ছিটগ্রস্থ ব্যমো

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৪/২০১৩ - ১০:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কেতুব ও বদি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে- এখন তাদের কি করা উচিৎ তা ভেবে পায় না। বদি আলের পাড়ের শুকনা খড়ের মত উশখুস করতে থাকে – ভেজা এঁটেল কাদার মত নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে কেতুব বলে ওঠে – ‘ও তাতেন কি আর করবা-লও ছালখান ছাড়ায়া লই’, তাতেন কেতুবের দিকে হিংস্র চোখে তাকায় ভেজা ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে ‘তুমি জাননা,ল্যাদা আমার ছাওয়াল এর লাহান?’ প্রত্যক্ষ অপমানে কেতুবের কালো চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বদি বলে- ‘লওবা গোর খুইড়া নেই’, গ্রীষ্মের খটখটে মাটি কেটে কবর খুঁড়তে তিনজনের ঘাম ছুটে যায়- শক্ত তৃষ্ণার্ত মাটি যেন প্রতিনিয়ত অস্বীকার করছে ল্যাদা’র মৃতদেহ গ্রহনে। সূর্য ঢলে যাওয়ার সময় তালগাছি গ্রামের এই বিরান প্রান্তরের মাটি কিছুটা নরম হয় ল্যাদার কবর হলে কেতুব ও বদি ফিরে আসে গ্রামের বাজারে। তাতেন জগতের সকল ব্যস্ততা উপেক্ষা করে শুন্য চোখে বসে থাকে ল্যাদার কবরের পাশে।
সেই সময় গ্রামের লোকেরা মদন ঘটের চায়ের দোকানে আসল ঘটনা জানতে পারে- চারপাশে বিড়ির ঘোলাটে ধোঁয়া যেন সব পরিস্কার করে দ্যায়। কেতুব ও বদি পাল্লা দিয়ে বলে চলে কিভাবে তারা তাতেনের বাড়ির দিকে যায় ‘বুঝলেন মেম্বার সাব, আমরা তো ঠাওর করব্যার পারিনা, হাট ব্যালা পার হয়া যায়, তাতেন হাটে আসেনা ক্যা? পাঁচ পণ খ্যাড় লইয়া গেছিগা হাটে- যাওনের কালে আবার বিশুর মা কইছে দুই ভাগা আতপ চাল আনতি... আর আমিতো মনে করেন ভাইবা কূল পাই না কি করুম’
কেতুব যখন আতপ চাল এবং ল্যাদার মৃত্যু সহযোগে উপাদেয় খিচুড়ি রাঁধতে শুরু করেছে তখন ই বদি ঠোঁট থেকে বিড়ি কেড়ে নেয়ার মত কথা কেড়ে ন্যায়। এবং সংক্ষেপে বলে যায় কিভাবে তারা তাতেনের খোজে যেয়ে দ্যাখে তাতেন ল্যাদার লাশের সামনে নির্বাক বসে আছে- কিভাবে রাতের আধারে কেউটের ছোবোলে ল্যাদার মৃত্যু হয়। কিভাবে তারা ল্যাদার কবর দিয়ে আসে। কেতুবের দীর্ঘ গল্পের বদলে বদির নিরস বর্ণনা গ্রামের লোকের ওপর কিরকম প্রভাব ফ্যালে বোঝা যায় না। বিড়ির ঘোলাটে ধোয়ার সাথে গ্রামের লোকেরা ল্যাদার মৃত্যুর সংবাদ পায়। গ্রামের একমাত্র গাধার মৃত্যুতে কেউ আফসোস করে ওঠে কেউ বা খুশি হয় – কেউ নির্বাক থাকে, চা এর দোকানের সমস্ত ধোয়াটে অনুভুতি নিয়ে খ্যালা করার ব্যর্থতা কেতুব কে গ্রাস করে। লুঙ্গির কাছা থেকে গুলের কৌটা বের করে এক খাবলা গুল তার তিত মুখের ভেতর প্রবেশ করিয়ে বলে ওঠে ‘তাতেন খুব দুক্কু পাইছে- ল্যাদাডা হ্যার ছাওয়ালের লাহান আছিল’,
কেতুব প্রশান্তি অনুভব করে,সে বুঝতে পারে গল্পের শেষ অংশে সে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে- দোকানের রুক্ষ মুখগুলোর মাঝে যেন বেদনার ছায়া পড়েছে।

গাধার মৃত্যু গ্রামের লোকদের স্মৃতিকাতর করে তোলে- তারা মনে করতে পারে তাতেনের বউ এর মৃত্যুর দিনের কথা। তারা মনে করে তারা আক্ষেপ করেছিল এভাবে- ‘আহারে তাগড়া বউডারে সাপে নিল!’ চায়ের দোকানের ভীড়ের কোনা থেকে কেউ বলে ওঠে- ‘আহারে তাগড়া গাধাডারে সাপে নিল!’ কেউ একজন তাতেনের সাথে সাপের শত্রুতা ও তাতেনের পোড়া কপাল নিয়ে বিশদ আলোচনায় বসে। তালগাছি বাজারে বহুদিন পর আবার কেউটে, তাতেন ও তাতেনের গাধা রাজত্ব করলো।

এরপর গ্রামের মানুষের নিস্তব্ধতা নেমে এলো ধীরে ধীরে- গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা শুরু হলো সে বছর তালগাছি গ্রামের বহু ঘরবাড়ির সাথে ভেসে গ্যালো ল্যাদা’র কবরও। সে বছর আমনের ডগা খেলল না পানির ওপর,বাড়ন্ত আমনের টুঁটি চিপে ধরেছিল বন্যায়- বাজারের চায়ের দোকানের বদলে নিয়মিত মজলিস বসলো মেম্বারের আলগা ঘরে,রাতে হেরিকেন আর কুচ নিয়ে গ্রামের লোকেরা চলল মাছ ধরতে- আব্দুল গাজীর উঠানে এক মোন ওজনের বোয়াল আটকা পড়লো। আব্দুল গাজী সমস্ত গ্রাম কে বোয়াল ভাগ করে দিল। আবার মেম্বারের আলগা ঘরে বিকেলের উত্তেজনা দ্যাখা গ্যালো-বোয়াল ছাপিয়ে আলোচনায় আবার স্থান নিল তাতেন। আলোচোনার মধ্যমণি অসীত জেলে। সে উত্তেজিত কন্ঠে বর্ণনা করতে থাকলো কিভাবে রাতে মাঝ ধরা শেষে ফেরার পথে সে তাতেন কে নদীর পাড়ে হামা দিয়ে ঘাস খেতে দেখেছে। গ্রামের কেউ বিস্মিত হলো- কেউ অবিশ্বাস করলো- কেউবা নির্বিকার থেকে বলল ‘আমি আগেই কইছিলাম তাতেনের মাথায় ছিট হইছে’, তারপর বেশ কিছুদিন তাতেনের মাথার কিলবিলে ছিট এবং ঘাস এবং চার হাত পায়ে ভর করে হাটা গ্রামের মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে গ্যালো। তারপর বন্যা নেমে গেলে- সাথে নামিয়ে নিয়ে গ্যালো তাতেনের ছিটে ভর করা গ্রামের আলস্য কে। গ্রামের লোকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো সরিষা, খেসারি আর বোরো বুনতে।
সে সময় ক্লান্ত শরীরে গভীর রাতে কেতুব স্বপ্ন দেখলো - বিশাল এক মাঠের মাঝে সে পচে গলে যাওয়া ল্যাদা’র শরীর থেকে ছাল ছাড়াচ্ছে। আর তাতেন- ‘আমার ছাওয়াল রে আলগা করিস না রে- আমার ছাওয়াল রে আলগা করিস না’ বলে চিৎকার করত করতে ছুটে আসছে। সেই সময় কেতুবের স্ত্রীর ভারি নিতম্ভের স্পর্শে কেতুবের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। বোঝা গ্যালো না কেতুব চামড়া সম্পূর্ণ না ছাড়াতে পারার ব্যর্থতায় ভুগছে কিনা।

গ্রামে নতুন উপদ্রব দ্যাখা দিল- তা নিয়ে উত্তেজিত মজলিস বসলো মেম্বারের আলগা ঘরে। অভিযোগ উঠলো কে বা কার গরু ছাগল রাতের ব্যালা সদ্য গজানো খ্যাসারি – সরিষা আর ধানের চারা খেয়ে যায়। রাতে পাহারা বসলো পালা করে কিন্তু লাভ হলো না। কেউ একটা গরু বা ছাগল ধরতে পারলো না কিন্তু সকালে ঠিকই ক্ষেতের পর ক্ষেত নস্ট হতে লাগলো। অবশেষে গ্রামের লোকেরা বুঝলো এ কোন পশুর কাজ নয়। এ যার কাজ তার নাম মুখে আনতে তাদের ভয় হলো- গ্রামের ইমাম কে দিয়ে জমির পর জমি সুরা পড়ে বাঁধানো হলো। জমি বাঁধানো শেষে গ্রামের লোকেরা কিছুটা শান্তি পেলো তারা আবারো বাজারের চায়ের দোকানে বিকালে বিড়ির ধোঁয়ায় ফসলের স্বপ্ন বুনে গ্যালো। কিন্তু তারপরেও সেই অশরীরী এর কার্যক্রম থামল না, গ্রামের লোকদের যখন সুরা আর ইমামের ওপর বিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে সে সময় চমকপ্রদ খবর দিল উত্তুর পাড়ের বদর আলীর ছেলে রুহুল আলী।
সেই খবর নিয়ে গরম হয়ে উঠলো বিকেলের চায়ের দোকান। এরকম আশ্চর্য খবরে কেউ দ্বিধান্বিত- কেউ নিশ্চিত কেউবা বিস্মিত হলো। রজব আলী অবিশ্বাস ভরা কন্ঠে বলে উঠলো ‘কিসে কি কও বাপু- এক তাতেন কিভাবে এতো খ্যাতের ফসল খাইবো!’ রুহুল আলী কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে সঠিক কি দেখেছে। রুহুল আমিন বলেছিল- “আমি উল্লাপাড়া থিকা গোলাপি এহন ট্রেনের রাইতের শো দেইহা আইতাছি , বিশুগো বাড়ি ছাইড়া ক্যাবল গাফার মিয়ার খ্যাতের কান্দে নামছি তহন দেহি এই আশ্চর্য ঘটনা...” গ্রামের লোক গভীর রাতেরে এ রোমহর্ষক কাহিনী শুনে উৎকণ্ঠিত হল, তারা জিজ্ঞেস করলো তারপর কি হলো? কারো আবার আকর্ষণ চলে গ্যালো নিস্তব্ধ রাতের ট্রেনের নিসঙ্গ গোলাপীর কাছে। রুহুল আলী বলে চলল – “দূর থাইকা দ্যাখলাম গাফার মিয়ার ক্ষেতের কাইন্দে কে জানি হামা দিয়া খ্যাসারী খাইতাছে, কাছে আগুয়া দেহি আমগো তাতেন!” গ্রামের লোক বিস্মিত হলেও তাদের বদ্ধমুল ধারনা হলো এ কাজ তাতেন এর ই। সেই সারা মৌসুম ক্ষেতের ফসল খেয়েছে। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে গ্রামের লোকেরা ভয় ও পেলো কেউ বলল ‘ল্যাদা’র ভূত ভর করছে তাতেনের ওপর’ কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করলো না একটা গাধা ভূত হতে পারে এবং তা একজন মানুষের কাধে ভর করতে পারে।

ধু ধু মাঠের মাঝে সে রাতে ছনের চালের ফাক দিয়ে গলে গলে পরা নক্ষত্র উপেক্ষা করে তাতেন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হলো- ঘুম গভীর থেকে গভীর হলে- চাঁদটা মাথা পেরোনোর পরপর ই তাতেন স্বপ্ন দেখলো- তার সমস্ত শরীর পচে গলে গেছে। শরীরে পোকা ধরেছে চোখ থেকে কিলবিল করে বেরিয়ে আসছে তার মাথার ছিট। এমন সময় একটা ছাল ছাড়ানো লাল টকটকে মাংশল গাধা তার গ্রীষ্মের মত খসখসে জীভ নিয়ে তার শরীরে লাঙ্গল টানছে। সেই সাথে উর্বর ভূমির মত উঠে আসছে তার গলে যাওয়া চামড়া। কেতুব- বদি- রজব আলী- মেম্বার- ইমাম সকলে দূরে দাড়িয়ে সেই কিম্ভুত গাধার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর স্বপ্ন ঘুম চেতনা ভেঙ্গে গেলে তাতেন তাকিয়ে থাকে ছনের ফাঁক দিয়ে কালো আকাশের দিকে।

তারপর তাতেনের স্বপ্ন পুরনো হয়ে যায়, ধীরে ধীরে আবারো গ্রামে ব্যস্ততা আসে। ধান কাটার সময় হয়। সেই সময় আবারো বাজারে চায়ের দোকানে শোরগোল উঠলো। আবারো আসরের মধ্যমণি কেতুব ও বদি। কেতুবের এক চিমটি গুল ভরা মুখে ধীর অথচ উত্তেজিত গল্প। সে এক নাগাড়ে বলে চলেছে কিভাবে তারা ধান কাটার জন্য তাতেন এর খোজে গিয়েছিল। এবং কিভাবে দেখলো তাতেন মরে পোঁচে গলে পরে আছে তার জরাজীর্ণ খাটে। কিভাবে তাতেনের মাথার ছিট বুড়া আঙুলের নখ গলে কিলবিল করে বেরিয়ে এসেছে। এরপর গুলের তিতকুটে স্বাদের সাথে বিড়িড় ধোঁয়া মিশে গল্পের বিষণ্ণতায় গ্রামের সকলে ব্যথিত হলো। ধোঁয়ার আশটে গন্ধে মতির চোখ জ্বালা করে। কেউ আফসোস করে উঠলো – কেউ নিশ্চুপ থাকলো।
ঠিক এই সময় গ্রামের লোকেরা দেখল মাঠের আইল ধরে এক বেওয়ারিশ গাধা ঘুরে ব্যাড়াচ্ছে এদিক ওদিক।

-----
পিনাক পাণি (নিবন্ধিত নাম)


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লেগেছে

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পিনাক পাণি এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।