রেজওয়ান বলল, ‘ফারুকের বাসায় যাবি নাকি?’
আমি জবাব দিলাম না। আগের মতই সিগারেট টানতে টানতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্রোত আসছে-যাচ্ছে। ব্রীজের উপর থেকে নদীটা অবশ্য পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকারের সাথে কিছুটা অনুভব করে নিতে হয়। আমার বেশ লাগে। কতদিন এই নদী থেকে দূরে ছিলাম। এই নদীর দিকে চেয়ে থাকলে কেমন একটা হাহাকার ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়।
‘কিরে কী হল?’ রেজওয়ান একটু বিরক্ত। আসলে আমি একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গেছি।
‘কিছু না।’ সিগারেটের ছাইটা ফেলে দিয়ে বললাম, ‘ওখানে গিয়ে কি লাভটা হবে শুনি?’
‘আরে চল না, মজা পাবি।’ রেজওয়ান চেপে ধরল। ‘মাঝে মাঝে অতীতকে ফিরে দেখতে হয়। মনের মধ্যে একটা শান্তি আসে।’
‘কোন দরকার নেই, আমি এমনিতেই অনেক শান্তিতে আছি। অতিরিক্ত শান্তি এটাও নিয়ে যেতে পারে।’
‘কেন? নিজেকে ঠিক রাখতে পাবি না?’ রেজওয়ান হাসতে লাগল।
‘এই আট বছর যখন ঠিক থাকতে পেরেছি বাকিটাও পারব আশা করি।’
‘তাহলে ভয় কিসের? চল যাই। বেচারাকে দেখলে বড্ড মায়া হয় রে।’
‘কেন?’
‘যে শালা আগে আমাদেরই একজন ছিল, আজ আমাদের দেখলে লুকিয়ে যায়। মনে হয় ওর অপ্রস্তুত ভাবটা আজও কাটেনি।’
আমি হাসলাম। ফারুককে দেখার শখ অবশ্য আমারও আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘আচ্ছা চল।’
রেজওয়ানকে নিয়ে একটা বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রেজওয়ান কীভাবে বাসাটা এত তাড়াতাড়ি খুঁজে পেল ভেবে পাই না। আমি হলে এই অন্ধকারে কখনই পেতাম না। বুঝতে পারলাম রেজওয়ান এ বাসায় প্রায়ই আসে।
দু’বার কড়া নাড়তেই ফারুক আসল। প্রথমে এই অন্ধকারে আমাকে চিনতে পারেনি। পরে স্পষ্ট বুঝলাম চমকে উঠেছে। রেজওয়ান বলল, ‘কিরে ঢুকতে দিবি না?’
‘ও হ্যাঁ আয় আয়...,’ বিব্রত কণ্ঠে ঢুকতে দিল। আমি চুপ করে রইলাম। আমার নীরবতাই ওর জবাবদিহি করুক।
আমাদেরকে বসতে বলে ও ভিতরে ঢুকল। আমরা অন্ধকারে বসে রইলাম। একটু পরে ও যখন মোমবাতি নিয়ে ভিতরে ঢুকল তখন ওকে দেখে আমিও চমকালাম। একি অবস্থা হয়েছে ওর? প্রচন্ড রোগা আর বয়স্ক দেখাচ্ছে ওকে। মোটা কাচের ফ্রেমে একটা ভাঙ্গা মুখ। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ফারুককে আজ কোন সিনেমার পার্শ্বচরিত্র লাগছে। যার জন্য কোন ভূমিকার প্রয়োজন হয় না।
‘কি খবর তোদের?’ ফারুক একটু হাসার চেষ্টা করল। এরপর আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘কবে ফিরলি?’
‘এইতো পরশু রাতে,’ ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলাম। এই প্রথম ফারুকের অবস্থাটা একটু বুঝতে পারলাম। ওর মত আমিও কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
‘আর বলিস না,’ রেজওয়ান বলল। ‘কাল সকালে উঠে দেখি কে যেন কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে দেখি হাসি হাসি মুখ করে এই শালা দাঁড়িয়ে আছে।’
আমরা হাসলাম। এ সময় ঘরে সুপ্রিয়া ঢুকল। ঘরে ঢুকেই সুপ্রিয়া আমাকে দেখে বলল, ‘এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল?’
সহজ কথা, কিন্তু ছুরির মত বুকে বিঁধল। আসার সময় অনেক কিছু ভেবেছি। কিন্তু এরকম সহজ করে সুপ্রিয়া কথা বলবে ভাবিনি।
আমি বোকার মত হাসলাম। কিছু না বললে খারাপ দেখায় তাই বললাম, ‘কেমন আছ?’
‘এইতো, যেমন থাকি সারাক্ষণ।’ সুপ্রিয়া সরাসরি আমার দিকে তাকাল। কথা বলতে একটুও গলা কাঁপল না, অতীত ফিরে আসল না। এ এক অন্য সুপ্রিয়া।
এরপর টুকটাক কথা হল। রেজওয়ানই বেশি বলল। আমি শুধু হ্যাঁ হুঁ করলাম। এরপর সুপ্রিয়া একটিবারের জন্যও আমার দিকে তাকাল না। আর তাকাবেই কেন, সে এখন আমার বন্ধুর স্ত্রী। মেয়েরা নিজেকে খুব সহজেই গুছিয়ে নিতে পারে। আর ছেলেদের গুছিয়ে নিতেই জীবন পার হয়ে যায়।
বের হয়ে এলাম। দু’জনের একজনও অনেকক্ষণ কথা বললাম। রেজওয়ানই প্রথম মুখ খুলল।
‘কি রকম দেখলি?’
‘কি?’
‘কি সেটা তুই ভালভাবেই জানিস।’
আমি আবার চুপ করে রইলাম। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে আবার এই ব্রীজের উপর এসে দাঁড়ালাম। আমি নদীকে অনুভব করতে লাগলাম। চেষ্টা করলাম ঐ হাহাকার ধ্বনি শুনতে।
মনে হল সেই হাহাকার ধ্বনি নদীর কাছ থেকে নয়, নিজের কাছ থেকেই পাব।
যুদ্ধের আগে সুপ্রিয়ার সাথে আমার প্রায় তিন বছর সম্পর্ক ছিল। ও হিন্দুধর্মী ছিল। তবে আমার ওসব ধর্ম-টর্ম গায়ে লাগে না। যুদ্ধ যখন শুরু হল তার ঠিক আগে আগে ওর সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল। ও আমাকে বিয়ে করতে বলছিল। আমি রাগ হয়ে বলেছিলাম, ‘দেশের এরকম অবস্থায় আমি বিয়ে করতে পারব না।’
ও শুধু চোখের পানি ফেলেছিল। কিন্তু সেই চোখের পানি আমি দেখতে পারিনি। আমার চোখে ছিল তখন শত্রুহননের অগ্নিদৃষ্টি। আগুন আর যাই পারুক, কারও চোখের পানি বুঝতে পারে না।
ও চোখ সেদিন আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিল। আমি দেশের টানে যুদ্ধে গিয়েছি, একটা বাপ-মা মরা হিন্দু মেয়ের কি হবে একবারও ভাবেনি। একবারও ভাবিনি, কাকা-কাকির আশ্রয়ে থাকা মেয়েটি তাদের জন্য কিরকম একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমি বুঝিনি, ফারুক বুঝেছে। ও যুদ্ধে যায়নি, ওর পঙ্গু বাবাকে ছেড়ে ও যেতে পারেনি। ওই শেষে সুপ্রিয়াকে বিয়ে করে...
আমি যখন যুদ্ধ শেষে এসে এটা জানলাম তখন আর থাকতে পারিনি। প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে ফারুককে খুন করতে চেয়েছিলাম। এই রেজওয়ানই আমাকে থামিয়েছে। এরপরই আমি বিদেশে চলে যাই। স্বাধীন দেশে একা বেঁচে থাকার চেয়ে পরাধীন দেশে একা থাকাই শ্রেয় মনে হয়েছে আমার।
আমি নদীর দিকে চেয়ে রইলাম। এই বাচাল রেজওয়ান পর্যন্ত অনেকক্ষণ কথা বলল না।
তারপর মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘এখনও ফারুককে মাফ করিস নি?’
আমি রেজওয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘না রে, ওর প্রতি আমার কোন রাগ নেই।’
নাহিয়েন
মন্তব্য
কপি করা গল্প মনে হচ্ছে, সুনিলের লেখা।
লিখতে থাকুন হাত খুলে।সুফল পাবেন পরে।
"ও হিন্দুধর্মী ছিল।" এ জায়গায় খুব সম্ভবত 'হিন্দুধর্মীয়' হবে । হিন্দুধর্মী বলতে আসলে একজনকে না, সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকেই বোঝায় । গল্প মোটামোটি ভালো লেগেছে
তালেব মাষ্টার
তালেব মাষ্টারকে ধন্যবাদ ভুলটি দেখিয়ে দেবার জন্য।
Amit কে অনুরোধ করব কোন গল্প সেটি জানানোর জন্য। প্রিয় লেখকের কোন গল্প যদি না পড়ে থাকি সেটি পড়ার যথেষ্ট আগ্রহ আমার আছে !
নাহিয়েন
সুবোধ অবোধ
নতুন মন্তব্য করুন