শীতের মধ্যে হুট করে কুয়াকাটা যাওয়ার পিনিক উঠলো- সাগর দেখিনা বহুদিন। পোলাপাইন অর্থাৎ রিমন,কিরন, আমি মিলে সিলেট থেকে রওনা দিলাম ঢাকা, ঢাকায় তাবু রাখা ছিল- ঢাকায় জুটলো দুইজন- রফি ভাই এবং তুর্য। ঠিক হল তিন দিন এর ট্যুর হবে সুতরাং তিন দিনের রসদ কিনে নিলাম রেডি মিক্স খিচুড়ি, নুডুলস- চকোলেট, চা চিনি ইত্যাদি- বালিশ ছিলনা পাঁচ টা ইনফ্লাটেবল বালিশ কিনে নিলাম বায়তুল মোকাররম থেকে। সিলেটে এবং ঢাকায় তখন কড়া শীত সিলেটে আট – দশ ডিগ্রী থাকছে তাপমাত্রা, সুতরাং ব্যাগ ভর্তি শীতের কাপড় নিলাম। প্রথম থেকেই ভয় পাচ্ছিলাম এই শীতে ক্যাম্পিং এ বিপদে পড়বো ভেবে- তারপরেও হুজুগের বাঘ কি সহজে মরে! সুতরাং আমরা সাতপাঁচ না ভাইবা সোজা বরিশালের লঞ্চে। ইন্সট্যান্ট ডেকের টিকেট কেটেছি দোতলার ডেকে কম্বল পেতে শুরু হল ২৯, আমি বাদে সবারই প্রথম লঞ্চ জার্নি কিন্তু ঠান্ডার প্রোকোপে বেচারারা জার্নিটাও ঠিকমতো উপভোগ করতে পারলো না- রাতে সবায় প্রায় ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু আমাদের ঘুম নাই – ডেকের টানানো পর্দা উড়ে হু হু করে বাতাস ঢূকছে। রিমন মাথায় ঢুকল ডেকের ভেতরেই তাবু ফ্যালার আইডিয়া। আইডিয়া কম বেশি সবাই পছন্দ হইল কিন্তু ডেকের অন্যান্য যাত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে এবং সকালব্যালা তাবুর নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্ষান্ত দিলাম। ভোরে বরিশালে পৌঁছে লঞ্চ ঘাটের পাশে কেবল চা পরটা খাইতাছি এমন সময় এক পাগল এর সাথে দ্যাখা- পাগল জিগাইলো আমরা কই যাবো, কুয়াকাটা যাওয়ার কথা বলতেই পাগল বলল বাস তো এখনি ছাইড়া গ্যালো- আপ্নারা এখনি ট্যাম্পু নিয়া গেলে বাস পাইবেন। সকালের প্রথম চা পরটা আধা খাওয়া অবস্থায় রাইখাই আমরা ভোঁ দৌড়- লঞ্চ ঘাটায় পাগল নিজ গরজে একটা ট্যাম্পু ঠিক কইরা দিল বিদায় দেয়ার আগে বেচারার বেশ মন খারাপ দখলাম বোধয় দশটা টাকা বকশিশ আশা করছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বসলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মানসিক অবস্থা তখন বকশিসের অনেক ঊর্ধ্বে। টেম্পু তে করে বরিশাল শহরের ভেতর বাসস্ট্যান্ড এ গেলাম(জায়গাটার নাম ভুলে গেছি) সেখানে গিয়ে দেখি বাস তখনো আসে নাই- তারা বলল যে বাস লঞ্চ ঘাটাতেই আছে সেখান থেকেই ছাড়বে- আমরা লঞ্চ ঘাটাতেই বাসে উঠতে পারতাম। ভাইবা দেখলাম পাগলের উপর চেইতা লাভ কি চিলের পিছনে তো আমরাই দউড়াইছি।
যাহোক বাস আসার পর দেখলাম সেখানে তিল ধারনের জায়গা নাই তারপরেও কন্ডাক্টারের সহমর্মিতায় আমাদের ইঞ্জিনের সিটের ওপর জায়গা হইলো। রিমন বাস ড্রাইভার রে জিগাইলো কতক্ষনের জার্নি- উত্তের আসলো- পাঁচ ঘন্টা। রিমন উইঠা বলে আমি এই বাসে যাব না- নাইমা পড়। যাহোক তারে বুঝাইলাম শীতের দিনে পশ্চাদ্দেশে গরম অনুভুতি খারাপ না- সুতরাং ইঞ্জিনের ওপর বইসা যাওয়া যায়। যাহোক এক বিভীষিকাময় যাত্রার শুরু হল- ইঞ্জিন আমাদের পাঁচ জনের পশ্চাদ্দেশ এক সঙ্গে নিতে অপারগ- সুতরাং আমদের একজন কে পালাক্রমে দাড়ায়া থাকতে হইল- সাম্নের মহিলা সিটের আন্টিদের সাথে ব্যাপক গল্প গুজব ও হইল। জানলাম এলাকার বহুত কথা কোন এলাকা ক্যামন কোন এলাকার লোক কেমন, আন্টিদের পরিবারের কথা। যাহোক অবশেষে কুয়াকাটা পৌঁছাইলাম।
আগেই ঠিক করা ছিল আমরা কুয়াকাটায় থাকবো না- সুতরাং নেমে এক বোতোল স্পিরিট কিনলাম চুলার জন্য এবং রউনা দিলাম ‘নেম্বুর চর’ এর উদ্দেশ্যে। ঠিক ছিল নেম্বুর চলে যেয়ে আজকের রাত টা ক্যাম্প ফেলবো- সৈকত ধরে হেটে গেলে নেম্বুর চর পাঁচ কিলো- আমরা হাঁটার সিদ্ধান্তই নিলাম। সইকতের পথে প্রচুর মরা মাছ পড়ে ছিল- এক জায়গায় দেখলাম ছেড়া জালের সাথে তিনটা বেলে মাছ আটকে আছে। রফি ভাই চাকু দিয়ে মাছ গুলোকে জাল থেকে ছড়িয়ে সাগরে ছেড়ে দিল। একের পর এক শুটকি পল্লী পড়েছে পথে- শুটকির দাম শুনে চাটগা এর পোলা তুর্য তো বাস্তা খানেক কিনতে চাইলো।
যাহোক আমরা প্রায় আঠারো ঘন্টার নির্ঘুম ভ্রমনে বেশ ক্লান্ত সুতরাং হাঁটার গতি ও ধীর ছিল- পথে একজন কে জিজ্ঞেস করি নেম্বুর চর কতদুর সবাই বলে অনেক দূর যাইতে যাইতে রাইত দশটা হয়ে যাবে। ভয় পেয়ে গেলাম যাহোক তারপরেও হাঁটতে থাকি প্রয়োজনে পথেই ক্যাম্প ফেলবো। কিন্তু ধীর গতির তিন ঘণ্টার হাটা শেষে সন্ধার পর পর পৌছুলাম নেম্বুর চর। পথে সন্ধার পর দেখলাম সৈকতে এক জায়গায় কিছু মানুষ কি যেন করছে কাছে গিয়ে জানতে পারলাম সেটা তরমুজের খেত তারা পাণি দিচ্ছে ক্ষেতে। জিজ্ঞাসা করলাম রাতে পাণি দেন সমস্যা হচ্ছে ন? তারা আকাশে চাঁদ দেখিয়ে বলল ওইযে আমাদের বাতি জ্বলে।
নেম্বুর চরে সোলাইমান এর দোকান আছে সেখানে তাঁকে ভাত রাঁধতে বলা হল তাঁর মাছের বাক্স থেকে একটা ইলিশ ভাজতে বলা হল সঙ্গে ডাল।
সারাদিন পর ব্যপক খানা দানা।
আকাশে পূর্ণ চাঁদ- সৈকতে কেবল দুইটা দোকান তাঁর সামনে বেঞ্চিতে গরম ভাত- মাছ ভাজা- পেছনে জঙ্গল। সেই সময় আমার মনে হলো পৃথিবী তে এর চেয়ে আদিম কোন সৌন্দর্য থাকতে পারে না। যাহোক সন্ধার পরেই কনকনে ঠান্ডা পড়লো আমাদের জত কাপড় ছিল পড়ার পড়েও ঠান্ডা মানছিল না। প্রায় পাঁচ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এদিকে হু হু বাতাস। খাওয়া দাওয়ার পর আমরা জঙ্গল দিকে এগিয়ে গেলাম পেছনে জঙ্গল রেখে বস্তা ফেলে বসলাম সৈকতের দিকে । সাগর- বন-জঙ্গল- সব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। পৃথিবীর এই আদিম রুপের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করলাম কিভাবে রাত বারটা বাজলো বুঝি ই নাই। সেরার পথে দেখি চাষিরা পাণি দিচ্ছে তখনো। তাঁদের সাথে কিছুক্ষন গল্প করে তাঁবুতে আসলাম।
বিপত্তি বাধলো রাত্রে তাবু ফেলে ঘুমানোর সময় দেখছি নিচে বালি থেকে হুহু করে ঠান্ডা উঠছে- আমাদের স্লীপিং ব্যাগ নাই- পাতলা কম্বল ঠান্ডা আটকাইতে পারলো না।
ভোরব্যালা উঠে দেখি সবার ই ঠান্ডা লেগে গেছে। রিমন বেশ কাবু। আমাদেরার কয়েক জায়গায় যাবার কথা ছিল কিন্তু শারিরিক অবস্থার কারনে যাওয়া আর সম্ভব হলো না। সকালে উঠে চা চুলা ধরিয়ে চা বানাইলাম। নুডুলস করলাম। রাত্রে সোলাইমান ভাই কাঁকড়া নিয়ে এসেছিল। সকালে কাঁকড়া ভেজে দিল। নুডলস এর সাথে কাঁকড়া ভাজি। খারাপ না। এদিকে আমাদের তাবুর চারপাশে জেলেদের ভীড় জমে গেছে। খাওয়া দাওয়া শেষে জেলেদের সাথে গল্প জমে উঠলো। তারা মাছ ধরতে গ্যালো কিছুক্ষন পর দেখি আট দশটা ইলিশ হাতে ফিরে আসছে। মাঝ ধরা শেষে এক জেলে কাদের মামা আমাদের বলল ‘চলেন মামা আপনাদের ঘুরায়া নিয়ে আসি’ ।
এই কথার অপেক্ষায় ই ছিলাম, নৌকায় তেল কিনে মামা কে নিয়ে চলে গ্যালাম সাগর ওপাশে সুন্দরবনের এই মাথায়। এই প্রথম আমার ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট দ্যাখা স্বাভাবিক ভাবেই আপ্লুত। সারাদিন ঘুরলাম জঙ্গলে হাইকিং আর জঙ্গলের ভেতরর সরু খালে ঘুরে ব্যাড়াইলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে দ্যাখা হলো ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে। তাঁকে অনুরোধ করে সেই জঙ্গলের ভেতরে ক্যাম্প ফ্যালার অনুমতি নিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে রিমনের শরীর বেশি খারাপ হতে শুরু করলো সুতরাং আমাদের পক্ষে আর মুভ করা সম্ভব হলো না। ফিরে আসলাম নেম্বুর চরে। আগের রাতে ঠান্ডায় কষ্ট পাওয়াতে পরের রাতে জেলে রা তাঁদের নৌকা থেকে বেশ কিছু কাঁথা কম্বল দিয়ে গ্যালো আমাদের । আমরা তাবু ফেলে মধ্যরাত পর্যন্ত জেলেদের সাথে আডডা দিলাম। কোথাও ব্যাড়াইতে গেলে – আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় সেখানকার মানুষ- তাঁদের সুখ দুঃখের গল্প। সে রাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া দুই প্যাকেট খিচুড়ি রাধালাম সোলাইমান ভাই এর চুলায়, ডিম ভেজে সবাই মিলে অর্থাৎ আমরা- জেলেরা- শুটকি ব্যবসায়ীরা নয়জন মিলে খানা হইল।
আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছে হলেও শারিরীক অসুস্থতার কারনে পরদিন আমরা ফিরে আসি ভারী ব্যাগপ্যাক আর মাথা ভর্তি জঙ্গল- জ্যোৎস্না- সমুদ্র- ঢেউ এর গর্জন- শ্বাসমূল আর অনেকগুলো মানুষের গল্প নিয়ে- কাদের জেলে- সোলাইমান- সোলাইমান এর তিন ভাই- পরিবার- কাদের জেলের সন্তান- সৈকত পাড়ের তরমুজের ক্ষেতে মধ্যরাতে সেচ দেয়া চাষি আরো আরো কত নাম না জানা জেলে কত মানুষের গল্প!! জেলেদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম সে সময়, তারা ঠান্ডায় কষ্ট হবে বলে নিজেদের বাসায় নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়েছিল আমাদের, আমরা যাবনা দেখে কাঁথা কম্বল দিয়ে গিয়েছিল। একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল রেমা কালিঙ্গার জঙ্গলে, সে গল্প পরে একদিন হবে। এ দেশের মাটি মানুষ আসলেই এতো বেশি আপন, মাঝে মাঝে নিজের সৌভাগ্যে কান্না আসে। মেঘদলের ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা’ অ্যাল্বামে সম্ভবত এরকম একটা কথা ছিল-
‘লালনের দেশে জন্মেছি বলে আমরা গর্ববোধ করি’ ।
-- মুক্তি পাওয়া বেলে মাছ
-- এভাবেই পড়ে আছে অসংখ্য মৃত মাছ
--- শুটকি পল্লিতে রফি ভাই এর সতর্কতা
-- নেম্বুর চরে সাগর ও জঙ্গলের সহাবস্থান
-লাকড়ি সন্ধানে শিশু -
-কুয়াকাটা সৈকত (শীতের কুয়াশার কারনে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের কোন অংশই ভালোভাবে দ্যাখা যায় নি)
-সাগরের ধারের জঙ্গল এদিকটার জঙ্গল পাতলা ভিতরের দিকের জঙ্গল ঘন
-সাগর পেরিয়ে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের সরু খাল
-- জেলে নৌকো
--ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট
-ঠান্ডায় সকাল পেরোনো ঘুম
-- তাঁবু বসতি
-- সোলাইমান ভাই এর কাঁকড়া ভাঁজা
- মাছ ভাঁজা
-- কাঁকড়া সহযোগে নুডুলস
--- ফিরে আসা।
------
পিনাক পাণি (নিবন্ধিত নাম)
মন্তব্য
ছবিগুলোও দারুন।
সুবোধ অবোধ
উফফ!! লোভ লাগায়া দিলেন মিয়া। দেখি এই গরমে যাওনের মতন কাউরে পাই কিনা!!
ঘুরে আসেন, গরমে আরো ভালো কাটবে সময়
ছবি মোটামুটি হলেও ভাষা ভাল লাগে নাই। ১ম লাইনেই শীতের মধ্যে হুট করে কুয়াকাটা যাওয়ার পিনিক উঠলো- পিনিক কি ! মানে কোথায় আছে এই শব্দ ?
facebook
'পিনিক' শব্দের কোন শৈল্পিক বা সাহিত্যিক গুনাবলি নাই। নিতান্তই একটা চলতি শব্দ। তবে শব্দটা আমার পছন্দের সে কারনেই ব্যবহার করি।
এই শব্দ কোথাও নাই অণু'দা, এর কোন শৈল্পিক বা সাহিত্যিক গুণাবলী নাই। নিতান্তই একটা চলতি শব্দ- কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমার পছন্দ। এ কারনেই ব্যবহার করি।
সহমত!
নুডলসে কাঁকড়া এত কম ক্যান? ঠগাইসে
কাঁকড়াভাজি উপাদেয় মনে হইতেছে. লেখা ছবি ভালু পাইছি
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ নুডুলস রান্না হওয়ার আগেই কাঁকড়া সাবাড় কইরা দিছি
আমি নভেম্বর এ গিয়েছিলাম। পুরনো স্মৃতি আবার জেগে উঠলো।
---------------------
মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান
কতবার যেতে যেতে যাওয়া হলনা ! এখন দেশের যে অবস্থা ! প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠেছে ! আচ্ছা কাকড়াভাজা খেতে কেমন ? আমি কখনো খাইনাই । এবার গেলে খাবই খাব ।
না খেলে তো বুঝবেন না কেমন ঃ০ তবে আমার চমৎকার লাগে।
ছবিগুলো ভাল লাগল।
কাঁকড়া সহযোগে নুডুলস কেমন ছিল খেতে?
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
চমৎকার
কাঁকড়া সহযোগে নুডুলস....
ঘুরাঘুরি দেখলেই মনে দুঃখ হয়।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ছবিগুলো দারুণ।
- ইউক্লিড
http://www.facebook.com/iEuklid
কুয়াকাটা থেকে কতদূর সুন্দরবন ?
নতুন মন্তব্য করুন