গত পরশু গিয়েছিলাম রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। সেখানে সারাদিন নৌকায় বন ও আশে পাশের দুই তিনটা গ্রাম ঘোরা শেষ হলে সন্ধ্যায় ক্যাম্প করলাম আলীনগর নামের এক ছোট্ট গ্রামে, গোয়াইন নদী ও বিলের মাঝখানে। আজকের গল্পটা হতে পারতো চমৎকার সেই ঘুরে ব্যাড়ানোর স্মৃতি গুলো নিয়ে , পানির নীচে তলিয়ে যাওয়া এক স্বর্গীয় বন, বনের সাপ, উল্লুক বা পাখিদের নিয়ে।
কিন্তু না,আজকের গল্পটা হবে আলীনগর নামের ছোট্ট এক গ্রাম, গ্রামের মানুষ ও একটি স্কুল নিয়ে।
আলীনগর, সিলেটের খাদিমনগর ইউনিয়নের একটা ছোট্টো গ্রাম। রাতারগুল বন ঘেঁষেই গোয়াইন নদীর পাড়ে অবস্থিত। আলীনগর কে প্রত্যন্তের কাছাকাছি এক এলাকা বলা যায়। শহর বা মফস্বলের শেষ ছোয়া থেকেও আলীনগর প্রায় সাত কিলো দূরে। সেখানে যাওয়ার কোন পাকা রাস্তা পর্যন্ত নাই। বর্ষা কালে কেবল বন নয়, ডুবে যায় আলীনগরের আশে পাশে সমস্ত কৃষিজমি ও রাস্তাঘাট। আলীনগর রুপান্তর হয় এক দ্বীপে, পানি উঠে আসে বাড়ীর উঠান পর্যন্ত -চলাচলের একমাত্র বাহন থাকে নৌকা। প্রকৃতি তাঁদের ওপর কখনোই সদয় হয় না, বন্যার পানি বাড়লে মাঝে মাঝে নিজেদের ঘরবাড়ি ও চলে যায় পানির তলে- অথবা কোনদিন প্রচন্ড ঝড় হলে ঘড়বাড়ি কোথায় উড়ে যায় তা নিজেরাও হয়তো জানে না তাঁরা। এখানকার মানুষদের ছয়মাস কৃষিকাজ ও ছয়মাস মাছধরে কাটে। তাঁরা একই সঙ্গে কৃষক এবং জেলে।
যেখানকার মানুষদের ক্রমাগত প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন নির্বাহ করতে হয় সেখানে শিক্ষা এক সুদূরপ্রসারী ভাবনা। কি অবস্থা সে গ্রামের শিশুদের? তাঁদের পড়াশোনার? সবচে কাছের স্কুল আলীনগর গ্রাম থেকে তিন কিলো দূরে। বর্ষায় পানিতে ভেসে গেলে তাঁদের নৌকা নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। কিন্তু তা আসলে সম্ভব হয়ে ওঠে না, পরিবারের একমাত্র নৌকা যায় মাছ ধরতে, স্কুলের চেয়ে অন্ন তাঁদের জন্য বেশি গুরুত্বপুর্ন, এমন কি অনেক পরিবারের নৌকা পর্যন্ত নাই। পুরো বর্ষাটাই দ্যাখা যায় শিশুরা স্কুল থেকে দূরে থাকে।
কিন্তু এই দুরাবস্থার মাঝেও গ্রামের কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল। সে সকল মানুষ গ্রামের অন্যদের সহযোগিতায় ২০১২ সালে গড়ে তোলে ‘আলীনগর শিশু শিক্ষাকেন্দ্র’ নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিজেরা চাদা তুলে নিজেরা শ্রম দিয়ে একটা টিনের ঘর তোলা হয়, ঘরের দেয়ালে চমৎকার একটা সাইনবোর্ড টানানো হয়। গ্রামের এক তরুন ‘শ্রী মিন্টু বাবু’ ও তরুনী ‘নাজমা বেগম’ মাত্র দুজন শিক্ষক দায়িত্ব নেন শিক্ষা বিস্তারের। শুরু হয় গ্রামের স্বপ্নের স্কুল। তাঁদের দিকে সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দ্যায় ‘কারিতাস বাংলাদেশ’ নামে এক এন জি ও। বিনা মুল্যে তাঁরা শিক্ষা উপকরন ও শিক্ষকদের একটা নামমাত্র বেতন দ্যায় তাঁরা। দুজন শিক্ষক বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিতা মাতাদের বোঝান শিক্ষার গুরুত্ব। যেখানে অভাবের সংসারে শিশুরাও দিনে চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা উপার্যন করে সেখানে শিশুকে পাঠশালামুখী করাটা খুব দুঃসাধ্য কাজ। এই কাজটাই করেছেন মিন্টু বাবু ও নাজমা বেগম। তাঁদের স্কুলে এক বছরে শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪০ জনে। বিনামূল্যে এই ১৪০ জন শিশু কে এক ঘরের পাঠশালায় পড়ানো হয় ব্যাচ করে।
কিন্তু সেই এক ঘরের পাঠাশালায় ও এখন আর ক্লাশ হচ্ছে না। কারণ গত এক তারিখে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে এক ঘরের আলীনগর শিশু শিক্ষাকেন্দ্র উড়ে চলে গেছে। তার কয়েকদিন আগে আর এক ঝড়ে বিদ্যালয়ের টিনের চাল উড়ে যায় কিন্তু পরে গ্রামবাসী নিজেদের উদ্যোগেই আবার তা মেরামত করে। কিন্তু ১ তারিখের ঝড়ে বিদ্যালয়ের যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তা মেরামত করতে গ্রামবাসীর প্রায় আশি হাজার টাকা লাগবে। যা তাঁদের পক্ষে এ সময় যোগাড় করা অসম্ভব। ‘কারিতাস বাংলাদেশ’ তাঁদের দুই হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে- তাঁরা চেয়ারম্যান এর কাছে দরখাস্ত করেছে- কিন্তু কোন ফল পান নি। কিন্তু মিন্টু দাস ও নাজমা বেগমেরা ভেঙ্গে পড়েন নি- বাধ্য হয়ে ক্লাশ নেয়া হচ্ছে আলীনগর মন্দিরে। আসলেই এ বিশ্ব মোদের পাঠশালা।
যাহোক এ সময় নিরুপায় গ্রামের লোকেরা আমাদের সাহায্য চায়, বিপদ্গ্রস্থ মানুষ খড়কুটোকেও আশ্রয় মানে । সহজ সরল গ্রামবাসী রা ভাবে আমরা অনেক বড় কিছু, বিশাল কিছু, আমরা চাইলে হয়তোবা তাঁদের স্কুল্টাকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারবো। তাঁদের বোঝাতে পারিনা আমরাও তাঁদের মতই সাধারন মানুষ। তারপরেও আমাদের দিকে আশায় মুখ তুলে থাকে তাঁরা – আমরা তাঁদের কথা দিয়ে এসেছি আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করব। ব্লগে আমরা বিপুল সঙ্খ্যক মানুষ আছি- হয়তো আমারা সামান্য চেষ্টা করলেই ‘আলীনগর শিশু শিক্ষাকেন্দ্র’ আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। এক ঘরের সেই পাঠশালা আবারো মুখর হবে কলতানে। হয়ত আমরা সাহায্য না করলেও তা হবে- হতেই হবে- কারণ আমি জানি এদেশের মানুষেরা অনেক বেশি সাহসী – সামান্য কোন ঝড় ঝঞ্ঝা স্বপ্ন হরন করতে পারে না।
যদি আপ্নারা কেউ সাহায্য করতে চান তবে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারেন-
কবীর আহমেদ
সভাপতি, “আলীনগগর শিশু শিক্ষাকেন্দ্র”
মুঠোফোন- ০১৭৩৬৮৫২৪৪৮
নীচে আলীনগর শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের কিছু ছবি দিলাম (মুঠোফোনে তোলা)-
-----
পিনাক পাণি (নিবন্ধিত নাম)
মন্তব্য
সুবোধ অবোধ
আশ্চর্য হলেও সত্য, পাকিস্তান আমলে গ্রামের অধিকাংশ স্কুলের চিত্রই এমন ছিল, ছাত্রদের নাকি মাইলের পর মাইল হাঁটতে হত, বর্ষায় জল-কাদায় একাকার হয়ে স্কুল-গমন করতে হত। মুরব্বিদের মুখ থেকে শোনা।
শ্রী মিন্টু বাবু এবং নাজমা বেগমকে স্যালুট! ওনাদের মত মানুষ আছেন বলেই শিক্ষা আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হবে না, শিক্ষার আলো তারা জ্বালিয়েই যাবেন, যত প্রতিকূল পরিবেশই থাকুক না কেন।
এমন একটি চমৎকার বিষয় নিয়ে লেখার জন্য এবং স্কুলটির বর্তমান সমস্যা সবার নজরে আনার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই।
এমন চমৎকার লেখাটির জন্য সাধুবাদ জানাই।
নতুন মন্তব্য করুন