‘’বৃদ্ধকে দিয়ো না দায়িত্ব...’’

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৫/০৪/২০১৩ - ১০:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৫ বছর ধরে আমার মা ঢাকার একটি পরিচিত দৈনিক কাজ করতেন। ওই দৈনিকের প্রাসাদে প্রায়ই লেখা নিয়ে আড্ডা দিতে আসতেন একজন বয়স্ক মানুষ। হাতে একটা ছড়ি থাকতো, তাতে নিজেকে বেশ ভারি ও সম্ভ্রান্ত লাগতো মনে করে তিনি আত্মতৃপ্তি বোধ করতেন। পত্রিকার সাহিত্য-সাময়িকী বিভাগের লোকজন ও সম্পাদক তাঁকে খুব পছন্দ করতেন, তা নয়। কিন্তু তিনি একজন সাবেক আমলা, প্রাক্তন সিএসপি (এই তিনটি অক্ষরের প্রতি কোনো কিম্ভুত কারণে বাঙালির এখনো একধরনের দুর্বলতা রয়েছে), সেই সাথে সাহিত্য-বাজারের পুরস্কারপ্রাপ্ত মুখ; উন্নাসিক, ‘’সফল’’, ফিটফাট।

তাঁর জন্য অফিসে বিশেষ চায়ের কাপের ব্যবস্থা করা হতো, কেননা পিয়নের আনা চায়ের কাপে তিনি চা পান করেন না।তাঁর বদলে বরং স্বর্গের সুরায় খুঁজে পেতেন জীবন, নিশ্চিতভাবেই।

গতকাল প্রথম আলোতে তাঁর লেখা মুদ্রিত বর্জ্য পড়ার পর মা’র সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে, এইসব ঘটনার কথা জানতে পারি। মা নাকি সেইসময়ে পত্রিকার সাহিত্যসম্পাদককে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, এই অশীতিপর বৃদ্ধকে টিনের কাপ দিয়ে যেনো বসিয়ে রাখা হয়।

লাকি আক্তার বিতর্কিত, ধরে নিলাম। রাজনীতি,স্লোগান,মিছিল,পিকেটিং- সবই তিনি করতে পারেন। এবং একজন সাবেক আমলা (ছিঃএস্পি) এ বিষয়ে বিরুদ্ধমতের আশ্রয় নিতেই পারেন। কিন্তু তাঁর ভাষা যখন মিলে যাচ্ছে বাঁশেরকেল্লা পেইজের সেইসব পোস্টের ভাষার সাথে, কাহিনী মিলে যাচ্ছে; এবং যখন তিনি বাশেরকেল্লার অধিবাসীদের মতোই ‘’শাহবাগি’’দের ড্রাগস দিচ্ছেন, রেইপ করাচ্ছেন, খেঁকশিয়ালের বিয়ে পড়াচ্ছেন- তখন প্রশ্ন জাগে, ‘’তাঁকে এইসব তথ্য সরবরাহের দায়িত্বে কে ছিলো?’’ মাননীয় উপসম্পাদকেরা?

কল্পনাশক্তি তাঁর খুবই সীমিত। নাহলে এর চেয়ে ভালো পাঠকটানা গল্প তিনি ফাঁদতে পারতেন। তাঁর দুতিনখানা বই পড়ার সু্যোগ হয়েছিলো। বাঙলা সাহিত্যের মানদন্ডেও যদি বিচার করা হয়, উনি দ্বিতীয় সারি থেকে বাদ পড়তে পড়তে রয়ে যান। সেই লোককে, কয়েকটি পত্রিকা মিলে, এই যুগের ‘’পাউন্ডে’’ আখ্যায়িত করতে গিয়ে ব্যাপকহারে মূলো ধ্বংস করেছে।

অনেকেই তাঁর ‘’নভেলা’’ বইটির কথা বলেন। আহামরি কিছু নয়, দুটি উপন্যাসিকার সমস্বয় এটি। ‘’সে এবং তার ছায়া’’ উপন্যাসিকায় এই বৃদ্ধের মানসিকতার একটু পরিচয় পাওয়া যায়। কাহিনী সরল- বিশ্ববিদ্যালয়ের সৎ শিক্ষক রেজার সংসারে টানাপোড়েন চলছে গল্পের শুরুতে। চাল-ডাল-নুনের ঝগড়াঝাটির আওয়াজ শোনা যায় কতক্ষণ। একসময় অর্থাভাবে ও গ্ল্যামারাস জীবনের ইশারায় রেজার নৈতিক স্খলন ঘটে যায়। ব্যবসায় নামে, দ্রুতই সে ‘’সফল’’ হয়ে উঠে। তাঁর সহজ-সরল কলেজপড়ুয়া মেয়ে তৃষার ‘’স্মার্টনেস’’ বৃদ্ধি পেতে থাকে বাবার টাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই...ব্লাব্লাব্লা। কামিজ-শাড়ি খসে গেলো। গায়ে উঠলো,লেখকের ভাষায়-‘’প্যান্ট,জিন্স,ওপরে শার্ট, হলটার টপ অথবা টি-শার্ট। তাকানো যায় না।‘’

শেষাংশে বাবা-মেয়ের আলাপ বেশ জরুরি। অন্য সময়ে হলে একজন সাধারণ কাহিনীকারের বর্ণনা-বিবৃতি বলে সরিয়ে রাখতাম। আজকের আবর্জনা পড়ার পর সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

‘’.........রেজা টিভিতে নাচের দৃশ্য দেখতে দেখতে বললো, কোথাকার মেয়েরে এরা?
-ইন্ডিয়ান। মল্লিকা শরাওয়াতের নাম শোনো নি? খুব বোল্ড রোলে অভিনয় করে।
রেজা ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে সপ্রশংস স্বরে বললো, বেশ স্মার্ট। ভালো নাচতেও পারে। ভেরি এক্মপ্লিশড। বলতে বলতে নিজের অজান্তেই তার হাত তৃষার কাঁধ শক্ত করে চেপে ধর। ‘’আব্বা’’ বলে প্রায় চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায় সে।......’’

হয়তো গল্পের প্রয়োজনেই কাহিনী এভাবে এগিয়েছে। এর সঙ্গে এ সময়ের আবর্জনার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। আবার মানস যদি লাম্পট্যে ভরা থাকে, তাহলে সম্পর্ক থাকতেও পারে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এই ছিঃএস্পিদের শোষণবাদী ভূমিকা নিয়ে অনেক বছর ধরে প্রশ্ন উঠছে। আর কে না জানে, নারীদের চেয়ে উৎকৃষ্ট শোষণযোগ্য ‘’বস্তু’’ আর কী থাকতে পারে? কিছু ঈদসংখ্যায়, মনে পড়ে, তাঁর এক-দুটি লেখা পড়েছি। বিষয়আশয়-শিল্পে-ফর্মে বৈচিত্র্য ও নিরীক্ষা কম; সুযোগ পেলেই যুবতী মাংসে একটু প্রচাপন করে নিয়েছেন।

এই গণআন্দোলন নিয়ে অনেক প্রশ্ন, সংশয়, দ্বিধা, অভিযোগ, গুজব, হতাশা- আরো কতো! কিন্তু গল্পের ক্যামোফ্লেজে, গণজাগরণের মেয়েটিকে মানসিক-ধর্ষণ করে তিনি কী সুখলাভ করলেন, সেটি জানার ইচ্ছে রইলো। ‘’বৃদ্ধেরা’’ নামে হুমায়ুন আজাদের একখানা কবিতা আছে (কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু)। হাতের কাছে নেই বইটা, তাই উদ্ধৃতি দিতে পারলাম না। আগ্রহীরা পড়ে নেবেন।

বৃদ্ধের দিকে দিকে কমে আসছে বাতাস, আলিঙ্গন, প্রীতি। তাই কি এই বিকৃতি?


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এই লোকের নাম বদলে হাসনাত আবদুল "লো" রাখা উচিত।

চরম উদাস এর ছবি

হো হো হো

অতিথি লেখক এর ছবি

আ-হা-হা, বুজলেন না, 'হাই' মানে হল গিয়ে 'চড়ে আছে' ... একদম টং হয়ে ...

- সম্রাট দাশুগুপ্ত

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

তাহলেও একটু বদল দরকার। হাসনাত আবদুল হাই (অন গঞ্জিকা)।

বন্দনা এর ছবি

চলুক চলুক

তানিম এহসান এর ছবি

দেঁতো হাসি

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম এই নিয়ে। একজন এসে কমেন্ট করল এত বড় একজন লেখক কিভাবে এই কাজ করতে পারল? আমি বেশ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। উনি কি আসলেই বড় লেখক? নাকি আমি ভুল জানতাম।
গতকালের লেখার পর দ্বিতীয় কেন চতুর্থ শ্রেনীর একজন লেখক হিসেবে গন্য হবেন। আর লেখক-ই বা বলি কী করে। এদের আসলে কী বলা যায়?

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

এই বিকৃতি কি শুধু বয়সের দায়? বার্ধ্যক্যের দায়? মনে হয় না। তাই শুধু শিরোনাম ছাড়া পুরো লেখায় উত্তম জাঝা!
আর লেখকের নাম পেলাম না!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হাসনাত আব্দুল হাইয়ের একটা ভালো লেখার উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তমসা এর ছবি

চটি তো চটিই ------------- তার আবার উত্তম অধম কি? তবে হ্যাঁ , উত্তেজনার মাত্রা নিরিখে হাই/ লো পরিমাপ করলে ভিন্ন কথা।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা ভাল কিনা জানিনা, তবে তাঁর লেখা কিছু গল্পের সফল চিত্রায়ন হয়েছে, কয়েকটার ফ্রি ট্রেইলার পাবেন এখানে। আপনাকে একটু ধৈর্য্য দিয়ে খুঁজতে হতে পারে।

-- রামগরুড়

স্বয়ম এর ছবি

প্রথম আলো অনলাইন থেকে লেখাটি সরিয়ে ফেলেছে। পড়তে পারিনি। ফেবুতে আলোচনা দেখলাম। লাকীকে নিয়ে বাজে কিছু লিখেছে। হাসনাত আব্দুল হাইর নামটা শুনে অবাক লাগলো। যে, নভেরা, সুলতান, পটুয়া কামরুল এর মতো জীবনী নিয়ে কাজ করে সে কিভাবে এমন কিছু লেখ্ েতাই পড়ার জন্য খুঁজলাম। নানান আলোচনায় যা বুঝলাম আমারদেশ, বাঁশের কেল্লা বা এদের থেকে ভিন্ন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি বা শব্দ তার নেই। তবুও পড়েই পূর্ণাঙ্গ মন্তব্য করতে চাই। আমার প্রশ্ন মতিকে নিয়ে। এখন উচিত মতির কানে ধরে শাহবাগে নতজানু করে ক্ষামা চাওয়ানো বায়তুল মোকাররমে যেমন চাইছিল। সম্পাদক হিসেবে দায়টা আগে তার। আর হাইকে আমাদের চেনা থাকলো যেমন অনেক বুদ্ধিজীবীর চেহারা আমরা এই সুযোগে চিনেছি।

স্বয়ম

মনির এর ছবি

খুব ভাল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

লেখকের নাম কোথায়?

অতিথি লেখক এর ছবি

শিরোনামটি হুমায়ুন আজাদের ওই কবিতা থেকেই নেয়া। হাসনাত হাই এর কথা মাথায় রেখেই দেয়া। এর বেশি কিছু নয়। তবে, আমাদের দেশের বৃদ্ধেরা (বয়স ও মানস- এ দুয়ের বিচারে) বিশ্বাসঘাতকতা করে করে দেশকে বারবার রাস্তায় বসিয়েছেন- এ কথা স্বীকার্য। তাই বৃদ্ধদের প্রতি একধরনের ক্ষোভ আছে, ''বয়স্ক তরুণ''দের প্রতি নয়।

মেঘা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।