অরিন্দম দা বহু আগে একবার বলেছিলেন “Un Chien Andalou ” নিয়ে লিখতে। বহুবার লিখতে বসেছি এবং তা অবধারিতভাবে বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, এই অত্যন্ত উদ্ভট অসাধারন সিনেমা নিয়ে আমার মত একটা ক অক্ষর কোমাংশের লিখতে বসাটা আরো বেশি উদ্ভট, স্যুরিয়ালিজম এ তা দালি কেও হার মানিয়ে যায়- তারপরেও ব্যপারটা আমার মাথার ভেতরে ঢুকে গেছে সুতরাং লেখার আদম্য আগ্রহ কে সামলাইতে পারলাম না-
‘একটি আন্দালুসিয়ান কুকুর’ উদ্ভট একটা নাম, মুভির সাথে তালে বা গোলে কোন ভাবেই মিল নাই যদি স্কুলের বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষায়- দালি বা বুন্যুয়েল কে নামকরণের সার্থকতা লিখতে দেয়া হতো তবে নিঃসন্দেহে তারা ফেল করতেন। যাহোক এই আন্দালুসিয়ান কুকুরের পরিচালক লুই ব্যুনুয়েল তবে মূল ভাবনা ব্যুনুয়েল এবং দালি উভয়ের। বুন্যুয়েল একদিন স্বপ্ন দ্যাখেন যে একটা ধারাল চাকু দিয়ে একটা মেয়ের চোখ এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়া হচ্ছে- সেই স্বপ্নের কথা তিনি দালি কে বলেন এরপর দুই স্বপ্নবাজ বন্ধু আডডা দিতে দিতে এই ফিল্মের ভাবনা তৈরি করেন।১ এবং স্যুরিয়াল জগতের দুই বিষয়ের দুই মহান কারিগরের প্রচেষ্টায় তৈরি হয় সিনেমা জগতের মাস্টারপিস, ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি এর পরে ব্যুনুয়েল কোন সিনেমাতেই আন্দালুসিয়ান কুকুরের ধারে কাছে যেতে পারেনি। এটা বোধয় সম্ভব হয়েছিল একমাত্র এই দুই ব্যক্তির সহাবস্থানের কারনেই।
অনেকের ধারনা এটা প্রথম স্যুরিয়াল ফিল্ম কিন্তু ধারনাটা সত্য নয়। তবে এটাই পৃথিবীর প্রথম পরিপূর্ণ স্যুরিয়াল ফিল্ম এবং আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে- এই ফিল্মটা পৃথিবীর প্রথম ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম অর্থাৎ বলা যায় ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার দের পথিকৃৎ লুই বুন্যুয়েল।
যাহোক- এই ফিল্ম তৈরির সময় দুই শিল্পীর ই অত্যন্ত কাঁচা বয়স তারা কেবল স্যুরিয়ালিজম এর গোলোক ধাঁধায় ঢুকেছেন- দালির মাথায় তখনো সফটিজমের ভূত পুরাপুরি ঢোকেনি কিউবিজম ও পিউরিজমেই আটকে ছিলেন,২ তারপরেও সেই সময়েই তিনি সফটিজমের খ্যালা ঠিকই দেখিয়েছেন এই সিনামায় তার ব্যাখ্যায় পরে আসছি।
সিনেমাটা ১৯২৯ সালে তৈরি প্রায় ৮৪ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও এটা এখনও সেরার তালিকায় আছে এমন কি শুরু থেকে শেষ অবধি সিনেমাটা নিয়ে বিতর্ক দিন দিন বাড়ছে কমছে না- যতই দিন যাচ্ছে মাস্টারপিস হিসেবে সিনেমাটা ততই দৃঢ় অবস্থানে আসছে।
এরকম একটা উদ্ভট বিতর্কিত সিনেমাকে আমি ব্যখ্যা করতে যাবনা, সে জ্ঞান ও আমার নাই আমি কেবল সিনেমার কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবো।
সিনেমার শুরুতেই বুন্যুয়েল এবং দালি আমাদের ব্যপক আকারে ধাক্কা দ্যান- শুরুতেই আমরা দেখি একজন মানুষ(বুন্যুয়েল) একটা ক্ষুর ধার দিচ্ছে- তারপর সে ব্যাল্কনি তে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষন চাঁদ দ্যাখে অতঃপর একজন মহিলার(সিমন ম্যারিউইল) চোখ দুই ভাগ করে কেটে ফ্যালে এবং একই সঙ্গে একটা ধারালো মেঘ চাঁদ টাকে দুই ভাগ করে কেটে চলে যায়। এইরকম একটা উত্তেজক বীভৎস দৃশ্য দিয়ে বুন্যুয়েল প্রথমেই আমাদের ভীতি তৈরি করেন এবং তারপরেই আমরা দেখি আট বছর পরের ঘটনা এবং সেখানে সেই একই মহিলা (সিমন ম্যারুইল) সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায়, তার চোখ কাটার কোন লক্ষন ই নাই। তাতে আমরা দর্শকরা কিছুটা শান্ত হই – যাক বাবা মহিলা ঠিক আছে।
এরপর নানের পোশাক পরে একজন(পিরে ব্যাৎশেফ) সাইকেল চালাইতে চালাইতে এক্সিডেন্ট করে ম্যারুইল এর বাসার সামনে, ম্যারুইল বিচলিত হয়ে নিচে নেমে দ্যাখে সাইকেল আরোহী মৃত- এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় একজন পুরুষ নানের পশাক পরে আছে অর্থাৎ এখানে তাঁরা কেবল একজন মানুষ রিপ্রেজেন্ট করেছেন কোন স্ত্রীলোক বা পুরুষ ত নই ই এমন কি হিজড়াও নয় (আমার ধারনা)
এবং মৃত ব্যক্তির নানের সেই পোশাক বিছানায় মানুষের মত সাজিয়ে ম্যারুইল বসে থাকেন-
এরপর ই আবার ও আমরা পিরে ব্যাৎশেফ কে দেখি কিন্তু এবার তার ভিন্ন রুপ, পরেরবার আগমনের সময় ই দ্যাখা যায় ব্যাৎশেফ এর হাতে পিঁপড়া ধরে আছে, পিঁপড়েরা তার হাত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, ব্যৎশেফ আর আর ম্যারুইল হাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে- পিঁপড়ে কে দালি তাঁর বিভিন্ন পেইন্টিংস এ ব্যাবহার করেছেন কোথাও তিনি পিঁপড়ে কে নারীর সিম্বলিক রুপে ব্যবহার করেছেন আবার কোথাও ধ্বংস বা ক্ষয় বোঝাতে ব্যবহার করেছেন।৩ এখানে দর্শক কিভাবে পিঁপড়ে কে দেখবেন তাঁর ব্যাপার তবে আমার মনে হয় এখানে দালি ও বুন্যুয়েল একজন ক্ষয়ে যাওয়া নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষ বুঝিয়েছে- অথবা এমন একটা সময় কে বুঝিয়েছেন যা আসলে নষ্ট হয়ে গেছে।
তারপর জানালা দিয়ে রাস্তায় একজন তরুণীর এক্সিডেন্টে মৃত্যু হওয়া দেখে ব্যাৎশেফ এর কাম জাগে- সে ম্যারুইল কে ধর্ষণের চেষ্টা করে সেই সময় আমরা দেখি তাঁর হাতের পিপড়ার পরিমান বেড়ে যায়-
ব্যর্থ হয়ে- ম্যারুইল এর বাধায় আশাহত ব্যাৎশেফ কে হঠাত দ্যাখা যায় দুইটা গ্র্যান্ড পিয়ানো টানতে একটা পিয়ানোর সাথে একটা পোঁচে যাওয়া গাধা বাধা আছে আর একটা পিয়ানো তে একজন প্রিস্ট বাধা আছে। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে প্রিস্ট টা হচ্ছে সাল্ভাদর দালি। আর একটা ভয়াবহ স্যুরিয়াল দৃশ্য- এর আগে দালির যে কোন পেইন্টিং এ পিয়ানোর ব্যাবহার দেখেছি মুক্ত জায়গায় যেমন বিস্তৃত মাঠ- সৈকত এ কিন্তু বদ্ধ ঘরের মাঝে পিয়ানো তে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা ঈশ্বর মালুম। আর পোঁচে যাওয়া গাধা দিয়ে তিনি তাঁর বিখ্যাত সফটিজমে ফিরে এসেছেন। সাধারনত পিয়ানো এবং পোঁচে যাওয়া গাধা দিয়ে বেশ কিছু জায়গায় তিনি শুদ্ধতম সঙ্গীত কে বুঝিয়েছেন৪ – এমন কি ‘দ্য রটিং ডাঙ্কি’ তাঁর একটা চিত্রকর্ম ও আছে। পোঁচে যাওয়া গাধা অর্থাৎ মাংশ খসে পড়া গাধার কঙ্কাল কে তিনি বহু জায়গায় শুদ্ধ বা শুভ্রের প্রতীক হিসেবে ধরেছেন কিন্তু এই জায়গায় তিনি কি বুঝিয়েছেন তা দর্শকের ব্যাপার।
এরপর দেখি ব্যাৎশেফ বিছানায় শুয়ে আছে ঘরে আর একজন লোকের আবির্ভাব হয় সেই আগুন্তুক ও ব্যাৎশেফ অর্থাৎ ব্যাৎশেফ এর ডুয়েল রোল কেবল পার্থক্য হচ্ছে আগুন্তক ব্যাৎশেফ এর বয়স কিছুটা বেশি মনে হয় সে প্রথমে নানের পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় এবং তারপর প্রথম ব্যাৎশেফ কে কটাক্ষ করে এরপর সে কিছু বই দ্যাখে সে সময় ফিল্ম স্লো মোশানে চলে বইগুলা বন্দুক হয়ে যায় এবং প্রথম ব্যাৎশেফ আগুন্তুক ব্যাৎশেফ কে খুন করে।
সিনেমাটার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় হচ্ছে ম্যারুইল এবং ব্যাৎশেফ আসলে কয়েকটা চরিত্রে অভিনয় করেছে-
ব্যাৎশেফ কে প্রথমে সাকেল আরোহী হিসেবে দ্যাখা যায় তাঁর বয়স তখন অল্প চেহারায় নিষ্পাপ একটা ভাব থাকে- এরপর যে ব্যাৎশেফ এর আগমন হয় তাঁর চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন সে একটা পার্ভার্ট এবং এর পর আগুন্তুক ব্যাৎশেফ এর আগমন হয় তাঁর চরিত্র আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কড়া মেজাজের। এখানে দুই ব্যাৎশেফ এর বয়সের পার্থক্য আছে এমন ও হতে পারে যে প্রথম জন হচ্ছে আসলে ব্যাৎশেফ এর অতীতের ভুল যা ব্যাৎশেফ কে হত্যা করছে।
আবার ম্যারুইল বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম শুরুতে সে স্বেচ্ছায় তাঁর চোখ কেটে ফেলতে দ্যায়- আবার তারপর সে ম্রিত্যুতে বিচলিত হয়- কমনীয় এক চরিত্র- এবং তারপর সে সম্ভ্রম রক্ষার্থে বিচলিত হয়- এবং শেষে সে শিশুর মত নিষ্পাপ আর সাবলীল হওয়ার চেষ্টা করে।
আমার কাছে সিনেমার অন্যতম একটা বড় রোল মনে হয়েছে একটা জড় পদার্থ কে অর্থাৎ সেই কাঠের বাক্স কে- সাইকেল আরোহীর গলায় যার আগমন তারপর ম্যারুইল সেখান থেকে একটা টাই বের করে- এরপর আমরা সেই বাক্স দেখি রাস্তায় তরুণীর হাতে তখন তাঁর মাঝে ঢুকিয়ে রাখা হয় কাটা হাত টা- এবং শেষে সাগর সৈকতে বাক্সটাকে দ্যাখা যায় ভাঙ্গা অবস্থায়। যার ভাঙ্গা টুকরোকে অবহ্যালায় ছুঁড়ে ফ্যালা হয়।
পরো সিনেমায় বুন্যুয়েল দর্শকের ওপর একটা মানসিক চাপ দিয়ে রেখেছেন এবং বিভ্রান্ত করে গেছে টানা। সিনেমায় তিনি ব্যক্তিত্ব কে অতিক্রম করেছেন কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বে চরিত্র স্থির ছিলনা, ব্যক্তিত্বের এলোমেলো বিচরনের সাথে আছে সময় ও স্থানের এলোমেলো বিচরন- চরিত্রের অস্বচ্ছতা অর্থাৎ এম্নিতেই চরিত্রের কোনো স্টাব্লিশ্মেন্ট নাই তাঁর ওপর এই থারমোমিটারের মত ব্যক্তিত্বের ওঠানামা স্বাভাবিকভাবেই মানসিক চাপ ফ্যালে। আর সময় কে তো তিনি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো দর্শক দের হাতে দিয়ে দিয়েছেন – এখন ইচ্ছেমত সাজাও তোমরা। স্থানের ক্ষেত্রেও তিনি তাই করেছেন। জীবন- বাস্তবতা- অবাস্তবতা এর মাঝে দর্শক কে ঘোরাইতে থাকে প্রতিনিয়ত।
সর্বোপরি আমার দ্যাখা শ্রেষ্ঠ উদ্ভট ফিল্ম অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্যারাডক্স। মাত্র সতের মিনিটের এই ফিল্ম বুন্যুয়েল এর অন্যান্য কাজ কেও হার মানায়। আর ফিল্ম কি প্রকাশ করছে তা পুরাটাই দর্শকের ওপর নির্ভরশীল এ কারনেই আমি আমার ব্যক্তিগত অনুভব এখানে প্রকাশ করিনি- কিছু জিনিস ব্যক্তিগত থাকা ভালো-
সব দৃশ্য একা দ্যাখাই ভালো- মনোসরণি
দর্শকরা যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ফিল্মটার অর্থ তৈরি করে নিতে পারেন- বুন্যুয়েল নিজেই বলেছেন
‘Our only rule was very simple, No idea or image that might lend itself to a rational explanation of any kind would be accepted’ – বুন্যুয়েল ৫
১ “Bunuel” written by John Baxter
২ ‘Salvador dali’ by leonie bennett
৩‘Salvador dali’ by leonie bennett
৪ ‘Salvador dali’ by mary ann caws
৫ ‘A companion to Luis benuel’
পিনাক পাণি (নিবন্ধিত নাম)
---------------------
#### গ্রেপ্তারকৃত ব্লগারদের অবিলম্বে মুক্তি চাই ####
মন্তব্য
দেখার ইচ্ছা আছে
facebook
সময় করে দেখে নিয়েন
নতুন মন্তব্য করুন