“আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে তারা ছাড়া আমাদের আর ভরসা নেই। ভোট আমরা আ-লীগকেই দেবো।“
বন্ধুর মুখে এ কথা শুনে চমকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা মানে কারা?”
“আমরা মানে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চাই, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চাই না।"
“চার ব্লগারকে গ্রেফতারের পর, হেফাজত ইসলামকে এত জামাই আদরের পরও আ-লীগকে ভোট দেব? মোটেই না। বামদলের জামানত হারানো প্রার্থীকে ভোট দেব। কাউকে না পেলে ‘না’ ভোট দেব।“
শুনে বন্ধু জিজ্ঞেস করলো – “আমাদের ভোট না পেয়ে আ-লীগ যদি হেরে যায়, জামাত-বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে কি খুশি হবি?”
বললাম, “সেটা হবে আ-লীগের জন্য একটা শাস্তি।“
“আ-লীগকে শিক্ষা দিতে গিয়ে দেশকে আফগানিস্তান হওয়ার পথে ঠেলে দিবি?”
“তার মানে মন্দের ভালো হিসেবে আবারও আ-লীগকে ভোট দিতে হবে?”
এটুকু আলাপের পরে মনে হলো, বন্ধুর কথাটিই ঠিক – “আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে তারা ছাড়া আমাদের আর ভরসা নেই। ভোট আমরা আ-লীগকেই দেবো।“
ক্ষমতার প্রথম চার বছর সরকার হিসাবে আ-লীগ খুব ব্যর্থ ছিল এমন বলা যায় না। রাষ্ট্র চালানোয় আ-লীগের যতোগুলো ব্যর্থতা ছিল, তা ঢেকে দিয়েছে বিরোধীদল হিসাবে বিএনপির ব্যর্থতা। ২০০৮এর নির্বাচনী ওয়াদার অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা। বিচার প্রক্রিয়া এগিয়েছেও অনেক। কিন্তু, শেষ পাঁচ ওভারে জেতার জন্য আ-লীগকে করতে হবে সত্তর রান। হাতে উইকেটও কম, পিটিয়ে খেলতে হচ্ছে। এখানেই সুযোগ নিচ্ছে জামাত-বিএনপি। সাইদীর রায়ের পর সারা দেশে জামাতের তান্ডব আমরা দেখেছি। সামনে গোলাম আজমের রায়, সাকা’র রায়, কামারুজ্জামানের রায়, মুজাহিদের রায়। এগুলো ঘোষণা হলে অবস্থা আরো খারাপ হবে। নির্বাচনী বছর, আস্কিং রান রেট অনেক বেশি। একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে, নিজের মাংস নিজে খাচ্ছে, জনসমর্থনও হারাচ্ছে।
কীভাবে সামাল দেবে আ-লীগ?
কাদের মোল্লার রায়ের পরে যে গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগে সৃষ্টি হয়েছে তা আচমকা সৃষ্টি হওয়া কোনো বিস্ফোরণ নয়। আ-লীগ ভুলে গেছে অথবা জানে না – ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে ইন্টারনেটে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে দিন রাত কীবোর্ড সংগ্রাম করে গেছে এক ঝাঁক ব্লগার। এসব ব্লগার কোনো দলীয় কর্মী নয়, দফতর সম্পাদক বা আপ্যায়ন সম্পাদক পদের লোভে এরা ফেসবুকে ব্লগে সংগ্রাম করেনি। আরেকটু আগে তাকালে আ-লীগের জানতে সুবিধা হতো – ২০০৬ সালে ‘প্রথম বাংলা কম্যুনিটি ব্লগ’এ জামাত শিবিরের আইটি টীম এবং দেশি বিদেশী দোসররা যতটা দাপুটে ছিল, জামাত সেক্রেটারি কামারুজ্জামানের ফান্ডিং’এ তার দুই ছেলের নেতৃত্বে অনলাইন দখলের যে চেষ্টা হয়েছিল তা কারা চুরমার করে দিয়েছিল? চুরমার করে দিয়েছিল দেশে বিদেশে অবস্থানকারী একদল দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণদল। তখন ইন্টারনেটে বাংলা ইউনিকোড ছিল না। দিনের পর দিন এরা ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ ‘মূলধারা ৭১’ এবং অন্যান্য বই থেকে রেফারেন্স দিয়ে গেছে, টাইপ করে গেছে অবিরাম। রাতের পর রাত স্বনামে বেনামে কখনো শ্লীল কখনো অশ্লীল শব্দে ‘ছাগু’ তাড়িয়েছে। জামাতিরা এসব অনলাইন যোদ্ধাদের নাম দিয়েছিল ‘ভারতের দালাল’, আর সুশীল বুদ্ধিজীবিরা দিয়েছিল ‘ভার্চুয়াল গুন্ডা’ খেতাব। কোনো লাভের আশায় নয়, কোনো অর্থের লোভে নয়, পদের লোভে নয়; কেবল রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নে। আ-লীগের শীর্ষনেতারা চাইলে সেসময়কার ব্লগ আর্কাইভ ঘুরে দেখতে পারেন। এসব ভার্চুয়াল গুন্ডারাই অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস সচেতন প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে। অনলাইন যোদ্ধার নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা ছাগু তাড়াচ্ছে এখানে ওখানে।
বন্ধুটি বলছিল, টিভি পর্দায় গ্রেফতার হওয়া ব্লগারদের মুখ দেখে তার চোখ পানিতে ভিজে গেছে। ব্লগার রাসেল পারভেজের সাথে তার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, সে পরিচয় অনলাইনেই সৃষ্ট। রাসেল পারভেজ যে রাসেল (........) নামে লিখতো, তার লেখনী ছিল অসম্ভব ধারালো। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে অসম্ভব মেধাবী, লাজুক এবং বিনয়ী। গ্রেফতার হওয়া রাসেল কোনো ব্যক্তি নয়, রাসেল অনেক ব্লগারের সমষ্টি। এই রাসেলরাই এক এগারোর যুগে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লিখেছিল, এই রাসেলরাই জামাত শিবিরের পেইড ব্লগারদের বিরুদ্ধে দিনরাত লড়ে গেছে। মোহম্মদপুরের সালাম আর সিডনীর ইসমাইলের জামাতি সন্তানদের অনলাইনে এই রাসেলরাই যুক্তিতে এবং ‘তুই রাজাকার’ উচ্চারণে পরাজিত করেছে বছরের পর বছর।
আজ যখন মিডিয়ায় রাসেলকে কুৎসিতভাবে হাজির করা হয়, তখন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হেফাজতে ইসলামের সাথে আত্মাগতভাবে থাকে, আর হা-হা করে হাসে মিডিয়ার সামনে।
ঠিক এখানেই, এখানেই পরাজয় ঘটে রাসেলদের, বাংলা অনলাইনের মুক্তচিন্তার যোদ্ধাদের।
আরো বেশি হেরে যায় আ-লীগ। মন্দের ভালো হিসাবে যে আ-লীগ শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের সমর্থন পেতো, তাদের কাছে আ-লীগ দু’মুখো সাপের চেহারা দেখিয়েছে।
ব্লগারদের গ্রেফতার করে, আইন প্রণয়ন করে, শাস্তি দিয়ে আ-লীগ আপাতত হেফাজতে ইসলামকে লেহন করে গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হয়ে গেল শুভ চিন্তার, শুভবোধের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষদের। আগামীতে বিএনপি জামাত কোনোদিন ক্ষমতায় এলে, আ-লীগের দেখানো রাস্তায়, শত শত ব্লগারদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। যে ব্লগার সংখ্যার হিসাবে দেখিয়েছিল – তিরিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল একাত্তরে – তাকে ফাঁসি দেয়া হবে। ভিডিও ফাইল শেয়ার করে যে ব্লগার প্রমাণ দিয়েছিল - শেখ মুজিব চমৎকার ইংরেজী বলতে পারতেন – ব্লগারের চোখ উপড়ে নেয়া হবে। সমস্ত স্যাটায়ার লেখকদের, প্রথম আলোর আনিসুল হক ব্যতীত, হাতের আঙুল কেটে নেয়া হবে। সেদিন হয়তো আ-লীগ আবার ভোল পালটে এসবের প্রতিবাদে প্রগতিশীল বেশে হরতাল ডাকবে। অথচ আ-লীগকে সেদিন আর ক্ষমা করা হবে না, সমর্থন দেয়া হবে না। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেবে অনলাইনে কন্ঠ রোধের চর্চা এবং ভিত্তি আ-লীগেরই সৃষ্ট।
আজ ব্লগারদের বুকে ছুরি চালিয়ে যে রাস্তা আ-লীগ নির্মাণ করছে – সে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া বিষাক্ত সাপ শেষ পর্যন্ত আ-লীগকেই কামড় দেবে।
আ-লীগ কি তা টের পাচ্ছে?
- সৌরভ সাখওয়াত
মন্তব্য
--- নীরা
সেটাই। বাংলাদেশের হিন্দুদের মারধোর ভাংচুর করা হলেও একই ব্যাপার, সরকারের বিশেষ গা নেই, কারণ হিন্দুদের তো লিগ ছেড়ে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। বিএনপি-জামাত তো তাদের একেবারেই বিপক্ষে। অতএব সরকার দেখছে যে যতই লাথিঝেঁটা মারো হিন্দুরা আমাদের কাছেই পড়ে থাকবে।
আপনার লেখার প্রতিটা শব্দ বুকে এসে বিঁধেছে । আসলেই কথাগুলো এতো সত্যি সব কিছু ভাবলে শিরদাঁড়া হিম হয়ে যায় আতঙ্কে । এই রকম অনুভূতি আগে কখনও হয়নি
"আজ বুঝবো না বুঝবো কাইল,
মাথা থাপড়াইবো পারবো গাইল!!!"
সুবোধ অবোধ
এক বলে কীভাবে দশ উইকেট নিতে হয় সেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে দেখালেন।
প্রাসঙ্গিক লিংক: Bangladesh PM Sheikh Hasina rejects blasphemy law
facebook
নতুন মন্তব্য করুন