রেলখাতের সমস্যাগুলো ও সম্ভাব্য সমাধানসমূহ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৯/০৬/২০১৩ - ৪:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা বিশেষ দিনের ঘটনা দিয়ে শুরু করি-

৭ই জুন, ২০১২

ঢ এবং এক্স-১, দুটো বগির প্রতিটির ৬০টি করে ১২০টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। অথচ, 'ঢ' বগিটি সংযুক্তই করা হয়নি। 'ড' এর পরবর্তী বগি, যেখানে 'ঢ' থাকার কথা ছিলো, সেখানে 'ঢ' মুছে (১) লিখে দেয়া হয়েছে চক দিয়ে। একই বগিতে ১২০ জন বৈধ টিকিটধারী মানুষ, ৬০ জন বসে আছে, ৬০ জন দাঁড়িয়ে আছে। বসে থাকা ৬০ জনের কেউ 'ঢ'-এর টিকিটধারী, কেউ 'এক্স-১'-এর, যে আগে আসতে পেরেছে আর কি !! কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা ৩:২০ এ। অথচ ট্রেন স্টেশনে আসলো ৩:২২ এ, ছেড়ে দিলো ৩:৩৫ এ, যাত্রীরা ঠিকঠাকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছুলে এর একটা বিহিত করবো, এই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ক'জন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম আমি, শাটল ট্রেনে চড়ে ভার্সিটি আসাযাওয়া করতাম। ট্রেন থামানোর ব্যাপারে তাই কিছু কিছু জানি। ট্রেনের ঠিক সামনেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেলাম ঝটপট। কয়েকজন ট্রেনের ড্রাইভারকে বোঝালাম, না ছাড়ার জন্য। ড্রাইভার আশ্বস্ত করলো, স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে সিগন্যাল না পেলে সে ট্রেন ছাড়বে না। ছুট লাগালাম স্টেশন মাস্টারের কেবিনে, অনেক কষ্টে ওনার অফিসে ঢোকার সুযোগ পেলাম। তিনি ভালো মানুষ, আমাদের সাথেই আসলেন ট্রেনের পরিচালকের সাথে কথা বলতে। পরিচালক প্রৌঢ়; তার কম্পার্টমেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মেও নেমে এলেন না। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী স্টেশন মাস্টার নিচে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, তার কাছে জানতে চাইলো,

"আপনার ট্রেনে যে একটা বগি নাই, আপনি কি এটা জানেন?"

পরিচালক তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, "হুম, জানি"

কয়েক সেকেন্ডের দেরিকে সময়ের অপচয় হিসেবে দেখলাম আমি সহ অন্যান্য যাত্রীরা। স্টেশন মাস্টারও বোধহয় কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন, "কখন থেকে জানেন?"

পরিচালক আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন, "এই স্টেশনে, যাত্রীরা এসে জানানোর পর"

স্টেশন মাস্টার আরো বিরক্তই হলেন, "আপনি এই ট্রেনের পরিচালক। এই ট্রেনে যতগুলো বগি থাকার কথা, ততগুলো আছে কিনা, আপনি শিওর না হয়েই কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়লেন কিভাবে?"

পরিচালক কিছুটা ঔদ্ধত্য দেখালো, "এটা শিওর করা আমার কাজ না, আমার কাজ হচ্ছে সিগন্যাল পাইলে ট্রেন ছেড়ে দেয়া। এত কিছু দেখার সময় আমার নাই"

কিন্তু স্টেশন মাস্টার নিশ্চিত যে এটা এনশিওর করা পরিচালকেরই কাজ, "তাহলে এটা কার কাজ?"

পরিচালক আরো ক্ষেপে গেলেন, "আমাকে জিজ্ঞেস করতেসো কেন? আর আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিবো কেন? কয় দিন হইসে জয়েন করসো?"

স্টেশন মাস্টার বললেন, "আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতেসেন কেন?"

পরিচালকের মাথায় কোন ভূত চড়েছিলো জানিনা, "তো তোর সাথে ক্যামনে কথা বলবো, হারামজাদা" বলে স্টেশন মাস্টারের দিকে একটা লাথি ছুঁড়ে মারলেন। ঠিক সময়ে সরে যাওয়ায় তার গায়ে সেটা লাগলো না। অপমানিত হয়ে তিনি পরিচালকের দিকে ছুটে যেতে চাইলে যাত্রীরা তাকে বাধা দিলাম। কোন সমাধান হলোনা এখানে।

এরপর আরো অনেকক্ষণ স্টেশন মাস্টারের রুমে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করলাম, উনি কর্তৃপক্ষের সাথে ফোনে কথা বললেন। ট্রেনের সমস্যার পাশাপাশি ট্রেনের পরিচালকের দুর্ব্যবহারের কথাও জানাচ্ছিলেন। একবার শুনি, 'ঢ' এর যাত্রীরা বসতে পারবে, আবার শুনি 'এক্স-১' এর যাত্রীরা বসার অধিকার পাবে। অনেক কষ্ট করলাম 'ঢ' এবং এক্স-১, উভয়ের হয়ে, চেষ্টা করলাম একটা এক্সট্রা বগি যাতে কমলাপুর থেকে আনানো হয়।

শেষ পর্যন্ত সেটা আর সম্ভব হলোনা, এক্স-১ এর যাত্রীদেরকে বসতে বলা হলো, 'ঢ' এর যাত্রীদেরকে টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে যেতে বলা হলো। কিন্তু, যাদের যাওয়া দরকার, তারা টাকা ফেরত নিয়ে কি করবে? এখানে আবার অনেকে ব্ল্যাকে ৩০০ টাকা দিয়ে টিকেট কিনেছে, তাদের ১৫০ টাকা লস। যারা কাউন্টারে টিকেট কিনেছে, তারাও ১৫০ টাকার টিকিট ১৮০ টাকায় কিনেছে। টাকাপয়সার লস বাদ দিলেও যে হয়রানিটা হলো, তার মূল্য কে দেবে?

* ট্রেন টিকেটের কালোবাজারিকরণঃ

মুদি দোকান, ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায়, কাউন্টারে পাওয়া যায়না। ব্ল্যাকারদের দৌরাত্ম্য পৌঁছে গেছে একদম শেষ সীমায়। ব্ল্যাকে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে, এবং এটার প্রতি আমাদের এক ধরনের মৌন সম্মতি তৈরি হয়ে গেছে......... যার কাছে অতিরিক্ত টাকা আছে, সেই সুবিধা পাচ্ছে, মানতে আমাদের তেমন কোন কষ্টই হচ্ছেনা !! যাত্রার দশদিন আগে থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হয়, কিন্তু সেদিন স্টেশনে গিয়েও টিকেট পাওয়া যায়না। সুবর্ণ, প্রভাতী, গোধূলি, তূর্ণা - এতগুলো ট্রেনের এতোগুলো সিট এক ঘণ্টার মধ্যে কিভাবে বিক্রি হলো, কাউন্টারের লোকজনের টিকিট বিক্রির গতির কথা চিন্তা করলে সেটা আইনগতভাবে একেবারেই ব্যাখ্যাতীত।

সমস্যার সমাধান আমাদের হাতেই, আমরা সবাই (সবাই মানে সবাই, একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট) যদি ঠিক করি যে আমরা ব্ল্যাকে টিকিট কিনবোনা, তাহলেই ব্ল্যাকারদের ব্যবসা লাটে উঠতে বাধ্য। কিন্তু, ঐ যে, আমাদের মৌন সম্মতি !! কবে এমন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে, যখন ব্ল্যাকে আর টিকিট কিনতে হবেনা?

ব্ল্যাকার'রাও কাউন্টার থেকেই টিকেট কেনে, কাউন্টার ম্যানেজারেরা এদেরকে চেনেও। তারপরেও তাদের কাছে দেদারসে টিকিট বিক্রি করে চলছে তারা, নিজেদের লাভের আশায়। পাবলিকের কথা ভাবলে তার পকেটে টাকা আসবেনা, এই ধান্ধায়।

সরকারি ট্রেন, বেসরকারি মোবাইল কোম্পানির টিকেট বিক্রিঃ

সরকারি কাজে বেসরকারি মোবাইল কোম্পানীর হাত'টাকেও মোটেই ভালো চোখে দেখতে পারছিনা। অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেয়ার মাধ্যমে এটাও ধনীদের'কেই সুবিধা দিচ্ছে। অথবা যারা এই প্রসেস টা ভালো করে বোঝে না (যেমন-দরিদ্র, যাদের মোবাইল নেই; অথবা অশিক্ষিত, যাদের শিক্ষার ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি), এভাবে টিকেট বিক্রি করলে ব্যাপারটা তাদের জন্য আরো বেশি পীড়াদায়ক হয়ে পড়ে।

রেলখাত লোকসানের হয় কিভাবেঃ

যেখানে ভারত টিকেটের দাম কমিয়েও রেলখাত থেকে লাভ তুলতে পারে, সেখানে আমরা পারছিনা কেন? সব টিকেট দশদিন আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরেও রেলখাত লোকসানের কেন? ঐ যে, ব্ল্যাকারদের কাছে আগে টিকেট দেয়া হয়ে যায়, অনেক সময় ব্ল্যাকাররা সব টিকেট বিক্রি করে উঠতে পারেনা, তখন সেগুলো তারা ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে নেয়। কিন্তু এদিকে মানুষ তো আর জানেনা যে টিকেটগুলো ফেরত দেয়া হয়ে গেছে। তাই, সেগুলো আর বিক্রি হয়না। সেই আসনগুলো নিয়ে বাণিজ্য করে ট্রেনে উপস্থিত কর্মকর্তারা। অতএব, আসন সব ভর্তি থাকলেও সরকারের কাছে টাকা পোঁছায় না।

সমাধানঃ

১) একেবারে শতভাগ মানুষ যেহেতু ব্ল্যাকে টিকিট কেনা বন্ধ করতে পারবেনা, কালোবাজারির সমস্যার সমাধান সরকারকেই করতে হবে। এবং এটা বেশ সহজেই করা সম্ভব, যদি ট্রেনের টিকিট কেনার সময় কার জন্য আসন বরাদ্দ করা হচ্ছে, তার নাম জমা নেয়া হয়। অর্থাৎ, টিকেট ইস্যু করা হবে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য, বিমানের মতোই(ট্রেন কোনভাবেই বিমানের চেয়ে কম মূল্যবান নয়)। একজন একাধিক টিকেটও কাটতে পারবে, তবে সেক্ষেত্রে সবার নামই তাকে সরবরাহ করতে হবে। ট্রেনে সবার টিকেট চেক করার নিয়মতো আছেই, শুধু সামান্য আরেকটু সময় ব্যায় করে তাদের পরিচয়পত্র চেক করতে হবে, নিজেদের লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। যেহেতু ব্ল্যাকাররা টিকেট আগেই সংগ্রহ করে রাখে, তাই কে চড়তে যাচ্ছে, সেই ইনফো দিয়ে টিকেট কাটা তাদের পক্ষে সম্ভব হবেনা। রেল কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিলে ব্ল্যাকিং এর দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

২) কখনোই চোখ-কান বুজে না থাকার সিদ্ধান্ত নিন। কয়েকজন মিলে প্রতিবাদ করেছি বলে কর্তৃপক্ষের কানে ব্যাপারটা গেলো। অন্তত একটা দল শান্তিতে ভ্রমণ করতে পারলো, আরেক দল টাকা ফেরত পেলো। প্রতিবাদী কণ্ঠের জয় হোক !!

৩) মোবাইল কোম্পানিগুলোর টিকেটের সমস্যাও সমাধান হতে পারে, যদি শতভাগ মানুষ এটাকে বর্জন করে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব না, এটা নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই, এই ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকেই !!

সবাই যেভাবে পারেন, ব্ল্যাকারদের ইনফর্মেশন পুলিশের কাছে দিন। পুলিশ হয়তোবা টাকা খেয়ে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এতে বারবার ব্ল্যাকারদেরকে হ্যারাস করা যাবে। কয়বার সহ্য করবে এই হ্যারাসমেন্ট? একসময় অন্য পেশা খুঁজে নেবে, এমনটাই আমার আশা

অবশেষেঃ

ট্রেন অনেকেরই যাতায়াতের সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। অনেকে তো বাস সহ্যই করতে পারেন না। আর ঢাকা-চিটাগাং রুটের যে অবস্থা, ট্রেনই সবচেয়ে সহজ, সস্তা, ও আরামদায়ক। এবং এজন্যেই এটা নিয়ে এতো ধরনের কাহিনী। সরকার কেন এদিকে পূর্ণ মনযোগ দিচ্ছে না? এ বিষয়ে সবাই জনমত গড়ে তুলুন, সরকারকে বাধ্য করুন পদক্ষেপ নিতে।


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

সরকার জানে না, এই কথাটা মনে হয় ঠিক না। আমার তো ধারণা সরকারের মৌন সম্মতিতেই বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।

ফরহাদ হোসেন মাসুম এর ছবি

সরকারের অনেকেই টাকা খাচ্ছে, এটা তো জানা কথা। সিস্টেম এমনভাবে করতে হবে, যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগই থাকবে কম। আমরাও এটা নিয়ে কোন আন্দোলন করিনা, সমস্যা এজন্যেই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লেখাটা কে লিখেছেন? লেখকের নাম নেই কেন?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফরহাদ হোসেন মাসুম এর ছবি

লেখাটি আমি লিখেছি। নাম দিতে ভুলে গেছি, এখন তো এডিট করার অপশনও পাচ্ছিনা। সচলে মাত্র লেখালেখি আরম্ভ করলাম, এটা আমার দ্বিতীয় লেখা। এখনো সবকিছু ঠাহর করে উঠতে পারিনি। দুঃখিত। পরবর্তীতে এমন ভুল হবেনা, আশা করি......... ফরহাদ হোসেন মাসুম

উর্ণনাভ  এর ছবি

রেলের টপ টু বটম প্রত্যেকটা লেভেলে দুর্নীতি । গ্রাউন্ড লেভেলে- ট্রেনের ভেতর টি,সি, কমলাপুরের প্লাটফর্মে রেল পুলিশ, গেইটে টি,সি , কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা প্রত্যেকটা লোক চিন্তা করে নিজের পকেটের সাইজ বড় করার । উপরের লেভেলের কথা তো না বলাই উত্তম । ৬০০ কোটি টাকা দিয়ে এসব কি ট্রেন কিনসে ? দুই বগির ট্রেনে উঠতে সমস্যা , নামতে সমস্যা, ভেতরে বসতে-দাঁড়াতে সমস্যা । ফাইজলামি !!!
আওয়াজ তুলার লোক নাই ভাই । সবাই দেখে-শুনে-বুঝে, কেউ বলে না । আফসুস

ফরহাদ হোসেন মাসুম এর ছবি

আমি একটু আওয়াজ তুলতে চাচ্ছি এটা নিয়ে। প্লিজ, সাহায্য করুন। সবাইকে আওয়াজ তুলতে বলুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।