মায়া

সুবোধ অবোধ এর ছবি
লিখেছেন সুবোধ অবোধ (তারিখ: মঙ্গল, ২৩/০৪/২০১৩ - ৩:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

পুলিশ ষ্টেশনের ঘন্টা যেন কেমন! একঘেয়ে, বিষন্ন আর মাঝে মাঝে ভূতুড়ে! রাত ১২ টার ঘন্টা আরও বেশি কেমন কেমন! একে তো মাঝরাত তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার ঘন্টা এই সময় টাতেই বাঁজে।
ঢং ঢং ঢং...
গুনে গুনে ১২ বার। রাতের নিরবতা আর গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে প্রতিটি ঘন্টার বাড়ি যেন বুকে এসে আঘাতকরে। আর যদি সেই ঘন্টা শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাহলে তো কথাই নেই।

গাছপালা ঘেরা বাড়িটাতে সন্ধ্যার পর এমনিতেই কেমন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়! চাঁদ না উঠলে গাঢ় অন্ধকার আর চাঁদ উঠলে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোতে কেমন মায়া মায়া একটা অন্ধকার! সে আলোতে বড়রাও বাড়ির একমাথা থেকে আরেকমাথায় যেতে অসস্তিতে ভোগে আর ছোটরা তো পারলে বাইরের দিকে না তাকিয়েই বাঁচে। তাই সন্ধ্যা হলেই বাড়িটা অনেক শুনশান! আর মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় ডেকে উঠে বেরসিক হুতুম পেঁচা। শুধু আমাদের বাড়ি না,এখানকার প্রতিটা বাড়িই এমন শুনশান হয়ে যায় সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষন পর।

আমার বেড়ে ওঠা মফস্বলে। পাশেই গ্রাম,তাই মফস্বলের সাথে শহর শব্দটা জুড়ে না দেয়াই ভাল। যদিও স্কুল,কলেজ,বাজার সবই আছে। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে গ্রামের ভাবটাই বেশি। কলেজ পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত যে মায়া মায়া অন্ধকার আমাকে স্বপ্নাতুর করে তুলত,আজ ৪ বছর যাবত ঢাকা থাকার ফলে সেই অন্ধকার আমাকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে! ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠৎ করেই ঢং ঢং ঢং...
চমকে জেগে উঠি সেই শব্দে। অনেকদিন পর এবং হঠাৎ ঘুম ভাঙায় কিছুক্ষন সময় লাগে বুঝতে যে এটা আসলে থানার ঘন্টার আওয়াজ। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকি বিছানায়। বুকের মধ্যে হাতুরি পেটানো বন্ধ হয় ধীরে ধীরে। উঠে গিয়ে পানি খাই,জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। আজ অর্ধেকটা চাঁদ উঠেছে। সে চাঁদের আলোতে উঠান টা যেন অতিপ্রাকিতিক কোন নাটকের মঞ্চ হয়ে আছে! হালকা একটা বাতাস বয়ে গেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। কেমন একটা ঝিরিঝিরি শব্দে পাতারা যেন হেসে স্বাগতম জানালো সেই ঠান্ডা ভেজা বাতাস কে। কাছেপিঠে কোথাও বোধয় বৃষ্টি হয়েছে। জানালা খোলা রেখেই বিছানায় ফিরে আসি। আরামদায়ক একটা ঠান্ডা ঘরটাতে বিরাজ করে। কখন যেন ঘুমিয়ে যাই টের পাই না।

২.

সকাল হলেই বাড়িটার চেহারা পাল্টে যায়। রাতের শুনশান নিরবতা কোথায় যে পালায়?! সারা বাড়ি জুড়ে কথা আর কাজের শব্দের আধিপত্য বিরাজ করে। ঘুম ভেঙ্গে উঠে বাইরে আসার সাথে সাথেই মা তারা দেন-“তারাতারি হাত মুখ ধুয়ে নে,খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”
আমি হাসি-“হোক না।”
-“ঠান্ডা হলে ভাল্লাগবে না,তারাতারি...”
আমি হাতমুখ ধুতে কুয়াতলায় চলে যাই।

এবার বেশ কিছুদিন পর বাড়ি ফেরার কারণে সব কেমন যেন অপরিচিত লাগে। অনেক কিছুই পাল্টে গেছে এই ৫/৬ মাসে। বাড়ি থেকে বের হয়েই পুকুরের নতুন বাঁধানো ঘাট চোখে পড়ে। আগে ছিল না।
“কবে আসলা?”-ঘুরে দেখি পাশের বাড়ির পল্টুর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন।
-“গত রাতে কাকা,সন্ধ্যার পর। কেমন আছেন?”
-“এইতো বাবা,ভালো। তোমার পড়ার আর কয়দিন বাকি? শেষ নাকি?”
-“না কাকা,আর এক বছর।”
-“আছো তো কয়েকদিন?”
-“হ্যা”
-“কই যাচ্ছিলা?”
-“সামনেই”
-“আচ্ছা যাও”

বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তা টা এখন পিচ ঢালা পথ। একপাশে পুকুর আরেক পাশে ছোট মাঠ। ছোট বেলায় যে মাঠে ছিল আমাদের গোল্লাছুট,কাঠকাঠুরে ভাই,ইচং বিচিং সহ আরো নানারকম খেলাধুলার চারণভূমি। এখন সেখানে গোবর শুকানো হচ্ছে! মনে হয় না আজকালকার বাচ্চারা খেলার সুযোগ পায়। সকালে ভাড়ী ব্যাগ নিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার মিছিল যায় এই রাস্তা দিয়েই। সাথে থাকেন ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে অতি সচেতন বাবা কিংবা মায়েরা। স্কুল থেকে ফিরেই আবার কোচিং। মায়াই লাগে। আহা! শৈশব!! অতি সচেতনতায় পিষ্ট শৈশব!!!

কিছুক্ষন ঘুরঘুর করে বাড়ি ফিরে আসি। বন্ধুবান্ধবরা কেউ এখন এলাকায় নেই। সবাই যার যার ভার্সিটি তে। দেখা সাক্ষাতই হয় না তেমন দুই ঈদের ছুটি ছাড়া। ঘরে ঢুকতেই মা ডাকেন-“এদিকে আয়,কথা আছে।”
-“হুম বল”
-“আগামি মাসেই তো এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে,নোটিশ দিছে”
-“নোটিশ দিছে?! কেন?”
-“তোর আব্বার তো চাকরী শেষ,নোটিশ তো দিবেই।“
-“তা তো বুঝলাম,কিন্তু আব্বা না টাকা পায় এখনো এদের কাছে?”
আমার বাবা স্থানীয় এই কলেজে শিক্ষকতা করেছেন ৩৪ বছর ধরে। মফস্বল এলাকার কলেজে যা হবার তাই হোত। ছাত্ররা কেউ ঠিক মত বেতন দিত না সারা বছর। আর ইন্টার পরীক্ষার আগে শুরু হত গভার্নিং বডির বিভিন্ন মেম্বারদের দিয়ে তদবির। মাঝে মাঝে এমনও হত যে ফর্ম ফিলাপের টাকা কলেজ থেকে ভর্তুকি দিয়ে দিতে হত! অথচ স্থানীয় প্রভাবশালীরা এবং গভার্নিং বডি মেম্বাররা তাদের ভোটার রক্ষার জন্য কলেজের উপর এই চাপ দিয়ে আসত প্রতি বছরই। ফলাফল শিক্ষকদের বেতন বাকি! বিভিন্ন সমইয়ে বেতন বাকি থাকতে থাকতে সেই এমাউন্টটা প্রায় ৪ লাখ এ গিয়ে ঠেকেছিল। সেই টাকা না দিয়ে তারা এখন বাসা ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছে!
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি বলি-“নোটিশ দিলেই ছাড়তে হবে? টাকা না দিলে যাব কেন?”
বাবা বলে-“ঝামেলা করার দরকার কি? বলছে তো দিবে আস্তে আস্তে,এখন নাকি টাকা নাই ফান্ডে।”
-“এদের তো কোন কালেই টাকা থাকে না!”
মা পাশ থেকে বলে-“অযথা রাগ করতেছিস কেন? এমনিতেই তো যেতে হবে। টাকা তো দিবেই বলছে আস্তে আস্তে।”
আমি আর কিছু বলি না। আমার জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠা এই বাসাতেই। ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা দিনের সাথে এই বাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি ঘর থেকে বেড় হয়ে উঠানে আসি। নিজের হাতে বোনা কলাবতি গাছটার একটা পাতা ঠিক যেন জিভ বেড় করে ভেংচি কেটে আছে আমাকে। নিজের হাতে করা বাগানের দিকে তাকাই। বাড়ি ছাড়ার আগ পর্যন্ত আমি আর মা মিলে বাগান করতাম। সেই কত আগের বেলি ফুল গাছটা এখনো আছে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করি। বাগানবিলাসের লতা কাঠাল গাছ বেয়ে উঠে গেছে সেই কত উচুতে। উপর থেকে ঝুঁকে উকি দিয়ে কচি ডগাটা যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করে-“পারলে এসে ধর” বলে। সম্পর্কের বেড়াজাল ছিড়ে আরো উপরে উঠে যাওয়ার যেন নেশা চেপেছে তার। আমি চোখ ফিড়িয়ে নেই। অবুঝ লতা কি আর বুঝবে আমাকে?! নিচু হয়ে ছুঁয়ে দেই ঘাস ফুলের ঝাড়। চুপচাপ বসে থাকি কিছুক্ষন বাগানের মধ্যে।

উঠে এসে ঘরের দেয়াল স্পর্শ করি। এক কোনাতে সেই ছোট্ট বেলায় খোদাই করে লেখা নিজের নাম চোখে পরে। হাত বুলাই। পরিচিত দোয়েল পাখিটা লেবু গাছটার উপরে এসে বসে আমার দিকে একবার বাঁকা চাহনী দিয়ে আবার উড়ে গেল। সব কিছুকেই হঠাৎ বড় পর মনে হয়। এতদিন ধরে একসাথে বেড়ে উঠেও কিছুই যেন নিজের না। আম গাছটাতে ঠেস দিয়ে উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকি। কত কিছুর সাক্ষীই না হয়ে আছে এই উঠান। গত রাতে যে উঠানকে অতিপ্রাকিতিক নাটকের মঞ্চ মনে হচ্ছিল,তাকে এখন স্মৃতির মঞ্চ মনে হচ্ছে! হঠাৎই যেন সেই মঞ্চে ছোট্ট আমাকে বৃষ্টির পর কাঁদা পানিতে গড়াগড়ি দিতে দেখি। গড়াগড়ি দিতেদিতেই আবার ঝুম বৃষ্টি নামে। উঠে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে লাফায় সেই ছোট্ট ছেলেটা। হঠাৎ বৃষ্টি কেটে গিয়ে সেখানে পারিবারিক আড্ডা ভেসে ওঠে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ ফিরিয়ে নেই। পুরো বাড়িটা যেন হঠাৎ মায়ায় ভড়ে ওঠে। চাঁদের আলো ছাড়াই এই প্রায় দুপুরের রোঁদেও যে এত মায়া মাখানো আলো হতে পারে তা কে জানত?

সুবোধ অবোধ


মন্তব্য

nahiyen এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সুবোধ অবোধ

মর্ম এর ছবি

পুরনো ব্যথা উথলে দিলেন। সুন্দর স্মৃতিমাখা লেখা।

আচ্ছা আপনি কি রমাপদ চৌধুরী'র 'বাড়ি বদলে যায়' পড়েছেন? পড়ে দেখতে পারেন!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।
হাসি
রমাপদ চৌধুরী'র 'বাড়ি বদলে যায়' বইটি পড়া হয় নি।

সুবোধ অবোধ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সুবোধ অবোধ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো ছিল।

- ইউক্লিড
http://www.facebook.com/iEuklid

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ...

সুবোধ অবোধ

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভাল লেগেছে স্মৃতিকথন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।