আমার বাবা তাঁর ছেলেবেলায় বাবা-মা'কে হারিয়েছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় যে, সামান্য বুদ্ধি হওয়ার পর বাবা তাঁর এক ভাবীকে জেনেছেন মা বলে, ভাইকে জেনেছেন বাবা হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর সেই সম্বোধন টিকে থাকেনি। বালকবেলায় বাবা যখন সেই সত্যটা জানলেন তখন তা কেমন প্রভাব ফেলেছিলো তাঁর শিশুমনে - আমার ভাবনায় আসেনা। ৬৭-৬৮ বছর আগে বিধাতা আমার বাবার জীবনটা একরকম অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই দূর্গম গিরি উনি কিভাবে পার করে জীবনের জল পান করলেন তা এই একবিংশ শতকে এসে মধ্যবিত্ত সংসারে বেড়ে ওঠা আমার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়না। একটি অজ পাড়াগাঁ থেকে বাবা কিভাবে তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করেছিলেন তা আমার কাছে এখনো বিস্ময়, আমার সন্তানদের কাছে তা রূপকথার মতো শোনায়। কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল, লেখাপড়ার দৌড় মক্তব পর্যন্ত এমন একটি পরিবারে লেখাপড়া করতে চাওয়া বাবুগিরির করতে চাওয়ার মতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে তা আমার বাবার মত ভুক্তভোগিরা জানেন ভালোভাবেই। জীবনের এই টানাপোড়েনের সময়কালে বাবার বড়বোন ও দুলাভাই তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। তাঁদের কাছে থাকার সময়টুকু বাবা তাঁর জীবনের জন্যে অনেক মূল্যবান বলে মনে করেন। প্রতিদিন আট মাইল রাস্তা হাঁটতে হতো বাবাকে স্কুলে যেতে আসতে। এরপর কলেজ করতেন প্রতিদিন চব্বিশ মাইল রাস্তা সাইকেল চালিয়ে। শরীরের উপর এই অত্যাচার এখন তাঁর ভাটির জীবনে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। পায়ের ব্যাথায় বাবা এখন খুব কম সময়ই ভালো থাকেন। চেয়ারে বসে নমাজ পড়েন। সিঁড়ি ভাঙ্গতে অনেক কষ্ট পান যদিও তবু তা হাসিমুখে মেনে নেন। তাঁর কন্ঠ আমাদের চেয়ে অনেক সতেজ। কোন চাহিদা নেই, না পাওয়ার বেদনা নেই। নির্মোহ, উদার একজন সাদামনের মানুষ।
যৌবনে বাবা খুব রাগী ছিলেন। আমরা তিন ভাই-বোন আমাদের ছেলেবেলায় তাঁর হাতে অনেক মার খেয়েছি। তবে মার দেয়ার পরদিন বাবা আমাদেরকে অনেক আদর করতেন। আমি যখন একটু বড় হয়েছি, মার খেলে যখন ছোট ভাই-বোনের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারিনা, বাবার ধমক আত্মসন্মানে লাগে, তখন বাবার পরদিনের আদর আমার কাছে অসহ্য লাগত। সেটা বাবাও নিশ্চয়ই বুঝতেন। তাইতো আমি ঘুমিয়ে পড়লে বাবা আমার পাশে বসে বা শুয়ে একটানা হাত বুলিয়ে যেতেন গায়ে-মাথায়, আর মুখে অনেক আদরের কথা বলতেন। যেন মারের ব্যাথা উনি আদর দিয়ে ভুলিয়ে দিতে চাইতেন। এরকম সময়ে জেগে গিয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকা ছাড়া অন্য উপায় ছিলোনা বলে তাই থাকতাম। আমাকে বাজার করতে দিলে আমি ১ বা ২ টাকা চুরি করতামই। কারণ ১,২,৩ করে একসময় আমার হাতে ৩৫ টাকা জমলে আমি পছন্দের গানের শিল্পীর ক্যাসেট কিনতাম। বাবা এটা টের পেলেন এবং সেটা ঠেকানোর জন্য এরপর থেকে বাজারের টাকা হাতে দিয়ে আলাদা করে ২/৩ টাকা আমাকে দিয়ে দিতেন। আমার চুরি করে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অনেক নেশা ছিল। বাবা প্রতি মাসে সিনেমা দেখার জন্য আমাকে একবার টাকা দিতেন। নিজেও কতবার আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেছেন। সিনেমা শেষে ফেরার সময় মোগলাই পরোটা খাওয়াতেন। আহ! কি স্বাদ ছিলো সেই পরোটার !
আমার বাবা তাঁর শৈশব জীবনের মত আবার এখন একা হয়ে গেছেন। মূখ্য কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংকের চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে যখন একটু থিতু হয়েছেন, তখনই আমার মা ২০০৮ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তখন থেকেই আমার বাবা একাকী জীবন পার করছেন। বয়স হয়েছে, অনেক রোগ শরীরে, কিন্তু বাবা এখনও সজীব ও কর্মক্ষম।
জীবনের সহযাত্রী হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন তা আমার মা জানতেন। অগুনতি শালা-শালীদের প্রিয় দুলাভাই আমার বাবা নানুভাই বা দাদুভাই হিসেবে কেমন ভবিষ্যতে তার মূল্যায়ন করবে তাঁর নাতি-নাতনীরা। কিন্তু সন্তান হিসেবে আমি আমার বাবাকে জানি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হিসেবে। বাবার স্বপ্নকে সারথী করে নিজের জীবনে সফলতার ছাপ রাখতে পারিনি বলেই আমি এখনও কুন্ঠিত হই বাবার সামনে। পারিবারিক চর্চ্চা না থাকার কারণে বড় হয়ে বাবাকে কখনও জড়িয়ে ধরা হয়নি, কখনও মুখে বলা হয়নি বাবাকে ভালোবাসার কথা। আজ এই লেখার মধ্যে দিয়ে বাবার প্রতি আমার সারাজীবনের কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা জানাচ্ছি।
বাবা, আপনাকে অনেক ভালোবাসি।
-কামরুজ্জামান পলাশ
মন্তব্য
আমার প্রথম লেখা সচলায়তনে। বাবার ছবিটা তিনবার কেন আসলো বুঝলাম না। আমি দুঃখিত।
সচলে স্বাগতম!
আমাকে সচলে প্রথম স্বাগত জানালেন আপনি স্যাম। অনেক ধন্যবাদ, অ-নে-ক ধন্যবাদ।
আমি যদি ভবিষ্যতে আপনাদের মত লিখতে পারি সচলে, যদি তখন অনেক মন্তব্য পাই নিশ্চয় অনেক ভালো লাগবে।
কিন্তু আমার প্রথম লেখার প্রথম মন্তব্য আপনার। আপনাকে ভোলা যাবেনা।
আপনি ভালো থাকবেন স্যাম। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা।
তিনটি এক ই ছবি আছে লেখায়, মডারেটরদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
আমি বিষয়টার জন্য খুব দুঃখিত। এই লেখাটা আমি তৃতীয় বারের চেষ্টায় পাঠাতে পেরেছি। দু'বার লেখা শেষ করে এডিট করার সময় ডিলিট হয়ে গেছে। ছবি আপলোড এর সময় বুঝতেও পারিনি যে তিনবার ছবিটা আসলো। আসলে দু'বার লেখাটা মুছে গিয়েছিলো বলে আমি ভয়ে প্রিভিউ বাটনে চাপ দেইনি। একবারেই সংরক্ষণ করেছিলাম। তাই এই পরিণতি!!
ঝরঝরে লেখা, ভাল লেখা। ভাল লেগেছে।
)
সচলে প্রথম লেখা প্রকাশিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন!
(দুইখান কবিতা বাতিল হওয়ার পর আমি এখন মন্তব্যেই শান্ত থাকি
- একলহমা
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ একলহমা। লেখার প্রশংসা করেছেন দেখে আমি খুব আতংকিত বোধ করছি। এর পরের লেখা যদি আবার গলে জাউ হয়ে যায়? আপনার লেখা বাতিল এর খবর আরো ভয় বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু আশা হারাবেন না ভাই। 'অশান্ত' হয়ে আবার লিখুন। নিশ্চয় আপনি সফল হবেন। আপনার জন্য অগ্রিম শুভকামনা র'লো।
আর আমাকে অভিনন্দিত করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সচলায়তন পড়তে ভালো লাগে ।
আমাদের কারোরই পড়তে খারাপ লাগেনা।
বাবা কে নিয়ে লেখাটা পড়ে চোখ পানিতে ভেসে গেল । তোর বাবা যে আমারও বাবা । লিখে যা ভাইয়া । এটাই যেন শেষ না হয় ।
তোর চোখ পানিতে ভাসাবি, আর আমার চোখ শুকনো থাকবে? কারণ বাবাটা যে আমাদের।
তুই আমার চেয়ে ভালো লিখিস, তোর সময়ও হাতে অনেক। আমার ধারণা সচলায়তনে তুই লিখতে থাকলে আমার আগেই সচল হয়ে যাবি।
শুরু করে দে আজই।
অনেক লিখি । আবার সেটা মুছেও ফেলি ।জানিনা, কেন যে সব লেখাগুলোই দুঃখবিলাসী হয় ! অন্যকে পড়াতে খুব সঙ্কোচ হয় ।
নতুন মন্তব্য করুন