বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিরসন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১০/০৪/২০১৩ - ৪:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আফজাল মোটেও স্বস্তির মধ্যে নেই।

সারাটা দিন ধরে কারেন্ট থাকে না। এই গরমের মধ্যে কারেন্ট ছাড়া থাকা যে কী রকম কষ্টকর তা এখন আফজাল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আগেরকার দিনে মানুষরা যে কীভাবে থাকত সে এখন তা চিন্তাও করতে পারে না। সে মেসে থাকে। তার রুমমেট শরীফ হচ্ছে বড্ড ঘুমকাতুরে। এই অসহ্য গরমেও সে দিব্যি আরাম করে ঘুমায়। ঘুমানোর সময় তার মুখটা কিছুটা হা করা থাকে। মুখ দিয়ে প্রায়ই লালা পড়ে বালিশ ভিজে যায়। আফজালের দেখতে কুৎসিত লাগে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না।

শরীফ গরমেও আরাম করে ঘুমোতে পারে। কিন্তু আফজালের এক ফোঁটা ঘুম আসে না। সে সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ ছটফট করতে থাকে। ভ্যাপসা গরমের সাথে থাকে মশার অত্যাচার। সে বিছানায় শুয়ে নানা চিন্তা করতে থাকে। অত্যন্ত বিচিত্র সেসব চিন্তাভাবনা। প্রয়োজন অনেক কিছুই মানুষকে ভাবতে শেখায়।

আফজাল আর শরীফ একটা মিনি কালার টেলিভিশন কিনেছিল, বিশ্বকাপের সময়। মেসের সবাই তখন তাদের রুমে ভিড় করত। সবাই তার ঘরে এসে হৈ হৈ করে খেলা দেখছে, আফজালের দেখতে বড় ভাল লাগত। সে সময় সে ‘আফজাল’ থেকে ‘আফজাল ভাই’ হয়ে গিয়েছিল।

সেই খাতিরও আজকাল নেই। টেলিভিশনটা ঘরের এক কোনে পড়ে আছে। আফজাল প্রায়ই তাকায় থাকে টেলিভিশন সেটটার দিকে, খেলনা ছাড়া ওটা আর কিছুই মনে হয় না।

আজকে সন্ধায় আফজাল প্রাইভেট পড়ানো শেষ করে মেসে আসল। আজও কারেন্ট নেই। সে রুমে ঢুকে অন্ধকারে হাতমুখ ধুয়ে নিল। হাতমুখ ধুয়ে সে একটু বাইরে আসল। এলাকার কোথাও বাতি দেখা যাচ্ছে না। দু-একটা বাড়িতে মোম জ্বলছে। সে সিগারেট ধরিয়ে মনে মনে বড়লোকদের একটা কুৎসিত গালি দিল। শালারা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা এসিতে থাকে। চানাচুর ওভেনে গরম করে খায়, রুমাল ইস্ত্রি করে- আর খেসারত দিতে লাগে আমাদের। শালা হারামিরা !

আফজাল মনে মনে মানিক মিয়ার কথাটা ভাবল। মানিক মিয়া তাদের পাড়ার দোকানি। সেদিন দোকানে বিস্কুট কিনতে গিয়ে মানিক মিয়া বলল, ‘আর যাই বলেন আফজাল ভাই, কারেন্ট না থাকিয়া আমার কিন্তু ম্যালা লাভ হইসে।’

‘কীরকম?’ আফজাল অবাক হয়। কারেন্ট না থাকায় কীভাবে কারও লাভ হতে পারে আফজাল ভেবে পায় না।

‘রাতে ঘুমাইতে যতই কষ্ট হোক, ইনকামের কথা ভাবলে শান্তির ঘুম আসে। যে হারে কারেন্ট যাইতেসে তাতে মোমবাতি, টর্চ-ব্যাটারির কদর বাইরা গেসে। আর আমিও বুঝিশুনি কোপ মারছি। এগুলা বেশি করে আনিয়া সেইরকম বেঁচছি এইবারে। আমার ইনকাম আগের থাকি অনেক বাড়ছে।’

আফজাল চমৎকৃত হল। কারেন্ট না থাকারও যে ফায়দা হতে পারে সে আগে ভাবেনি। আরেকটা জিনিস তার খেয়াল হল যে মোমবাতি তার নিজেরও দরকার। মানিক মিয়াকে বলতেই সে একটু হাসল। তারপর দুটো মোমবাতি বের করে তাকে দিল।

এগুলোই তার মাথায় ঘুরছিল। সে ঘরে ফিরে এল। সে আজ ঘরে একা। শরীফ গিয়েছে মামার বাড়ি। সে ঠিক করল পত্রিকায় একটা চিঠি লেখা দরকার। একজন না একজনকে তো বিষয়টা জানাতে হবে। বিষয় কি দেওয়া যায়? “

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের নিরসন চাই।” এটা কি ঠিক হবে? নাকি অন্য কিছু লিখব? নাহ, ঠিকই আছে।

সে লিখতে শুরু করলও মোমের আলোয়, “শ্রদ্ধাস্পদেষু, আমি আপনার পত্রিকার একজন নিয়মিত পাঠক...”

লেখার মাঝখানেই হঠাৎ কারেন্ট চলে এল। মাথার উপরের ফ্যানটা ঘুরতে শুরু করল। আফজাল কিছুক্ষণ ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল। শীতল হাওয়ায় তার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। সে লেখা ছেড়ে লাইট অফ করল। তার মনেই ছিল না যে তাদের ঘরে একটা ডিমলাইট আছে। নীল রঙের, কবে কিনেছিল মনে নেই। আফজাল লাইট অফ করে ডিমলাইটটা অন করল। মুহূর্তেই আবছা নীল রঙে ঘরটা অন্যরকম হয়ে উঠল। যেন কোন রেস্টুরেন্টের আধো-অন্ধকার পরিবেশ। আফজাল লেখাটা অসমাপ্ত রেখে বিছনায় গা এলিয়ে দিল। সে জানে এই সুখ বেশিক্ষণ থাকবে না। একটু রিলাক্স করা দরকার। কারেন্ট আবার গেলে তখন লেখা শুরু করা যাবে।

ঠাণ্ডা হাওয়ায় সত্যিই সে শীতলবোধ করল। আস্তে আস্তে সে ঘুমিয়ে পড়ল। গাঢ়, প্রশান্তির ঘুম।

সকালে উঠল সে দেরিতে, প্রায় সোয়া ন’টায়। অন্যদিন সাতটার মধ্যে ওঠা তার অভ্যাস। আজকে দেরি হওয়ার কারণটা সে বুঝতে পারল। বুঝতে পেয়ে তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা দেখা গেল। ফ্যানটা এখনও ঘুরছে। কাল থেকে একবারও কারেন্ট যায়নি। এজন্যেই তার এত গাঢ় ঘুম হয়েছে।

সে মুখ ধুয়ে নাস্তা করল। নাস্তা করে এসে রাতের অসমাপ্ত চিঠিটা দেখল। একবার চোখ বুলিয়ে নিল। যদিও তার চিঠি পাঠানোর ইচ্ছে চলে গেছে তবুও সে ইচ্ছাটা আমলে নিল না। কারেন্ট আবার কখন যায় ঠিক নেই। সে যত্ন নিয়ে লেখাটা শেষ করল। তারপর বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হল। “বিদ্যুৎ বিভ্রাটের নিরসনের” চিঠিটা বুক পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। রুমের তালা লাগাতে ভুলল না। কিন্তু ভুলে গেল ফ্যানের সুইচ অফ করতে। আর ফ্যানের সুইচটা, যেটা রাতে রেস্টুরেন্টের আধো-অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

নাহিয়েন


মন্তব্য

রাসিক রেজা নাহিয়েন এর ছবি

“আর ফ্যানের সুইচটা, যেটা রাতে রেস্টুরেন্টের আধো-অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল”

শেষ লাইনে ফ্যানের পরিবর্তে ডিমলাইটের হবে। অনিচ্ছাকৃত ভুলটির জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কীভাবে পুনরায় সম্পাদনা করা যায় আমার জানা নেই, তাই মন্তব্যে সংশোধনটি জুড়ে দিলাম।

মর্ম এর ছবি

রুমের তালা লাগাতে ভুলল না। কিন্তু ভুলে গেল ফ্যানের সুইচ অফ করতে। আর ফ্যানের

শুদ্ধি অনুসারে 'ডিমলাইটের'

সুইচটা, যেটা রাতে রেস্টুরেন্টের আধো-অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

পুরো গল্পটা এখানে বলা হয়ে গেছে।

সচেতন 'আমাদের' প্রচ্ছন্ন খোঁচাটুকু দিতে পারার জন্য অভিনন্দন! চলুক

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

আলোকিতা এর ছবি

হাততালি

রাসিক রেজা নাহিয়েন এর ছবি

ধন্যবাদ।

সুমাদ্রী এর ছবি

হাততালি ভাল লাগল। চালিয়ে যান।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

হাততালি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।