সে, আমি ও বৃষ্টি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/০৪/২০১৩ - ৯:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

ছোটবেলা থেকেই আমার বৃষ্টি খুব প্রিয়। কিন্তু আজকের বৃষ্টিটা খুব বিরক্ত লাগছে। ভাসির্টি থেকে বাড়ি ফিরছি। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ভাসির্টি যাওয়ার সময়ও রোদ ছিল অথচ এখন এই বৃষ্টি। ছাতাও নিয়ে আসিনি। বৃষ্টি থামা পযর্ন্ত অপেক্ষাও করতে পারছি না, বাসায় ফিরতেই হবে। বাসায় সময়মত না গেলে আমার খবর আছে। কারণ আজকে আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। এই নিয়ে সপ্তম পাত্রপক্ষ। কোনো পাত্রকেই আমার মায়ের পছন্দ হয় না। আমি বুড়ি না হওয়া পযর্ন্ত মনে হয় কোনো পাত্র পছন্দ হবেও না।

মা আমাকে আসতে দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বাসায় থাকলে সারাক্ষণ সাজগোজ নিয়ে মায়ের উপদেশ, আমার হয়ত হবু বরকে(!) নিয়ে শিখার(আমার ছোটবোন) ফাজলামি সহ্য করতে হত। এজন্যই জোর করে ভাসির্টিতে আসা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না আসাই ভাল ছিল। একটা রিকশাও চোখে পড়ছে না। তাই ভিজতে ভিজতে হাঁটছি। ঠান্ডায় সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মানুষজন কেমন হৃদয়হীন, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়েও আসছে না। সবাই শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। হঠাৎ টের পেলাম মাথার উপর কেউ ছাতা ধরল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম এক বলিষ্ঠ যুবক, গায়ে সাদা পাঞ্জাবী, গায়ের রঙ শ্যামলা, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

“অনেকক্ষণ থেকে দেখছি যে আপনি ভিজছেন, তাই আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলাম। কিছু মনে করলেন না তো?” ছেলেটি বলল।
“না, না, মনে করার কি আছে? তবে আমরা এক ছাতার নিচে হাঁটলে মানুষ যদি কিছু মনে করে?”
“এতক্ষণ ধরে যে আপনি ভিজছেন তাতে তো কেউ কিছু মনে করল না। তাই ওদের কোনো অধিকার নেই আমাদের নিয়ে কিছু মনে করার।” ছেলেটি বলল।
“আপনি কি সবাইকেই এরকম সাহায্য করেন?”
ছেলেটি হাসলো। বলল, “মানুষকে সাহায্য করাটা আমার একধরণের শখ বলতে পারেন। আপনার যদি বেশি অস্বস্তি লাগে তবে আপনি ছাতাটা নিয়ে চলে যান।”
“না, না, তা কি করে হয়?” কথাটা বলেই দেখলাম একটা রিকশা আসছে। থামাতে গিয়ে তা আমার কাছে এসেই থামল। রিকশায় আমার ভাই, সাদিব।
“মা তোকে নিতে পাঠালো। যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, চল তাড়াতাড়ি।” সাদিব বলল।
“হ্যাঁ, চল।”
ছেলেটির দিকে ফিরে তাকিয়ে বললাম, “সাহায্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।”
“আরে এতে ধন্যবাদ দেয়ার কি আছে। এটা তো মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব।”
“তবু, আপনি ছাড়া তো আর কেউ এগিয়ে এল না। তাই, থ্যাংক ইউ।”
“আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। ওয়েলকাম।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে গেলাম।”
ছেলেটি হেসে মাথা ঝাঁকালো।

সাদিবের সাথে রিকশায় উঠে কিছুদূর গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি ছেলেটির নামটাও জানা হল না।

২.

আমার মাকে দেখে মনে হতেই পারে যে আমাদের বাড়িতে বারাক ওবামা আসছে। অল্পতেই অস্থির হওয়া আমার মায়ের স্বভাব। নিজেও অস্থির হয়ে আছে, সবাইকেও অস্থির করে রেখেছে।
“তুই এখনো পুরোপুরি তৈরী হসনি যে? ৬টা বেজে গেছে। সাতটার সময় ওরা এসে যাবে। এজন্যেই বলেছিলাম কলেজ যাসনে। না, আমার কথা তো শুনবি না............(অবিরাম বকবক)”
পাত্রপক্ষ আসার এখনও এক ঘন্টা বাকি। শুধু চুল বাধা বাকি আছে, তাতেই কত কথা শোনা লাগলো।

ঘরে বসে আছি। বেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মায়ের অপেক্ষার অবসান হল বোধহয়।
সবাই বাইরের ঘরে। শুধু আমি একা বসে আছি। শিখাটা যে কোথায়। বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে। তাই একটা বই নিয়ে বসলাম। যদিও পড়ায় মন বসছে না। আচ্ছা ছেলেটি দেখেতে কেমন হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরে শিখার আগমন।
“এই শোন, আবির ভাইয়া না দেখতে খুব সুন্দর। তোর রূপের সাথে পাল্লা দেয়ার মত।”
“এই আবির ভাইয়াটা কে?”
“আরে! তুই তোর হবু বরের নামই জানিস না?”
“হবু বর না ছাই। নাম জেনে কি হবে? মায়ের কি কোনদিন কোন ছেলে পছন্দ হয়?”
“আবির ভাইয়া কে মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে।”
“তুই কেমন করে জানলি?”
“মা আমাকে বলেছে। আর হ্যাঁ, মা তোকে চায়ের ট্রে নিয়ে ভিতরে যেতে বলেছে।”
বিষয়টা এখন সত্যিই আজব লাগছে। তাই বেশি চিন্তা না করে চায়ের ট্রে নিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকলাম। যে ছেলেটিকে সবার আগে চোখে পড়লো, তাকে দেখেই রীতিমত চমকে উঠলাম, এই সেই, যে আজ আমাকে বৃষ্টির মধ্যে সাহায্য করেছিল। এই ছেলেটিই কি আবির? এছাড়া রুমে সোফায় বসে রয়েছেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। তারা তো কেউ আবির হতে পারে না। তারমানে ছেলেটিই আবির। ট্রা টা টেবিলে রাখলাম। ভদ্রমহিলাটি বললেন, “বসো মা।”
ভাবগতিক দেখে বুঝলাম আমাকে ভদ্রমহিলার পছন্দ হয়েছে। অবশ্য এ পযর্ন্ত যত পাত্রপক্ষ এসেছে সবাই আমাকে পছন্দ করেছে।
আবিরের দিকে তাকালাম। তার চোখে কৌতুক। চোখ নামিয়ে নিলাম।
“তুই এবার ঘরে যা”, মা বললেল। তার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।

ঘরে ফিরে এলাম। মাথায় কিছু ঢুকছে না। আবিরের সাথে সত্যিই যদি আমার বিয়ে ঠিক হয়, তাহলে আমার অতীতের ব্যাপারটি তাকে বলতে হবে। এটি তো আমি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি যে যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবে তাকে আমি এই বিষয়টি বলবো। তাহলে এত ভয় লাগছে কেন?

“নীরা আপু, নীরা আপু, Congratulation!” শিখার চিৎকারে ভাবনায় ছেদ পড়ল। শিখার পিছনে বাবা, মা, সাদিবও রয়েছে।
“তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী মাসে”, শিখার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে। তার খুশি দেখে মনে হচ্ছে ঈদ লেগেছে। লজ্জায় লাল হয়ে বসে রইলাম। মনে হাজারো উৎকন্ঠা।

৩.

“কিরে মা? তোকে মনমরা লাগছে কেন?” , মা বললেল।
চুপ করে রইলাম।
“তোর কি আবিরকে পছন্দ হয়নি?”
“তা নয়, মা। আমি... আমি আসলে রাজীবের ব্যাপারটা আবিরকে খুলে বলতে চাই।”
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ মারে, এটি তোর জীবনের একটি অনেক গুরুত্বপূণ সিদ্ধান্ত। তোর যদি মনে হয় তোর বলা উচিত, তাহলে বলবি। একটা কথা শোন, আমি আবিরের চোখে যে সততা, ন্যায় ও ধৈয দেখেছি, তা ভুল নয়। আবির খুবই ভাল ছেলে। আমার বিশ্বাস ও বুঝবে।”
“আর যদি না বুঝে?”
“সেসব ভেবে লাভ নেই। তুই যদি সত্যি বলতে চাস, আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
“তাই করো, মা।”

৪.

দুই দিন পর
একটি ক্যাফেতে বসে আছি। আবিরের অপেক্ষায়। আজ আমাকে আমার অতীতের কথা আবিরকে বলতেই হবে। আমি আবিরকে ধোঁকা দিতে চাই না। কখনোই না।
“বসতে পারি?” আবিরের কথা শুনে ফিরে তাকালাম।
“অবশ্যই, অনুমতি নিচ্ছেন কেন?”
আবির হেসে বলল, “ফরমালিটি!”
“আমার সাথে ফরমাল হওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“তা আমি জানি। এবার বলুন, এত জরুরী তলব কেন?”
একটু ইতস্তত করে বললাম, “আসলে, আমি আমার অতীতের ব্যপারে আপনাকে কিছু বলতে চাই।”
“দাঁড়ান, কফি দিতে বলি।”
ওয়েটারকে ডেকে কফি দিতে বললো আবির। হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এবার বলুন।”
“আবির, আমি বিয়ের আগেই আপনাকে কিছু বলে দিতে চাই। অতীতে আমি কিছু ভুল করেছি। আমি তখন টিন-এজার, ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার এক ক্লাসমেটের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। তার নাম রাজীব। বন্ধুত্ব হওয়ার প্রায় দুমাস পরে সে আমাকে বলে যে সে আমাকে ভালবাসে। তখন আমার মনে প্রচুর আবেগ। যা দেখি সবই রঙিন লাগে। আমার বন্ধুরা আমাকে সাবধান করে যে রাজীব ভালো ছেলে নয়, এই বয়সেই অনেক মেয়েকে ধোঁকা দিয়েছে। কিন্তু রাজীব বলে এই সব মিথ্যে। মেয়েগুলি তার পিছনে ঘুরত, সে পাত্তা দেয়নি বলে তার নামে এগুলো মিথ্যে রটিয়েছে। রাজীব আরো বলে যে সে শুধু আমাকেই ভালবাসে।”
এটুকু বলে থেমে গেলাম। ওয়েটার কফি নিয়ে এসেছে। ওয়েটার চলে যেতেই আবার শুরু করলাম,
“আমি প্রথমে রাজী হইনি রাজীবের প্রস্তাবে। কিন্তু রাজীব বিভিন্নভাবে আমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে যে সে আমাকে সত্যি ভালবাসে। শেষপযর্ন্ত আমি তার প্রস্তাবে সাড়া দেই। তখন আমার বয়স কম, সবকিছু আবেগ দিয়ে বিচার করতাম। তখনো বুঝি নি ভালবাসা কি। আমার বান্ধবীরা প্রেম করত, তাই আমিও করতাম। কেন করতাম, জানতাম না। তিনমাস পর ছেলেটি আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে যায়। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পারি, ছেলেটি আমার যোগ্যই ছিল না।”
আবির চুপ করে বসে আছে।
আবার বলতে শুরু করলাম, “আবির, আমি জানি না আপনার সিদ্ধান্ত এখন কি হবে। শুধু এটুকু বলতে পারি, আপনার যা সিদ্ধান্ত হবে, আমি মেনে নেব। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমি... আমি আপনাকে ভালবাসি। যখন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, তখনই আমার আপনাকে ভালো লাগে। ভালোলাগাটা যে কখন ভালবাসায় পরিণত হয়েছে বুঝতেই পারিনি।
আবির তবুও চুপ করে আছে। আবিরের চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। আবির কিছু বলছে না কেন? চোখ নামিয়ে রেখে বললাম,
“আমি বুঝতে পারছি, আপনার সিদ্ধান্তে আমি বাধা দেব না। পারলে আমাকে মাফ করে দিবেন।”
এ কথা বলে রেষ্টুরেন্ট থেকে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। আজও বৃষ্টি হচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকে চোখের পানি আটকে রেখেছিলাম। বাইরে আসতেই চোখের পানি আর বাধা মানল না, বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যেতে লাগল। মাথা যেন কাজ করছে না। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ভিজতে ভিজতে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ হাত টেনে ধরল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, আবির।
“ম্যাডাম, কথা শেষ না হতেই চলে এলেন যে? আরে! কাঁদছেন নাকি? শুনুন ম্যাডাম, আপনাকেও আমি তখনই ভালবেসে ফালাছি জখন আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা। আর আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। তাছাড়া আপনি তো কোনো দোষ করেননি। দোষ করেছে রাজীব। তার শাস্তি আপনি কেন পাবেন?”
“সত্যি বলছেন?” অবাক চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বললাম।
“হ্যাঁ নীরা, আমি তোমাকে ভালবাসি, অনেক ভালবাসি।”
প্রথম আবিরের মুখে “তুমি” ডাক শুনলাম। অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে, মিশে গেল বৃষ্টির জলের সাথে। তবে এ অশ্রু দুঃখের নয়, আনন্দের।
আমার প্রিয় বৃষ্টি পড়ছে, আর এই বৃষ্টিতে আমার হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আমার সবচেয়ে প্রিয়জন, এ অবস্থায় আমার থেকে সুখী মানুষ কি পৃথিবীতে কোথাও আছে?

- জোছনাময়ী

ছবি: 
31/05/2007 - 2:46অপরাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ সুন্দর একটি গল্প। অনেক সুন্দর।

-চক্রবাক।

তারেক অণু এর ছবি

জবের রোমান্টিক ব্যাপার!

ছেলেটার মনোভাব ভাল লাগল, মেয়েটার সততাও, কিন্তু গল্পের প্লট খুব ক্লিশে।

তিথীডোর এর ছবি

অতি নাটকীয় না?

ছবিসুত্র উল্লেখ করেননি।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

বন্দনা এর ছবি

একটু নাটকীয় হলে ও বেশ ভালো লেগেছে ।

ময়ুরাক্ষী এর ছবি

খুবই ভালো লেগেছে। এই ব্লগে পড়া গল্পগুলোর মধ্যে এটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে।

জোছনাময়ী এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে।

-জোছনাময়ী

বেচারাথেরিয়াম এর ছবি

আপনার লেখার হাত খুব ভাল, গল্প আগানোর ভঙ্গিটাও ভাল। কিন্তু প্লটটা চিরচেনা

শিশিরকণা এর ছবি

পুরনো গল্প, সুন্দর লেখা।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।