মুম রহমান
১.
একুশে ফেব্রুয়ারির সকালটা রায়ানের খুব ভাল লাগে। ভোর বেলা থেকেই কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ। প্রভাত ফেরি, ফুলের গন্ধ, অসংখ্য মানুষ, ব্যানার, ফেস্টুন - সব মিলিয়ে দারূণ একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব। শুধু একটা জিনিসই খারাপ লাগে রায়ানের - খালি পায়ে ঘোরাঘুরি, দ্যাটস রিয়েলি ডার্টি।
আজকের ফেব্রুয়ারির সকালটা অন্য রকম। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। খুবই হাল্কা। দার্জিলিংয়ে মেঘের ভেতরে
একুশে ফেব্রুয়ারির সকালটা রায়ানের খুব ভাল লাগে। ভোর বেলা থেকেই কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ। প্রভাত ফেরি, ফুলের গন্ধ, অসংখ্য মানুষ, ব্যানার, ফেস্টুন - সব মিলিয়ে দারূণ একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব। শুধু একটা জিনিসই খারাপ লাগে রায়ানের - খালি পায়ে ঘোরাঘুরি, দ্যাটস রিয়েলি ডার্টি।
আজকের ফেব্রুয়ারির সকালটা অন্য রকম। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। খুবই হাল্কা। দার্জিলিংয়ে মেঘের ভেতরে দাঁড়ালে গায়ে যেমন পাউডারের মতো বৃষ্টি পড়ে তেমনি বৃষ্টি হচ্ছে। রায়ানের একটু টেনশন হতে থাকে। কী জানি, বাবা যদি এই বৃষ্টির অজুহাতে বের হতে না চায়। বাবাটা এমনিতে আলসে টাইপ। ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে, অথচ এখনও শাওয়ার নেয়নি। রায়ান এক ছুটে দাদুর ঘরে চলে আসে। দাদুর বয়স আশি ছাড়িয়েছে। দাঁত নেই প্রায়, চোখে কম দেখে, কানে কম শোনে, রায়ান সচারাচর দাদুকে এড়িয়েই চলে। তবু এই মুহূর্তে দাদু ছাড়া তাকে আর কেউ হেল্প করতে পারবে না। সে দাদুর কানের কাছে গিয়ে চেচিয়ে বলে, গুড মর্নিং দাদু!
- কে রে, বর্ণ নাকি!
বর্ণ নামটা রায়ানের একদম পছন্দ না। কিন' আজ দাদু যে নামে খুশি তাকে ডাকুক, তাতে আপত্তি নেই।
- দাদু, পাপা এখনও রেডি হয়নি। আমরা শহীদ মিনার যাবো না!
- কি?
- ওএমজি! বলছি, বাবা এখনও রেডি হয়নি। তুমি কিছু একটা বলো!
- ও, প্রভাত ফেরিতে যাবি।
দাদু খুশি হয় নাতির এই তাড়া দেখে। এখন তিনি নিজে যেতে পারেন না, কিন' ছেলে, ছেলের বৌ আর নাতি ঠিকই যায়। তিনি নিজ হাতে বাগানের দুটো ফুল নাতির হাতে তুলে দেন।
- কী হলো!
- হু। দাঁড়া ব্যবস'া করছি। অভি, অভি...
অভি তখন বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সে লক্ষ্য করছে, চেহারায় কেমন একটা বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। অর্ধেক দাড়িই এখন সাদা, শুধু তাই না, থুতনির নীচে বাড়তি মেদ ঝুলে পড়েছে। বয়সটা এইভাবে আকস্মিক হানা দেবে অভি তা বুঝতে পারেনি। তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই সময়ই সে বাবা মোশাররফ হোসেনের ডাক শুনতে পায়। মোশাররফ সাহেব আজকাল আর কাউকে ডাকেন না, নিরিবিলিই থাকেন। নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অভি ছুটে যায়।
- বাবা ডাকছিলে?
- তুই এখনও তৈরি হস নাই বাপ?
- এই তো রেডি প্রায়।
- পাপা ইউ আর অলয়েজ লেট।
- যা তৈরি হয়ে আয়, ছেলেটা সকাল থেকেই উশখুশ করছে। এসো রায়ান।
- তোরা ওর বর্ণ নামটা গ্রহণই করলি না।
- না বাবা, তা নয়, আসলে হয়েছে কি...
- আমার স্কুল ফ্রেন্ডরা অমন উইয়ার্ড নাম লাইক করে না পাপা...
- আহ, রায়ান, সব কথার উত্তর দিতে হয় না। এসো আমার সাথে।
অভি ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচে। মোশাররফ সাহেবের চোখে পানি এসে যায়। ছেলের নাম রাখতে চেয়েছিলেন বর্ণ, পারেননি তিনি, বউয়ের পছন্দ হয়নি। শখ করে নাতির নাম রাখলেন বর্ণ, সেটিও গ্রহণযোগ্য হলো না। একটা চোরা খাদ তার বুকের মধ্যে থেকে থেকেই দীর্ঘশ্বাস ছড়ায়।
২.
মা-বাবাকে নিয়ে প্রভাত ফেরিতে যাবে রায়ান। দাদুর ঘরে এসেছে বিদায় নিতে। আর তক্ষুণি দরজার ঘণ্টা ধ্বণি বেজে ওঠে।
বাবা আমি দেখছি, বলে অভি বেরিয়ে যায়। দুয়েক মিনিট পরে ফিরে আসে, উল্লোসিত কিছুটা বা রোমাঞ্চিত।
- বাবা, সাংবাদিক এসেছে।
- হ্যাঁ?
- সাংবাদিক, টিভি জার্নালিস্ট। তোমার ইন্টারভিউ নিতে চায়।
মোশাররফ হোসেন মুখ ফিরিয়ে নেন।
- ওয়াও, গ্রেট! দাদু ইউ আর আ সেলিব্রেটি!
রায়ানের উত্তেজনা মোশাররফ সাহেবকে ছোঁয় না। তিনি শীতল কণ্ঠে বলেন, ওদেরকে যেতে বলো, আমার শরীর ভালো না।
- কাম অন দাদু তোমাকে টিভিতে দেখাবে! কতো মজা হবে! আমি ইউটিউবে, ফেইসবুকে দিবো, সবাই লাইক দিবে...
- বর্ণ, আমার ভাল লাগছে না।
- বাবা, কেন এমন করো!
- বাবা চলুন তো!
বউমা তাকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না। সঙ্গে করে নিয়ে আসে ড্রইংরুমে। কাধে একটা চাদর ঝুলিয়ে দেয়। ইতোমধ্যেই ক্যামেরা বসানো হয়ে গেছে। একটা সানগান জ্বালানো হয়েছে। অনুষ্ঠানের পরিচালক প্রবীর কুমার নিজে এগিয়ে আসেন।
মোশাররফ সাহেবকে সিঙ্গেল সোফায় বসানো হয়। প্রবীর মনিটরে ফ্রেমটা দেখে। দেয়ালে বড় করে একটা হ্যারি পটারের ছবি ঝোলানো। প্রবীর বলেন, এই ছবিটা নামাতে হবে।
রায়ান সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে, নো, ইম্পসিবল।
অভি এগিয়ে আসেন।
- কী হয়েছে?
- ওই ছবিটা ঠিক আমাদের মেজাজের সঙ্গে যায় না, বুঝতেই পারছেন, উনি ভাষা সৈনিক, ওনার ঘরের দেয়ালে দেশ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এই টাইপের কোন ছবি ঝুলালে ভালো হয়।
- কিন' এ রকম কিছু তো আমাদের ঘরে...
- আছে, ঐ যে মা’র নিজে হাতে সেলাই করা একটা ওয়লা হেঙ্গিং আছে। কী যেন লেখা, যাও পাখি বলো টলো টাইপের কি যেন একটা...
অভির বউ আগ বাড়িয়ে কথাগুলো বলে। সে নিজ হাতে এই ফ্লাট গুছিয়েছে। শ্বাশুড়ির করা এমন একটি শুচি কর্ম সে স্টোরে সরিয়ে রেখেছিলো। যাক, এখন সেটি কাজে লাগছে।
প্রবীর শসি- ফিরে পায়।
- তাহলে ঐটিই টানানো হোক।
- না, আমি কিছুতেই আমার হ্যারি পটারের ছবি সরাতে দেবো না।
রায়ান একগুয়ে স্বরে পরিস্কার জানিয়ে দেয়। রায়ানের এই এক সমস্যা। জেদটা বড় বেশি। দাদুর কাছ থেকেই সে বনেদি জেদ পেয়েছে। দাদুর মতো হয়তো বয়স বাড়তে বাড়তে তারও জেদ কমে যাবে। কিন' এখন সে জেদের মুখোমুখি দাঁড়ানো সত্যিই কঠিন। অভি পরিস্কার ধমক দিয়ে দেয়।
- রায়ান, ডোন্ট ডু এনি থিং টু মাচ। বড়রা যখন বলছে তখন আর কোন আর্গুমেন্ট করতে হয় না।
রায়ানের মাও বোঝায়, রায়ান বাবার কথা শোনো।
রায়ান এবার কাঁদতে শুরু করে।
- আমার ছবি নামাতে দেবো না, নো, ইম্পসিবল।
এবার প্রবীর নিজে বোঝাতে আসে, শোনো, এটা তো মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার, শুটিং শেষ হলেই আবার তোমার হ্যারি পটার ওঠে যাবে।
- ইটস জাস্ট ফর ফিউ মিনিটস।
- আই ডোন্ট কেয়ার, আমি এক মিনিটের জন্যেও হ্যারি পটারকে নামাতে দেবো না। হি ইজ মাই আইকন। আই লাভ হ্যারি পটার।
- তোমাকে একটা চড় দেয়া উচিত।
অভি’র এই কথায় মোশাররফ সাহেব ভাবেন, চড়টা আসলে কার কাকে দেয়া উচিত। কয়েক মিনিটের জন্যে হ্যারি পটার নামিয়ে দেয়ালে শুচিকর্ম ঝুলিয়ে শুটিং করলে কী আসে যায়! যদি সত্যিই সারা বছর... না, খুব বেশি ভাবতে পারেন না মোশাররফ সাহেব। এই বয়সে বেশি ভাবতে গেলেও মাথার রগ টন টন করে। তিনি আসে- ওঠে দাঁড়ান। ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, আমরা বরং ওই কোণাটায় গিয়ে শুটিং করি।
- তাই হোক।
সবাই ঘরের অন্য কোণাটায় শুটিংয়ের এরেঞ্জমেন্ট করতে থাকে।
রায়ান কান্না থামিয়েছে আর দেয়ালে হ্যারি পটারের ছবিটা বিজয়ীর হাসি হাসছে।
মন্তব্য
এমনকি হতে পারে যে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে হ্যারি পটারের মতো সঙ্গে করে নিতে ব্যর্থ হচ্ছি? মোশারফ সাহেব এবং অভিদের কি তাদের ব্যর্থতার কথা ভাবা প্রয়োজন নয়? এখনো বোধহয় সময় রয়েছে।
গল্প চমৎকার। কেবল যুক্তাক্ষরে "ত' লিখতে কয়েকটা টাইপো তৈরি হয়েছে। আপনার ছোট ছোট ছোটগল্প সচলে পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
সচলায়তনে স্বাগতম
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আমার মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি আর হ্যারি পটার - এ'দুটো জিনিস মিলিয়ে দেখা উচিত নয়। হ্যারি পটারের বই এক অসাধারণ লেখিকার অসাধারণ সৃষ্টি, - পাঠকের কাছে তার উন্মাদনা একটা আলাদা ব্যক্তিগত মাত্রা পাবেই। এটা ভক্ত পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবে। তুলনা হওয়া উচিত অনুরূপ বাংলা সাহিত্যকর্মের সাথে - যেমন ধরা যাক ফেলুদা। আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, আজও আমাদের কাছে ফেলুদার জনপ্রিয়তা হ্যারি পটারের থেকে কম নয়।
সম্রাট দাশুগুপ্ত
আমরা যেখানে 'শুটিং'এর 'এরেঞ্জমেন্ট' করি... সেখানে এক বালকের হ্যারি পটার প্রীতির দোষ কী? এভাবেই তো একদিন গা সওয়া হয়ে যায় আমাদের। আমরাও তো ঠাকুরমার ঝুলি ছেড়ে রুশ দেশের উপকথায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।
তিন প্রজন্মের টানাপোড়েন ভালো লেগেছে। গল্পও। কিছু টাইপো আছে, ঠিক হয়ে যাবে আশাকরি।
স্বাগতম মুম ভাই। সেদিন দেখলাম বিটিভিতে ইশিতার সঙ্গে গপসপ করছেন, এগিলি ঠিক্না ঠিক্না
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সমর্থন!!! আমি এখনো কলেজ স্ট্রীটে পুরনো বইয়ের দোকানে ওই বইগুলো দেখলে দাঁড়িয়ে যাই! সেদিনো একটা কিনলাম।
সম্রাট দাশুগুপ্ত
নতুন মন্তব্য করুন