আস্তিক প্রমাণের রাজনীতি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৩/০৩/২০১৩ - ৭:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক.
শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের চলমান আন্দোলন থেকে আবারো বোঝা গেলো বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে আপনি ‘নাস্তিক’ না। আমাদের ‘পাবলিক পারসেপশন’-এ রেওয়াজটি নতুন কিছু নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতি নিয়ে যারাই প্রশ্ন তোলেন পাবলিক তাদেরকে ‘নাস্তিক’ ভেবে বসেন। ইদানিং বুদ্ধিজীবীরাও সেই দলে ভিড়তে শুরু করেছেন। আমাদের জন্য এই অভিজ্ঞতাও নতুন নয় যে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাঙালির আস্থা চল্লিশে নিস্তেজ হতে শুরু করে। আর, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে বোঝাপড়া মধ্য চল্লিশেই খতম হয়। বাকি জীবন চলে এর সাথে মধুর সহবাস নয়তো আপোস করে। যতোদূর জানি, ‘আস্তিক’ শব্দের একটি স্বীকৃত অর্থ-পরম্পরা রয়েছে। ‘নাস্তিক’ও তাই। তবে বাংলাদেশে সেই পরম্পরা অনেক আগেই তামাদি হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো শাহবাগের পর ‘নাস্তিক’ ও ‘রাজাকার’-কে সমার্থক ভাবার চল উঠেছে। অনেকের ধারণা, ‘রাজাকার’ ও ‘নাস্তিক’-এ কোনো প্রভেদ নেই। তারা কঠিন হৃদয়ের মানুষ। দুনিয়াবি হাসিলের জন্য পাগল। যে-কারণে অপকর্ম করতে তাদের হাত কাঁপে না। বিবেক কম্পিত হয় না। সুতরাং যারা ‘রাজাকারি’ করে তারা সবাই ‘নাস্তিক’ এবং নাস্তিক হওয়ার কারণে কোনো অপকর্মই তাদের গায়ে লাগে না। আল্লা-খোদায় বিশ্বাস ও ভয় থাকলে যা কখনোই সম্ভব হতো না! বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ ও ‘নাস্তিক’কে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে এমন কামান দাগার ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। ‘সেলুকস! কী বিচিত্র এই দেশ’!

সে যাহোক, সময়ের সাথে শব্দের অর্থ পালটায়। বিদ্যাসাগরের যুগে ‘রমণী’র সমার্থক হিসাবে ‘মাগি’ শব্দটি অনেকে ব্যবহার করতেন। বিদ্যাসাগরও করেছেন। প্রয়োগটিকে তখন অশ্লীল মনে হতো না। সময়ের পালাবদলে ‘মাগি’ শব্দের আদি অর্থ পালটাতে শুরু করে এবং অশ্লীল ও যৌনবাচক গালিতে পরিণত হয়। ঘটনার চাপে শব্দের অর্থ এভাবেই পালটায়। ‘মৌলবাদ’ যেমন পালটেছে। তার আদি অর্থ ধরে কেউ তাকে ডাকে না। ‘রাজাকার’ ও ‘নাস্তিক’ শব্দ দুটি সম্ভবত অনুরূপ নিয়তি বরণ করতে যাচ্ছে। মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত ও স্বেচ্ছাশ্রমে ফতুর মানুষকে এক কালে ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন করা হতো। একাত্তর সেই অর্থটি পালটে দিয়েছে। ‘স্বেচ্ছাসেবী’ করেন এমন মানুষকে এখন ‘রাজাকার’ ডাকলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন। অর্থ-বিপর্যয়ের পাল্লায় পড়ে ‘রাজাকার’ শব্দটি তার মহিমা হারিয়েছে। সহসা সেটি পুনুরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই।

অন্যদিকে নাস্তিকের সংকট আরো গভীর। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী। ধর্মীয় বিধি-নিষেধে মেনে দিন গুজরান করেন। এর প্রতি তাদের আস্থা ও অনুভূতি নিখাদ। পপুলার এই ফ্রেমিংয়ের বিপক্ষে নাস্তিকের একটি অবস্থান রয়েছে। ফ্রেমিংটিকে তারা সন্দেহ করেন। মানুষের জন্ম-কর্ম-মৃত্যুকে ঐশী বিধি-বিধানের মাঝে সংকীর্ণ ও বিভাজিত করার ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারেন না বলে নিজেকে নাস্তিক হিসাবে প্রচার করেন। প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসকে মানব সভ্যতার জৈব-সামাজিক ইতিহাসের ভিতর দিয়ে তারা বিবেচনা করেন। সেক্ষেত্রে মানুষের উদ্ভাবিত শাস্ত্রগুলো তাদেরকে সহায়তা করে। প্রয়োজনীয় তথ্য ও যুক্তি বহনে শক্তি যোগায়। প্রচলিত ধর্মে ঈশ্বরের স্বরূপ ও ঐশী বাণী সম্পর্কে ধর্মীয় কিতাব যেসব বক্তব্য দিয়ে থাকে নাস্তিককে সেগুলো নিয়েও ভাবতে হয়। যুক্তি-তর্কের চড়াই-উৎরাই বেয়ে চলার কারণে নাস্তিকদের বক্তব্যে মাঝেমধ্যে যুক্তির বাড়াবাড়ি চোখে লাগে। যদিও আস্তিকের ভক্তিসর্বস্ব বাড়াবাড়ির তুলনায় তা কম বিরক্তিকর।

নাস্তিককে নিয়ে পাবলিকের মনে একটি কমন ভুল বোঝাবুঝি কাজ করে। পাবলিকের ধারণা, ‘নাস্তিক’ এমন এক মানুষ যে আসলে কোনোকিছুতে বিশ্বাস করে না। অনেকে তাই প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, এই যে কোনোকিছুতে বিশ্বাস করে না, এটা কি একপ্রকার বিশ্বাস নয়? তাইলে ওই বেটা নাস্তিক হয় ক্যামনে!’ নাস্তিক্যবাদের ইতিহাস ও দর্শন কিন্তু তা বলে না। প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসীরা আচারনিষ্ঠ মানুষ। শরিয়তের অনুসারী। তাদের এই বিশ্বাস ও আচারকে নাস্তিকরা ইহজাগতিক ঘটনার ফ্রেমে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। নাস্তিকদের মতে প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর অ-সৃষ্ট নয়। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে মানুষ তাকে সৃষ্টি করেছে। মানুষের অনুভূতিশীল মন হচ্ছে সেই সৃষ্টির সূতিকাগার। আর মগজ হলো দৈব বা আসমানি কিতাব তৈরির কারখানা। মানুষের অতিকল্পনা ও মন্ময়ভাব থেকে সৃষ্ট এই ঈশ্বরকে আসমানি কিতাবগুলোর মাধ্যমে একটি সংহত প্রথা ও প্রতীকে রূপ দেয়া হয়েছে। কালে-কালে তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে গেছে। সৃষ্ট ঈশ্বরকে মেনে চলার ঠেকা যুক্তিশীল নাস্তিকের থাকার কথা নয়। এই অর্থে তিনি অবশ্যই অবিশ্বাসী।

নাস্তিকের কাছে ঈশ্বরের চেয়ে মানুষ ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণটি পরিষ্কার। পৃথিবীতে মানুষ হলো একমাত্র সত্তা যে কিনা অনামা, অজানা ঈশ্বরকে ভাবতে সক্ষম হয়েছে এবং ভাববাদী সংস্কৃতির মিনার খাড়া করে তাকে আজো টিকিয়ে রেখেছে। এই মিনারের মাধ্যমে জগতের সকল আস্তিক ঈশ্বরকে অনুভব করেন। ঈশ্বরের সৌন্দর্য, সরলতা এবং ক্ষমতার কথা ভেবে সম্মেহিত হয়ে পড়েন। যুক্তি দিয়ে মিনারের জটিল নকশার কুল-কিনারা পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে মনের মধ্যে সন্দেহের চেয়ে পূর্ব নির্ধারিত বিশ্বাসের ভাব প্রবল হওয়ার কারণে ভক্তিরসের বল্গাহারা আবেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। রসের সাহায্যে মিনারের গুণগান করতে থাকেন। অন্যদিকে নাস্তিকের হৃদয় সত্যিই কঠিন। সে হলো এক বগগা ঘুড়ির মতো। মনের মধ্যে মিনার নিয়ে প্রশ্ন, সংশয় ও যুক্তির তোলপাড় দূর না হওয়া অব্দি এর সাথে লেগে থাকে। উপলব্ধির বিরামহীন এই চেষ্টাকে আস্তিকরা ভক্তি নামে বোঝেন। যুক্তি যার নাগাল পায় না বলে তাদের ধারণা। কিন্তু নাস্তিকের পৃথিবীতে ভক্তির চেয়ে যুক্তির আদর বেশি। আস্তিকের কাছে বিশ্বাসের অর্থ হলো এটা প্রমাণ করা যে ঈশ্বর হচ্ছেন সবকিছু। মানুষ সেখানে উপলক্ষ মাত্র। আর নাস্তিক এই বিশ্বাস বজায় রাখা জরুরি মনে করেন যে জাগতিক ঘটনারা মানুষে কেন্দ্রীভূত হয়ে ঈশ্বরকে জন্ম দিয়েছে। বিশ্বাসের কথা যদি বলি, তবে উভয়ের মধ্যে এখানেই তফাত!

মানুষকে নিয়ে ঈশ্বর কী ভাবছেন বা জন্ম-মৃত্যুর চক্র শেষে তাকে কোথায় রাখা হবে, -এই অনুমানে আয়ু শেষ করার ইচ্ছা নাস্তিকের নাই। মানুষ তার অনুভব ও চিন্তায় ঈশ্বরকে কীভাবে বয়ান করে সেই ইতিহাস তার কাছে সোনার চেয়ে দামি। যে-কারণে আস্তিকের সাথে নাস্তিকের বিরোধ অনিবার্য হয়। আস্তিক যাকে খোদার মহিমা মনে করে মারহাবা বলে উঠেন, নাস্তিক তাকে মানুষের মহিমা ভেবে আলিঙ্গন করেন। নাস্তিকরা মনে করেন ঈশ্বরে বিশ্বাস ও ইমান-আকিদা অনুসরণের প্রশ্নে মানুষ দুটি দলে ভাগ হয়ে গেছে। একদল শরিয়তকে আমল করে। অন্যদল শরিয়তকে মারিফতের রাস্তায় নিকেশ করে। প্রথম দলটি জড়স্বভাবী। অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠান ও নেকির হুজুগে মানুষকে শুধু-শুধু খাটিয়ে মারে। দ্বিতীয় দলটি মরমী অনুভূতির নাম করে যুক্তিহীন যুক্তি তৈরির ধাঁধায় সমাহিত থাকে। মারিফতির চর্চা অভিনব। তবে মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও বোধ-বিবেচনা এতে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। মারিফত হলো বায়বীয় ও বায়ুগ্রস্ত এক বিশ্বে ঢুকে পড়া এবং ক্রমান্বয়ে সকল ইহজাগতিক অভিজ্ঞতার বাইরে চলে যাওয়া। মজা হলো শরিয়তীদের কাছ থেকে মারিফতিরা প্রায়ই নাস্তিকের তকমা লাভ করেন এবং নির্যাতিত হন। শরিয়তি ও মারিফতি উভয়ের সাথে জঙ্গে নামার কারণে নাস্তিককে এতো বদনাম সইতে হয়। এবার দেখা যাক জঙ্গে নেমে নাস্তিক আসলে কী করেন। সংক্ষেপে ফর্দটিকে এভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে :-

ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথার জন্ম কেন বা কীভাবে হয়, নাস্তিকরা সেই কারণগুলো মানুষকে খতিয়ে দেখার প্রেরণা যোগান। সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ভৌত পদার্থ বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাগুলো নিজে বোঝার ও অন্যকে বোঝানোর আগ্রহ বজায় রাখেন। মানব স্যভতার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক ইতিহাসের পাঠ নিতে আগ্রহ বোধ করেন এবং অন্যের মধ্যে সেটি জাগিয়ে তোলেন। এছাড়া আমাদের সকলের ভিতরে যে কাণ্ডজ্ঞান ও প্রশ্নশীল মন রয়েছে তাকে সক্রিয় করার জন্য খেটে মরেন।

আরেকটি কথা, ধর্ম ও ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীর যুক্তি তুলে ধরলেও বস্তুজগতের ধর্ম ও মহাজাগতিক ঈশ্বরের (Cosmological God) সম্ভাবনাকে নাস্তিকরা অস্বীকার করেন না। তবে ভৌত পদার্থবিদ্যা ও প্রাণের বিবর্তন সূত্র অনুযায়ী তা যুক্তিসঙ্গত হতে হয়। কাজেই, প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসে অবিশ্বাস পোষণের অপরাধে নাস্তিককে বিষোদগার করার আগে তার কর্ম ও চিন্তন পদ্ধতিকে আমাদের বোঝা প্রয়োজন। অন্যথায় কু-চিন্তা ও কু-তর্কের দোকানদারিকে মুক্তচিন্তা মনে করে আমরা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই থাকবো। আর, মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে বাগাড়ম্বর ধর্মীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে ধর্ষিত হতেই থাকবে। শাহবাগের চেতনাদীপ্ত তরুণরা যেমনটি হচ্ছেন!

দুই.
বাস্তবতা হচ্ছে, ব্লগার থাবা বাবা খুন হওয়ার পর শাহবাগের তারুণ্য জটিল এক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। বিরোধীপক্ষ চতুরভাবে আন্দোলনের ফ্রেমিংয়ে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটায়। ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমান করার বহু ব্যবহৃত অস্ত্রটি দিয়ে তরুণদের কোপাতে শুরু করে। বাংলাদেশে এই একটি ইস্যু কখনোই তামাদি হয় না। এই দেশে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত ও নাস্তিকতাকে লোকে একদম সইতে পারে না। যদিও আঘাত আসলেই করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করার মতো সচেতনা পাবলিকের নেই। এই চেতনায় মানুষকে দীক্ষা দেওয়ার সুযোগ একাত্তর করে দিয়েছিল। কিন্তু কায়েমি স্বার্থের কারণে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে বোঝা যায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষ এখানে কীভাবে বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। শাহবাগের তারুণ্যের জন্য বিষয়টি বিব্রতকর। ধর্মীয় অনুভূতির আবেগে যুক্তিহীনভাবে ডুবে থাকার কারণে বাংলাদেশের ‘পাবলিক পারসেপশন’ মিথ্যা প্রচারণায় সহজে বিশ্বাস করে এবং যুক্তিকে সন্দেহ করে। যে-কারণে শাহবাগের দামাল তারুণ্য ধর্মীয় অনুভূতির সাথে আপোসরফা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। নিজেকে ‘আস্তিক ও পরহেজগার’ হিসাবে প্রমাণ করার ওপরে তাদের চেতনা গঠনকারী আন্দোলনের ভূতভবিষ্যৎ নির্ভর করছে!

মিথ্যা প্রচারণার কাছে যুক্তির এই অসহায় আত্মসমপর্ণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন নাস্তিকরা। শাহবাগের দাবির সাথে একাত্ম নাস্তিকের জায়গা সেখানে থাকছে না। শাহবাগ যেভাবে ‘নাস্তিক’-এর সাথে ‘রাজাকার’কে এডপ্ট করলো তা মেনে নেওয়া কোনো নাস্তিকের পক্ষে সম্ভব নয়। এতে অবশ্য শাহবাগের কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে প্রতি ৬ জন লোকের মধ্যে ১ জন নাস্তিক হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটির কোনো গুরুত্ব নেই। এখানে নাস্তিকরা হচ্ছেন সংখ্যালঘুদের সংখ্যালঘু। অতএব, শাহবাগে তারা থাকলেন না গেলেন সেটা আন্দোলনে প্রভাব রাখে না। এ গেলো একটি দিক। অন্যদিকে সংখ্যার বিচারে মার্জিনাল হলেও প্রভাবের বিচারে নাস্তিকরাই আন্দোলনের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তারা হচ্ছেন সেই প্রভাবক, ধর্মীয় বিশ্বাসের মোড়লরা যাকে চিরকাল ভয় পেয়ে এসেছে। তাদের কাছে নাস্তিকতা হলো ভীতিকর এক চেতনার নাম। দীর্ঘ রক্তপাতের ইতিহাস সহ্য করে অবিশ্বাসীদের দলটি এখনো টিকে আছে এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম (মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ) জনগোষ্ঠীর আকার ধারণ করেছে। একুশ শতকের পৃথিবীতে নাস্তিকের বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিকে প্রতিরোধ করার মতো অস্ত্র ধর্মীয় বিশ্বাসীদের হাতে নেই। একমাত্র ছুরি ও চাপাতি ছাড়া। গালাগাল বা হুমকি-ধামকি ছাড়া।

কোনো জনপদে যুক্তি শক্তিশালী হলে অজ্ঞতা আপনা থেকে পিছু হটে। ইহজাগতিক বোধের জাগরণ ঘ্টায় ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপান্তর ও সংশোধনের যজ্ঞ শুরু হয়। ফলে মেজরিটি হওয়া সত্ত্বেও ধর্মে বিশ্বাসী লোকজন মুক্তচিন্তার বিপক্ষে শক্ত কোনো অবস্থান গড়ে তুলতে পারে না। এর মানে অবশ্য এই নয় যে ‘পাবলিক পারসেপশন’ নাস্তিক্যবাদের পেছনে ছুটতে থাকে। পৃথিবীর কোনো দেশে সেটা আজ অব্দি ঘটেনি। মানুষগুলো তখনো ঈশ্বর ও ধর্মে আস্থা পোষণ করেন। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলেন। তবে তাদের ঈশ্বর-ভাবনা বা ধর্মীয় চেতনার জগতে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। ধর্মকে ব্যক্তির বোধ-বিশ্বাস ও চেতনার জায়গা থেকে বিবেচনা করার যুক্তিতে তারা অভ্যস্ত হতে থাকেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের কঠিন সমালোচক কিংবা ধর্মবিরোধী কোনো বক্তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর চাইতে যুক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার ইহজাগতিক মানসিকতা পাবলিকের মাঝে জায়গা করে নেয়। যার ফলে ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে দাঙ্গা বাঁধানোর সুযোগ ধর্মের নেতা ও পুরুতরা নিতে পারেন না।

উপরের কথাগুলো ইসলাম-শাসিত কোনো দেশের ক্ষেত্রে খাটে না। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে খাটে না। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও খাটে না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ধর্মীয় বিশ্বাসকে মর্যাদা দানের প্রশ্নে বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ‘সেকুলার’ রাখতে পারেনি। শব্দটির সহজবোধ্য অর্থকে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের মারপ্যাঁচ দিয়ে অযথা জটিল করা হয়েছে। রাষ্ট্রের ‘সেকুলার’ হওয়া মানে কোনোভাবেই ধর্মহীনতা বোঝায় না, -সহজ এই উপলব্ধিকে সেকুলার চেতনার পক্ষের লোকজন পাবলিকের মধ্যে প্রাণ দিতে পারেননি। এক্ষেত্রে বিরোধীরা বরং সফল। সেকুলার চেতনার সাথে ইসলামী বিশ্বাস ও ইমানী চেতনার সাংঘর্ষিক এক ইমেজ তাঁরা গড়ে তুলেছেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে সেই ইমেজের মধ্যে বন্দি করেছেন। শাহবাগের আন্দোলন এখন তার মাশুল গুনছে।

শাহবাগের তরুণরা যখন জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলেন তখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের যুক্তিসঙ্গত আর্তি আড়ালেই পড়ে থাকে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির অধিকার সংবিধানে বহাল রেখে সকল মত-পথ ও ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সমতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কী করে সম্ভব? -এই প্রশ্নের মীমাংসা আজো কিন্তু হয়নি! ৪২ বছরে তৈরি হওয়া এই রাজনৈতিক বাস্তবতাকে শাহবাগ তাই অতিক্রম করতে পারে না। তথাকথিত সংখ্যালঘু জনগণ এবং সংখ্যালঘুদের সংখ্যালঘু নাস্তিকদের ট্রাম কার্ড হিসাবে ব্যবহারের অশুভ খেলা অতীতে হয়েছে। এখনো হচ্ছে। শাহবাগ তা প্রতিহত করার সাহস রাখে না। কেননা প্রতিহত করতে গেলে রাষ্ট্রদেহে ধর্মীয় অনুভূতির রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবি উঠবেই। শাহবাগকে তখন ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য লড়তে হবে। তার পক্ষে এই মুহূর্তে সেটি সম্ভব নয়। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হলে সেকুলার চেতনা নিয়ে ‘পাবলিক পারসেপশন’-এ যে বিভক্তি রয়েছে তা দূর করা প্রয়োজন। দ্বি-খণ্ডিত জনসমর্থন নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতিকে ‘না’ বলা আসলেই কঠিন। ইসলামপন্থী ও কায়েমি স্বার্থের মাঝে স্যাণ্ডউইচবন্দি শাহবাগের পক্ষে তো আরো কঠিন!

চেতনার প্রশ্নে শাহবাগ আন্দোলন জাতিকে পরিষ্কার দুটো শিবিরে ভাগ করে ফেলেছে। একপক্ষ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। অন্যপক্ষ বিরূপ। আন্দোলনের এই পর্যায়ে নিজেকে ‘আস্তিক ও পরহেজগার’ প্রমাণের জন্য শহিদ হয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের ‘পাবলিক পারসেপশন’ সহজে বুঝতে চাইবে না যে শাহবাগী ব্লগাররা কেউ নাস্তিক নয়, সাচ্চা মুসলমানের বাচ্চা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও ইসলামি চেতনার নাম করে যে বিষ শত-শত বছর ধরে পাবলিকের মনে ঢোকানো হয়েছে তা কীভাবে নামানো যায় সেই ওঝাগিরি মনে হয় অনেকবেশি জরুরি ও প্রাসঙ্গিক এখন।

তিন.
এটা জরুরি, কারণ, মানব সভ্যতায় ইসলামের ভূমিকা নিয়ে আমাদের বিদ্যাচর্চা বালকবেলার ভয়, বিস্ময় ও অন্ধ-সমীহ কাটিয়ে আজো সাবালক হতে পারেনি। ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন উঠালেই ‘বিশ্বাস ও অনুভূতিকে আঘাত করা হচ্ছে’ বলে আপত্তি করা হয়। প্রশ্নকর্তার মুণ্ডুপাত চলতে থাকে। তার গায়ে ‘নাস্তিক’, ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’-এর ছাপ্পর মেরে দেওয়া হয়। তবে এই ফতোয়াবাজি বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না। আজকাল অনলাইনে একদল একটিভিস্টের দেখা মিলে। ইসলামকে তাঁরা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। কট্টরপন্থীরা অবশ্য তাঁদেরকে ইহুদি-নাসারার এজেন্ট বলে প্রচার করে থাকেন। যে যাহোক, এসব একটিভিস্ট মনে করেন বর্তমান সভ্যতায় ধর্মীয় বিশ্বাস অপ্রসাঙ্গিক হতে চলেছে। গায়েবি সত্তায় বিশ্বাসের ক্ষুধা প্রাচীন হলেও শুধু ধর্মীয় কিতাবের ওপর নির্ভর করে সেই ক্ষুধা মেটানো সম্ভব নয়। যে-কারণে পাপবোধ, নৈতিকতার স্খলন ও আধ্যাত্মিক শূন্যতাকে মানবিকবিদ্যার অন্যান্য জ্ঞান দিয়ে বিচার করা প্রয়োজন। সেখানে ইসলামী শরিয়তের চর্বিতচর্বন এবং ইমান-আকিদার প্রতি অন্ধ আনুগত্য এই ধর্মের অনুসারীদের পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। তারা অতীতমুখী ও সহিংস হয়ে উঠছেন। পরিণত হচ্ছেন রাজনীতির গুটিতে। ইবনে ওয়ারাক, ননি দারবিশ, আলী সিনা, এম. এ. খান, আনোয়ার শেখ, মোহাম্মদ আসগর, আবুল কাশেম ফজলুল হক, সুজিৎ দাস-এর মতো বহু অনলাইন একটিভিস্ট ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কট্টর ও মধ্যপন্থী উভয় প্রকার ইসলামকে নিয়ে নিজের সন্দেহকে তাঁরা ব্যাখ্যা করছেন। ইসলামের প্রচলিত ও বিশ্বস্বীকৃত ইমেজকে বাতিল করে নতুন সব বক্তব্য দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে পশ্চিমা পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের চেয়ে কোরআন, হাদিস, সুন্না, তাফসির ও ফেকাহশাস্ত্রে বর্ণিত টেক্টস্ট এবং মুসলমান ঐতিহাসিকদের বিবরণগুলোকে তাঁরা বেশি আমলে নিচ্ছেন।

এম. এ. খান-এর ইসলামিক জিহাদ, আনোয়ার শেখ ও ননি দারবিশের আরব সাম্রাজ্যবাদ অথবা আলী সীনা ও সুজিত দাশের মোহাম্মদের লগে বোঝাপড়া নামের মনঃস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণগুলো নতুন এক ইসলামকে পাঠকের সামনে হাজির করেছে। এই ইসলাম অস্বস্তিকর। লজ্জাস্করও বটে। ‘মদিনা সনদ’ বা ‘ওমরের চুক্তিনামা’র কথা শুনলে আমরা আবেগে গলে পড়ি। আমাদের মধ্যে যারা এর হয়ে ওকালতি করি তাদের পক্ষে এম. এ. খান বা আলী সিনা’র মতো নাস্তিকদের বিশ্লেষণী-চাপ সহ্য করা কঠিন হবে। যেসব ব্লগে তাঁরা লেখালেখি করেন সেখানে প্রতিদিন হুমকি-ধামকি আসে। অনেকে আবার বাক-বিতণ্ডায় অংশও নেয়। আমাদের জামাত-শিবির ও তাদের বিরোধীপক্ষের দৌড় সম্ভবত এতোদূর পৌঁছায়নি। নইলে লঙ্কাকাণ্ডের কিছু বাকি থাকতো না।

এখনো মনে আছে, ইসলামের প্রচলিত ইতিহাসকে খণ্ডন করে লেখা বেঞ্জামিন ওয়াকারের ‘দ্যা ফাউন্ডেশন অব ইসলাম’ বইটি সা’দ উল্লাহ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তখন বিএনপি’র জামানা চলছে। বইটি প্রকাশ হওয়ার মাস তিনেক পরেই ব্যান করা হয়। অথচ অনলাইনে পরিস্থিতি অন্যরকম। আলী সিনা’র কথাই ধরি। ইরান দেশে তাঁর জন্ম। সেখানকার মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায়। বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন। সিনা একাধিক ব্লগে লেখালেখি করেন। নিজেও দুটি ব্লগ পরিচালনা করছেন। ইরান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন ও মিশরের নামকরা আলেম-ওলামা ও ইসলাম বিশেষজ্ঞরা তাঁর ব্লগে ‘Debate with Ali Sina’য় প্রায়শ অংশ নিয়ে থাকেন। কট্টর থেকে মধ্যপন্থী সকলেই এতে যোগ দিয়েছেন। বিশেষ কোনো কটূক্তি বা উসকানি ছাড়া বাহাসগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

বাংলাদেশের ব্লগ ও গণমাধ্যমে এরকম বিতর্কের কথা চিন্তাও করা যায় না। আমাদের পরিপাকতন্ত্র নাজুক। তথ্য, ব্যাখ্যা ও যুক্তি দিয়ে সুগঠিত বক্তব্য হজম করার শক্তি একেবারেই নেই। তারচেয়ে ‘নূরানী চাপা’র মতো শস্তা মাল নিয়ে রাজনীতি করা অনেক সহজ। পাবলিক বিগড়ানো যায়। শাহবাগী তরুণদের নাকানি-চুবানির একশেষ করা যায়। এতে ধর্ম-ব্যবসা বজায় থাকে! আমাদের প্রধান দুই নেত্রীর রেষারেষি নিয়ে অনেকে তির্যক মন্তব্য করেন। মন্তব্যগুলো অসত্য নয়। তবে, এই একটি ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে কোনো ঝগড়া নেই। মধুর সহবত আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে হয়তো।

চার.
কোনো বিষয়ে কটুক্তি ও উসকানি অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু তথ্য ও যুক্তির প্রতি সৎ উক্তির মূল্য এখানে কে দেয়! ধর্মীয় বিশ্বাসকে আমরা নিরেট ভক্তির জায়গা থেকে দেখার যে অভ্যাস করেছি সেখানে থেকে আর বের হতে পারিনি। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, ধর্ম যে ঈশ্বরের কথা বলে তাঁকে পাওয়ার দুটো রাস্তা খোলা রয়েছে, এর একটি জ্ঞান ও বিচারের দিকে মোড় নিয়েছে এবং অপরটি ভক্তির দিকে গেছে।জ্ঞানের পথ সকলের হজম হয় না।আমপাবলিকের জন্য ভক্তির রাস্তা-ই হলো সোজা রাস্তা। ‘আমি বিশ্বাস করি’ -এই অনুভূতি সেখানে শেষ কথা। ভক্তের জন্য অনুভূতি-ই হলো জ্ঞান। স্মার্টফোন ও ফেসবুকিংয়ে চটপটে হলে কী হবে, আমাদের চেতনার জগতে মুক্তচিন্তার ঢেউ আজো উঠেনি। আমরা এখনো সেই ঊনিশ শতকে পড়ে আছি!

ঊনিশ শতকে লটকে থাকার একটি বড়ো কারণ হলো বাংলাদেশ বিজ্ঞানচেতনাকে কখনো আমলে নেয়নি। রিচার্ড ডকিন্স ‘স্বার্থপর জিন’ লিখে ডারউইনের তত্ত্বকে আরো অকাট্য ও প্রামাণিক করে তুলেছেন। আমাদের রাষ্ট্র এসবে কখনোই আগ্রহ বোধ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় না। চার্চের আপত্তি আছে। একটি মহল সেখানে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ নামে সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিবর্তনের মনগড়া ব্যাখ্যা পাবলিকের মগজে ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কারণে সেই তত্ত্বের ভুল ও অসৎ উদ্দেশ্য ধরিয়ে দেওয়া এবং পাবলিককে বোঝানোর সুযোগ সেখানে রয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষিতের গড় হার এবং শিক্ষার মান এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। আর তথ্যপ্রবাহ এতোটা সুগম নয় যে বিজ্ঞানের ভূয়া ও উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ সম্পর্কে পাবলিক জানতে ও বুঝতে পারবে। সংবিধানে ধর্মীয় চেতনাকে বহাল রেখে সেটা কখনো করা যাবে না। ‘বিজ্ঞানচেতনা বা বৈজ্ঞানিক পন্থায় ভাবা’ -এই ইমেজটি আমাদের ভক্তিবাদী মনের সাথে কখনোই খাপ খায়নি। যে-কারণে সুধীন দত্ত খুব কম বাঙালির প্রিয় কবি হতে পেরেছেন। আর ঠোঁটকাটা হুমায়ূন আজাদকে চাপাতির কোপে মরতে হয়েছে।

কাণ্ডজ্ঞান বলে, একটি ঘটনাকে শুধু ভক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্বাস স্থাপন করা অনুচিত। বিশ্বাস করার আগে যুক্তির নিক্তি দিয়ে তাকে বিচার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই অভ্যাসটি শক্ত হয়ে ওঠেনি। ফলে মুক্তচিন্তার রাস্তাটি সরু হয়ে এসেছে। ভক্তিরসের রসিক রামকৃষ্ণ পরমহংস কট্টর ইহজাগতিক বিদ্যাসাগরের সাথে একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন। আবেগ-আপ্লুত রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘এতোদিন সাগরের নাম শুনে এসেছি। আজ দরশন হলো।’ উত্তরে স্মিত হেসে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘এসেই যখন পড়েছেন, একটু লোনা জল নিয়ে যান।’ বিপরীত ভাব ও বিশ্বাসের দুটি মানুষ পরস্পরকে এভাবে চিনে নিয়েছিলেন। সেই চেনার মধ্যে শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার কোনো কমতি ছিল না। বিনিময়ের এই সুতো বোনার কাজ বাংলাদেশ থেকে ক্রমে লোপ পেয়েছে। ৪২টি বছর ধরে আমরা পাক্কা মুসলমান হওয়ার রাজনীতির মধ্যে বসবাস করছি। ‘বাঙালিরা পাক্কা মুসলমান নয়’, -এই রাজনীতি দিয়ে একাত্তরে মানুষকে কচুকাটা করা হয়েছিল। মুসলমান হওয়ার দাপটে শুদ্ধ মানুষ হওয়ার প্রশ্নগুলো তাই আজ মরতে বসেছে।

বাংলাদেশের মানুষের বোঝার সময় হয়েছে যে ‘পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান’ নামে যে ইসলামকে এখানে আমল করা হয় তা অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতায় ভরপুর। কেননা এর প্রতিটি অক্ষরকে আমরা বিশ্বাস করি। সন্দেহ করি না। সেভাবেই আমাদের শেখানো হয়েছে। সেভাবেই আমরা কোরআন, হাদিস চিনে বড়ো হয়েছি। শরিয়ত ও মারিফতের মারপ্যাঁচের মাঝে মজহাবের আইনগুলোকে আমল করছি। কোরআন, হাদিস, সিরা, তাফসির, ফেকাহ এবং মুসলমান ঐতিহাসিকদের উপর ভিত্তি করে ইসলামের যে অনুশীলন এখানে হয় তার মধ্যে ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বকে এক-পাল্লায় মেপে নেওয়ার বাতিক রয়েছে। কাজটি শুধু কওমি-দেওবন্দি-তাবলিগ বা মওদূদীর চেলারাই করেন না, বাংলাদেশে ইসলামের সাথে জাতীয়তাবাদের মিলন ঘটাতে ব্যাকুল একদল বামপন্থী ও ভাবান্দোলনের সৈনিকরাও করেন। নিরেট ঐতিহাসিক তথ্যকে দার্শনিক ব্যাখ্যার মোড়কে ভরে তাঁরা বাজারে চালান করছেন। সেইসাথে প্রলেতারিয় তত্ত্বের সাথে এর নিকাহ পড়ানোর উপায় খুঁজছেন! তাঁরা সকলেই প্রচণ্ড ইহজাগতিক। ভোগবাদী। পুঁজিবাদী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পুঁজিবাদী দুনিয়ার সুখ ও কামিয়াবি ছেড়ে আখেরাত ও পুলসিরাত চাইবেন বলে মনে হয় না। তবে আখেরাতকে দার্শনিক মহিমা দেওয়ার রাজনীতি বজায় রাখা তাঁদের জন্য জরুরি। যে-কারণে মনে হয়, বাংলাদেশে ইমানী-বিশ্বাস একটি রাজনীতি। একে ‘থিওলজি’ বা ধর্মতত্ত্বের সাথে মেশাতে পারলে যে বটিকা তৈরি হয়, তা-দিয়ে পাবলিককে সহজেই আহাম্মক বানানো যায়। দুনিয়াবির ফায়দাও হাসিল হয়! জাকির নায়েক, আহমেদ দিদাত বা হারুন ইয়াহিয়ার সাথে এইসব বামপন্থী ও ভাবান্দোলনকারী বুদ্ধিজীবীদের পৃথক করা মুশকিল। তাঁরা সকলেই ধর্মীয় রাজনীতির আড়তদার। বাংলাদেশে এই রাজনীতি একটি ব্যবসা। একে বজায় রাখার স্বার্থে ওইসব লোকেরা বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যা করেন, ভুল ঐতিহাসিক তথ্যকে আরো বেশি ভুল পথে ব্যবহার করেন এবং ইমান-আকিদার রাজনীতিকে পাঞ্চ-লাইন করে পাবলিকের মগজে বিভ্রান্তি ও আনুগত্যের বিষ ঢোকান।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতিকে ব্যবহার করে ওঠার রাজনীতি এখন বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতি। এর বাইরে দ্বিতীয় কোনো স্পেস এখানে তৈরি হয়নি। মুজিব হত্যার পর থেকে এভাবে সবকিছুকে ছকবন্দি করা হয়েছে। সুতরাং পাবলিক থেকে বুদ্ধিজীবী সবাইকে এখানে ‘আস্তিক’ হতেই হবে। লুঙ্গি খুলে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া ছাড়া অপর কোনো সত্তার অস্তিত্ব এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েদের আর কী দোষ!
... ... ...
আহমদ মিনহাজ
২৩.০৩.১৩

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আপাতত একটাই করণীয়। সেটা হচ্ছে প্রসঙ্গ ধরে রাখা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সক্রিয় থাকা। গত সাড়ে তিন সপ্তাহ ধরে হেফাজতে ইসলাম যা করছে সেটাকে আন্দোলনকারিরা জামাত থেকে আলাদা করে গুরুত্ব দিতে গেলেই পাঁকে অনেক বেশি করে জড়িয়ে পড়তে হবে। বাংলা ব্লগিঙের বয়স ছয় বছর। এতোকাল সাড়া না দিয়ে কেন কেবল জামাত কোনঠাসা হবার পরেই হুজুরদের টনক নড়লো সেটা আগে দেখতে হবে। হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে যে মওদুদীবাদীদের আশির্বাদ আছে গণজাগরণ মঞ্চের কাছে সেটাকেই জরুরি তথ্য হতে হবে। সরকারের কাছেও সেরকম হলেই ভালো। মানে জনগণের জন‌্য ভালো। সরকারের জন্য বা সরকারী দলের জন্য কোনটা ভালো সেই হিসাব জনস্বার্থের সাথে না মিলবার সম্ভাবনাই বেশি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাংলা ব্লগিঙের বয়স ছয় বছর। এতোকাল সাড়া না দিয়ে কেন কেবল জামাত কোনঠাসা হবার পরেই হুজুরদের টনক নড়লো সেটা আগে দেখতে হবে

সরকারের জন্য বা সরকারী দলের জন্য কোনটা ভালো সেই হিসাব জনস্বার্থের সাথে না মিলবার সম্ভাবনাই বেশি

চলুক

হাসিব এর ছবি

আমাদের জন্য এই অভিজ্ঞতাও নতুন নয় যে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাঙালির আস্থা চল্লিশে নিস্তেজ হতে শুরু করে।

এইটা মনে হয় অতিকথন হইলো। মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাঙালির আস্থা ছিলো না কোনকালেই।

মহাজাগতিক ঈশ্বরের (Cosmological God) সম্ভাবনাকে নাস্তিকরা অস্বীকার করেন না।

বলেন কি!

যে-কারণে শাহবাগের দামাল তারুণ্য ধর্মীয় অনুভূতির সাথে আপোসরফা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। নিজেকে ‘আস্তিক ও পরহেজগার’ হিসাবে প্রমাণ করার ওপরে তাদের চেতনা গঠনকারী আন্দোলনের ভূতভবিষ্যৎ নির্ভর করছে!

ঠিক।

শাহবাগ যেভাবে ‘নাস্তিক’-এর সাথে ‘রাজাকার’কে এডপ্ট করলো তা মেনে নেওয়া কোনো নাস্তিকের পক্ষে সম্ভব নয়।

আমার ধারণা আপনি এই বাক্য যা বুঝাতে চেয়েছেন সেভাবে কিবোর্ড দিয়ে বাক্যটা বের হয়নি। শাহবাগ রাজাকারদের এডোপ্ট করেছে এমনটা ভাবার কারণ নেই।

ইবনে ওয়ারাক, ননি দারবিশ, আলী সিনা, এম. এ. খান, আনোয়ার শেখ, মোহাম্মদ আসগর, আবুল কাশেম ফজলুল হক, সুজিৎ দাস-এর মতো বহু অনলাইন একটিভিস্ট ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

আমি এদের কাউকেই চিনি না। আমার ধারণা পাঠকদের মধ্যে আমি একাই এই সমস্যায় আক্রান্ত না। একটু পরিচিতিমূলক কিছু যোগ করলে আমাদের সুবিধা হতো।

কোনো বিষয়ে কটুক্তি ও উসকানি অবশ্যই নিন্দনীয়।

কটুক্তি বাছতে বসলে কোন সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানে পৌছানো যাবে না। অতএব এই রাস্তায় আগায় লাভ নাই।

আপনার লেখায় একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের বক্তব্য আর্গুমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে দুই বার ব্যবহার করেছেন। আপনার লেখার টোনের সাথে এইটা ঠিক যায় না।

অতিথি লেখক এর ছবি

পয়েন্ট আউটের জন্য ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যের বিপরীতে কিছু কথা যোগ করতে চাই। ১. মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাঙালির আস্থা ছিল না এমনটি বলা খুব বেশি সিদ্ধান্তমূলক হয়ে যায়। সাহিত্য থেকে রাজনীতি, কিষাণ থেকে শহুরে তরুণ, উপনিবেশ থেকে পাকি ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে বাঙালির ভূমিকা একবার খেয়াল করুন। দেশ-কাল ও ঘটনা পরম্পরায় বাংলার সীমাবদ্ধ আকাশে মুক্তচিন্তার ঢেউ বারেবারে উঠেছে। কলোনিয়াল রেজিমে ‘ইয়াং বেঙ্গল’রা মুক্তচিন্তার বীজ ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। তবে নিজেকে সেই চিন্তায় পরিপক্ক করে তুলতে পারে নাই। যে-কারণে তারা মার খেয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে ‘বেঙ্গল’রা সকলেই পুরোনো সংস্কারের ফিরে গিয়েছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী এবং পরবর্তিতে বিনয় ঘোষ এটা নিয়ে বিস্তর চর্চা করেছেন। তৃণমূলে বাউল সাধকরা তাদের নিজস্ব ‘ভাববাদী পারসেপশন’ থেকে খোলামনে ভাবার চেষ্টা করেছেন। মানবিক এক ঈশ্বরকে তারা ভাবনা করেছেন। ধর্মের কঠোর রূপকে উদার, সহিঞ্চু ও মানবিক এক ঈশ্বর-বিশ্বাসের মাঝে অবগাহন করানোর প্রয়াস ছিল সেখানে। তবে মারিফতির চোরাটানে অন্যদিকে মোড় নেয়ার কারণে এক লালন বাদে অন্যরা এই চেতনাকে সেভাবে ধারণ করতে পারেননি। তবে দেশকালের বিচারে তাদের এই সংগ্রাম কিন্তু কম মূল্যবান ছিল না। প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে মুক্তচিন্তার বাণী পৌঁছে দিতে হলে লালনের মতো সাধকের ভাবনাগুলোকে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরায়নি। অন্যদিকে, লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চায় বাঙালি সেকুলারচেতনার প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করে। যে-কারণে পহেলা বৈশাখ শরিয়তীদের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে এতোটা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পেরেছে। পাকি রেজিমের পুরোটাই আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে ভরপুর। মুক্তচিন্তার বীজ বহনকারী তারুণ্যই কিন্তু সেখানে অগ্রবীজ রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। বাহান্নো, ঊনসত্তুর বা একাত্তর সম্মুখগতির তাড়না থেকে সৃষ্ট। সমস্যা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এই চেতনাগুলোকে আমরা ভাষা দিতে পারিনি। বাহাত্তরের সংবিধানে সুযোগটি ছিল। আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। ফলে মুক্তচিন্তার পরিসর ক্রমে সঙ্কুচিত ও দিকভ্রান্ত হয়েছে। ‘পাবলিক পারসেপশন’কে বদলানোর রাজনীতি সুবিদাবাদী চেহারা ধারণের কারণে মুক্তচিন্তার সম্ভাবনা মরুসাহারায় পথ হারিয়েছে। বাঙালির সমুখগতির চেতনাও তাই চল্লিশে অস্তমিত হওয়ার জগদ্দল অভ্যাসের মাঝে গিয়ে পড়েছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের আরো লড়তে হবে। এই দেশে প্রগতির বীজ যেখানে যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাকে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে না-ফেলে কুড়িয়ে আনা প্রয়োজন। অপরের বিশ্বাসকে ঘৃণা করে মুক্তচিন্তার বীজকে মহীরূহে পরিণত করা যায় না। তার বিশ্বাসের কারণগুলোকে খতিয়ে দেখা এবং নিষ্ক্রমণের সড়ক তৈরির চেষ্টাই হলো প্রগতি। কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন।

২. এক্ষেত্রে ঠিক পরের লাইনটি বোধহয় আপনি খেয়াল করেননি। ভৌত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে চূড়ান্ত কোনো রায় ঘোষণা করেনি। স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে পদার্থ বিজ্ঞানের গাণিতিক সূত্রগুলো এখনো প্রমাণিত কোনো সত্য নয়। গানিতিক ও যৌক্তিক অনুমানের সমষ্টি মাত্র। সেটা হকিং পড়লেই টের পাওয়া যায়। যে-কারণে ‘বৈজ্ঞানিক অধিবিদ্যা’ হিসাবে এগুলোকে বিবেচনা করা হয়। এই ‘অধিবিদ্যা’ দর্শন বা থিওলজির ‘অধিবিদ্যা’র সাথে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। গাণিতিক হিসেব-নিকেশ ও যুক্তিসূত্রের ওপর ভর করে সম্ভাব্য অনুমান মাত্র। যেখান থেকে ‘বিজ্ঞানের দর্শন’ নামক চিন্তাটিকে আমরা পাঠ করি। এতে শিক্ষিত হয়ে উঠি এবং বিজ্ঞানচেতনায় দীক্ষা লই। যুক্তির বিচারে শক্তিশালী হওয়ার কারণে ধারণা করা হচ্ছে, কণাবাদী বলবিজ্ঞান ও জেনেটিক ইভ্যালুয়েশনের পারস্পরিক যোগফল থেকে অনুমানুগলো একদিন প্রমাণিত তত্ত্বে পরিণত হবে। সুতরাং, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা প্রসূত ‘স্রষ্টা’র ধারণায় বিশ্বাস করা মানে কিন্তু এই নয় যে ধর্মীয় কিতাবের ঈশ্বরকে সে বৈধ করছে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা। ধর্মের ঈশ্বরকে খারিজ করার জন্য ধর্মীয় বিশ্বাসের বিবর্তন এক্ষেত্রে যথেষ্ট। উপযুক্ত পরিসর পেলে এ-নিয়ে বিস্তারিত হওয়ার ইচ্ছে রইলো।

৩. শাহবাগ ‘রাজাকার’কে কীভাবে এডোপ্ট করেছে সেটা বোধহয় পুরো লেখার মধ্যেই বলার চেষ্টা করেছি। আরেকবার পড়তে অনুরোধ করি।

৪. ইবনে ওয়ারাক … প্রমুখদের ব্যাপারে আগ্রহী হলে islam-watch.org/ alisina.org/ faithfreedom.org/ nobojug.org এই সাইটগুলো ভিজিট করতে পারেন। Google ও Facebook-এ তাঁদের ব্যাপারে সবিস্তার তথ্য পাবেন। এছাড়া মুক্তমনা ব্লগে ‘বিকল্পধারার ইসলামচর্চা ও এম. এ. খানে’র জিহাদ‘ শিরোনামে একটি রিভিউ পোস্ট করেছিলাম। লেখাটি এ-ব্যাপারে আপনাকে বিস্তারিত তথ্য দিতে সহায়তা করবে আশা করি।
৫. আমার লেখার টোনের সাথে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নাম-উল্লেখ কেন যায় না সেটা ঠিক বুঝলাম না। বুঝিয়ে দিলে নতুন করে ভাববো হয়তো।

আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গোটা লেখাটার জন্য একবার ধন্যবাদ, যদিও সকল বিষয়ে আপনার সাথে সহমত নই। দ্বিতীয় দফা ধন্যবাদ মারিফাতের প্রসঙ্গটি তুলে আনার জন্য। এই প্রসঙ্গটিতে আপনার কাছ থেকে স্বতন্ত্র পোস্ট আশা করছি। বাংলাদেশে মারিফাতের ধ্বজাধারীদের কিয়দংশ অরাজনৈতিক, কিয়দংশ জামায়াতবিরোধী রাজনৈতিক আর বাকি অংশ জামায়াতসহায়ক রাজনৈতিক। রাজনীতি নিয়ে তাদের অবস্থান যা-ই হোক না কেন সার্বিক পশ্চাদপদতার জন্য তাদের যে বিরাট ভূমিকা আছে, এবং ধর্ম ব্যবসায়ে তাদের যে বিরাট স্টেক আছে সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ষষ্ঠ পাণ্ডব, আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। শরিয়ত ও মারিফতের মৌল বিরোধ নিয়ে কতোটুকু কী লিখতে পারবো জানি না, তবে ইচ্ছে আছে। আধ্যাত্মিক মর্ম ও পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্সের জায়গা থেকে শরিয়ত ও মারিফত নিয়ে ভাব-বিনিময় বা মন্তব্যের আদান-প্রদান দিনে-দিনে জরুরি হয়ে উঠছে। তবে বাংলাদেশে মারিফতের ধ্বজাধারী বা ব্যবসায়ী বলে যাদেরকে আপনি মিন করতে চাইছেন, বিনয়ের সাথে বলছি, তারা সম্ভবত এই কাতারে পড়েন না। বাংলাদেশে মারিফতের প্রবাহের দুটি ধারা এসে মিশেছে। একটি পীর-আউলিয়ার সূত্র ধরে এখানে এসেছে। শরিয়তের সাথে এর শক্ত কোনো বিরোধিতা নেই। বরং আপোস ও নমনীয়তা রয়েছে। পীর-আউলিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম শরিয়তের খুটিকে শক্তিশালী করতেই ভূমিকা নিয়েছে। অন্য প্রবাহটি বৌদ্ধ, হিন্দু ও পারস্য-প্রভাবিত ইসলামের জটিল রসায়নে এ-দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে। এই মারিফতে সুফি ও বাউলভাবের জটিল মিশ্রণ যেমন পাই, পীর-আউলিয়াদের আইকনসদৃশ ইমেজকেও প্রতিফলিত দেখতে পাই। তৃণমূলের মানুষ বা লোকায়ত জীবনের মধ্যে মারিফতের এই যুগলবন্দি স্বরূপকে লোকে এবাদত করেন। দীর্ঘ সময় জুড়ে এর আধিপত্য ছিল। এখনো বাঙালিজীবনে সেটি অন্তঃসলিলা রূপে বইছে। তবে ওয়াহাবি ধারার হুকুমত পন্থীদের চাপে এবং ত্রাসে মারিফতের সেই রূপখানি আগের মতো নেই! সে যাহোক, বাংলাদেশে ইসলামী মত-পথের বিচিত্র ধারা বা প্রবাহ এসে মিশেছে। এগুলো নিয়ে নিবিড় ভাবনা ও অনুসন্ধান সত্যিই প্রয়োজন। সেই ক্ষমতার জায়গায় পৌঁছালে নিশ্চয় লিখবো। আপতত প্রশ্নগুলো উসকানোর কাজটি চলুক না হয়। অনেক ধন্যবাদ।

পৃথ্বী এর ছবি

চাপাইনবাবগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎ কর্মচারীদের বাড়িতে জামায়াতের আগুন দেওয়া নিয়ে সময় টিভির প্রতিবেদনে পরিস্কার দেখা গিয়েছিল ইহজাগতিক জিনিসপত্রের পাশাপাশি পারলৌকিক কোরানও পুড়েছে। ইন্টারেস্টিংলি, টিভিতে এই পোড়া কোরানের ছবি দেখে দেশের কোথাও কোন বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে বলে শুনি নাই। চাপাইনবাবগঞ্জের ভুক্তভোগীরাও কোন বিক্ষোভ করেনি। বায়তুল মোকাররমের টাইলস ভাঙা, গালিচায় আগুন দেওয়া, বাঁশ ও হাতবোমা নিয়ে মসজিদে ঢোকা, মসজিদের ভেতরে বসে মারামারি করা প্রভৃতি কর্মযজ্ঞেও কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগছে বলে মনে হয় না, এ নিয়ে অরাজনৈতিক সাধারণ মুসলমানদের কোন বিক্ষোভ সমাবেশ তো দেখলাম না। ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগলে যারা সবার আগে দা-বটি নিয়ে রাস্তায় নামে, তারা ওই সময়ে বায়তুল মোকাররমের ভেতর থেকে পুলিশের প্রতি ইট মারায় ব্যস্ত ছিল।

আমি মনে করি "ধর্মানুভূতি" নামক কিম্ভূত অনুভূতি আসলে জামায়াত ও জামায়াতঘেষা মৌলবাদী দলগুলার স্বেচ্ছাচার করার মামাবাড়ির আবদার ছাড়া কিছু না। "ধর্মানুভূতি" নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আমরা পরোক্ষভাবে "ধর্মানুভূতি" নামক অনুভূতিটার জন্ম দিতে সহায়তা করছি, আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি যে সাধারণ মানুষ আসলেই পেট চালানোর চিন্তা বাদ দিয়া ধর্ম টেকানোর চিন্তায় মগ্ন - এটার লাভের গুড় পুরোপুরি জামায়াতের কাছে যাবে। যেই কথিত ৯০% মুসলমানের দেশে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের সাথে জোট বেধে সব ইসলামী দলগুলাকে ছাপিয়ে ১৮০ এর মত আসন পায়, সেই দেশের লোকজনের "ধর্মানুভূতি" আছে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাবধারা এখনও ইসলামিস্ট(মানে, ইসলামকে একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে পালন করা) হয়ে উঠেনি, সরকারের উচিত হবে সময় থাকতে থাকতেই "ধর্মানুভূতি" এর গুষ্টি কিলিয়ে জামায়াতকে গুড়িয়ে দেওয়া। জামায়াতের মগজধোলাই প্রক্রিয়া যতদিন চলতে থাকবে, ততদিন "ধর্মানুভূতি" ধীরে ধীরে বাস্তব রুপ নিতে থাকবে। তখন আমাদের ধর্মানুভূতি নিয়ে আসলেই উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

"ধর্মানুভূতি" নামক অনুভূতিটাকে তৈরী করার প্রক্রিয়ায় সরকার বর্তমানে জামায়াতের সাথে হাত মেলাচ্ছে, ইচ্ছায় নাকি অনিচ্ছায় সেটা ভিন্ন বিতর্ক। আওয়ামী লীগ আসলেই বাঙ্গালীকে ইসলামিস্ট মনে করে কিনা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, বাঙ্গালীকে এতটা মুমিন মনে করলে ধর্ম নিয়ে খেলা করার জন্য নির্বাচনের আগের বছর পর্যন্ত্য অপেক্ষা করতে হবে কেন? তবে আওয়ামী লীগ যদি মনে করে নির্বাচনের আগে আগে আলগা দাড়ি লাগিয়ে তারা ধর্মান্ধ ভোট পাবে, তবে তারা ভুল করছে। ধর্মান্ধরা ঠিকই আলগা দাড়ি আর আসল দাড়ির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। স্বীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের উচিত হবে এখনই বালখিল্যতা ত্যাগ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নির্মূলে মনযোগী হওয়া। কোন সমান্তরাল মহাবিশ্বেই ইসলামিস্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভাত থাকবে না।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কমেন্টে পাঁচ তারা। পৃথ্বী, আপনার কাছ থেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে স্বতন্ত্র পোস্ট আশা করছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

প্রয়োজনীয় লেখা - আমার বেশ ভাল লেগেছে - আলোচনা চলুক - মন্তব্যগুলো থেকে আরো কিছু জানতে পারব আশা করি। ধন্যবাদ লেখক কে।

অবনীল এর ছবি

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, সাধারনের ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব এবং এদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে কার্যকরণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিপুণ হাতে এক অসাধারণ বিশ্লেষন তুলে ধরেছেন । সার্বিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষন করে এরকম একটা লেখা অনেক দরকার ছিল। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এ বিষয় নিয়ে আরও লেখা আশা করছি আপনার কাছে থেকে। লেখাটি ফেবুতে শেয়ার করলাম।

মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাঙালির আস্থা চল্লিশে নিস্তেজ হতে শুরু করে। আর, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে বোঝাপড়া মধ্য চল্লিশেই খতম হয়। বাকি জীবন চলে এর সাথে মধুর সহবাস নয়তো আপোস করে।
------------------
বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ ও ‘নাস্তিক’কে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে এমন কামান দাগার ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। ‘সেলুকস! কী বিচিত্র এই দেশ’!
-----------------------------
নাস্তিকদের মতে প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর অ-সৃষ্ট নয়। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে মানুষ তাকে সৃষ্টি করেছে। মানুষের অনুভূতিশীল মন হচ্ছে সেই সৃষ্টির সূতিকাগার। আর মগজ হলো দৈব বা আসমানি কিতাব তৈরির কারখানা। মানুষের অতিকল্পনা ও মন্ময়ভাব থেকে সৃষ্ট এই ঈশ্বরকে আসমানি কিতাবগুলোর মাধ্যমে একটি সংহত প্রথা ও প্রতীকে রূপ দেয়া হয়েছে। কালে-কালে তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে গেছে। সৃষ্ট ঈশ্বরকে মেনে চলার ঠেকা যুক্তিশীল নাস্তিকের থাকার কথা নয়। এই অর্থে তিনি অবশ্যই অবিশ্বাসী।

নাস্তিকের কাছে ঈশ্বরের চেয়ে মানুষ ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণটি পরিষ্কার। পৃথিবীতে মানুষ হলো একমাত্র সত্তা যে কিনা অনামা, অজানা ঈশ্বরকে ভাবতে সক্ষম হয়েছে এবং ভাববাদী সংস্কৃতির মিনার খাড়া করে তাকে আজো টিকিয়ে রেখেছে। এই মিনারের মাধ্যমে জগতের সকল আস্তিক ঈশ্বরকে অনুভব করেন। ঈশ্বরের সৌন্দর্য, সরলতা এবং ক্ষমতার কথা ভেবে সম্মেহিত হয়ে পড়েন। যুক্তি দিয়ে মিনারের জটিল নকশার কুল-কিনারা পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে মনের মধ্যে সন্দেহের চেয়ে পূর্ব নির্ধারিত বিশ্বাসের ভাব প্রবল হওয়ার কারণে ভক্তিরসের বল্গাহারা আবেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। রসের সাহায্যে মিনারের গুণগান করতে থাকেন। অন্যদিকে নাস্তিকের হৃদয় সত্যিই কঠিন। সে হলো এক বগগা ঘুড়ির মতো। মনের মধ্যে মিনার নিয়ে প্রশ্ন, সংশয় ও যুক্তির তোলপাড় দূর না হওয়া অব্দি এর সাথে লেগে থাকে। উপলব্ধির বিরামহীন এই চেষ্টাকে আস্তিকরা ভক্তি নামে বোঝেন। যুক্তি যার নাগাল পায় না বলে তাদের ধারণা। কিন্তু নাস্তিকের পৃথিবীতে ভক্তির চেয়ে যুক্তির আদর বেশি। আস্তিকের কাছে বিশ্বাসের অর্থ হলো এটা প্রমাণ করা যে ঈশ্বর হচ্ছেন সবকিছু। মানুষ সেখানে উপলক্ষ মাত্র। আর নাস্তিক এই বিশ্বাস বজায় রাখা জরুরি মনে করেন যে জাগতিক ঘটনারা মানুষে কেন্দ্রীভূত হয়ে ঈশ্বরকে জন্ম দিয়েছে। বিশ্বাসের কথা যদি বলি, তবে উভয়ের মধ্যে এখানেই তফাত!
-----------------------------
কোনো জনপদে যুক্তি শক্তিশালী হলে অজ্ঞতা আপনা থেকে পিছু হটে। ইহজাগতিক বোধের জাগরণ ঘ্টায় ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপান্তর ও সংশোধনের যজ্ঞ শুরু হয়। ফলে মেজরিটি হওয়া সত্ত্বেও ধর্মে বিশ্বাসী লোকজন মুক্তচিন্তার বিপক্ষে শক্ত কোনো অবস্থান গড়ে তুলতে পারে না। এর মানে অবশ্য এই নয় যে ‘পাবলিক পারসেপশন’ নাস্তিক্যবাদের পেছনে ছুটতে থাকে। পৃথিবীর কোনো দেশে সেটা আজ অব্দি ঘটেনি। মানুষগুলো তখনো ঈশ্বর ও ধর্মে আস্থা পোষণ করেন। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলেন। তবে তাদের ঈশ্বর-ভাবনা বা ধর্মীয় চেতনার জগতে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। ধর্মকে ব্যক্তির বোধ-বিশ্বাস ও চেতনার জায়গা থেকে বিবেচনা করার যুক্তিতে তারা অভ্যস্ত হতে থাকেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের কঠিন সমালোচক কিংবা ধর্মবিরোধী কোনো বক্তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর চাইতে যুক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার ইহজাগতিক মানসিকতা পাবলিকের মাঝে জায়গা করে নেয়। যার ফলে ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে দাঙ্গা বাঁধানোর সুযোগ ধর্মের নেতা ও পুরুতরা নিতে পারেন না।
-----------------------------

রাষ্ট্রের ‘সেকুলার’ হওয়া মানে কোনোভাবেই ধর্মহীনতা বোঝায় না, -সহজ এই উপলব্ধিকে সেকুলার চেতনার পক্ষের লোকজন পাবলিকের মধ্যে প্রাণ দিতে পারেননি। এক্ষেত্রে বিরোধীরা বরং সফল। সেকুলার চেতনার সাথে ইসলামী বিশ্বাস ও ইমানী চেতনার সাংঘর্ষিক এক ইমেজ তাঁরা গড়ে তুলেছেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে সেই ইমেজের মধ্যে বন্দি করেছেন। শাহবাগের আন্দোলন এখন তার মাশুল গুনছে।
-----------------------------

মানব সভ্যতায় ইসলামের ভূমিকা নিয়ে আমাদের বিদ্যাচর্চা বালকবেলার ভয়, বিস্ময় ও অন্ধ-সমীহ কাটিয়ে আজো সাবালক হতে পারেনি। ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন উঠালেই ‘বিশ্বাস ও অনুভূতিকে আঘাত করা হচ্ছে’ বলে আপত্তি করা হয়। প্রশ্নকর্তার মুণ্ডুপাত চলতে থাকে। তার গায়ে ‘নাস্তিক’, ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’-এর ছাপ্পর মেরে দেওয়া হয়
-----------------------------
আমাদের পরিপাকতন্ত্র নাজুক। তথ্য, ব্যাখ্যা ও যুক্তি দিয়ে সুগঠিত বক্তব্য হজম করার শক্তি একেবারেই নেই। তারচেয়ে ‘নূরানী চাপা’র মতো শস্তা মাল নিয়ে রাজনীতি করা অনেক সহজ। পাবলিক বিগড়ানো যায়। শাহবাগী তরুণদের নাকানি-চুবানির একশেষ করা যায়। এতে ধর্ম-ব্যবসা বজায় থাকে!
-----------------------------

আমপাবলিকের জন্য ভক্তির রাস্তা-ই হলো সোজা রাস্তা। ‘আমি বিশ্বাস করি’ -এই অনুভূতি সেখানে শেষ কথা। ভক্তের জন্য অনুভূতি-ই হলো জ্ঞান। স্মার্টফোন ও ফেসবুকিংয়ে চটপটে হলে কী হবে, আমাদের চেতনার জগতে মুক্তচিন্তার ঢেউ আজো উঠেনি। আমরা এখনো সেই ঊনিশ শতকে পড়ে আছি!

--------------------------------
‘বিজ্ঞানচেতনা বা বৈজ্ঞানিক পন্থায় ভাবা’ -এই ইমেজটি আমাদের ভক্তিবাদী মনের সাথে কখনোই খাপ খায়নি। যে-কারণে সুধীন দত্ত খুব কম বাঙালির প্রিয় কবি হতে পেরেছেন। আর ঠোঁটকাটা হুমায়ূন আজাদকে চাপাতির কোপে মরতে হয়েছে।

কাণ্ডজ্ঞান বলে, একটি ঘটনাকে শুধু ভক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্বাস স্থাপন করা অনুচিত। বিশ্বাস করার আগে যুক্তির নিক্তি দিয়ে তাকে বিচার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই অভ্যাসটি শক্ত হয়ে ওঠেনি। ফলে মুক্তচিন্তার রাস্তাটি সরু হয়ে এসেছে। ভক্তিরসের রসিক রামকৃষ্ণ পরমহংস কট্টর ইহজাগতিক বিদ্যাসাগরের সাথে একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন। আবেগ-আপ্লুত রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘এতোদিন সাগরের নাম শুনে এসেছি। আজ দরশন হলো।’ উত্তরে স্মিত হেসে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘এসেই যখন পড়েছেন, একটু লোনা জল নিয়ে যান।’ বিপরীত ভাব ও বিশ্বাসের দুটি মানুষ পরস্পরকে এভাবে চিনে নিয়েছিলেন। সেই চেনার মধ্যে শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার কোনো কমতি ছিল না। বিনিময়ের এই সুতো বোনার কাজ বাংলাদেশ থেকে ক্রমে লোপ পেয়েছে। ৪২টি বছর ধরে আমরা পাক্কা মুসলমান হওয়ার রাজনীতির মধ্যে বসবাস করছি। ‘বাঙালিরা পাক্কা মুসলমান নয়’, -এই রাজনীতি দিয়ে একাত্তরে মানুষকে কচুকাটা করা হয়েছিল। মুসলমান হওয়ার দাপটে শুদ্ধ মানুষ হওয়ার প্রশ্নগুলো তাই আজ মরতে বসেছে।

------------------------------------------
...ইসলামের যে অনুশীলন এখানে হয় তার মধ্যে ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বকে এক-পাল্লায় মেপে নেওয়ার বাতিক রয়েছে। কাজটি শুধু কওমি-দেওবন্দি-তাবলিগ বা মওদূদীর চেলারাই করেন না, বাংলাদেশে ইসলামের সাথে জাতীয়তাবাদের মিলন ঘটাতে ব্যাকুল একদল বামপন্থী ও ভাবান্দোলনের সৈনিকরাও করেন। নিরেট ঐতিহাসিক তথ্যকে দার্শনিক ব্যাখ্যার মোড়কে ভরে তাঁরা বাজারে চালান করছেন। সেইসাথে প্রলেতারিয় তত্ত্বের সাথে এর নিকাহ পড়ানোর উপায় খুঁজছেন! তাঁরা সকলেই প্রচণ্ড ইহজাগতিক। ভোগবাদী। পুঁজিবাদী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পুঁজিবাদী দুনিয়ার সুখ ও কামিয়াবি ছেড়ে আখেরাত ও পুলসিরাত চাইবেন বলে মনে হয় না। তবে আখেরাতকে দার্শনিক মহিমা দেওয়ার রাজনীতি বজায় রাখা তাঁদের জন্য জরুরি। যে-কারণে মনে হয়, বাংলাদেশে ইমানী-বিশ্বাস একটি রাজনীতি। একে ‘থিওলজি’ বা ধর্মতত্ত্বের সাথে মেশাতে পারলে যে বটিকা তৈরি হয়, তা-দিয়ে পাবলিককে সহজেই আহাম্মক বানানো যায়। দুনিয়াবির ফায়দাও হাসিল হয়! জাকির নায়েক, আহমেদ দিদাত বা হারুন ইয়াহিয়ার সাথে এইসব বামপন্থী ও ভাবান্দোলনকারী বুদ্ধিজীবীদের পৃথক করা মুশকিল। তাঁরা সকলেই ধর্মীয় রাজনীতির আড়তদার। বাংলাদেশে এই রাজনীতি একটি ব্যবসা। একে বজায় রাখার স্বার্থে ওইসব লোকেরা বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যা করেন, ভুল ঐতিহাসিক তথ্যকে আরো বেশি ভুল পথে ব্যবহার করেন এবং ইমান-আকিদার রাজনীতিকে পাঞ্চ-লাইন করে পাবলিকের মগজে বিভ্রান্তি ও আনুগত্যের বিষ ঢোকান।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতিকে ব্যবহার করে ওঠার রাজনীতি এখন বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতি। এর বাইরে দ্বিতীয় কোনো স্পেস এখানে তৈরি হয়নি। মুজিব হত্যার পর থেকে এভাবে সবকিছুকে ছকবন্দি করা হয়েছে। সুতরাং পাবলিক থেকে বুদ্ধিজীবী সবাইকে এখানে ‘আস্তিক’ হতেই হবে। লুঙ্গি খুলে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া ছাড়া অপর কোনো সত্তার অস্তিত্ব এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েদের আর কী দোষ!

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

Emran এর ছবি

প্রধান তিনটি সেমিটিক ধর্মের মধ্যে নাস্তিকতা এবং সমালোচনার বিরুদ্ধে ইসলামের মতো খড়গহস্ত আর মনে হয় কোনটাই না। এই বিষয়টা এবং এর কারণ (ঐতিহাসিক/সামাজিক/রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক) নিয়ে কি কোন তুলনামূলক আলোচনা হতে পারে?

অতিথি লেখক এর ছবি

ইমরান, অবশ্যই পারে। তবে আগে ঠিক করে নেওয়া চাই যে আলোচনাটি ইসলামী থিওলজি’র ভিত্তিতে হবে? নাকি ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করে শুরু হবে? ইসলামিক স্কলার, এমনকি পশ্চিমের বহু বিদ্বান মনে করেন, সেমিটিক ধর্মগুলোর মধ্যে পরমত সহিঞ্চুতা, উদারতা ও ইহজাগতিকতার প্রশ্নে মূসা ও ঈসায়ী ধর্মের চেয়ে ইসলাম অধিক প্রগতিশীল। সাম্প্রতিকদের মধ্যে ক্যারেন আর্মস্ট্রং এই ধারণার একজন বড়ো প্রবক্তা। তুলামামূলক ধর্মতত্ত্বের এই নিবিড় পাঠক মধ্যযুগের খ্রিস্টিয় ইনকুইজিশন ও ক্রুসেডের ঘটনাবলীকে মোহাম্মদী দীনের আলোকে তুলনা করে ইসলামের প্রশস্তি গেয়েছেন। আর্মস্ট্রংয়ের লেখায় ইতিহাস ছাপিয়ে থিওলজি বড়ো হয়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় ডকট্রিনের চেয়ে মোহাম্মদের তৌহিদী বাণীকে তিনি অনেক বেশি প্রগতিশীল মনে করেন। যদিও ইতিহাস তা বলে না। যে-কারণে থিওলজি’র লজিক্যাল ফ্যালাসিতে ডুব দেওয়ার আগে প্যাগান প্রথা-আচার ও সেমিটিক বিশ্বাসের সাথে ইসলামী বিশ্বাসের সংঘাত ও বিরোধিতার ইতিহাসকে অনুসরণ করা ফরজ। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে ইসলাম কেন বারেবারে সহিংস হয়ে ওঠে, -এই প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলে ঐতিহাসিক ঘটনা ও তার ব্যাখ্যায় সফর করতেই হবে। ‘কোরআন’, ‘হাদিস’, ‘সিরা’, ‘মযহাব’ ও মুসলমান ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যাগুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট ফলদায়ী। অনেক প্রশ্ন ও স্ববিরোধিতার জবাব সেখান থেকেই মিলবে।

একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। ইসলাম সন্ন্যাস ও বৈরাগ্যের বিরোধী। এই ভাবনার জের ধরে সুফি ঘরানার লোকজনকে শরিয়তপন্থীরা সুনজরে দেখতেন না। শরিয়তিদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ইমাম গাজ্জালি অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। সুফিবাদী চিন্তাধারার ফাদার ফিগার হিসাবে তাঁকে এখনো গণ্য করা হয়। অথচ গাজ্জালি’র মতো ব্যক্তি বিধর্মী বা অবিশ্বাসীদের প্রতি সদয় ছিলেন না। এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদে নামাটাকে তিনি পুণ্য বলে মনে করেছেন। গাজ্জালির ভাষ্যে মুমনি-মুসলমানকে, ’বছরে একবার জিহাদে অবশ্যই যেতে হবে। দুর্গে অবস্থানকারীদের মাঝে নারী-শিশুরা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে গুলতি ব্যবহার করা যেতে পারে। অগ্নিসংযোগ করে তাদেরকে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে। তাদের গাছপালা কেটে ফেলা যেতে পারে। তাদের অতি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ (বাইবেল, তৌরাত প্রভৃতি) অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। জিহাদীয় লুণ্ঠিত মালামাল (গণিমতের মাল) ইচ্ছে অনুযায়ী গ্রহণ করতে পারে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশে আমরা যে তাণ্ডব দেখছি, তার পেছনে এক হাজারটা পলিটিক্যাল রিয়েলিটি হয়তো রয়েছে। কিন্তু তাণ্ডব যারা করছে তাদের বিশ্বাস ও চেতনার জগতে গাজ্জালি’র মতো প্রভাবশালী চিন্তাবিদ এবং জিহাদী ডকট্রিনের ভূমিকা প্রবলযে-কারণে তুলনামূলক আলোচনায় যাবার সময় থিওলজির সাথে ইতিহাসের লেখচিত্রগুলো পড়া বোধহয় অনেক বেশি জরুরি। অন্তত আমার কাছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মিনহাজ, অন্যের পোস্টে কমেন্ট করতে গেলে শেষে নিজের নাম তো লিখবেনই যখন নিজের পোস্টে কমেন্ট করবেন তখনও কমেন্টের শেষে নিজের নাম লিখুন। হাচল না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে এটা করতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

shishircma এর ছবি

দারুন লেখছেন ভাই।।।।।।

অতিথি লেখক এর ছবি

বিভিন্নজনের মন্তব্যের মধ্যে পৃথ্বী প্রাসঙ্গিক পয়েন্ট রেইজ করেছেন। আপাতভাবে তাঁর বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণের কারণ দেখি না। তিনি ঠিক-ই ধরেছেন, বাংলাদেশে ‘ধর্মানুভূতি’ এখন অব্দি আরোপিত ঘটনা। যুগে-যুগে শরিয়তপন্থীরা তাদের স্বার্থে এই ইমেজটি খাড়া করেন এবং পাবলিকের ওপর আরোপ বা ব্যবহার করেন। এটাও ঠিক, সাম্প্রতিক জামাতি তাণ্ডব বা ‘কোরআন’ ইত্যাদি পোড়ানো নিয়ে পাবলিক রিঅ্যাকশন চোখে পড়েনি। কিন্তু এর মানে কি এই যে পাবলিকের ‘ধর্মানুভূতি’ এতে আহত বোধ করেনি? পেটের ধান্ধায় থাকার কারণে নিজের ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে সে ভাবেনি? বিষয়টি বোধহয় বড্ডো সরলীকরণ হয়ে গেলো।

ব্যক্তিগতভাবে বহু মানুষের সাথে আমি আলাপ করেছি। খেটে খাওয়া মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে ‘কোরআন’ পোড়ানো ও জামাতি তাণ্ডবের বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে কনফিউশন বিরাজ করছে। শহিদ মিনার ও জাতীয় পতাকার অবমাননায় তাদের অনেককে আমি আহত বোধ করতে দেখেছি। আবার ‘কোরআন’ পোড়ানো ও মসজিদে মারামারিকেও মন থেকে সমর্থন দিতে পারেনি। অথচ দুটো ঘটনার একটিতে এই বিপুল সংখ্যক মানুষরা রাস্তায় নামেনি। কেন?

শহিদ মিনার ও জাতীয় পতাকার অবমাননায় জাগরণ মঞ্চের সাথে একাত্ম মানুষজন প্রতিবাদ করেছেন। আবার ‘কোরআন’ পোড়ানোর ঘটনাটি নিয়ে জামাত-বিরোধী আলেম-ওলামাদের সীমিত অংশ সমাবেশ-টমাবেশ করেছেন। বাকিরা যে নিশ্চুপ রইলেন তার পেছনে ‘ধর্মানুভূতি’র ইমেজকে ছাপিয়ে কনফিউশন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে মনে হয়। এই খেটে খাওয়া মানুষের দল আগের চেয়ে অনেক বেশি নামাজী। ইহজাগতিক বিশ্বাসের সাথে ইসলামী চেতনার কোনো বিরোধ আছে বলে তারা মনে করেন না। মসজিদের ইমাম সাহেব বা ওয়াজ-মাহফিলের কথার ওপর তাদের বিশ্বাস ও চেতনার অনেকখানি নির্ভর করে। তাণ্ডব জামাত করছে নাকি জামাতের ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগ এসব করাচ্ছে এই নিয়ে পাবলিক পারসেপশনে প্রচুর দ্বিধা-জটিলতা আমি দেখেছি। এটা যে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে না এ-সম্পর্কে এখুনি এতোটা নিশ্চিত হচ্ছি কী করে? ২০০৮ আর ২০১৩-র বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিষয়টি সম্ভবত আমরা মিস করে যাচ্ছি।

ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়ার প্রশ্নে পাবলিকের নিষ্ক্রিয় থাকার একশো একটা কারণ রয়েছে। দেশের জটিল রাজনীতির কারণে মানুষগুলোর প্রতিবাদস্পৃহা এরিমধ্যে ভোঁতা হয়ে এসেছে। ভয়-আতংক ও অবদমনের রাজনীতিতে এটা খুব স্বাভাবিক। সুতরাং দল-অন্ধ পারসেন্টজকে বাদ দিলে খেটে খাওয়া পাবলিক গত তিন দশকে একটি ভাসমান চরিত্র ধারণ করেছে। কোনো দলের প্রতিই নিরঙ্কুশ আস্থা তাদের নেই। যে-কারণে একবার নাওয়ে ওঠার হুজুগে মাতে, তো পরেরবার ধানের শিষে সিল মারে। ‘সময়’ টেলিভিশনের বিপরীতে ‘দিগন্ত’ বা ‘আমার দেশ’-এর প্রচারণা ‘ধর্মীয় অনুভূতি লঙ্ঘনের’ বিষয়কে একটি পারসেপশনে পরিণত করেছে। ‘ধর্মানুভূতি’র বাংলাদেশী সংজ্ঞায় জনমতের বড়ো অংশকে তারা প্রভাবিত ও কনফিউজ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। সেটা আশপাশে কান পাতলেই বোঝা যায়। বিষয়টি নিয়ে কি আমরা ভবাছি?

মাহমুদুর গংয়ের সংজ্ঞা ইসলামিস্ট চেতনার সাথে খাপ খায় কিনা সেটা পৃথক তর্কের বিষয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা বিশেষ মূল্য বহন করে না। এটা ইসলামের সামগ্রিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে জরুরি। এক্ষেত্রে নয়। অন্যদিকে কওমি-দেওবন্দি ও তাবলিগরা ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র এক ধরনের সংজ্ঞা লালন করেন। এই মুহূর্তে ‘নাস্তিক, মুরতাদ’ প্রতিরোধের নামে জামাতি সংজ্ঞার সাথে ইনারাও রিলেট করছেন। ফলে স্বীকার করুন বা না করুন, ‘ধর্মীয় চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ’ একটি মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেছে। আর খেটে খাওয়া পাবলিকের দল সেই ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে আরো বেশি কনফিউজ হয়ে উঠছে। সুতরাং জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করা হলে সব হিসাব সহজ হয়ে যাবে এমনটি ভাবা ঠিক হচ্ছে কিনা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

এই নিষিদ্ধকরণে ‘ধর্মানুভূতি’র বিষ সাময়িক নামবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে নামাতে হলে ধর্মীয় রাজনীতির পুরো প্রক্রিয়াকে মোকাবিলা ও নিষ্ক্রিয় করার মতো শক্তিশালী মুভমেন্ট প্রয়োজন। যেখান থেকে এই রাজনীতি ও তার তাত্ত্বিক ফ্রেমিংকে ‘না’ বলা সহজ হবে। জাগরণ মঞ্চের সেই ক্ষমতা যে নেই তা এরিমধ্যে প্রমাণিত। সুতরাং জামাত-শিবিরের ‘গুষ্টি কিলানো’র আগে ‘ধর্মানুভূতি’, সেটা যে আকারেই থাকুক, তার এনকাউন্টার দেওয়ার মতো রসদ নিজের ভাণ্ডারে থাকা চাই। ‘বিশ্বাস অন্ধ হতে পারে, যুক্তি নয়’ -এই মনোভাব পাবলিকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এক্ষেত্রে কাজ দিতে পারে। এবং সেটা চলমান শাহবাগীদের নিয়েও শুরু করা যায় হয়তো!

মিনহাজ ২৫।০৩।২০১৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।