বিউটিফিকেশান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৯/০৪/২০১৩ - ২:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্যস্ত সমস্ত নগরীতে সকাল হয়েছে বেশ খানিকটা আগেই, শহর ঘুমায়না, শহর জেগে থাকে তার বাড়ন্ত সুসময়ের সন্ধিক্ষণে এমনকি তার ধংসাস্তুপের মর্মর ধবনি শোনার আগ পর্যন্ত সে জেগে থাকবে। সুতরাং শহরের ঘুম ভাঙ্গার প্রশ্নই ওঠে না, বরং এই বনসাই আর বারান্দার মানিপ্ল্যান্ট পরিবেষ্টিত শহরে পাখি বলতে যে কেবল কাক ই অবশিষ্ট আছে তা আশে পাশে তাকালে স্পস্টই বোঝা যায়। শহরের সবচে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা প্রান বিবর্জিত আবার একই সঙ্গে তা প্রাণের প্রাচুর্যতায় পূর্ণ। এরকম ই এক শহরের সকাল , কাক ও মানুষ উভয়েই পূর্ণ উদ্যমে জীবিকার পেছনে ছুটতে শুরু করেছে। আধা আবাসিক আধা ব্যবসায়িক এলাকার প্রশস্ত এক রাস্তার মাঝখান দিয়ে চরের মত জেগে আছে একটা সরু রোড আইল্যান্ড। কাটাতারে ঘেরা এই সরু সড়ক দীপের মাঝে সারিবেধে রুগ্ন মুমূর্ষু সৈনিকের মত বেশ কিছু পাতাবাহারের গাছ যেন মৃত্যুর আগে শেষ কুচকাওয়াজে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সরু সরু ডাল সূর্যকে ছুঁয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেস্টায় লিপ্ত। এক কোনায় পাতাবাহারের রঙ ছাপিয়ে চকচকে একটা সাইনবোর্ড বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাতে লেখা ‘বিউটিফিকেশান বাই ব্যাঙ্ক এশিয়া’, আর যাই হোক পাতাবাহারের গাছগুলো শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির বদলে শহরের কদর্যতা যে বেশি প্রকট করে তুলছে তা বোধয় এই বণিক সম্প্রদায় খেয়াল করেননি। ঠিক সেই চকচকে সাইনবোর্ডের নিচে দুই পাতাবাহারের গাছের মাঝে এক রমনী ঘুমিয়ে আছে। তার বয়স বেশি নয় মোটেও এ বয়সের যে কোন নারীকে নির্বিঘ্নে তরুনী বলা যায় কিন্তু তরুনী কথাটার সঙ্গে যে যৌবনের সম্পৃক্ততা রয়েছে তা এই রমনীর মাঝে অপ্রতুল। তার এলোমেলো নোংরা শাড়ী হয়তো কোন এক সময় পাতাবাহারের পাতার মতই উজ্জ্বল সবুজ ছিল কিন্তু তা অতি ব্যাবহারে বর্তমানে ধুসর হতে হতে কালোয় রুপ নিয়েছে। তার শারীরিক অবস্থাও সেই শাড়ীর মতই, স্পস্টতই বোঝা যায় অতি ব্যবহারে তা জীর্ণ, ক্ষীন দুইটা হাত তার একটা বালিশের কাজ করছে। ধুসর এলোমেলো চুলে মোড়ানো একটা কঙ্কালসার মাথার ভারে এখনো যে সেই রুগ্ন হাত ভেঙ্গে পড়েনি তা আশ্চর্যজনক। তার বুকের মাঝে আর এক হাত দিয়ে সে জড়িয়ে আছে তার সন্তান, বয়স দশ মাসের মত হলেও তার শারিরিক গঠন দেখে মনে হয় বড়জোড় এক কি দু মাসের এক শিশু। মা শিশু গভীর ঘুমে নিমজ্জিত এই জেগে থাকা শহর, শহরের আদীম যানবাহনের কর্কশ সঙ্গীত, জেগে ওঠা শহুরে মানুষের কলরব তাঁদের ঘুমে বিঘ্ন ঘটাতে পারে নি। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য মানুষের ভীড়, ব্যস্ততা উপেক্ষা করেও মা শিশু নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছে।
হঠাত এক তরুনের চঞ্চল ব্যস্ত দৃষ্টি পড়ে মা-শিশুর দিকে। তরুনে কাধে কালো ঝোলা ব্যাগ, ইস্ত্রী করা শার্ট প্যান্ট চকচকে কালো জুতা দেখে মনে হতেই পারে তরুনের সদ্য চাকরি জুটেছে। এই ফিটফাট সকালে জীবনের প্রারম্ভে প্রবেশ করা উচ্ছল কোন তরুনের এমন দৃশ্যে চোখ আটকে যাওয়া মোটেও উচিৎ নয় তারপরেও তরুন এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তরুনের কাঙ্খিত বাস তার পাশ দিয়ে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে গেলেও তরুনের হুশ ফেরে না। সে রাস্তার পাশের ফুটপাথে বসে পড়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত মা ও শিশুর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে সেই ঝাপসা চোখ গভীর শীতের কুয়াশার মত গাড় হতে থাকে গাড় হতে হতে কুয়াশা বৃষ্টিতে রুপ ন্যায়।

সেই ফুটপাথ দিয়েই হয়তো কলেজে পড়া একদল তরুনী প্রাক্টিক্যাল খাতার ফাঁকে সবার অলক্ষে ঢুকে পড়া কোন ঠিকানাহীন প্রেমপত্র নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। দলছুট এক তরুণীর সেই গোপন প্রেমপত্রের বাইরে এসে দৃষ্টি পরে ফুটপাথে বসা তরুনের দিকে , তরুনের ঝাপসা মুখ থেকে দৃষ্টি প্রতিফলিত হয়ে যায় সবুজ দ্বীপে ঘুমিয়ে থাকা মা-শিশুর প্রতি। হঠাত তরুণীর কি হয় জানে না, তরুনীর কাজল চোখ আরো কালো হয়, এক গভীর শোক নেমে আসে তার চোখে, ধীরে সে বসে ক্রন্দনরত তরুনের পাশে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরুনের হাত ধরে মা ও শিশুর দিকে দৃষ্টি রেখে সে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সেই অদ্ভুত শোকেসে সাজানো পুতুলের মত তরুন তরুনী কে কাঁদতে দেখে ডায়বেটিক আক্রান্ত এক বৃদ্ধ তার প্রাচীন হাঁটা বন্ধ করে থমকে যায়। সে এগিয়ে যায় তরুন তরুনী কে সান্তনা দেবার লক্ষে। তারপর তার কোঁচকানো চামড়া আরো কুঁচকে যায় প্রাচীন ব্যর্থতায় তার ডায়বেটিক এর মাত্রা বাড়তে থাকে এক দুই তিন... চোখের কোনা দিয়া গড়াতে থাকে তার দীর্ঘদিনের সঞ্চিত চিনিহীন জল। এভাবে আরো মানুষ বাড়তে থাকে, আরো ক্রন্দন , আরো ভিড়, জটলা , ধীরে ধীরে জড়ো হয় মধ্যবয়স্ক চাকুরে, বাদাম ওয়ালা, বাচ্চার হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়া মা, স্কুলে পড়ুয়া শিশু, কোমল সূর্যের আলোয় আহত হয়ে সানগ্লাস পরা তরুনী, সুই একটা রিক্সাওয়ালা, বেল্টের বকলেসে চে গুয়াভারার স্বারকলিপি বয়ে ব্যাড়ানো তরুন, ভারী চশমায় আচ্ছাদিত ডাক্তার, বাসের টিকেট বিক্রেতা, সদ্য নিজেকে বেচতে বের হওয়া কোন হকার। এরকম আরো অনেকে। সকলেই সেখানে দাঁড়িয়ে অঝরে কাঁদতে থাকে। এই সকল ভীড়,কান্না উপেক্ষা করে মা নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে থাকে কিন্তু অনভ্যস্ত শিশুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে সে জড়িয়ে ধরে মায়ের শুকনো স্তন, তারপর পান করতে থাকে সেই সুধা যা পৃথিবী তাঁকে দ্যায়নি। তার সাথে ভেড়ে বেশ কিছু মাছি, প্রতিযোগিতামুলক পানে শিশু এগিয়ে যায় মাছিদের পেছনে ফেলে। আর মা স্তনে শিশুর ঠোটের ছোয়া পেয়ে আরো গভীর ঘুমে চলে যায়, ঘুমে নামতে নামতে সে ঢুকে যায় স্বপ্নের স্তরে। চোখ বুজেই সে দ্যাখে তার সামনে এক ধু ধু বিস্তৃত মরুভূমি, সেখানে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কাক অদৃশ্য দড়ি থেকে ফাঁসিতে ঝুলে আছে , মাটিতে ছড়িয়ে আছে কিছু মৃত শকুন, সেই বিপুল মরুভুমিতে একটা পানকৌড়ি পানির আশায় তপ্ত বালির ওপর ছটফট করছে। সেই সময় সব মৃত কাক চিৎকার করে ওঠে, তীক্ষ্ণ চিৎকারে তার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, কিন্তু ঘুম ভাঙে না সে স্বপ্ন থেকে আবার খুমে তলিয়ে যায়।

কোন এক কাকের বাচ্চা পরে গেছে রাস্তার পাশে, তাঁকে উদ্ধারের জন্য ছুটে এসেছে শহরের সমস্ত কাক, শহরের আকাশ কালো, কা কা এর তীক্ষ্ণ ধারালো সঙ্গীতের কন্সার্টে মগ্ন। কাকের সঙ্গীতে মা শিশুকে ঘিরে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর হুশ ফেরে। সানগ্লাস পড়া তরুনী তার বিশাল ব্যাগের ভেতর থেকে এক বাক্স টিস্যু বের করে তার চোখ মুছে ন্যায় তার পর বাক্সটা ভেড়ের মাঝে বিলিয়ে দ্যায় অকাতরে। জটলার সকলে সফেদ টিস্যুর সফল ব্যাবহার শেষে একে একে চলে যায় যার যার কাজে। ডাক্তার হন্ত দন্ত হয়ে ছুটতে থাকে রোগীর কাছে, ডায়বেটিক আক্রান্ত বৃদ্ধ আবার শুরু করে তার প্রাচীন হাঁটা, কলেজের তরুনীর প্র্যাক্টিক্যাল খাতার ভাঁজে থাকা চিঠির কথা মনে পরে, সে ভুলে যায় পাশের তরুন কে, হকার আবারো তাজা খবর বিক্রি করতে চিৎকার করে। ধীরে ধীরে স্থবীর হয়ে যাওয়া পথে গতি ফিরে আসে। কেবল সেই শিশু মাছিদের সঙ্গে প্রবল প্রতিযোগিতায় দুধ পান করতে থাকে।

_____
পিনাক পাণি (নিবন্ধিত নাম)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ ভালই লাগল।
আঃ হাকিম চাকলাদার

পিনাক পাণি এর ছবি

হাসি

মেঘা এর ছবি

গল্প বেশ ভালো লেগেছে শুধু বানানের দিকে এক্টুমনযোগ দিতে হবে দাদা।

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

পিনাক পাণি এর ছবি

দুঃখিত আমিতো অতিথি, সুতরাং এডিটের কোনো অপশান আমার হাতে নাই। হাসি আর গল্পটা টানা ব্লগে বসেই লেখা সুতরাং লেখার পরে এডিট করার মত ধৈর্য ছিল না। তবে পরবর্তীতে সাবধান হব।
ধন্যবাদ দিদি হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল। হাসি
------------------------
মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান

শাব্দিক এর ছবি

ভাল লাগল। চলুক

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

পিনাক পাণি এর ছবি

হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দুঃখিত পিনাক পাণি, গল্প ভালো লাগেনি। কী ভালো লাগেনি? ফর্ম, কনটেন্ট, ল্যাঙ্গুয়েজ কোনটাই ভালো লাগেনি।

আজ নীড়পাতায় তিন জন অতিথির লেখা গল্প পড়ে হতাশ ও বিরক্ত হয়েছি। লেখা পোস্ট করার সময় পাঠকের কথা একটু মাথায় রাখা দরকার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পিনাক পাণি এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি এ ধরনের মন্তব্যই চাচ্ছিলাম হাসি গল্পটা দ্বিতীয়বার পড়ার সময় আমার নিজেরো ভালো লাগে নি - আমি যা চোখ বন্ধ করে দেখেছি তা আমি গল্পে ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। তা নিঃসন্দেহে আমার ব্যর্থতা হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।