মা

সুবোধ অবোধ এর ছবি
লিখেছেন সুবোধ অবোধ (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/০৪/২০১৩ - ২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তখন বেশ ছোট। কত হবে বয়স? দশ কিংবা এগারো। আমার খালা কে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে বলে আমার মা গেলেন মামা বাড়ি। আমার পরীক্ষা চলছে বলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আমার মা উনাদের ভাই বোনদের মধ্যে সবার বড়, তাই যাওয়াটাও জরুরি ছিল। সেই ছিল আমার প্রথম মা ছাড়া বাসায় থাকা। বাসায় ছিলাম আমি বাবা আর বড় বোন। যাওয়ার আগে মা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করলেন,"থাকতে পারবি তো?" আমি যথেষ্ট চাপা স্বভাবের সেই ছোট বেলা থেকেই। বলে দিলাম "অবশ্যই পারবো।" মুখে অনেক কষ্টে হাসি ধরে রেখে বিদায় দিলাম মা আর বড় ভাই কে। প্রসঙ্গত কয়েকটা কথা জানিয়ে রাখি- আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ কিন্তু বাবার চাকরির সুবাদে থাকতাম টাঙ্গাইলে। যমুনা নদীর এপার ওপার।

যে সময়ের কথা বলছি তখন যমুনা সেতু হয় নি। তাই নদী পারাপারের জন্য লঞ্চই ভরসা। সে লঞ্চও আবার বরিশালগামী লঞ্চের মত বড় লঞ্চ না, ছোট ছোট। আর তখনকার যমুনা নদী এখনকার মত মরা ছিলো না। বলা হত পাগলা নদী! বিদায় দিয়ে আমি শুধু আকাশের দিকে তাকাই আর মনে মনে দোয়া করি যেন মেঘ না করে আকাশে। বাতাসে গাছের পাতা একটু জোরে কাঁপলে আমার বুক তার চেয়ে কয়েকগুন জোরে কাঁপে! ভয় হয়-ভাল একটা লঞ্চ ছিলো তো? নদী তে জোরে বাতাস ওঠেনি তো? স্বসংকোচে বাবা কে থেকে থেকে জিজ্ঞেস করি, "ঝর আসার আগে তো বোঝা যায়, তাই না?" বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে কেমন লজ্জা লাগে যদি বাবা বুঝে ফেলে যে আমি আসলে মা'র জন্য ভয় পাচ্ছি! নাহ, তখনও আমাদের দেশে মোবাইল ফোন আসেনি। তাই, চাইলেই ফোন করে খোঁজ নেয়া যেত না। বিকেল কাটলো, সন্ধ্যা কাটলো। কিন্তু রাতে খাবার আগে সব লজ্জার মাথা খেয়ে প্রথমে শুরু হল আমার ফুঁপিয়ে কান্না, তারপর হাউমাউ করে। আমার বাবা এবং বোন অনেক বুঝিয়েও আমার কান্না থামাতে পারে না। আমি জোরে শব্দ হবার ভয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদি! তবুও টের পেয়ে পাশের বাসার কাকা কাকী চলে আসেন। উনারাও বোঝাতে চেষ্টা করেন। ছোট আমি কিছুই বুঝতে চাই না!! বুঝতে ইচ্ছাও করে না। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম হয়তো। তার পরদিন বিকেলে মা বাসায় ফিরে এসেছিল। ফিরে আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে দুঃখী মানুষ ভাবতে থাকা আমি মা ফিরে আসার সাথে সাথে নিজেকে মনে হল পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ!

সাভার রানা প্লাজার সামনে ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পরা পোশাক শ্রমিকদের হাজার হাজার স্বজনেরা বাইরে অপেক্ষায় দাড়িয়ে। আট দশ বছরের একটা মেয়ে হাতে মায়ের ছবি নিয়ে অপেক্ষায় আছে তার মা এর ফিরে আসার। সাংবাদিকদের প্রথাগত প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারে না! সব লাজ লজ্জা ভুলে হাউমাউ করে কাঁদে! অস্পষ্ট ভাবে কোনরকমে বলতে পারে যে তার মা এই বিল্ডিংয়েরই কোনো এক তলায় কাজ করতো। ভবন ধ্বসের পর তার কোনো খোঁজ সে জানে না। বলেই আবার কাঁদতে থাকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমার। ঝাপসা চোখে আমি আমার ছোটবেলার সেইদিনটি কে দেখতে পাই। এই মেয়েটি কি আর কোনদিন খুব সুখী মানুষ ভাবতে পারবে নিজেকে? দেয়াল চাপা পড়ে মারা যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতেও যে মানুষটা তার ২ বছরের বাচ্চাকে কে দেখবে ভেবে অস্থির হয়ে ওঠে নিজের কথা ভুলে,সেই মানুষের অভাব পুরন করার সাধ্য পৃথিবীর কোনকিছুর পক্ষেই সম্ভব না!

চার দিন ধরে ধ্বংসস্তুপের নিচে দেড় বছর বয়সী কন্যাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাওয়া শাহিনা শেষ পর্যন্ত মারা গেছে!! তার মেয়েটি মৃত্যুর মানে বোঝেনা এখনো! একদিন সে বড় হবে, তার মায়ের মৃত্যুর ইতিহাস জানবে। ধ্বংসস্তুপের নিচে ধুঁকেধুঁকে বেঁচে থাকা তার মায়ের মতোই ধুঁকেধুঁকে বেঁচে থাকা এই জাতি কি কখনো তাকে সুখী করতে পারবে???

সুবোধ অবোধ


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

৩ বচ্ছর হয়ে গেল...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।