সবই ঠিক আছে। সবার মত আমরাও সকালে উঠি, গোসলে যাই। খেয়ে-টেয়ে যে যার কাজে যাই, আবার ফিরে আসি। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় সন্ধ্যা হলেই। ঘরে আলো জ্বালানো হলেই মা চেঁচিয়ে বলেন, ‘আলো জ্বালাইল কে রে? কে জ্বালাইল? ওরে চোখ যে জ্বালা করে...’
মা এমন জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকেন যে তাতে আলো জ্বালিয়ে রাখা যায় না। অগ্যতা আলো নিভিয়ে রাখতে হয়। আমি কখনও কিছু বলি না। তবে মাসুম ভাই মাঝে মধ্যে খেপে যায়, চিৎকার-চেঁচামেচি করে। কিন্তু বাবার সামনে গেলেই আর কিছু বলে না। এমন না যে বাবা খুব রাগী। আমি আমার এই একুশ বছরের জীবনে কখনও বাবাকে রাগতে দেখি নি। যতই রাগ হয়ে থাকি না কেন বাবার সামনে গেলেই আমাদের দুই ভাইবোনের সব অভিযোগ-অনুযোগ কর্পূরের মত উড়ে যায়। বাবার চোখের দিকে কখনই তাকাতে পারি না। কেন জানি ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।
আমার মা বদ্ধ উন্মাদ। পাঁচ বছর আগে সবই ঠিক ছিল। আমাদের সবচেয়ে ছোটবোন সুরমা মারা যাওয়ার পরপরই মা’র মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। বাবা অনেক ছোটাছুটি করেছে। কোথাও কোন লাভ হয় নি। সবাই বলে পাগলাগারদে পাঠাতে। শুনলে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত। মাসুম ভাই তো একবার রাস্তায় একটা লোককে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। পরে পুলিশ এসে হুলস্থূল কাণ্ড!
মায়ের অবস্থা শুনে আমাদের নানাও বাসায় এসেছিলেন। আমরা আমাদের নানাকে এর আগে কখনই দেখিনি। মা ছিলেন আমাদের এই বড়লোক নানার একমাত্র আদরের মেয়ে। মা পালিয়ে বাবাকে বিয়ে করায় নানা মাকে তাজ্য করেছিলেন। ও বাসার কাউকে মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে দেননি। মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু একটিবারও ও বাসায় যাননি। এমনকি আমাদেরকেও নিয়ে যাননি। মা ছিলেন অসম্ভব জেদী মহিলা।
নানা বাসায় আসায় বাবা একদম চুপসে গিয়েছিলেন। নানা আমাদের সাথেও কথা বলেননি। উনি একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়ে এসেছিলেন। তিনি অনেকক্ষণ আমাদের বাসায় ছিলেন। সবার সাথেই কথা বলেছেন। আমার সাথে যখন কথা হয় তখন তিনি একটা হাসি দিয়ে বলেন, ‘ভয় পেও না, তোমার মা ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি কোন কথা বলি না, চুপ করে থাকি।
‘তোমার নাম কী?’
‘তিতলি।’
‘ঘটনাটা খুলে বল।’
আমি আবার চুপ করে থাকি। উনি খুব কোমল গলায় বলেন, ‘দেখ তিতলি, তুমিও চাও তোমার মা ভাল হোক, আমিও চাই। এখন তুমি যদি কিছু না বল তাহলে আমি কীভাবে তোমার মা’র চিকিৎসা করব? বুঝতে পারছ?’
‘জ্বি, পারছি।’
‘ঘটনাটা বল, কিছু বাদ দিও না।’
আমি ঘটনাটা বলতে থাকি। উনি মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন করেছেন। আমি উত্তর দিয়েছি।
‘সুরমা ছিল আমাদের সবচেয়ে আদরের ছোটবোন। ও খুব দুষ্টু ছিল। কি একটা কারণে মা ওকে একদিন খুব মারেন। ও কাঁদতে কাঁদতে ছাদে যায়। ওখান থেকে পা পিছলে নিচে পরে যায়। ইটে মাথা লেগে মাথা থেঁতলে যায়। সাথে সাথে মারা যায়। মা ওকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যান।’
‘ওর বয়স কত ছিল?’
‘সাত বছর।’
উনি প্যাডে টুকে নিলেন। এরপর আমি আবার শুরু করি।
‘তিনদিন পর্যন্ত মা স্বাভাবিক হতে পারেন নি। চতুর্থ দিন মা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমরা ভাবলাম যাক শোক কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি অদ্ভুত সব আচরণ শুরু করলেন আমরা সবাই ঘাবড়ে গেলাম।’
‘কী রকম?’ উনি প্রশ্ন করলেন।
‘মা এমন ভাব করতে লাগলেন যে সুরমা মারা যায় নি। উনি ওকে দেখতে পান। আগের মত খাওয়ার টেবিলে ওর প্লেটটাও দেওয়া হয়। মা আগের মত ওকে খাবার নাড়াচড়া করা দেখে ধমকান। আগে যেমন ওর পিছনে ছোটাছুটি করতেন সেরকম।’
উনি প্যাডে আরও কি কি জানি লিখলেন। টুকটাক প্রশ্ন করলেন। শেষে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা কর না তিতলি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
কিন্তু কিছুই ঠিক হয় নি। মা সারাক্ষণ সুরমাকে নিয়ে থাকেন। সকালে নাস্তায় যখন সবাই একসাথে খাই তখন দেখা যায় মা সুরমাকে বকছেন,
‘অ্যাই সুমু পা নাচাচ্ছিস ক্যান? কতদিন না নিষেধ করেছি?’
খাওয়ার এই পর্যায়ে মাসুম ভাই অর্ধেক না খেয়েই উঠে যায়। আমারও গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। আর বাবা বাইরে তাকিয়ে থাকেন। ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।
আমি কলেজে যাওয়ার জন্যে যখন রেডি হচ্ছি তখন মা আমার হাতে কিছু টাকা গুছিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তিতলি যা তো, কলেজের পর সুমুর জন্যে একটা জামা নিয়ে আনিস।’
মা এমনভাবে বলেন যে চোখে পানি এসে যায়। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকিয়ে রাখি। মা বলতে থাকেন,
‘নীল রঙের আনিস, ওকে খুব সুন্দর দেখায়।’
কলেজ শেষে আমার বান্ধবী টুম্পাকে নিয়ে মার্কেটে যাই। ওর ভীষণ অস্বস্তি বোধ হয় বুঝতে পারি। কিন্তু ও কিছু বলতে পারে না।
বাসায় ফিরে মাকে জামার প্যাকেটটা দেই। মা নিয়ে খুব খুশি হন। চিৎকার করে ডাকতে থাকেন, ‘সুমুউউউ...দেখ তিতলি আপু তোর জন্যে কী এনেছে...’
এরপর আমি আর থাকতে পারি না। ঘরে ঢুকে হু হু করে কাঁদতে থাকি। অনেকক্ষণ কেঁদেটেতে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করি। সময়ের প্রয়োজনে হতে হয়।
ছ’ মাসের মধ্যে মা’র মাথা পুরো খারাপ হতে যায়। মাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। আলো একদম সহ্য করতে পারেন না, কাপড় চোপড় ঠিক থাকে না। সারাদিন মা চিৎকার করতে থাকেন। মাঝে মাঝে মাসুম ভাই খেপে ওঠে। অনেক কষ্টে ওকে সামলাই। বাবা সারাদিন অমানুষিক পরিস্রম করেন। বাবাকে দেখলে খুব কষ্ট হয়। আগের হাসিখুশি ছোট মানুষটাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। বাবা ভীষণ রোগা হয়ে গেছেন। কথা-বার্তা বলেন না বললেই চলে। রোজ রাতে মা যখন ঘুমায় বাবা চুপচাপ মায়ের পাশে বসে থাকেন। পরম মমতায় স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। দেখি বাবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি সরে আসি। ও সময়টা শুধু তাদের জন্যে রেখে দেই।
ঘরে এসে আমিও কাঁদতে থাকি। বড্ড মরে যেতে ইচ্ছে করে।
জুন মাসের একুশ তারিখ রাতে আমার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর এ বাসায় আরও নীরবতা নেমে আসে। বাবা সারাক্ষণ মায়ের ঐ ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। খাওয়াদাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছেন। সংসারের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে মাসুম ভাইয়ের মধ্যে। মাসুম ভাই আগের থেকে অনেক শান্ত হয়ে গেছে। একটা চাকরিও করছে। কখন কি লাগে সবসময় আমার কাছে জানতে চায়।
বুঝতে পারি আমার মধ্যেও একটা পরিবর্তন এসেছে। জীবনটাকে খুব বেশি চিনতে পারছি। রোজ রাতে আমার মা আর আদরের প্রিয় বোনটার জন্যে কাঁদি। অনেকক্ষণ কেঁদেটেতে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করি। সময়ের প্রয়োজনে হতে হয়।
নাহিয়েন
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন