ছবিঃ মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান
নদীমাতৃক দেশ এই বাংলাদেশ। আমাদের দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদী , খাল, বিল। মাত্র একটি নদী বাদে সকল নদীরই উৎস হিমালয়ের পাদদেশে অথবা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। নদীর উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন সকল নদীই শেষ হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। আমাদের দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী গুলো আমাদের জন্য হয়ে এসেছিল আশির্বাদ হয়ে। নদী গুলো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, আর নানা প্রজাতির জলজ প্রাণির আবাসস্থল আমাদের এই নদ-নদী গুলো। অনেক জেলে পরিবার এই নদী গুলো থেকে মৎস আহরন করে জীবন ধারন করে। নদী গুলোকে কেন্দ্র করে আমাদের জনপদ গুলো গড়ে উঠেছে। গ্রাম অঞ্চলের বেশির ভাগ হাট-বাজার এই নদী তীরে গড়ে উঠেছে। অনেক ঐতিহ্যবাহী মেলা উৎযাপন করে নদী পারের বসিন্দারা। মেলা উপলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হত। বিজয়ী দলকে পুরস্কৃত করা হত। ব্যাবসা বানিজ্য ও যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসেবে এই নদীপথ ছিল জনপ্রিয়। আর নৌকা ছিল নদী পথে যোগাযোগের প্রধান বাহন।
এই নদী পথ গুলো হারিয়ে যেতে চলেছে। উজান থেকে নেমে আসা পলি আর বলু মাটিতে আমাদের নদী গুলোর নাব্যতা কমে আসছে। নাব্যতা কমে আসার কারনে বর্ষা কালে নদী ভাঙন প্রকট আকার ধারন করে। নদী ভাঙনের কারনে গ্রামের পর গ্রাম নদীর মধ্যে হারিয়ে যায়। অনেক পরিবারকে তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে একেবারে পথে নামতে হয়েছে। নদীর গভীরতা কম হওয়ার কারনে বর্ষা কালে পানি প্রবাহ নদী গুলো ছাপিয়ে গ্রাম গুলোকে ভাসিয়ে দেয়। শুরু হয় বন্যা। বন্যার পরবর্তী জমিতে যদি বালির আস্তরন পড়ে তাহলে কৃষকের সর্বনাশ। জমিতে তখন কোন ফসল হয়না।
বাংলাদেশ ও ভারতের যে অভিন্ন নদী গুলো আছে সেগুলোতে ভারতের বাঁধ দেওয়ার ফলে সেই নদী গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে তাই নদীতে পানির অভাবে চোখে পরে ধু ধু বালু চর। পানির অভাবে কৃষকের সেচ কাজের জন্য পানি পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বাঁধের কারনে আমাদের যে অপূরনীয় তি হয়েছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। টিপাই মুখ বাঁধ নিয়েও সরকারের কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতে দেখা যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ বরাক নদীর উৎস স্থলে নির্মিত টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে উৎপন্ন বিদ্যুতের তিন ভাগের এক ভাগ দাবি করবার চেষ্টা করছে। এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। কিন্তু এ বাঁধের ফলে বাংলাদেশের কি ক্ষতি হবে তা আগে দেখা উচিত। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে নদীতে যে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে তার ফলে নদীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সাথে তিস্তা নদীর পানি বন্টন চক্তির কথা থাকলেও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার কারনে সেটিও এখন ঝুলে আছে। ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিনিময়ে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। ভারতের সাথে অভিন্ন নদী গুলোর মুখে একের পর এক বাঁধ দেওয়ার ফলে আমাদের নদীগুলো হয়ে পড়ছে মরুভূমি। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে সচ্ছতার ভিত্তিতে অভিন্ন নদী গুলোর পানি বন্টন চুক্তি করতে হবে।
যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম আমাদের এই নদী পথ যেমন হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সড়ক অথবা রেলপথের চেয়ে অনেক কম খরচে যাত্রী ও পন্য পরিবহন করার জন্য নৌপথের কোন জুড়ি নেই। দেশের প্রধান প্রধান শহর গুলো নদী তীরে অবস্থিত ছিল। অনেক নদী ক্রমে হারিয়ে গেছে। আবার অনেক নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। কিছুদিন আগে তিতাস নদীর উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে তিতাসকে মৃত্যুর মুখোমুখি করে দিয়েছিল। সমাজের সচেতন নাগরিক আর আমাদের মিডিয়ার বদৌলতে সেই রাস্তা তুলে ফেলা হচ্ছে। ফলে তিতাস হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু যে নদী গুলো ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য থেকে আমাদের জীবন থেকে। এক শ্রেনীর লোভী অসাধু মানুষ আবার নদী ভরাট করতে তৎপর। তারা নদী ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করছে। ছোট বেলায় আমরা সবাই পড়েছি ”আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে” । এখন হয়তো সেই নদী আর খুজে পাওয়া যাবেনা। হয়তো ভরাট হয়ে গেছে হয়তো দখল হয়ে গেছে।
দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের দেশে অসংখ্য কল-কারখানা গড়ে উঠছে। এর অনেক গুলোই নদী তীরবর্তীতে গড়ে উঠেছে। এই সব কারখানার বজ্র পদার্থ সরাসরি নদী গুলোতে ফেলা হচ্ছে। যদিও কারখানার বজ্র পদার্থ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ অপসারন করার কথা থাকলেও কেউ তা মানছে না। বিষাক্ত পদার্থ গুলো নদীর পানিতে মিশে নদীর পানিকে দুষিত করে তুলছে। ঢাকার অভ্যন্তরের তিনটি (বুড়িগঙ্গা,তুরাগ,বালূ) নদীর পানির দিকে তাকালে বুঝা যায় পানি কি পরিমান বিষাক্ত। পানির রং যখন কালো তখন সেখানে কোন প্রানী ও উদ্ভিদ বাঁচতে পারেনা। এই নদী গুলোতে নেই কোন উদ্ভিদ ও প্রানি। এমন অনেক নদী আছে দেশের আনাচে কানাচে। বগুড়ার করতোয়া নদীর একসময় খুব নাম ডাক থাকলেও এখন সেটি একটি খালে পরিনত হয়েছে। তাছাড়া বড় বড় নদী গুলোতে এক সময় ডলফিন (শুশুক), মিঠা পানির কুমির পাওয়া যেত যা এখন বিলুপ্ত প্রায়। যার প্রধান কারন নদী দূষন।
নদী গুলোকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সরকারের বেশ কিছু পদপে গ্রহন করা অতিব জরুরী। নদী গুলোকে পুন খনন করতে হবে। ফলে নদীর নাব্যতা ফিরে আসবে। সরকারের এ জন্য দরকার পর্যাপ্ত ড্রেজিং মেশিন যা তাদের কাছে নেই। আশার কথা হল দেশে এখন আন্তজার্তিক মানের ড্রেজার তৈরি করছে। নদী গুলো পুন: খনন করা হলে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক ভাবে হবে। অনেক জনপদ রাক্ষা পাবে বন্যা ও নদী ভাঙনের হাত থেকে।
বাংলা সাহিত্যেও নদীর সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। নদীকে ঘিরে অনেক গান,কবিতা উপন্যাস রচিত হয়েছে। যেমন: পদ্মা নদীর মাঝি। আবার মাঝি নাও ছড়িয়া দে মাঝি পাল উড়াইয়া দে জাতীয় গান । এক সময় প্রায় সব বড় নদীতেই পাল তোলা বানিজ্যিক নৌকা বা জাহাজ দেখা যেত। আর দেখা যেত মাঝি গলা ছেড়ে গান গাইছে। এখন এই দৃশ্য দেখা যায় না। নদীগুলোতে আর খুব একটা নৌকা দেখা যায়না। যোগাযোগের একটি বড় মাধ্যম হতে পারে আমাদের নৌপথ। নদী গুলো মৎস সম্পদের একটি বিশাল আধার হতে পারে। যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারে। শুধু দরকার নদী গুলোর পর্যাপ্ত খনন, অবৈধ দখল মুক্ত করা, দূষন মুক্ত রাখা। নদীকে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। ঐতিহ্যের প্রয়োজনে আমাদের নদী গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদী আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদকে রাক্ষা করার জন্য সরকার ও জনগনকে এগিয়ে আসতে হবে।
মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান
নিবন্ধিত নাম-( M.Asaduzzaman)
E-mail:
মন্তব্য
নদী ছাড়া বাংলাদেশ চিন্তাই করা যায় না। নদী মাতৃক বাংলাদেশ।
একটা বিষয় যোগ করতে চাই, যদিও ভিন্নভাবে হয়তো বলেছেন: সমাজের সচেতন নাগরিক আর আমাদের মিডিয়ার বদৌলতে সেই রাস্তা তুলে ফেলা হচ্ছে। -- তিতাস নদী’র উপর সেই রাস্তা নিয়ে প্রতিবাদে বাংলাদেশের ব্লগগুলোর অবদান ব্যাপক।
সত্যিই তাই। যোগ করার জন্য ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ধন্যবাদ
টঙ্গীর তুরাগ নদীর কালো পানির দিকে তাকালে কষ্ট হয়। পানিতে কোন জীব টিকে আছে বলে মনে হয় না। গাজীপুর জেলার মাছের সবচেয়ে বড় উতস হলো বিল বেলাই। সেখানের পানিও কালো হয়ে যাচ্ছে ফ্যাক্টরীর বর্জ মিশে।আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না এই সব জলাশয়ে। আমাদের নদীগুলি মরে যাচ্ছে।
সিরাজুল লিটন
:(
নতুন মন্তব্য করুন