লাল ডায়রি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৪/২০১৩ - ১০:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কেউ যদি আমার কাছে জানতে চায় যে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়টা কি, তাহলে আমি বলব যে, আগে যখন আমার মা আমাকে রাতে ঘুমানোর সময় গল্প শোনাতো, সেই সময়টা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আর সবচেয়ে খারাপ সময়টা হল যখন আছিয়া খালা আমাকে বাথরুম করিয়ে দেয়। আমার বয়স বার। আমাকে এই বয়সেও বাথরুম করিয়ে দিতে হয়, কারণ আমি হাঁটতে পারি না। এমনকি আমি একটু নড়তে পযর্ন্ত পারি না। একটা সড়ক দুঘর্টনায় আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। ঐ দুঘর্টনায় আমার মা মারা যান। আমার আব্বুর অনেক টাকা, তাই আমাকে দেখাশোনা করার জন্য দুজন মহিলা আছে। তারা মিষ্টি মিষ্টি করে হেসে আমার কাজগুলো করে দেয়। তবুও আমার তাদেরকে একটুও ভালো লাগে না। তাই বলে আমি মন খারাপও করি না, কারণ আমি যখন আগে স্কুলে পড়তাম, তখন আমার এক মিস বলেছিলেন যে কখনও মন খারাপ করতে নেই, মন খারাপ করলে শরীরও খারাপ হয়। আমার শরীর এমনিতেই খারাপ, তাই যদি মন খারাপ করি শরীর আরো খারাপ হবে। আমি জানি যে আমি একদিন ঠিক ভাল হব, আবার হাঁটব, আবার খেলব। আমি অনেক তাড়াতাড়ি ভালো হতে চাই, তাই আমি মন খারাপ করি না। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় যদি আমি লিখতে পারতাম তাহলে অনেক ভালো হত। আমি এসব কথা লিখে রাখতে পারতাম। আমার তখন সুন্দর একটা ডায়রি থাকত। ডায়রিটার মলাট হত লাল। কিন্তু লেখার ক্ষমতা তো আমার নেই, তাই আমি এভাবে মনে মনে ডায়রি লিখি। আমার কল্পনার এই ডায়রিটার রং-ও লাল, টকটকে লাল। আমি না অনেক গোপন একটা কথা জানি, আমার আব্বু সম্বন্ধে। তা হল, আমার আর আম্মুর এক্সিডেন্টটা আব্বু করিয়েছিল। আমি আর আম্মু গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা ট্রাক এসে আমাদের গাড়িটাতে ধাক্কা মারে। সেই ট্রাকটাকে আব্বুই পাঠিয়েছিল। আব্বু অবশ্য তখন জানত না যে সেই।গাড়িতে আমিও থাকব। আমি এতসব কথা কি করে জানলাম বলি, এক্সিডেন্টের তিন-চার দিন পর ডাক্তাররা অনেক কষ্টে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তখন আমার জ্ঞান ছিল, কিন্তু আমি বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকতাম। জেগে থাকলেও চোখ বন্ধ করে থাকতাম কারণ চোখ খুলতেও কষ্ট হত। তেমন একদিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। হঠাৎ টের পাই কেউ আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। একটু পরে কন্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম আব্বু। আমি এর আগে কখনো আব্বুকে কাঁদতে দেখি নি বা শুনি নি। আমার কেমন জানি লাগছিল, তাই আব্বুকে বুঝতে দিলাম না যে আমি জেগে আছি, চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। এইসময় কেউ একজন ঘরে ঢুকে আব্বুকে বললেন, “কাঁদিস না, জাভেদ, নীরা ঘুমাচ্ছে, জেগে যাবে।”
আমি গলা শুনে বুঝতে পারলাম ইনি আব্বুর বন্ধু, ইয়াকুব চাচু।
তখন আব্বু অনেক জোরে জোরে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, এর জন্যে আমি দায়ী, আমি।”
“এসব কি বলছিস জাভেদ, এখানে তোর কি দোষ? এটা একটা এক্সিডেন্ট।”
“না, এটা শুধুমাত্র একটা এক্সিডেন্ট নয়, এই এক্সিডেন্ট আমি করিয়েছিলাম, যাতে নীরার মা মারা যায় আর আমি আমার সেক্রেটারী নায়লাকে বিয়ে করতে পারি। নীরার মা আমাকে বলেছিল যে সে শপিং এ যাবে আর ঐ সময় নীরার কোচিং-এ থাকার কথা। কি থেকে যে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না।” বলে আব্বু আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। (আসলেই আমার সেসময় কোচিং-এ থাকার কথা কিন্তু আমার কিছু কেনাকাটা ছিল তাই সেদিন কোচিং-এ না গিয়ে আম্মুর সাথে শপিং এ যাচ্ছিলাম।)
তখন ইয়াকুব চাচু আস্তে করে শুধু একবার বললেন, “ছি!”
আমি উনার আর কোন আওয়াজ শুনিনি। তখন একজন মহিলা, মনে হয় ডাক্তার, এসে বললেন, “আপনারা বাইরে যান, আপনারা থাকলে রোগীর অসুবিধে হতে পারে।”
আব্বুর কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আব্বুর প্রতি রাগও হচ্ছিল না। কেমন জানি কষ্ট হচ্ছিল। আমার ইচ্ছা করছিল আব্বুকে ঘৃণা করতে। কিন্তু আমার মিস বলেছিল কাউকে ঘৃণা করতে নেই। তাই আব্বুকে আমি ঘৃণা করিনি। কিন্তু সেদিন আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল, অনেক। মনে হচ্ছিল এগুলো না শুনলেই ভালো হত। আব্বুর এই সেক্রেটারী নায়লাকেও আমি দেখেছি। এক্সিডেন্টের প্রায় একমাস পর যখন আমাকে বাসায় আনা হল, আর তিন-চার দিন পর আমাকে উনি দেখতে এসেছিলেন। আমি তখন জানতাম না যে ইনিই নায়লা। আমার কাছে ওনার চেহারা প্রথমে বেশ ভালোই লেগেছিল। উনি এসে আমার বিছানার পাশে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলেছিলেন, “এখন কেমন আছ?” আমি উত্তর দাওয়ার আগেই আব্বু ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে মহিলাটিকে বললেন, “নায়লা তুমি? তোমার সাহস কি করে হল এ বাড়িতে ঢোকার? এক্ষুণি এখান থেকে যাও।”
আব্বুর কথা শুনে বুঝলাম, ইনিই নায়লা। তখন কেন জানি উনার চেহারা ডাইনি বুড়ির মত লাগছিল।
নায়লা নামের সেই মহিলাটি কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আব্বু তার কোনো সুযোগ না দিয়ে বললেন, “আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, এক্ষুণি চলে যাও। তোমাকে যেন আর কোনদিন এখানে না দেখি।” রাগে তখন আব্বুর গলা কাঁপছিল।
এক্সিডেন্টের প্রায় সাত-আট মাসহতে চলল। এতদিনেও আব্বু ঐ মহিলাকে বিয়ে করেনি। মনে হয় আর করবেও না।
আমার স্কুলের সব মিসরা আমাকে একদিন দেখতে এসেছিলেন। আমার যে মিসট সবসময় আমাদের উপদেশ দিতেন, উনিও এসেছিলেন। তিনি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোমার কি মন খারাপ মা?”
আমি বলেছিলাম, “না মিস, কারণ আপনি বলেছিলেন মন খারাপ হলে শরীর খারাপ হয়। আমার শরীর তো এমনিতেই খারাপ, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি ভালো হতে চাই, তাই মন খারাপ করি না।”
আমার কথা শুনে মিস কেন জানি সেদিন অনেকক্ষ্ণ কেঁদেছিলেন, তারপর চলে গিয়েছিলেন। তারপর আমাকে আর কোনোদিন দেখতে আসেননি। আমার খুব ইচ্ছে করে ঐ মিসের সাথে কথা বলতে। আমি ঐ মিসকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু উনি তো আসেননা। আমি যখন ভালো হব, তখন উনার কাছে গিয়ে ওনার সাথে অনেক কথা বলব।
ইয়াকুব আংকেল আমাকে প্রায়ই দেখতে আসেন।
একদিন উনি বললেন, “তোর কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তো মা?”
“না তো আংকেল”
“অথচ তোরই সবচেয়ে বেশি অভিযোগ থাকার কথা।” বলে উনি একটি দীঘর্শ্বাস ফেলেছিলেন। আর কোনো কথা বলেননি। আমিও আর কিছু বলিনি। উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চলে গিয়েছিলেন।
কার যেন পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। এটা আব্বুর পায়ের আওয়াজ। আমি এখন সবার পায়ের আওয়াজ চিনি। শুয়ে শুয়ে কোন কাজ নেই তো। ঐ যে আব্বু।
“কেমন আছিস রে মা?” বলে আব্বু আমার মাথায় হাত রাখল।
“ভালো আব্বু, তুমি আজ সারাদিন আসোনি কেন?”
“একটু কাজ ছিল রে মা। ......... কিরে মা, এমন করছিস কেন?” আব্বু আতঙ্কিত গলার বলল।
আমার মাথা ঘুরছে। কিছু শুনতে পাচ্ছি না। উফ! খুব ব্যাথা করছে মাথায়। চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। এত কষ্ট কেন? সবকিছু এত দুলছে কেন? এত কষ্ট... কষ্ট......
“ভাইজান, মামনি তো নিশ্বাস নিচ্ছে না। দেখেন না একটু।” আছিয়া বলল।
জাভেদ সাহেব মেয়ের নাড়ি দেখলেন। কোন শব্দ নেই। পাগলের মত হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করলেন। সেখানেও জীবনের কোন ছোঁয়া নেই। সব শেষ.........

- লীলাবতি


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালোই লাগছিলো, কিন্তু শেষটায় খুব তাড়াহুড়ো হয়ে গেলো।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সাবেকা  এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল। চলুক

লিখতে থাকুন।

নাহিয়েন

তারেক অণু এর ছবি

শেষটায় খুব তাড়াহুড়ো হয়ে গেলো

অতিথি লেখক এর ছবি

বিভুতীভুষন বন্দপাধ্যায়ের মত হুট করে মেরে ফেললেন???!!

সুবোধ অবোধ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন‌্যবাদ সবাইকে।
এরপরের লেখায় যাতে শেষে তাড়াহুড়ো না হয় খেয়াল রাখব।

-লীলাবতি

অতিথি লেখক এর ছবি

@ সুবোধ অবোধ......... গল্প লেখার সময় একথা মাথায় আসে নি। তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার একজন প্রিয় লেখক। তার লেখা থেকে অবচেতন মনে অনুপ্রাণিত হতে পারি।

-লীলাবতি

আশা এর ছবি

উত্তম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।