আজ পহেলা মে। মে দিবস, মহান মে দিবস। সারা বিশ্বের জন্য এদিনটি শ্রমিকদের মুক্তিগাঁথা হলেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য এটি প্রহসন ব্যতীত আর কিছু নয়। ১৯৭১ সালের পূর্বে পরাধীন কালের কথা বাদ দিলাম, স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ টি বছর চলে গেলেও আমাদের শ্রমিকদের কোন স্বাধীনতা নেই, মুক্তি নেই; তারা আজও পুঁজীবাদ আর কর্পোরেট বাণিজ্যের শেকলে আবদ্ধ।
বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির একটি হল সমাজতন্ত্র। এটি প্রচলিতভাবে সংজ্ঞায়িত সমাজতন্ত্র না হলেও ন্যূণতমভাবে রাষ্ট্র রাষ্ট্রের সকলের জন্য সমান দৃষ্টি রাখবে সে দাবিটি রাখে। কিন্তু এ দাবিটি বাংলাদেশের জন্য বারবার অসার হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। গরিবেরা বরাবরের মতনই নিগৃহীত, শ্রমিক শ্রেণিটি আরো বেশি অবহেলিত।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে শ্রমিকদের হাত ধরে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার কথা বললে তৈরী পোশাক শিল্পের কথাটিই আগে বলতে হয় যেখানে অধিকাংশই নারী শ্রমিক। অথচ তারা কেবলই নিগৃহীত, নির্জাতিত। তাদেরকে যে মজুরী দেওয়া হয় তাতে তাদের তিন বেলা খাবার তো দূরের কথা ২ বেলার ঠিক খাবারটাও জোটার কথা না। অথচ তৈরী পোশাক কারখানার মালিকেরা যখন বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ নিয়ে আসেন তখন তাদেরকে কথা দেন যে তারা শ্রমিকদের কথা ভাববেন। মালিকপক্ষের সেই ভাবনা ইলানেই সমাপ্তি ঘটে।
শ্রমিকেরা তাদের নায্য মজুরীর জন্য বারবার আন্দোলন করে আসলেও কোন কাজ হয় নি, উল্টো পুলিশের লাঠি আর মালিকের পোষা গুণ্ডাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সরকারের এই দিকটাতে নজর দেওয়ার ফুরসাৎ নেই, তারা ব্যস্ত মালিক পক্ষকে খুশি করতে করের ব্যাপারে নানা ছাড় দিতে, নানা প্রণোদনা নিশ্চিত করতে; কেননা এই মালিকদের দেওয়া চাঁদাতেই হয়তো চলবে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী খরচ! মালিকপক্ষ বারবারই এক ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেন যে শ্রমিকদের বেশি মজুরী দিতে গেলে তাদের ব্যবসা চালানো সম্ভব না, কারখানা বন্ধ করে পথে চলতে হবে। কিন্তু তাজরিন দুর্ঘটনার পর টিভি চ্যানেলে অনন্ত জলিলের কথায় প্রমাণ পাওয়া যায় মালিকেরা কতটা মিথ্যাচার করেন। তিনি বলেছেন, তার কারখানায় শ্রমিকদের পারশ্রমিক ছাড়াও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয় যা অন্য কারখানাতে বিরল। শ্রমিকদের জন্য বাড়তি দেওয়ার পরও তার অনেক টাকা থাকা যা দিয়ে তিনি প্রতি বছর কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
না্য্য মজুরী তো আজ অনেক দূরের কথা শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মস্থলেরই নিশ্চয়তা নেই। জানের নিরাপত্তা ছাড়াই শ্রমিকেরা প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যাচ্ছেন কোন রকমে পরিবার নিয়ে পেট চালাতে। অধিকাংশ কারখানাতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় না। বিজেএমইএ, বিকেএমিএ তো দেখেই না, সরকারের কোন বিভাগেরই নজর নেই এই খাতে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তি আর নির্বাচনী চাঁদা পেয়েই খুশি। অন্যদিকে ফিনিক্স, তাজরীন আর সবশেষে সাভারের রানা প্লাজার মতন দুর্ঘটনা একের পর এক ঘটে চলছে। আগের ঘটনাগুলো ঘটবার পর শুধুমাত্র লোক দেখানো তদন্ত কমিটি ছাড়া আর কিছুই হয় নি, লাশের দাম উঠেছে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। কাউকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় নি, আবার আইনগুলোও মালিকদের রক্ষা করেই তৈরি করা যেখানে হাজার মানুষ নিহত হলেও সর্বোচ্চ শাস্তি কখনোই মৃত্যুদণ্ড নয়। এবার অবস্থা বেগতিক দেখেই শেখ হাসিনা সরকার মালিকদেরকে গ্রেফতার করেছে। এখন সময়ই বলে দেবে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে।
আজকের দিনে মহান মে দিবসকে ঘিরে কিছু সেমিনার হবে, সমাবেশ হবে, কিছু দাবি তোলা হবে। সময়ের চোরা স্রোতে সব দাবি ভেসেও যাবে। এইসব সমাবেশে যারা বক্তব্য রাখেন তারা নিজেরাও জানেন তারা প্রকৃত শ্রমিক নন, শ্রমিক নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসায়ি তাদের কাজ। তাই তারা দাবি তোলার জন্যই দাবি তোলেন, দলকে চাঙা রাখতে। আর সরকার সব শুনে একটু হু-হা করবে এ যা।
শ্রমিক মারা যাবে আর শ্রমিকদের লাশের ওপরে প্রথম আলো, স্কয়ারের মতন কর্পোরেট বেশ্যারা উদ্দাম নৃত্যের আয়োজন করবে, কিছু অর্থ কড়ি ফেলে ঔদ্ধত্য দেখাবে। এভাবেই চলে যাবে বছরের পর বছর, পহেলা মে আসলেই সাজ সাজ রবে পালিত হবে মহান মে দিবস, লালঝাণ্ডার মিছিল হবে, ফকির আলমগীরের গান হবে। আর কিছুই বদলাবে না, শাহীনারা মারা যাবে বছরের পর বছর। সেই রক্তের টাকায় ধনী মালিকেরা কোন বারে বসে পৌনে নগ্ন বারগার্লের নাচ দেখবে আর ভদকা, জ়ীন, রাম, টাকিলার গেলাসে চুমুক দিয়ে একজন আরেকজনকে বলবে, 'ভাই, এভাবে কি আর ব্যবসা চলে? শ্রমিকদের শুধু খাই খাই! ওদেরকে এত টাকা দিলে কীভাবে চলবো। ঐ ব্যাটা অর্থমন্ত্রীকে বলতে হবে যেন আরো কিছু সুবিধা দেয়...... ...... ......'
লেখাটা শেষ করছি সাভার ট্র্যাজেডি আর কর্পোরেট বেশ্যাদের ঔদ্ধত্য নিয়ে লেখা একটা দ্বাদশপদী দিয়ে।
আঁধারের মাঝে টর্চটা যে জ্বলে
নিভু নিভু করে। কেউ কেটে চলে
মানুষের হাত লোহার করাতে।
পারছে আ ঠিক, তাই তার সাথে
আহত মেলায় আরেকটা হাত
বাঁচবার আশে। নতুন প্রভাত
দেখবে কি সে? একই আঁধারে
আলোর ফোয়ারা! আহা রে! বাহা রে!
বাণিজ্য-গণিকা নোংড়া নৃত্য করে
উদ্ধত আয়েশে লাশেদের 'পরে।
সব সুশীলতা ইলানেই ইতি!
টাকাটাই যেন জীবনের নীতি!
২৯ এপ্রিল, ২০১৩
দেবাশিস্ মুখার্জি
দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ
মন্তব্য
অর্থাৎ সমতায় বিশ্বাস করলেই সেটি সমাজতন্ত্র হয়ে যাবে? তাহলে তো আমেরিকাতেও সমাজতন্ত্র আছে বলতে হবে!!! দুনিয়ার প্রায় সব দেশকেই তাহলে সমাজতন্ত্র বলতে হবে। খুবই ধোঁয়াটে এবং দূর্বল বক্তব্য।
এই সমতায় বিশ্বাসকে কিন্তু আমি সমাজতন্ত্র বলছি না, বলছে আমাদের সংবিধান। আমি জানি সমাজতন্ত্র কী, আমাদের সংবিধানের সংশোধনকারীরা বোঝে কি না সন্দেহ!
দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ
দারুণ লেখা। একমত পোষণ করছি লেখকের সাথে। ধন্যবাদ।
স্বাগতম!!
দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ
ইলানেই ইতি বুঝিনাই. ইলান মানে কি?
..................................................................
#Banshibir.
ইলান - ঘোষণা।
চুতিয়া প্রথল আলো, আর কর্পোরেট মেরিল তাদের শোক এক মিনিটের নীরবতা আর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইতি ঘটিয়েছে।
দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ
প্রতিবার 'দুর্ঘটনা' ঘটে, আর ভাবি লাশের দাম কতোয় বিকোবে । সেসব লাশগুলোর স্বজনদের অশ্রুর মূল্য নির্ধারণের জন্য দশমিকের পর কত ঘর শূন্য বসাতে হয় । এই লাশগুলোও যে একসময় মানুষ ছিল, সরকার-বিজেএমইএ বিশ্বাস করবে সে কথা ? উত্তর পাই না কিছুরই
আসলে সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে অনেক আগেই । হারাতে হারাতে বলতে হয়, আমাদের আর হারাবার কিছু নেই
তালেব মাষ্টার
নারে ভাই, সব নষ্টদের দখলে যায় নি। নষ্ট হয়েছে কিছু রাজনৈতিক বেশ্যা, কর্পোরেট বেশ্যা আর সুশীল বেশ্যারা। সাধারণ মানুষ যে এখনো কতটা ভালো তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাভার ট্র্যাজিডিতে আর্তের সাহায্যার্থে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষের আচরণে। সমস্যাটা হল আমাদের যারা চালাবে সেই নীতিনির্ধারকদের দেউলিয়াত্ব প্রকট আকার ধারণ করছে কিংবা আমরাই বারবার ভুল মানুষ নির্ধারণ করছি গুরুদায়িত্বের জন্য।
দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন