আমি গল্পকার নই। তবুও গল্প ঘোরে মাথার ভিতরে। কোনোটিই পরিণতি পায় না। অর্ধেক মূর্ত হয়ে বাকিটুকুর প্রার্থিতায় মাথাকুটে মরে। তাকে সঙ্গত দিতে আমিও সঙ্গি হই তার। তাই এ লেখাকে গল্প না বলে গল্প ভাবনার পরিণতি প্রত্যাশা বলাটাই ভালো। এটা একটা প্রচেষ্টা । দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে এটা বেসুরো ঠেকবে হয়তো। মন্তব্য জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।
রোদ ধরা খেলা
সাদাকালো স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে থাকে মনসুর। স্বপ্নের ঘোরটা কাটতে চায় না সহজে। কি দেখেছে তাই মনে করার চেষ্টা করে সে। কিছু মনে পড়ে কিছু অধরা থেকে যায়, অনেকটা ভোরের রোদের মতন। বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলে যে রোদ ঢুকে পড়ে একেবারে অন্দরে। অপ্রতিহত, অনামন্ত্রিত সে রোদের একটা আলাদা মায়া থাকে। আদুরে ঘুম ভেঙে দেওয়া অনাহুত রোদটার ওপর রাগ করা যায় না কোনোমতেই। বরং একমনে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। ভাবতে ভাবতে ঘরের মেঝেতে দুলতে থাকা এক চিলতে রোদের দিকে চোখ যায় মনসুরের। আড়মোড় ভেঙে উঠে বসে সে। ঠোঁটের কোনায় একটু হাসিও খেলে যায় তার যেখানে ভালোলাগার চেয়ে দুষ্টুমির চিহ্নই প্রধান হয়ে ওঠে হয়তো। বসা থেকেই অনেকটা হামাগুড়ির মতো করে সে যেতে চায় রোদটার কাছে। সে আজ রোদ ধরা খেলা খেলবে, ছোট থাকতে যেমন খেলত। ছোট মানুষের মতই মনসুর হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে রোদটার দিকে।
রোদের যেন পা গজিয়েছে। সেও খেলতে শুরু করে মনসুরের সাথে। এক চিলতেই রোদ, কিন্তু সে যেন প্রাণ পেয়েছে, খলবলিয়ে হাসছে যেন, যেন নেচে বেড়াচ্ছে ঘরজুড়ে। সে যেন পণ করেছে আগের মত আর ধরা দেবে না মনসুরের কাছে। নাকি একটু আধটু ভয়ও পেয়েছে সে? হয়তো তার ভাবনা মনসুরের হাতজোড়া নিয়ে, যা কোমল নয় আর, হয়ত সে অভিমান করেছে এত বছরের বিচ্ছেদের কারণে অথবা হয়ত কিছুই নয় মনসুরের ছোট কোমল দস্যি হাতের কাছে বারবার পরাজিত সে আজ একবার জয়ী হতে চাইছে কেবল। যে কারণেই হোক মনসুরকে ফাঁকি দিয়ে রোদটা নেচে বেড়ায়।
রোদের সাথে ঝুঝে ঘেমে ওঠা মনসুরের রোখ চেপে যায় ক্রমশ। যেই সে বাগে পেয়েছে ভেবে লাফ দিয়ে ধরতে যাবে রোদটাকে অমনি একটা চেনা কন্ঠ অচেনা সম্বোধনে তাকে ডাকে, মনু আর কত ঘুমাইবি? ওঠ.. আরো কিছু বলে যায় সে, পুরোটা শোনে না মনসুর। মনু ডাকটা শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। সে একবার রোদটার দিকে তাকায়, আবার কন্ঠটা নিয়ে ভাবে। কণ্ঠটা যতটা কর্কশ হওয়ার কথা ততটাত নয়, বরং অনেকটাই যেন সুরেলা। যতটা বয়সী হলে মানায় তার চেয়ে অনেক অনেক.. ভাবতে পারে না আর। মনসুর অথবা মনু, সে জানে না এখন। ঘরে এক পলকে কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে সে, হয়ত আয়না নিজেকে মেপে নিতে, মনসুর নাকি মনু নাকি অন্য কিছু। কিন্তু তা এক পলকই। তারপর সে খালি পায়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে, দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, বোঝা যায় না তার দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে নাকি কপাট ছুঁয়ে থাকতে।
সে আস্তে আস্তে দরজা ডিঙিয়ে বাইরে পা বাড়ায়। তাকে আসতে দেখে, খুদ খুঁটে খাওয়া মুরগীগুলো এদিক ওদিক দৌড়ে যায়, মিশ্রিত নানা শব্দের একটা আলোড়ন উঠে আবার মিলিয়ে যায়। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে থাকে একটা কুকুর। টাইগার-চিনতে পারে মনসুর। তার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। শিষ তুলে তাকে কাছে ডাকে সে। কিন্তু রোদটার মতো সেও যেন আজ খেলতে চায় মনসুরের সাথে। উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে টাইগার। দু-বার পরাজিত হতে চায় না নামনসুর। সেও হাঁটতে থাকে তার পেছনে। অথবা কোনও কারণই নেই, এমনিতেই হাঁটে সে কুকুরটাকে সামনে রেখে। সে যেতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সুপারি গাছের ঘন বাগানটা তাকে গিলে না খায়। ছোট থাকতে এখানে দিনের বেলাতেও কত ভূত দেখেছে সে।
মনসুর যেতে যেতে বেতঝোপটার কাছে চলে আসে। সে বেতঝোপের কাছে উবু হয়ে থাকে কিছুক্ষণ বেতফলের প্রত্যাশায়। ‘কিছু খুঁজছেন চৌধুরী সাহেব? কিছু হারিয়েছে? চশমাটা নিশ্চয়? মনসুর সম্বিত ফিরে পায়। খালেদ সাহেব, চিনতে পারে সে। একটু কাঁচুমাচু করে সে বলে, ‘ না মানে টাইগার, আমার কুকুরটা’। খালেদ সাহেব হাসেন, এবং আঙুল তুলে বেতঝোপের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ক্ষীণ পথটা দেখিয়ে দেন। মনসুরের সন্দেহ হয়। সে খালেদ সাহেবকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। তবুও অনেকটা নিয়ন্ত্রিতের মতন ওদিকেই পা বাড়ায়।
‘শুধু হাঁটলে অধরা থাকে অনেক, দৌড়াতে হয় মাঝে মাঝে...’ আরো কিছু বলছিল হয়তো খালেদ সাহেব পেছন থেকে। বাকিটা শোনার আগেই দৌড় শুরু করে মনসুর। দৌড়াতে দৌড়াতে তার হাত-পায়ের নানা জায়গায় ছড়ে যেতে থাকে বুনোঝোপে লেগে। তবু সে দৌড়াতেই থাকে। পথ ধীরে ধীরে প্রশস্ত হতে থাকে।
যেতে যেতে সে দেখতে পায় একটা গুঁড়ির উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে বিমল স্যার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘বিজ্ঞান পড় আর যাই পড় ইতিহাস জানা চাই, অুীত হচ্ছে আগামী ভুলের ভবিষ্যতদ্রষ্টা.. .. ’। ‘ওহ্ উপদেশ খালি’, ভাবে মনসুর, ‘এখন কি আমার থামবার সময় আছে? বুঝবে না, কিছুতেই বুঝবে না এরা।’ সে বরং তার দৌড়ের গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। এর মাঝেও বিমল স্যারকে নিয়ে ভাবতে থাকে সে, ‘এখানে কীভাবে এল?’ ভাবতে ভাবতেই আরেকজনের ঘাড়ে গিয়ে পড়ছিল বেখেয়ালে। কোনোমতে সামলে নিয়ে তাকিযে দেখে, কুঁজো করে কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে একজন। লোকটা রাগ করার বদলে হেসে দিয়ে বল্ল, বাবা কত কিছুইতো কত জায়গায় থাকার কথা নয়। হাসি দেখে বশির চাচাকে চিনলো মনসুর। তার এই হাল কেন? ক্ষণিক কেবল। নিজেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিয়ে আবার ছুটতে শুরু করল।
ছুটতে ছুটতে কখন পাকা রাস্তায় উঠে এসেছে সে জানে না। সে টের পায়, সে জানে না কেন ছুটছে, কিসের পেছনে ছুটছে। মনসুর মনে করতে পারে না কিছুই। শুধু জানে, সে কেবল ছুটছিল। কেন, এই কথাটাই কেবল তার মনে নেই। মনে পড়াটাও তার কাছে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে। এভাবেই অকান্ত ভাবনায় আর পায়ে ছুটতে থাকে মনসুর। হঠাৎ দূরে একটা টঙঘর দেখতে পেয়ে পানির তেষ্টা পায় তার। ক্রমেই এই তৃষ্ণা এমন হলো যে তার মনে হলো সে আর কখনো ঐ টঙঘরে পৌঁছাতে পারবে না। এতক্ষণে সে কান্ত বোধ করে। মুহূর্তেই এই কান্তি তাকে গ্রাস করতে শুরু করে। পা জোড়া তার পাথরের মতো ভারি মনে হতে থাকে।
‘মনু একটু জিরাইয়া ল এইহানে’। খুব চেনা কণ্ঠে কথাটা যেই বলে থাক, তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের জন্যেই হোক অথবা নিরুপায় হয়েই হোক মনু অথাবা মনসুর পাকা রাস্তা থেকে নেমে জমিনের ঢালে বসে একটু জিরাতে চায়। বসার জায়গা খুঁজে নিয়ে যেই বসতে যাবে সে, অমনি কিছু একটাতে পা হড়কে হঠাৎ অনিয়ন্ত্রিত গড়িয়ে পড়তে থাকে।
একঘে য়ে অনিশেঃষ গতিতে গড়িয়ে পড়তেই থাকে সে মানে মনু অথবা মনসুর। বাধাহীন, মুক্ত, অনিচ্ছা আর অনিয়ন্ত্রনের মিশেলে গড়িয়ে পড়ে সে। কিছু একটা ধরে থামাতে চেষ্টা করে সে। দু-চোখে ভর করে ভয় অথবা বিষ্ময়। এতো উঁচুতে ছিল নাকি জায়গাটা। সে গড়িযে পড়তেই থাকে। তার মনে পড়ে সরোজের কথা, মূহুর্তেই সে চিনতে পারে, সরোজই তাকে জিরোতে বলেছিল, অথচ তার থাকার কথা না এখানে। তার বুক তৃষ্ণায় ফেটে যেতে থাকে। সে হতবিহ্বল হয়ে যায়, সে চায় এই পতন ঠেকাতে। সে সেরাজের হাত ধরতে চায়, তার চোখ খোঁজে সরোজকে, তার হাত খোঁজে শিকড়। সে পায় না, সে পারে না। সে সর্বশক্তি দিয়ে নিজ অস্তিত্ত্বকে জানান দিতে চায়, সে চিৎকার করে ওঠে, কণ্ঠচেরা চিৎকার। চিৎকার করতেই থাকে মনু অথবা মনসুর...
আঁ আঁ এর মতো বোবা এক ধরনের শব্দ করতে করতেই হঠাৎ লাফ দিয়ে ওঠে মনসুর। তার কপালে এখনো বিন্দু বিন্দু ঘাম। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। পুরোটা ধাতস্ত হয়নি এখনো।
‘ আবারো সেই স্বপ্ন? একই স্বপ্ন আর কত দেখবে? একটু ঘুরিযে ফিরিয়ে দেখলেওতো পারো।’ কথা শুনে মনসুর বক্তাকে খুঁজে নেয়। তার চোখ এখনো বড় বড় হয়ে আছে, শ্বাস এখানো স্বাভাবিক হয়নি। সেই ঘন শ্বাস আর বড় হযে থাকা চোখেই জেবুকে সে চিনতে পারে। সে ভেবে পায় না জেবু এখানে কী করছে। কিছুক্ষণ ভেবে জেবুই যে তার স্ত্রী মনে করতে পারলেও, জেবু নামের আড়ালে পুরো ভারিক্কি নামটা মনে করতে পারে না কোনোমতেই। যেমন সে পারল না নিজের সম্বন্ধেই নিশ্চিত হতে। সে আসলে কে? মনসুর চৌধুরী? এর আগেও কি কিছু আছে? নাকি মনসুর? নাকি মনু শুধূ? জেবুকে জিঞ্জেস করলে কেমন হয়? মনসুর ভেবে ভেবে প্রশ্নটা জিঞ্জেস করবে কিনা মনস্থির করতে পারে না। তার বরং পানির তিয়াসের কথা মনে পড়ে। সে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খায়। তারপর সে জেবুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। জেবু এই সাতসকালে বেশ পরিপাটি হয়ে আছে। কেন ভেবে পাচ্ছে না।
‘আমি বেরুচ্ছি, তোমার অফিস কি ছুটি দিল নাকি?’ এইটুক বলেই জেবু ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ে। লাল কালো মিশেল ব্যগ তার, নানান কারুকার্যখচিত, মাঝে মাঝে ছোট-ছোট কাঁচ লাগানো। সেই কাঁচে ঝিলিক দিয়ে ওঠে এক টুকরো রোদ। জেবুর চলে যাওয়ারর দিকে তাকিযে থাকতে থাকতে মনসুরের রোদের কথা মনে পড়ে। মনসুর বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল গলিয়ে ধীরে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। আলতো হাতে পর্দা সরিয়ে কপাট খুলে দাঁড়ায়। জানালার ওপাশে একটা বাগান দেখতে পায় সে। ওখানে সে যায়নি কোনোদিন। একমনে তাকিয়ে থাকে ওদিকে।
মনসুর কখন বাগানটাতে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেই বলতে পারে না। খুব চেনা জায়গা, এমনভাবে বাগানে হাঁটতে থাকে সে। পায়ে সবুজ ছোঁয়াবে বলে সে স্যান্ডেল খুলে রেখে খালি পায়ে হাঁটে। হঠাৎ একটা হাসির শব্দ শুনতে পায় সে। শিশুর নাকি বয়সীর বুঝে উঠতে পারে না। নিজের ধন্ধে নিজেই ঘোরে কিছুক্ষণ। তারপর ঘোরে হাসির উৎসের পেছনে।
একটা লাল ফ্রক পরা শিশুকে দেখতে পায় সে। শিশুটি বোধ হয় তাকে দেখেছে আগেই। এটা বোঝা যায় তার লুকিযে পড়ার ধরণ দেখে। মনসুরও লুকোচুরি খেলতে চায় তার সাথে। শিশুটি হাসতে থাকে শৈশব ছাড়ানো দূরত্বে, শিশুটি বলতে থাকে ‘আমি জানি এনসব---’। তার হাসি ভালো অথবা মন্দ লাগে মনসুর অথবা মনুর। সে তার সাথে ছুটোছুটি করতে থাকে, হাসতে থাকে সেও। একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে শিশুটি। মনসুর নিশব্দ পায় এগিযে যায় শিশুটির দিকে, ছুঁতে যায় তাকে। শিশুটির চোখে অগম্য বিষাদ আর আনন্দ খেলা করে একসাথে। মনসুর ছুঁতে যায় শিশুটিকে। শিশুটি ঝোপজুড়ে ফুল হয়ে থাকে। লাল ফুল। মনসুরের ভাবন্তর হয় না। মনসুরের ইচ্ছে হয় না ফুলটির নাম শুধাতে। থাক অনামা। মনসুর লাল ফুল পছন্দ করে। মনসুর বুনো ফুল পছন্দ করে। নামে কী আসে যায়? মনসুর ফুলটিকে নিজের করে নিতে, ফুলটিকে বৃন্তচ্যুত করতে হাত বাড়ায়। তার হাতের স্পর্শে ফুলটি সেই লাল ফুলটি গলে পড়তে থাকে। মনসুর বিষ্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ফুলটি সেই লাল ফুলটি রক্ত হযে যেতে থাকে। ফুলটি গলে যায়, রক্তে হয়ে যায়, কিসের উত্তাপে, মনসুরের নাকি তার ছায়ার? মনসুর ভেবে পায় না। মনসুর দাঁড়িয়ে থাকে। ফুল গলে পড়া রক্তে মনসুরের পা-জোড়া মেখে যেতে থাকে। মনসুর ভাবে আর দেখে, আর শোনে, কে যেন বলছে, ‘মনু সইরা খাড়া, গায় লাগব’, মনসুর তবু স্থির হয়ে থাকে, সে ভাবতে থাকে কিন্তু ভেবে পায় না, কে ডাকে তাকে, অচেনা কণ্ঠে চেনা সম্বোধনে।
স্বয়ম
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন