাচতেন। রুমি চক্রাকারে ঘুরে খোদাকে পাওয়ার চেষ্টা করতেন, আমার সরল চাচাও কি তাই করতেন? রুমি একজন বিশ্ববরেণ্য মুসলিম ছিলেন, আমার চাচা একান্তই সাধারণ আর আটপৌরে মুসলিম ছিলেন, তবু তাদের মধ্যে কেমন একটা মিল ছিল, তাই না? একটা বৃত্তের উচ্চতম আর নিম্নতম বিন্দু কখনো কখনো পৃথক করা যায় না, মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তারা, তবে একটি চক্র পূর্ণ করতে হয় তার জন্য। আমরা এখনো ঘুরছি, চক্র পূরণে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে হয়ত।
বাউলা গান, ঘাটু গান আনন্দের তুফান
গাহিয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম
মানুষ ছিল সরল, ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহিন কোন পথে যাইতাম
তথ্যসূত্র: ১. বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা, আকবর আলি খান
২. ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব, ড তারাচাঁদ
কাজি মামুন
১৭।০৩।২০১৩
মন্তব্য
কারা কারা এই বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন? কোন রেফারেন্স? পূর্ববাংলায় কেন ও কীভাবে মুসলমান বসতি হয়েছে এই বিষয়ে তো বেশি আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত থিওরি আছে।
আমি তো জানতাম এই রক্ষণশীলতার কারণেই নিম্ববর্ণের হিন্দুরা মুসলমান হয়েছে দ্রুতগতিতে।
আবারো, এই গল্পগুলো কাদের করা? বিদেশী সরকারের দ্বারা হিন্দু ধর্ম যেরকম প্রভাবিত হয়েছে সেরকম মুসলিম ধর্মতো প্রভাবিত হয়নি। হিন্দুরা সেটা মেনেও নিয়েছে। উদাহরণ, সতিপ্রথা, প্রকাশ্যে বলি দেয়া, বিধবা বিবাহ ইত্যাদি।
আমি এইপর্যন্ত কোট করে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আরো বিস্তর পড়ালেখা করা করে ইতিহাস বিষয়ে লিখতে নামা উচিত।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
অনেক খাটা-খাটুনি করে লেখাটা নামিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আলোচনা করছিল না দেখে মন খারাপ হয়েছিল। তাই আপনার মন্তব্য পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেয়নি আপনার উপরের বাক্যটি। আপনার শেষ কথায় মনে হল, আমি খুব অপরাধ করে ফেলেছি। কিন্তু আমার লেখাটিতে কি কোন কুৎসা বা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছিল? আমি তথ্যসূত্রে কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করেছি। আমি গবেষক নই। কিন্তু আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতা আর ঐ বইগুলো পাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছি। বোধ করি, আকবর আলি খানকে আপনি উপরের কথাগুলো বলতে পারতেন না! যাহোক, আমার লেখার মূল ভাবনাটি ছিল:
আজ আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মুসলিমের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব কাজ করছে। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব আর্টিফিশিয়াল, ম্যনুফ্যাকচারড, ন্যাচারাল নয়। বাংলাদেশের মুসলিমরা ঐতিহাসিকভাবেই সহনশীল, নৃতাত্ত্বিক কারণেই উদার ও অসাম্প্রদায়িক। আমাদের আসল পরিচয় ফুটে উঠে শাহ আব্দুল করিমের 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম' গানটিতে। 'করিম দীনহীন' হলেন আমাদের দেশের মুসলিমদের সত্যিকারের প্রতিনিধি।
টাইটাস বলেছেন:
ডুরান্ট বলেন:
ভারতে মুসলিমরা এতগুলো শতাব্দী শাসন করার পরও সেই সময়ের কমন সিনারিও অনুযায়ী কেন ধর্মান্তরিতের সংখ্যা তুলনামূলক কম, তা বিশ্লেষণ করতে যেয়েই ঐতিহাসিকরা (আমি নই) গবেষণা করেই উপরের সব কারণ বের করেছেন। আরেকজন ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন রায় কি বলছেন, দেখুন:
আর পূর্ব বাংলার গ্রাম-সংগঠনের দুর্বলতা, তা থেকে তৈরি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, আর এর সঙ্গে ব্রাহ্মন্যবাদী গোঁড়ামির স্বল্পতা এই এলাকার মানুষদের জন্য ধর্মান্তকরনের সহায়ক হয়েছিল বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরাই ধর্মান্তরিত হয়েছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পূর্ববাংলায়, কিন্তু ব্রাহ্মন্যবাদী গোঁড়ামির কম অনুপস্থিতি এবং গ্রাম-সংগঠনের দুর্বলতাজনিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ছিল এর মূল নিয়ামক।
আর হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা কিভাবে পাহাড়-সম বাঁধা তৈরি করতে পারে ধর্মান্তরকরণে, তার মাত্র একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মুসলমানদের ছোঁয়াতে কিন্তু জাত চলে যেত। বর্ণ-চ্যুতির শাস্তি শুধু এ জন্মে নয়, পরের জন্মেও ভোগ করতে হত।
এই সংস্কারগুলি তাহলে মুসলিম শাসনের প্রভাবের ফসল? ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমার লেখায় একটি থিয়োরির কথা উল্লেখ আছে, যা আমার রচিত নয়, বরং তথ্যসূত্রের বইগুলো পাঠ করে প্রাপ্ত। কিন্তু আপনি মনে হয়, আলাদা থিয়োরির কথা জানেন। একটু বলবেন কি? দেখুন, আমি বই পাঠ করে থিয়োরি লিখতে এই লেখাটি লিখিনি। কেন লিখেছি উপরের বোল্ড করা আমার মূল ভাবনাতে উল্লেখ করেছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মুসলমানের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িকতার উল্লম্ফন দেখেছি, তার প্রেক্ষিতেই এ লেখা।
আকবর আলি খানের এই কথাটি জানি না আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে কিনা:
পরিশেষে একটা স্বীকারোক্তি। আমার পড়াশুনা সত্যি বেশি নয়। আমার তথ্যসূত্রে দেয়া বইগুলোর পাঠ আর আমার পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখতে ইচ্ছা করেছিল। মনের তাগিদে। কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। আপনার প্রশ্নগুলোও খারাপ লাগেনি। কারণ অন্যদের সাথে আলোচনা করে নিজের বোধকে আরও ঝালিয়ে নেয়ার জন্যই লেখা। কিন্তু আপনার শেষ কথায় মনে হল, পড়াশুনা না করে আবর্জনা লিখে মহা-বিরক্তি ঘটিয়েছি আপনার। আমার পড়াশুনা না থাকলেও আপনার নিশ্চয়ই আছে। আমি কিছু উত্তর দিয়েছি এবং প্রশ্ন করেছি। আশা করি, আপনার মতামত পাব।
মুক্তিযুদ্ধ যে শুধু বাংলাদেশের মুসলমানরাই করেছিলেন এইটা আসলেই জানতাম না। আজিবতো।
মনে হয়, ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১ পেরিয়ে এরাই জন্ম দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের এই লাইনটির কারণেই আপনার আপত্তি। কিন্তু ভাই, আপনি ভুল বুঝেছেন আমাকে। আর স্বীকার করছি, এই লাইনটি থেকে এমন ভুল বোঝাও অস্বাভাবিক নয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এবং সাংখ্যিক অনুপাতে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান হয়ত মুসলিমদেরও ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু এবার আমার ব্যাখ্যাটি শুনুন। আমার এই লেখাটি মুসলিমদের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা থেকে। সাম্প্রতিক কারণেই মুসলিমদের নিয়ে আমার ভাবনা। অন্য কোন লেখায় হয়ত অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা থাকবে। বাংলাদেশের মুসলিমরা ঐতিহাসিকভাবেই সহনশীল, নৃতাত্ত্বিক কারণেই উদার ও অসাম্প্রদায়িক। অথচ আজ আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মুসলিমের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব কাজ করছে। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব আর্টিফিশিয়াল, ম্যনুফ্যাকচারড, ন্যাচারাল নয়। বাংলার মুসলিমরা যে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচনা করেছিল ১৯৭১ এ , তার মধ্যেই লুকায়িত আমাদের দেশের মুসলিমদের সত্যিকারের স্বরূপ। আমি তাই বলতে চেয়েছি।
তারপরও আমার লেখায় ভুল বোঝার উপসর্গ থাকলে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
নতুন মন্তব্য করুন