কেউ যদি দেবতাদের অপমান করে থাকে, দেবতারাই তার ব্যবস্থা করুক। - রোমান সম্রাট তিবেরিয়াস (খ্রীঃ ১৪-৩৭)
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারগুলোর একটি হল, অন্য ধর্মের প্রতি আমাদের হুজুর সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান ভালবাসা! যেমন, সেদিন এক ধর্মীয় নেতার মুখে শুনলাম, "এই নাস্তিক ব্লগারদের হাতে এমনকি হিন্দু বা খ্রিস্টান ধর্মও নিরাপদ না, এরা সব ধর্মের প্রবর্তকদের নিয়ে কটাক্ষ করে।''
ঐ ধর্মীয় নেতার মুখের কথা যদি হয় তার মনের কথা, তাহলে বলতে হয়, উনি নিজ ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মগুলিরও সমান নিরাপত্তা কামনা করেন এবং প্রতিটি ধর্মের জন্য এমন একটি 'নিরাপত্তা চাদর' চান, যেখানে ধার্মিকগণ একটি নাস্তিক-মুক্ত পরিবেশে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে, নির্বিবাদে আর নির্ভয়ে ধর্মকর্ম সারতে পারবেন। নির্বিবাদ ধর্মকর্ম করতে চাওয়া কিন্তু দোষের নয় এবং জাতিসংঘের 'সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা'র ১৮ অনুচ্ছেদ এবং সংবিধানের 'তৃতীয় ভাগ: মৌলিক অধিকার, ৪১তম ধারার ১ উপধারার ক' অনুযায়ী সহি। কিন্তু 'নাস্তিকমুক্ত পরিবেশ' চাইছেন কেন ধার্মিকগণ? বা, অন্যভাবে প্রশ্ন করলে, একটি 'নাস্তিকরোধক নিরাপত্তা চাদর' কি ধর্মগুলোর নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে সক্ষম? ইতিহাস কিন্তু বলে অন্য কথা। ইতিহাসের পাতা সামান্য উল্টালেই পাওয়া যায়, নাস্তিকেরা নয়, বরং ধর্মগুলি নিজেরাই একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করেছে যুগে যুগে, একে অপরের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যমদূত।
ইতিহাসের পাতা খুললে আরেকটা চরম সত্য বেরিয়ে আসে, তা হল, নাস্তিকেরা নন, বরং ধর্মনেতারাই অন্য ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ওল্ড টেস্টামেন্টের অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব আব্রাহামের একটি জগদ্বিখ্যাত গল্পটির (মিডর্যাশ ৩৮ঃ১৩ থেকে প্রাপ্ত) কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আব্রাহামের পিতা শুধু একজন একনিষ্ঠ মূর্তি উপাসকই ছিলেন না, মূর্তির এক বড় কারিগরও ছিলেন। তো একদিন তিনি আব্রাহামকে দোকানে বসিয়ে সফরে বের হন। এসময় এক লোক মূর্তি ক্রয় করতে এলে আব্রাহাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'আপনার বয়স কত?' লোকটি জবাব দেয়, "পঞ্চাশ, ষাট হবে''। আব্রাহাম লোকটিকে বলেন, ''এটা কি খুবই দুঃখজনক নয় যে, ষাট বছরের একজন লোক একটি একদিন-বয়সী মূর্তির কাছে মাথা নত করতে চাচ্ছে?" লোকটি লজ্জিত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
এর কিছুক্ষন বাদে এক মহিলা দেবতাদের নিবেদনের উদ্দেশ্যে এক ঝুড়ি রুটি দিয়ে গেলেন আব্রাহামকে। আব্রাহাম হঠাৎ একটি হাতুড়ি হাতে নিলেন, তারপর সবচেয়ে বড় মূর্তিটিকে বাদ দিয়ে বাকি সব মূর্তি ভেঙ্গে ফেললেন। সবশেষে, বড় মূর্তিটিখানার হাতে হাতুড়িটি ঝুলিয়ে দিলেন।
আব্রাহামের পিতা বাড়ি ফিরে তার স্বহস্তে নির্মিত মূর্তিগুলির এই হাল দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, জিজ্ঞাসা করেন, ''কে করেছে এই কাজ?'' আব্রাহাম বিচলিত না হয়ে উত্তর দেন, " এক মহিলার অনুরোধে আমি এক ঝুড়ি রুটি মূর্তিগুলোর মাঝে বণ্টন করতে গেলে, প্রতিটি মূর্তিই রুটি পাওয়ার জন্য হাউকাউ করতে থাকে। এ গোলমালের মধ্যে হঠাৎ বড় মূর্তিটি হাতুড়ি দিয়ে অন্য সব মূর্তিকে হত্যা করে পুরো খাবারটা নিজেই গ্রাস করে।" আব্রাহামের পিতা ছেলের কথা বিশ্বাস করতে না পেরে বলেন, "এটা কি করে সম্ভব? মূর্তিগুলোর কি চেতনা আছে?" তখন আব্রাহাম ছুঁড়ে দেন তার সেই ইতিহাস-খ্যাত উক্তি: "তোমার নিজের মুখেই কিন্তু স্বীকার করলে, মূর্তিগুলোর কোন ক্ষমতা নেই; তাহলে কেন তাদের পুজো কর?"
উপরের কাহিনী থেকে সুস্পষ্ট, ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত আব্রাহাম শুধু বাইরের কোন ব্যাক্তির ধর্মকে নিয়েই বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেননি, একই সঙ্গে নিজের পিতাকেও তার অনুসরিত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন। আমরা নিউ টেস্টামেন্টেও দেখি প্রায় একইভাবে, প্রচলিত ধর্ম বা তার দেবতাদের নিয়ে কঠোর সমালোচনামূলক বানী:
এবং যে মানুষগুলো এইসব প্লেগ ( বা ধ্বংসযজ্ঞ) দ্বারা নিহত হয়নি, তারা এখনও তাদের স্বহস্তের কাজগুলোর জন্য অনুতপ্ত নয়, অর্থাৎ, তাদের উচিত নয় 'ডেভিল' এবং স্বর্ণ, রৌপ্য, পিতল, পাথর ও কাষ্ঠ-নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করা, যাদের না আছে দেখার ক্ষমতা, না শোনার, না হাটতে পারার। ( বাইবেল, রেভেলেশন, অধ্যায়: ৯, ভার্সঃ ২০)
খেয়াল করে, প্রচলিত ধর্মের দেবতাদের 'ডেভিল' পর্যন্ত আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ আশ্চর্য হল, 'বাইবেল' কর্তৃক সনাতন ধর্মের সমালোচনা বা 'আব্রাহাম' কর্তৃক সনাতন দেবতাদের বুকে হাতুড়ি চালানোর কাজ বাইবেল বিশ্বাসীদের কাছে কোন অফেন্স হিসেবে গণ্য হয় না। বরং, এই সমালোচনা সত্য উদঘাটনের এক অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবেই মর্যাদা পেয়ে আসছে আজ অবধি!
এভাবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ের অধিকাংশ ধর্ম-নায়কেরা যেখানে আবির্ভূত হয়েছে, সেখানকার প্রচলিত ধর্মমতগুলোকে কঠিন সমালোচনা করেছেন, সনাতন ধর্মগুলোর অসারতা (তাদের দৃষ্টিতে) বোঝাতে গিয়ে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন সেগুলোকে। আজকের দিনেও আমরা যে তার ব্যতিক্রম দেখতে পাই, তা না। যেমন, ধরা যাক, আমাদের আলোচিত ধর্মনেতা একজন হিন্দুর কাছে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে চান; সেক্ষেত্রে তাকে কি হিন্দু ধর্মের তুলনায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বগুলো (তার দৃষ্টিতে) তুলে ধরতে হবে না? এই শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার কাজটি উনি কিভাবে করবেন হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করা ছাড়া? বা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে গেলে কি অবধারিতভাবেই চলে আসবে না হিন্দু ধর্মের সমালোচনা?? এমনিভাবে, যেকোনো ধর্ম যদি অন্য যেকোনো ধর্মাবলম্বীকে (জোরপূর্বক না, এমনকি স্বেচ্ছা-পদ্ধতি প্রয়োগে হলেও) নিজ ধর্মে ধর্মান্তরের আহবান জানাতে চায়, তাহলে ঐ অন্য ধর্মটির সমালোচনা কি অবধারিত নয়? আসলে, সামান্য সমালোচনা ছাড়া যে ধর্ম-মত প্রচার ও প্রসার হয় না, তার প্রমান পেতে চাইলে জ্ঞান-রাজ্য চষে বেড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না, ধর্মের ইতিহাস হাতড়ালেই চলে! বস্তুত, ধর্মপ্রচারের অধিকার সাথে ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার এত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, একটাকে অন্যটা থেকে আলাদা করা খুব কঠিন ।
যাহোক, নিজ ধর্ম/মত প্রচার, প্রসার বা অন্য ধর্ম/মতের সমালোচনার অধিকার কি সঙ্গে করে নিয়ে আসে কোন ধর্মাবলম্বীর মনে আঘাত দেয়ার অধিকারও? বা, এই মনে আঘাত দেয়ার অধিকার কি একটা বাই-প্রোডাক্ট বা অবধারিত আউটপুট, যা কোন ধর্ম প্রচার/প্রসারের সাথে অবধারিতভাবেই চলে আসে? সরাসরি উত্তর হচ্ছে: না। আসলে এটা বোধগম্য নয় যে, কি করে কোন ধর্মাবলম্বীর মনে আঘাত লাগতে পারে,
১.যদি না কেউ কোন ধর্মাবলম্বীর অনিচ্ছা স্বত্বেও তার ঘরে জবরদস্তিমূলক কড়া নাড়া অব্যাহত রাখেন, তাকে নিজ ধর্মে/মতে ধর্মান্তরিতের/দলভুক্তির আশায়, বা,
২. যদি না কেউ কোন ধর্মাবলম্বীকে শুধু তার ধর্মের জন্য উপহাস-ঠাট্টার পাত্র করে তোলেন, বা,
৩. যদি না কেউ কোন ধর্মাবলম্বীর (যার হয়ত যেকোন যৌক্তিক বিশ্লেষণ গ্রহণ করার ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল) মনকে কুশ্রী-কদাকার-অযুক্তি দিয়ে বিষিয়ে তোলেন? বা,
৪. যদি না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আঘাত উৎপাদন করা হয় ?
উপরের 'যদি-না' গুলো হচ্ছে, যেকোনো ধর্ম/মত প্রচার/প্রসার বা তজ্জনিত সমালোচনার অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্ব-জনিত বিধিনিষেধ, যার অমান্যতা অধিকারটিকে সংকুচিত করেই না শুধু, পুরো প্রক্রিয়াটিকেই হাস্যকর করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে, কোন ব্যাক্তি যদি গণতান্ত্রিক দায়িত্ব/বিধি-নিষেধগুলো মানতে না চান, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী নিয়ে সমালোচনা করার অধিকারও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হারান তিনি।
কিন্তু একজন মানুষের যেকোনো ধর্ম পালনের অধিকারের সাথে সমালোচনার অধিকারের যোগসূত্র তো পাওয়া গেল, কিন্তু সে কোন ধর্মের অধীনের রয়েছে, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতাও কি তার আছে? এর উত্তর খোঁজার আগে আমার পরিচিত এক কামাল ভাইয়ের কথা বলে নেয়া যাক। কামাল ভাই একটি ইসলাম সম্মত জীবনযাপন করেন, কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট নন, একটা ইসলাম সম্মত সমাজব্যবস্থাও তিনি প্রত্যাশা করেন। এজন্য তিনি একটা ইসলামি দলের খোঁজ করছেন, যারা তাকে ইসলাম-সম্মত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রদান করতে পারবে। তিনি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে অবাক হলেন, কম করেও ১১ টি সরাসরি ইসলামিক দল আছে, এছাড়া প্রায়-ইসলামিক দল আছে আরও কটা। এখন উনি কি করবেন? কিছুক্ষণ মাথা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, নিশ্চয়ই দলগুলোর গন্তব্য এক, কিন্তু পথ ভিন্ন। তাই তিনি পথের সন্ধান করতে বক্তৃতা-বিবৃতি আর দল-দর্শন পড়তে শুরু করলেন, কিন্তু অচিরেই আবিষ্কার করলেন, এই দলগুলির অনেকেই একে অন্যকে এমনকি 'ইসলামি দল' মানতেই নারাজ। তাহলে এখন উনি কি করবেন? এদিকে আ'লিগ-বিএনপি-জাপাও গলা ফাটিয়ে সমানে জানান দিচ্ছে, 'আমরাও ইসলামি, আমাদের কাছে এসো।' তাহলে কামাল ভাই কি করবেন এখন? তিনি কোথায় খুঁজবেন ইসলামি সমাজব্যবস্থার নিয়ামক? কোথায় পাবেন তার ইসলাম?
আমাদের কাছে পরিস্থিতি জটিল ও ঘোলাটে মনে হলেও কামাল ভাইয়ের কাছে মনে হয়নি। উনি কিন্তু ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন বাংলাদেশের নিবন্ধিত যেকোনো একটি দল। বস্তুত কামাল ভাইয়ের একটি নিজস্ব ধর্মিয় দর্শন আছে, যা ছোট থেকে দেখতে-দেখতে, বুঝতে-বুঝতে তার ভেতর তার মত করেই গড়ে উঠেছে; কেউ দাবি করতে পারে না, কামাল ভাইয়ের এই একান্ত নিজস্ব ধর্মিয় দর্শনের উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ আছে। এই দর্শন একান্ত স্বতন্ত্রভাবেই কামাল ভাইয়ের মধ্যে সময় ও সামাজিক বিবর্তনে জন্ম নিয়েছে। ফলে এমন হয়েছে যে, কামাল ভাইয়ের যদি মনে হয়, আ'লিগের ইসলামের সাথে তার মেলে, তিনি আ'লিগেই যাবেন। আবার তার একান্ত ইসলামি দর্শন খেলাফতের সমরূপ হলে, তিনি সেখানেই দৌড়ে দেবেন। কামাল ভাইয়ের ঘটনাটি থেকে আমরা যা বুঝতে পারি, তা হল, কোন মানুষ কোন ধর্মের, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক শুধু সে মানুষটির রয়েছে, অন্য কারো নয়। কারণ তার একান্ত নিজস্ব ধর্মিয় অবয়বের খবর তিনিই জানেন, অন্য কারো সেই অন্দরে প্রবেশের অধিকার নেই। একজন মানুষ মুসলিম না হিন্দু, তা কেবল সেই বলতে পারে, কোন ধর্মিয় নেতা নন। আবার ঐ মানুষটি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিলে, ইসলামের কোন ধারাটি (যখন বহু ধারা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে) তার জন্য, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিকও সে।
প্রকৃতপক্ষে, কোন এমন ফর্মুলা যদি থাকত, যা দিয়ে ক্যালকুলেটর করে বলে দেয়া যায়, ইনি মুসলিম বা ইনি অমুসলিম, তাহলে একাধিক ইসলামি দল থাকত না বা এক ইসলামি দল অন্য ইসলামি দলকে অনৈসলামিক আখ্যায়িত করতে পারত না। কারণ সেক্ষেত্রে ফর্মুলার প্রয়োগেই মুসলিম নামধারী অমুসলিম দলগুলো আউট অব সিন হয়ে যেত।
আর যেহেতু একজন মানুষের ধর্ম নির্ধারণের সবটুকু দায়িত্ব শুধু তার কাঁধেই বর্তায়, তাই কোন দল, যেমন, 'খেলাফত' একজন মুসলিমকে যদিও বা আহবান করতে পারে তার পথে-মতে, কিন্তু কখনোই এই ঘোষণা দেয়ার অধিকার রাখে না যে, 'আমার তরিকায় না এলে, তুমি আর মুসলিম থাকো না।' একইভাবে, কোন ব্যক্তি যদি নিজেকে কাদিয়ানী মুসলিম দাবি করে, তাকে অমুসলিম ঘোষণা করার অধিকার কারো থাকতে পারে না। উদাহরণস্বরুপঃ 'খেলাফত' নামক দলটির অধিকারের চূড়ান্ত সীমানা তার দলীয় গণ্ডির মধ্যেই থাকতে বাধ্য এবং এ অধিকার প্রয়োগ করে তারা আইনসম্মত-ভাবেই ঘোষণা দিতে পারে কাদিয়ানীরা তাদের (মানে, খেলাফত নামক দলটির) দলভুক্ত নয়; তবে এ পর্যন্তই। এরপর অধিকারের সীমানা ডিঙ্গিয়ে যদি তারা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করে, তাহলে তা কিন্তু হবে 'সার্বজনীন মানবাধিকার' ও 'সংবিধানের' লঙ্ঘন, যা আমাদের আলোচ্য ধর্মিয় নেতা নিশ্চয়ই চাইতে পারেন না, যেহেতু তেমন কোন ফর্মুলা নেই বা তেমন কোন সংগঠন নেই যার উপর একজন মানুষের মুসলমানি-ত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা সর্বসম্মতভাবে অর্পিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্ধারণের ভারটি বরং উপরওয়ালার উপর ছেড়ে দেয়াটাই উত্তম নয়কি, যেহেতু এটি তারই ব্যাপার?
কিন্তু ধর্ম প্রচার, প্রসার, সমালোচনা, নিজস্ব ধর্মীয় আইডেন্টিটি ঠিক করার অধিকার কি শুধু প্রচলিত ধর্মগুলোর জন্য বরাদ্দ? কি হবে যারা প্রচলিত ধর্মগুলোতে বিশ্বাস করে না তাদের? বা যারা কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না তাদের? আমাদের আলোচিত ধর্ম নেতা যদি একজন হিন্দুর দ্বারে নিজের ধর্ম প্রচারের অধিকার প্রয়োগ করতে চান, তাহলে একজন হিন্দুরও কিন্তু তার দ্বারে হিন্দু ধর্মের প্রচার ও উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রচার-প্রসারের অধিকার অস্বীকৃত ধর্ম বা মতের উপরও প্রযোজ্য হবে, কেননা, আমরা আগেই দেখেছি, ধর্ম বা মত কোন স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির বিষয় নয়, একান্তই নিজস্ব চেতনালোকে তৈরি তা। তাই ধর্ম/মত প্রচার-প্রসারের অধিকার থাকবে কাদিয়ানীদের, অন্য সব সংখ্যালঘুদের!
একটা সম্পূরক প্রশ্ন উঠে আসে এক্ষেত্রে, কেউ যদি জগদীশ্বরে বিশ্বাস না করেন, তার কি তার বিশ্বাসহীনতার মত প্রচারের/প্রসারের অধিকার রয়েছে যেকোনো বিশ্বাসী ধর্মপ্রচারকদের মত? অথবা, তার কি অধিকার রয়েছে তার বিশ্বাসহীনতার মত প্রচার করতে গিয়ে অন্য ধর্মের সমালোচনা করার? যদি বিশ্বাসী ধর্মপ্রচারকদের ধর্ম প্রচার ও প্রসারের অধিকার মেনে নিতে হয় সংবিধান ও সার্বজনীন মানবাধিকারের আলোয়, তাহলে জগদীশ্বরে বিশ্বাস-হীনদের অধিকার অস্বীকার করা যায় কোন যুক্তির বলে? কারণ ধর্মিয় স্বাধীনতা একটা নাগরিক স্বাধীনতা, যার পূর্বশর্ত অবশ্যই চিন্তা ও যুক্তির স্বাধীনতা । আমরা যদি বিশ্বাস-হীনদের মত প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা হরণ করি,আমরা কিন্তু চিন্তা ও যুক্তির স্বাধীনতাকেই হরণ করি। আর চিন্তা ও যুক্তির স্বাধীনতা যখন নিহত হয়, তখন ধর্মিয় স্বাধীনতাও কি বিলীন হয় না? কারণ কে তখন আর চিন্তা ও যুক্তি দিয়ে এমনকি ধর্মিয় স্বাধীনতার ঝাণ্ডা উচ্চে তুলে ধরবে? এমন কোন কণ্ঠস্বর থাকবে কি তখন? আমরা আগেই তো সেই স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে গলা টিপে মেরে ফেলেছি! জল লক যিনি বিশ্বাসী এবং যুক্তিবাদী - দুটোই ছিলেন, চিন্তা ও যুক্তিকে অগ্রাহ্য করার বিপদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:
যে ব্যক্তি প্রত্যাদেশের জায়গা করে দেওয়ার জন্য যুক্তিকে সরিয়ে নেয়, সে ঐ দুই বস্তু থেকেই আলো নিভিয়ে ফেল; এবং এক অদৃশ্য তারকার দূরাগত আলো টেলিস্কোপে গ্রহণ করার নিমিত্ত কোনও মানুষকে তার নিজের চোখ তুলে ফেলতে রাজী করানোর মত প্রায় একই ধরণের কাজ করে সে।
সুতরাং, ধর্মের/মতের স্বাধীনতা থাকবে, সে ধর্ম/মতকে ব্যাখ্যা ও উপলব্ধির ব্যক্তিক অধিকার বিদ্যমান থাকবে, সর্বোপরি, তা পালন ও প্রচারের জন্য সমালোচনার স্বাধীনতাও থাকবে দায়িত্বজনিত বিধিনিষেধ মেনেই - আর এসব মেনে নেয়া হলেই শুধু ধর্মের যে সাংবিধানিক ও সার্বজনীন অধিকারের কথা সগৌরবে ব্যক্ত করেন আমাদের রাজনৈতিক, ধর্মিয় ও সাংস্কৃতিক নেতারা, তার প্রকৃত মর্যাদা দেয়া হবে। সত্যি বলতে কি, চিন্তা ও যুক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে, ধর্মিয় স্বাধিনতাও নিশ্চিত হবে; অন্যদিকে, চিন্তা ও যুক্তির কন্ঠরোধ করা হলে, ধর্মগুলিও পরাধীনতার শেকলে বন্দী হবে কালবিলম্ব না করেই। প্রশ্ন হচ্ছেঃ আমাদের আলোচ্য ধর্মিয় নেতা, যিনি সব ধর্মের নিরাপত্তার জন্য উদার ও উচ্চকন্ঠ, তিনি চিন্তা ও যুক্তির নিরাপত্তার জন্য সামান্য জায়গা ছেড়ে দেবেন কিনা? যদি না দেন, তাহলে তার নিজের জায়গাটিই কিন্তু আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে পড়বে। ইতিহাস তাই বলে।
অন্য সকল স্বাধীনতার উপরে আমাকে জানার, বলার, এবং আপন বিবেক অনুসারে তর্ক করার স্বাধীনতা দিন। - জন মিল্টন
কাজি মামুন
১৮।০৫।২০১৩
মন্তব্য
ধর্ম নিয়ে যে হারে কাঁদা ছুড়া ছুড়ি শুরু হয়েছে ,ধর্ম এখন নিজেই সংকটে আছে । ধর্ম নিয়ে ওতি বাড়াবাড়ি বলেন,রাজনীতি বলেন এই সব সহ্য করা কঠিন ।
ভেবেছিলাম অনেক আলোচনা করার সুযোগ পাওয়া যাবে; কিন্তু লেখাটা এতই দুর্বল হয়েছে যে কাউকেই আলোচনায় আগ্রহী করতে পারেনি; সচল পরিবারের সাথে অনেকদিনের সম্পর্কের কারণেই হয়ত নিতান্ত স্নেহভারেই প্রকাশিত হয়েছে এই দুর্বল লেখা । সচলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি এই সুযোগে!
আর আপনার প্রতিও কৃতজ্ঞতা, এই দুর্বল ব্লগে আলোচনা করার জন্য!
আসলে ধর্মকে নাস্তিকেরা সংকটে ফেলে না, বরং ধর্মগুলি নিজেরাই একে অন্যের (এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের) যমদূত হয়ে দাঁড়ায় --- ইতিহাসের পাতায় পাতায় তারই স্বাক্ষর, ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত পাতাগুলিই ধর্মযোদ্ধাদের দখলে!
ভাল থাকবেন, আপু।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা মোটেও কাম্য নয়! কিন্তু কে শোনে কার কথা? এমনকি এ বিষয়ক ধর্মীয় আদেশ-নির্দেশও শুনতে নারাজ ধর্মের ধ্বজাধ্বারীরা! এর থেকে পরিত্রান পাওয়ার উপায় একমাত্র শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, এবং সেটা একদম রুট লেভেলে নিয়ে যেতে হবে!
বটতলার উকিল ৷
নতুন মন্তব্য করুন