ছোট বেলায় একটা সোনার হাঁসের গল্প পড়েছিলাম। এক দিন এক কৃষক হাট থেকে একটা হাঁস কিনে নিয়ে আসে। এবং সেই হাঁসটা প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়ত। কিন্তু এতে করে কৃষক ও কৃষাণির মন ভরেনি। তারা একই সাথে আরও সোনার ডিমের লোভ করল এবং একদিন হাঁসটাকে কেটে ফেলল অনেক সোনার ডিমের লোভে। কিন্তু হাঁস কেটে তারা কিছুই পেল না! তার পর দুই জনই হায় হায় করতে থাকল!!!
আশির দশকের শুরু হওয়া পোশাক শিল্পকে সেই সোনার হাঁসের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না বোধহয়। যেখানে পোশাক শিল্প কর্মীরা সেই সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মত কাজ করে আর মালিক পক্ষ সেই লোভী কৃষকের ভূমিকায় থাকে। একটু একটু করে গড়ে উঠা সেই শিল্প আজ ১১ হাজার থেকে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণীত হয়েছে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশের অবদান এই পোশাক শিল্প এবং একটা বড় চাকুরী দাতা উৎস।
কিছু মালিকদের অতি মুনাফা লোভের কারণে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার লোকের জীবন হারিয়েছে এবং কয়েক হাজার মানুষ শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ছোটবড় ২৩ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে পোশাক শিল্প কারখানা গুলোতে আর এর বেশির ভাগই কারণ ত্রুটিযুক্ত ভবন নির্মাণ এবং মালিক পক্ষের অসুস্থ ব্যবস্থাপনা।
কিন্তু আজকে এই পোশাক শিল্পই এসে এমন এক সংকট এর মধ্যে এসে পৌঁছেছে সেখান থকে উত্তরণের জন্য আমাদের সবাইকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করতে হবে। এখানে আমি আমার কিছু ভাবনার কথা তুলে ধরব যদিও আমি এই বিষয়ে একদম অজ্ঞ, শুধুমাত্র একজন সাধারন মানুষের ভাবনা নিয়ে এই চিন্তা গুলো।
১। কোন পোশাক শিল্প গড়ে তোলার জন্য ভবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিল্প কারখানার জন্য ইমারত বিধিমালা মেনে ভবন গড়তে হবে আর সেটি নিশ্চিয়তার দায়িত্ব বেশি কারখানা মালিকেরই এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোও এর দায় এরাতে পারে না। নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপেই সব কিছু যাচাই বাচাই করতে হবে। এখন একটা শিল্প কারখানার অনুমোদনের জন্য প্রায় ৩০ টির বেশি জায়গা থেকে অনুমোদন নিতে হয় যা কাগজ পত্রেই পর্যন্ত। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে যাচাই করে প্রতিটি অনুমোদন দিতে হবে। কোন আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে শিল্প কারখানার অনুমোদন দেয়া যাবে না। ঘনবসতি অঞ্চলে শিল্প কারখানার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিরুৎসায়ী করতে হবে। কারখানার যাওয়ার জন্য প্রশস্ত রাস্তা ও পানির পর্যাপ্ত ব্যাবস্তা থাকতে হবে।আইনে কঠিন শাস্তির বিধান রেখে নতুন আইন করতে হবে।
২। আমাদের দেশে পোশাক কারখানা গুলোর জন্য কোন ধরনের নিয়ন্ত্রক বোর্ড নেই যেমনটা রয়েছে বিটিসিএল মোবাইল ফোন কোম্পানির জন্য বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল ব্যাংকের রেগুলেটর হিসেবে কাজ করে। সরকার নিজ উদ্যোগী হয়ে এমন একটা রেগুলেটরি বোর্ড গঠন করবে যেটা পোশাক কারখানার সব রকমের কমপ্লাইন্স মিট করার জন্য চাপ প্রয়োগ করবে এবং তা যথাযত ভাবে নিশ্চিত করবে।
৩। যেকোনো পোশাক শিল্পকারখানার ভবন রাজউক ছাড়া অন্য কোন জায়গা থেকে ভবন নির্মাণ অনুমোদন দেয়া যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে কেউ যেন আবাসিক ও বানিজ্যিক কাজের ভবন শিল্পকারখানা ব্যাবহার না করতে পারে।
৪। ফায়ার সার্ভিস ও সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় মিলে একটা আদর্শ পোশাক কারখানা কি কি ব্যবস্থা থাকা উচিত সেটা নিয়ে একটা সুষ্পট দিকনির্দেশনা তৈরি করতে হবে। এবং সে গুলো বাস্তবায়নের জন্য জোরদার মনিটরিং করতে হবে।
৫। কোন এলাকায় পোশাক শিল্পকারখানা গড়ে তোলার আগে সেই এলাকায় শিল্পকারখানার পরিবেশগত প্রভাব গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
৬। শিল্প পুলিশের পরিধি আরও বাড়াতে হবে এবং তাদেরকে ম্যাজিষ্ট্রি পাওয়ার দিতে হবে।
৭। সকল গার্মেন্টস চাকুরীজীবীদের তথ্য একটা সেন্ট্রাল ডাটাবেজে থাকবে এবং সেটা নিয়মিত আপডেট করা হবে।
৮। মহিলা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনসহ মার্তৃকালীন ছুটি দিতে হবে এবং একটি বেবি কেয়ার সেন্টার থাকতে হবে।
৯। সকল গার্মেন্টস চাকুরীজীবীদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেডিকেল সুবিধা রাখতে হবে এবং সকল ওয়ার্কিং এলাকায় একটি করে ফাস্ট এইড বক্স থাকতে হবে এবং এই গুলোর ব্যাবহার শিখিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি শ্রমিক তার ওয়ার্কিং এলাকায় এক বোতল খাবার পানি ও কিছু শুকনা খাবার রেখে দিবে যেটা কোন আপদকালীন সময়ে প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করবে।
১০। প্রতিটি পোশাক কারখানায় একাধিক বড় গেইট থাকবে এবং অবশ্যই জরুরী গেইট এবং সিঁড়ি থাকতে হবে। সিঁড়ি অবশ্যই প্রশস্ত হতে হবে বের হওয়ার সুবিধার জন্য। গেইটে কাজ চলা কালীন সময় কোন অবস্থাতেই তালা লাগানো যাবে না।
১১। আগুন নেভানোর এক্সটিংগুইসার সব ওয়ার্কিং এলাকায় থাকতে হবে এবং ব্যাবহার নির্দেশিকা বাংলায় লেখা থাকবে। এবং অবশ্যই এগুলো ঠিক আছে কিনা কিছু কিছু দিন পর পর পরীক্ষা করতে হবে।
১২। শ্রমিকদের কাজে যোগ দেয়ার আগে কম পক্ষে এক মাসের সেইফটি ট্রেনিং দিতে হবে।
১৩। শ্রমিক-মালিক-সরকার এই তিন পক্ষের ঐক্যে একটি বেতন নির্ধারণ কমিটি গঠন করা হবে এবং সেই কমিটি বেতন নির্ধারণ করবে এবং প্রতি বছর সেই স্কেল রিভিউ হবে। আই.এল.ও-এর ১৩১ নং কনভেনশনে অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ হবে।
১৪। সরকার শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্পেশাল সেল গঠন করতে হবে যেখান থেকে শ্রমিকের সমস্যা গুলো সমাধান করবে সেই সেল এবং সেই সেলের একটি টোল মুক্ত জরুরী ফোন নাম্বার থাকবে যেখান যেকোনো শ্রমিক ২৪ ঘণ্টাই তাদের অভিযোগ জানাতে পারবে।
১৫। আজকের এই পোশাক শিল্পের সংকটকালে আমাদের বিজ্ঞ রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি হরতালে পোশাক শিল্পের ক্ষতি হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা তাই এই শিল্পকে হরতাল আওতা মুক্ত রাখতে হবে।
১৬। সকল শ্রমিকের জীবন বীমা করিয়ে দিতে হবে এবং তাদের কারখানার ও বীমা করতে হবে মালিকদের।
১৭। পোশাক ক্রেতা ও মালিক পক্ষ মিলে একটি শ্রমিক কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠন করা যেতে পারে। যেখানে প্রতিটি পোশাক থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ও মালিক পক্ষ তাদের লাভের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ এই কল্যাণ ট্রাষ্টে জমা দিবে।
১৮। মালিক ও সরকার পক্ষ মিলে একটি লবিং টিম গঠন করা যেতে পারে যেখানে ঐ টিম ক্রেতা-দেশ গুলো ও পোশাক ক্রেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং আমাদের দেশের এই শিল্পের শ্রমিকের ও কারখানা গুলোর ও বিনিয়োগের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়মিত অবহিত করবে।
১৯। কোন কারখানায় ১০০ এর বেশি শ্রমিক থাকলে সেখানে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করার অনুমতি দিতে হবে।
২০। আমাদের দেশে সস্তা শ্রমের কারণে পোশাক ক্রেতারা আকৃষ্ট হচ্ছে কিন্তু সেটা বেশি দিন না ও থাকতে পারে তাই এখনই সময় শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো ও বিনিয়োগের সুস্থ পরিবেশ বাড়ানো যাতে করে নতুন বিনিয়োগ বেশি করে আসে।
২১। একটি কারখানার উৎপাদন নির্ভর করে কারখানার শ্রমিকের সুস্থ থাকার উপর তাই প্রতিটি পোশাক কারখানা ন্যুনতম স্বাস্থ্য পরিসেবা দিতে হবে।
২২। পোশাক শিল্প ঘন এলাকায় একটি রেস-কিউ সেন্টার গড়ে তুলতে হবে যাতে করে যেকোনো দুর্ঘটনায় সল্পতম সময়ে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা যায়।
২৩। রেডি-মেড পোশাক তৈরির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে এই শিল্পের অন্যান্য কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য এগিয়ে আসতে হবে এবং সর্বোপরি এই শিল্পকে নিয়ে সারাবিশ্বে আমাদের একটা ব্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে হবে।
২৪। পোশাক শিল্পের মান উন্নয়নের জন্য পোশাক শিল্প মালিকদের এই ক্ষেত্রে গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসতে হবে।
নতুন নতুন আরও বিষয় আপনারা এখানে যুক্ত করতে পারেন।
আমরা যদি আমাদের এই বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করতে চাই তাহলে এখনি সময় সম্মিলিত ভাবে সবাই এক সাথে কাজ করা। আমি অনেককেই দেখেছি টিভিতে টকশোতে গিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা বলে এবং অনেক সময় দেখা যায় ঢালাও ভাবে মালিক পক্ষে বিষাদগার করে। আমি তাদের সাথে একটু ভিন্ন মত পোষণ করে বলব আমাদের এখন সময় ঢালাও ভাবে মালিক পক্ষকে বিষাদগার করা না, সময় এই শিল্পের সাথে জড়িত সবাইকে এক সাথে কাজ করা।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে কারখানা ভাংচুর ও জ্বালাও পোড়াও দিয়ে। আমি শ্রমিক নেতাদের বলবো এই ধরনের ধংবসাতক কাজ থেকে শ্রমিকদের বিরত রাখার চেষ্টা করুন এবং সমস্যা সমাধানে মালিক ও সরকার পক্ষের সাথে সংলাপে বসুন।
ডিজনি ২০১৪ সালের পর আর আমাদের দেশ থেকে আর পোশাকে বানাবে না আগেই বলে দিয়েছে আর এখন যদি আমাদের এই অব্যবস্থাপনার কারণে বাকি বড় বড় ব্যান্ড গুলো ডিজনির পথে হাটে তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কোন পর্যায়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রেকর্ড পরিমাণ আছে আর যদি এই সংকট গুলো সমাধান না করা যায় তাহলে এই সবল মুদ্রার মজুদ রোগায় পরিণীত হবে এবং সাথে সাথে প্রায় লক্ষাধিক পোশাক শ্রমিক বেকার হবে।
আমি আমার লেখার ভূমিকায় আমার তীরটা মালিক পক্ষের দিকে ছেড়েছি তা বুঝতে হয়তো কারো সমস্যা হয়নি, আমি মনে করি এই সংকটের মোকাবেলা মালিক পক্ষেরই বেশি এগিয়ে আসা উচিত।
আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও মজবুত করে সাজাই এবং একটি সুস্থ সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলি!
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো, বাংলা নিউজ, বিডিনিউজ
-----বিশ্বজিৎ পোদ্দার (ভালো মানুষ)
দক্ষিন কোরিয়া
মন্তব্য
ইপিজেডের মতো গার্মেন্টস পল্লী বানানো যায় না?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমি আপনার সাথে একমত এবং একে ঘিরে একটা ইকোনোমিক জোন গড়ে তোলা যায়
আমাদের ইউনুস নবীজী নাকি অলরেডি প্রস্তাব দিয়েছেন ৩৫ ডলারের শার্টে ৫০ সেন্ট যাবে শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে গ্রামীণ ব্যাংক অথবা ব্রাকের মাধ্যমে। এইটাকে বিশাল "গেমচেঞ্জিং আইডিয়া" বলে ফেসবুকে দেখলাম কিছু আঁতেল লাফালাফি করতেসে। একজন লিখসেঃ
এইটা যে কিভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করবে সেইটাই বুঝতেসি না!
আইডিয়াটা খারাপ না! কিন্তু এটা গ্রামীন বা ব্রাকের মত কোন এনজিও কে দিয়ে কেন? এটা তো শ্রমিকদের মধ্যে থেকেই কোন সংগঠনের করা উচিত কারন এটা শ্রমিকের টাকা।
শ্রমিক অথবা কোন সরকারী সংগঠনের মধ্য দিয়ে টাকা আসলে তো নবীজীর সামাজিক ব্যবসা চলবে না। আমার তো ধারণা তাঁর মূল লক্ষ্য হল গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করা।
ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ভাল ব্যবসায় চলছে। এবার পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের কল্যান নিয়ে নতুন ব্যাবসায়ের আভাস পাচ্ছি। আরও একটা পুরষ্কার জুটতে পারে।
নতুন মন্তব্য করুন